আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৩- সন্ধি - আপোষরফা সংক্রান্ত অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৬৯৯
১৬৭৮. কিভাবে সন্ধিপত্র লেখা হবে? অমুকের পুত্র অমুক এবং অমুকের পুত্র অমুক লিখতে হবে। গোত্র বা বংশের দিকে সম্বোধন না করলেও ক্ষতি নেই।
২৫১৯। উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসা (রাহঃ) .... বারা’ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যিলকদ মাসে নবী (ﷺ) উমরার উদ্দেশ্যে বের হলেন। কিন্তু মক্কাবাসীরা তাঁকে মক্কা প্রবেশের জন্য ছেড়ে দিতে অস্বীকার করল। অবশেষে এই শর্তে তাদের সাথে ফয়সালা করলেন যে, তিন দিন সেখানে অবস্থান করবেন। সন্ধিপত্র লিখতে গিয়ে মুসলিমরা লিখলেন, এ সন্ধিপত্র সম্পাদন করেছেন, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)।’ তারা (মুশরিকরা) বলল, আমরা তাঁর রিসালাত স্বীকার করি না। আমরা যদি এ কথাই মনে করতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল তাহলে আপনাকে বাধা দিতাম না। তবে আপনি হলেন, আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ।’ তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল এবং আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ।’
তারপর তিনি আলীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ শব্দটি মুছে দাও। তিনি বললেন, না। আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে (রাসূলুল্লাহ শব্দটি) কখনো মুছবো না।’ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তখন চুক্তিপত্রটি নিলেন এবং লিখলেন, ‘এ সন্ধিপত্র মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সম্পন্ন করেন-খাপবদ্ধ অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নিয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করবেন না। মক্কাবাসীদের কেউ তাঁর সঙ্গে যেতে চাইলে তিনি বের করে দিবেন না। আর তাঁর সঙ্গীদের কেউ মক্কায় থাকতে চাইলে তাকে বাধা দিবেন না।’ (সন্ধির শর্ত মুতাবেক) তিনি যখন মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেল, তখন তারা এসে আলীকে বলল, ‘তোমার সঙ্গীকে আমাদের এখান থেকে বের হতে বল। কেননা নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে।’
নবী (ﷺ) রওয়ানা হলেন। তখন হামযার মেয়ে হে চাচা, হে চাচা, বলে তাদের পেছনে পেছনে চলল। আলী (রাযিঃ) তাকে হাত ধরে নিয়ে এলেন এবং ফাতিমাকে বললেন, ‘এই নাও তোমার চাচার মেয়েকে। আমি ওকে তুলে এনেছি।’ আলী, যায়দ ও জা‘ফর তাকে নেয়ার ব্যাপারে বিতর্কে প্রবৃত্ত হলেন। আলী (রাযিঃ) বললেন, আমি তার বেশী হকদার। কারণ সে আমার চাচার মেয়ে। জাফর (রাযিঃ) বললেন, সে আমার চাচার মেয়ে এবং তার খালা আমার স্ত্রী।’ যায়দ (রাযিঃ) বললেন, ‘সে আমার ভাইয়ের মেয়ে।’
এরপর নবী (ﷺ) খালার অনুকূলে ফয়সালা দিলেন এবং বললেন, ‘খালা মায়ের স্থলবর্তিনী।’ আর আলীকে বললেন, আমি তোমার এবং তুমি আমার।’ জাফরকে বললেন, ‘তুমি আকৃতি ও প্রকৃতিতে আমার সদৃশ। আর যায়দকে বললেন, ‘তুমি তো আমাদের ভাই ও আযাদকৃত গোলাম।’

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬ষ্ঠ হিজরীতে উমরা আদায়ের লক্ষ্যে মক্কা মুকাররামার সফর করেছিলেন। কিন্তু হুদায়বিয়ায় পৌঁছার পর মক্কার মুশরিকদের পক্ষ থেকে তিনি বাধার সম্মুখীন হন। ফলে তার পক্ষে উমরা আদায় করা সম্ভব হয়নি। তিনি তাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসেন। এটিই বিখ্যাত 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' নামে পরিচিত। এ সন্ধির একটি শর্ত ছিল পরবর্তী বছর তিনি উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় যেতে পারবেন। সেমতে পরের বছর সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি উমরা আদায় করেন। উমরা আদায়ের পর তিনি যখন মক্কা থেকে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হন, তখন হযরত হামযা রাযি.-এর শিশুকন্যা 'চাচা চাচা' বলে ছুটে আসল।

হযরত হামযা রাযি. হিজরী ৩য় সনে উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সালমা বিনতে উমায়স রাযি. তখনও হিজরত করেননি। এ কারণে তাঁর কন্যা উমারা বর্ণনান্তরে উমামা মায়ের সঙ্গে মক্কা মুকাররামায় থেকে গিয়েছিলেন। এবার তিনি মদীনা মুনাউওয়ারায় যেতে চাইলেন এবং সে উদ্দেশ্যে চাচা চাচা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে ছুটে চললেন।

উমারা যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাতো বোন ছিলেন, তা সত্ত্বেও চাচা বলার কারণ হয়তো তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অথবা তা বলেছিলেন এ কারণে যে, তার পিতা হযরত হামযা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হলেও তাঁরা দু'জন একই দুধমায়ের দুধ পান করেছিলেন। সে হিসেবে তাঁরা দুধভাইও।

যাহোক হযরত আলী রাযি. উমারাকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। তিনি তাকে নিয়ে হযরত ফাতিমা রাযি.-এর হাতে তুলে দিলেন। বললেন, এ তোমার চাচাতো বোন। এর যত্ন নিও। তিনি তাকে নিজের সাথে বাহনে তুলে নিলেন। তারপর সেখানেই অথবা মদীনায় আসার পর তার লালন-পালনের অধিকার নিয়ে হযরত আলী রাযি.. হযরত জা'ফর রাযি. ও যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। তাদের প্রত্যেকেই সে মেয়ের লালন-পালনের অধিকার দাবি করলেন। হযরত আলী রাযি. বললেন, সে আমার চাচাতো বোন এবং আমিই তাকে সঙ্গে করে এনেছি। হযরত জাফর রাযি. বলছিলেন, সে আমার চাচাতো বোন এবং তার খালা আমার স্ত্রী। হযরত যায়দ রাযি. বলছিলেন, সে আমার ভাইয়ের মেয়ে। ভাইয়ের মেয়ে এ হিসেবে যে, হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপন করেন, তখন হযরত যায়দ রাযি.-কে হযরত হামযা রাযি.-এর ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে হিসেবেই উমারা হযরত যায়দ রাযি.-এর ভাতিজী হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সে দাবি-দাওয়ার মধ্যে যখন ফয়সালা দান করেন, তখনই এ নীতিবাক্যটি উচ্চারণ করেন যে-
الخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الأُمِّ (খালা মায়ের সমতুল্য)। কাজেই একে এর খালার হাতে ন্যস্ত করা হোক। এই বলে তিনি উমারাকে তার খালা এবং হযরত জা'ফর রাযি.-এর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়স রাযি.-এর কাছে সমর্পণ করেন। তারপর তাদের তিনওজনের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করলেন। হযরত আলী রাযি.-কে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে এবং তুমি আমার সঙ্গে রয়েছ। হযরত জাফর রাযি.-কে বললেন, তুমি আকৃতি ও প্রকৃতিতে আমারই মত। আর হযরত যায়দ রাযি.-কে বললেন, তুমি আমার ভাই ও মাওলা (আদাযকৃত গোলাম বা বন্ধু)।

এর দ্বারা জানা গেল, প্রতিপালনের অধিকার খালারই জন্য সংরক্ষিত; আসাবা (যাবিল ফুরূয ব্যতীত অন্যান্য উত্তরাধিকারী)-এর জন্য নয়। হযরত হামযা রাযি.-এর আপন বোন সাফিয়্যা রাযি. তখনও জীবিত ছিলেন। যদিও জানা যায় না, তিনি লালন- পালন করতে চেয়েছিলেন কি না, কিন্তু তাঁর বর্তমান থাকা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খালা মায়েরই মত। এ কথা বলেননি যে, ফুফুর দাবি না করার কারণে খালা মায়ের মত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. খালা মায়ের মত। কাজেই মায়ের মতই তার খেদমত ও ভক্তি-সম্মান করা উচিত।

খ. বিচারকের উচিত ন্যায়সম্মত ফয়সালা দানের পর বাদী-বিবাদী উভেয়ের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন