আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪৩- সন্ধি - আপোষরফা সংক্রান্ত অধ্যায়
২৫১৪। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) .... সাহল ইবনে সা’দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, কুবা-এর অধিবাসীরা লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এমনকি তারা পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সে সংবাদ দেয়া হলে তিনি বললেন, ‘চল তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেই।’
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
ইসলামে মানুষের মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি করে দেওয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এ হাদীছ দ্বারা পরিস্ফুট হয়। এর জন্য এমনকি মিথ্যা বলার পর্যন্ত অবকাশ আছে, অথচ এমনিতে মিথ্যা বলা কত কঠিন পাপ। এক হাদীছে জানানো হয়েছে, মুমিন ব্যক্তির স্বভাবে মিথ্যা বলার খাসলত থাকতে পারে না। অপর এক হাদীছে বর্ণিত আছে- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যাবাদীকে জাহান্নামে লোহার আংটা দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত হতে দেখেছেন। তো যে মিথ্যা বলাটা এমন গর্হিত কাজ, বিবাদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারও পর্যন্ত অবকাশ রাখা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে— ليس الكذاب الذي يصلح بين الناس (ওই ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়)। অর্থাৎ, যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ-বিবাদ দেখা দেয় এবং কোন ব্যক্তি তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার চেষ্টা করে আর তা করতে গিয়ে তাকে মিথ্যা বলার আশ্রয় নিতে হয়, তবে সে তা নিতে পারে। এতে তার কোনও গুনাহ হবে না। মিথ্যুক নয় বলে বোঝানো উদ্দেশ্য যে, মিথ্যা বলার কারণে সে গুনাহগার হবে না। না হয় মিথ্যা তো মিথ্যাই। উদ্দেশ্য সৎ হওয়ায় মিথ্যা তো সত্য হয়ে যেতে পারে না। فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ অর্থ : 'সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নাও। এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে যে, মুসলিমদের মধ্যে যদি কোনও বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তবে তা দূর করে পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক করে নেওয়া চাই। কেননা পারস্পরিক মনোমালিন্য দেখা দিলে যদি তা যথাশীঘ্র মিটমাট করা না হয়, তবে তা বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। দুই ব্যক্তির মধ্যকার কলহ দুই পরিবারকেও স্পর্শ করে। এমনকি অনেক সময় তা পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা সংঘর্ষেরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সে পর্যায়ে পৌঁছার আগেই পরস্পরের মধ্যে মিটমাট করে নেওয়া চাই। নিজেরা তা করতে না পারলে অন্যদের কর্তব্য তাতে ভূমিকা রাখা। এটা অনেক বড় ছাওয়াবেরও কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন– أَلَا أُخبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصَّيَامِ وَالصَّلاةِ وَالصَّدَقَةِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ الله! قَالَ: إِصْلَاحُ ذَاتِ الْبَيْنِ، وَفَسَادُ ذَاتِ الْبَيْنِ الْحَالِقَة ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা রোযা, নামায ও সদাকা অপেক্ষাও উত্তম? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, তা হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে সন্ধি–মীমাংসা করে দেওয়া। কেননা পারস্পরিক অমিল–অশান্তি ধ্বংসকর।২১৫ পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়াকে ধ্বংসকর বলা হয়েছে এ কারণে যে, এর ফলে হিংসা–বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তখন একে অন্যের ক্ষতি করার জন্য নানারকম অবৈধ কাজকর্ম করা হয়– মিথ্যা কথা বলা হয়, গীবত করা হয়, অপবাদ দেওয়া হয়, জান–মালের ক্ষতিসাধনের জন্য বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়। এমনকি নামায–রোযা পর্যন্ত নষ্ট করা হয়। এভাবে পারস্পরিক কলহ–বিবাদ মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত সবই বরবাদ যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার দ্বারা যেহেতু উভয়পক্ষকে সে পরিণতি থেকে রক্ষা করা যায়, তাই এটা নফল ইবাদত–বন্দেগী অপেক্ষাও বেশি ফযীলতের কাজ। إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ অর্থ : ‘প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই–ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। এ আয়াতে মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে কলহ দেখা দিলে তা মিটমাট করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। সে আদেশের পূর্বে বলা হয়েছে মুমিনগণ ভাই–ভাই। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্বের দাবি হল মিলেমিশে থাকা ও কলহ–বিবাদে লিপ্ত না হওয়া। দুর্ঘটনাক্রমে কখনও কলহ দেখা দিলে যথাশীঘ্র মিলেমিশে যাওয়া চাই। মিলেমিশে যাওয়ার চেষ্টা প্রথমত তাদেরই করা উচিত, যাদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়েছে। যদি তাদের মধ্যে সে উদ্যোগ পরিলক্ষিত না হয়, তবে অন্যদের এগিয়ে আসা উচিত। কেননা যে দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ দেখা দিয়েছে তারা তাদের ভাই। দুই ভাইয়ের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হলে অপর ভাই তার নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারে না। তার কর্তব্য তাদেরকে নিবৃত্ত করার উদ্যোগ নেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলছেন– فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ (তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও)। অর্থাৎ ভাই হিসেবে তোমার কাছে তাদের এটা প্রাপ্য যে, তুমি তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে ভূমিকা রাখবে। বস্তুত দুই মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিলে অপর মুসলিম ভাইয়ের তা নিরসন করার চেষ্টা কেবল তাদের স্বার্থেই নয়; বরং নিজ স্বার্থেও করা উচিত। কেননা দ্বন্দ্ব–কলহ প্রথমেই নিরসন করা না হলে আগুনের মত তা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে তা অন্যদেরও গ্রাস করে নেয়। তার থাবা থেকে নীরব দর্শকও রেহাই পায় না। এজন্যই তারা নিজেরা মিটমাট না করলেও অন্যদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তাদের মধ্যে মিটমাট করে দেওয়া উচিত। আত্মকলহের একটা বড় ক্ষতি এইও যে, তাতে শত্রু সুযোগ পায়। শত্রু চায় কলহ দীর্ঘস্থায়ী হোক। আত্মকলহে যেমন আত্মিক শক্তি নষ্ট হয়, তেমনি অর্থবল ও পেশীশক্তিরও ক্রমক্ষয় ঘটে। শত্রু তো সেটাই চায়, যাতে করে মুমিনগণ নিজেরা মারামারি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর সে অবকাশে তারা নির্বিঘ্নে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। আমরা শত্রুকে সে সুযোগ দেব কেন? ইতোমধ্যে সে সুযোগ আমরা তাদের অনেক দিয়ে ফেলেছি। একদিন যারা আমাদের দ্বারা শাসিত ছিল, আজ বিশ্বব্যাপী তাদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের যাতাকলে আমরা পিষ্ট হচ্ছি। এ আমাদের আত্মকলহেরই পরিণাম। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বৃহৎ পরিসরে আমাদের আত্মকলহের সুযোগ তারা হরদমই নিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের প্রকৃষ্ট উপায় আত্মকলহ ভুলে পরস্পর ঐক্য–ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় থাকা। যেখানেই যখন কোনও দ্বন্দ্ব–কলহ দেখা দেয়, যথাশীঘ্র তা মিটমাট করে ফেলা– বিবদমান দু'ভাই নিজেই কিংবা তৃতীয় ভাইয়ের উদ্যোগে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যাচ্ছে মুসলিম ভ্রাতৃবর্গের পারস্পরিক দন্দ্ব-কলহ নিরসন করা এবং তাদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় ভূমিকা রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন