আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৪১- হিবা তথা উপহার প্রদান, এর ফযীলত ও এতে উৎসাহ প্রদান
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৬৩১
১৬৩৯. মানীহা* অর্থাৎ দুধ পানের জন্য উট বা বকরী দেওয়ার ফাযীলত
*মানীহা' ঐ দুগ্ধবতী জন্তুকে বলা হয় যা কাউকে দুধ পান করার জন্য দেওয়া হয় এবং দুধ পান শেষে মালিকের নিকট ফেরত দেওয়া হয়। (আইনী)
*মানীহা' ঐ দুগ্ধবতী জন্তুকে বলা হয় যা কাউকে দুধ পান করার জন্য দেওয়া হয় এবং দুধ পান শেষে মালিকের নিকট ফেরত দেওয়া হয়। (আইনী)
২৪৫৬। মুসাদ্দাদ (রাহঃ) .... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, (আল্লাহ্ তাআলার বিশেষ প্রিয়) চল্লিশটি স্বভাবের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল দুধ পান করার জন্য কাউকে বকরী দেওয়া। কোন বান্দা যদি সাওয়াবের আশায় এবং পুরষ্কার দানের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে উক্ত চল্লিশ স্বভাবের যে কোন একটির উপরে আমল করে তবে আল্লাহ অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। হাসসান (রাহঃ) বলেন, দুধেল বকরী মানীহা দেওয়া ছাড়া আর যে, কয়টি স্বভাব আমরা গণনা করলাম, সেগুলো হল সালামের উত্তর দেওয়া, হাঁচি দাতার হাঁচির উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা, (চলাচলের) পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ইত্যাদি। কিন্তু আমরা পনেরটি স্বভাবের বেশী গণনা করতে সক্ষম হলাম না।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে চল্লিশটি আমল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ছাওয়াব ও প্রতিশ্রুত প্রতিদানের আশায় তা করলে আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময়ে অবশ্যই জান্নাত দান করবেন। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে বকরির ‘মানীহা’ (مَنِيحَةٌ)।
মানীহা বলা হয় কাউকে দুধপানের জন্য কোনও পশু সাময়িকভাবে দান করা। অর্থাৎ দুধপান শেষে সে পশুটি ফিরিয়ে দেবে। তা বকরি, গাভী, উটনী ইত্যাদি যে-কোনও পশুই হতে পারে। এ হাদীছে সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে বকরির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় গাভী ও উটনী দেওয়ার ছাওয়াব আরও বেশি।
চল্লিশটি আমলের মধ্যে সর্বোচ্চ বলা হয়েছে বকরি দান করাকে। কেননা বকরির দুধ পান করার দ্বারা ক্ষুধা নিবারণ হয়। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের চাহিদাই সবচে' বড়। তাই মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করা সবচে' বড় উপকার। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা মানুষের প্রতি তাঁর নি'আমতসমূহের কথা স্মরণ করাতে গিয়ে খাদ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এবং অন্যকে খাওয়ানোর কাজকে একটি বড় সৎকর্মরূপে দেখিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদীছে খাদ্যদানে উৎসাহিত করেছেন। কোনও কোনও হাদীছে খানা খাওয়ানোকে একটি শ্রেষ্ঠতম আমলরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। মানীহা দ্বারা যেহেতু মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণে সহযোগিতা করা হয়, তাই এ হাদীছে একেও চল্লিশটি নেক কাজের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে।
সালামের জবাব দেওয়া
رد السلام -সালামের জবাব দেওয়া। এক মুসলিমের সঙ্গে আরেক মুসলিমের সাক্ষাত হলে তাদের প্রথম কাজ একজন আরেকজনকে সালাম দেওয়া। যাকে সালাম দেওয়া হবে তার কর্তব্য সালামের জবাব দেওয়া। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا ‘যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম দেয়, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষাও উত্তমরূপে সালাম দিও কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিও। সূরা নিসা (৪), আয়াত নং ৮৬
সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। একাধিক ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া হলে সকলের পক্ষ থেকে একজন উত্তর দিলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। কেউ উত্তর না দিলে সকলেই গুনাহগার হয়। উত্তর না দেওয়া অসৌজন্যমূলক আচরণও বটে। এর দ্বারা সালামদাতাকে অবজ্ঞা করা হয়। সেইসঙ্গে তার মনে দুর্ভাবনাও সৃষ্টি করা হয়। কেননা সালাম মূলত নিরাপত্তাদানের ভাষা। যে ব্যক্তি সালাম দেয় সে সালামের বাক্য দ্বারা আশ্বস্ত করে যে, তোমরা নিরাপদ। আমার দিক থেকে তোমাদের কোনও অনিষ্টের আশঙ্কা নেই। তারপর সে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে যে, তারাও তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে কি না। উত্তর না দিলে তার মনে অনিষ্টের আশঙ্কা দেখা দেয়। সে আশঙ্কা দূর করার জন্য উত্তর দেওয়া অবশ্যকর্তব্য।
সালাম দেওয়া ও তার উত্তর দেওয়া ইসলামের অতি মূল্যবান এক শিক্ষা। এটা ইসলামী তাহযীব ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনও বটে। যেখানে সালামের রেওয়াজ আছে সেখানকার লোকজন যে মুসলিম এবং তারা ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত, তা এই রেওয়াজ দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের কর্তব্য ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটির মূল্য বোঝা এবং সর্বস্তরে এটা বাস্তবায়ন করা।
হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা
হাদীছটিতে বর্ণিত আরেকটি আমল হল تشميت العاطس হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা, অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। تشميت العاطس অর্থ কল্যাণ ও বরকতের দু'আ করা। শব্দটির উৎপত্তি شماتة থেকে। যার অর্থ অন্যের বিপদে আনন্দিত হওয়া।تشميت অর্থ সেই আনন্দ প্রতিহত করা। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হয় তার বিপদও কেটে যায়। ফলে শত্রুর আনন্দ ঘুচে যায়। যেহেতু এ দু'আটি পরিণামে শত্রুর আনন্দ ঘুচিয়ে দেয় তাই একে تشميت নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কারও মতে تشميت এর উৎপত্তি شواميت থেকে। شواميت অর্থ হাত-পা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সেই হিসেবে تشميت অর্থ স্থিত ও প্রতিষ্ঠিত রাখা। يرحمك الله বলার দ্বারা হাঁচিদাতার জন্য তাকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার দু'আ করা হয়। তাই এ দু'আকে تشميت নাম দেওয়া হয়েছে।
হাঁচি দেওয়া একটি নিআমত। এর দ্বারা আলস্য কাটে ও শরীর ঝরঝরে হয়। ফলে কাজকর্মে স্ফুর্তি আসে। তখন ইবাদত-বন্দেগী করতে ভালো লাগে। তাই হাঁচিদাতার কর্তব্য হাঁচি দেওয়ার পর আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা। অর্থাৎ আলহামদুল্লিাহ বলা আলহামদুল্লিাহ শোকর আদায়ের ভাষা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে হাঁচির এ দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি হাঁচির ব্যাপারে আমাদের জন্য এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা রেখে গেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ- إذا عطس أحدكم، فليقل: الحمد لله، فإذا قال: الحمد لله، قال له أخوه يرحمك الله، فإذا قيل له يرحمك الله : فليقل: يهديكم الله ويصلح بالكم 'তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন বলে الْحَمْدُ لِلَّهِ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)। সে যখন الْحَمْدُ لِلَّهِ বলবে তখন উপস্থিত ভাই যেন বলে يَرْحَمُكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন)। তাকে লক্ষ্য করে يَرْحَمُكَ اللَّهُ বললে সে যেন বলে يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।[১৫]
হাঁচিদাতা আলহামদুল্লিাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা ওয়াজিব। অনেকেই এই ওয়াজিব পালনে অবহেলা করে। তা করা উচিত নয়। তাতে এক তো ওয়াজিব তরকের গুনাহ হয়। দ্বিতীয়ত, হাঁচিদাতাকেও হেলা করা হয়, বিশেষত সে যদি গরীব হয় বা তথাকথিত সামাজিক দৃষ্টিতে নিম্নস্তরের হয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে হেলা করা কঠিন অপরাধ। এ ব্যাপারে সতর্কতা জরুরি। সুতরাং হাঁচিদাতার উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ অবশ্যই বলতে হবে, সে যেই হোক না কেন। অবশ্য যদি বারবার হাঁচি দেয়, তিনবার বা তারও বেশি তবে সেটা সর্দির আলামত। সেক্ষেত্রে বারবার উত্তর দেওয়ার জরুরত নেই।
উপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা হবে তখন আবার হাঁচিদাতার কাজ তাদের জন্য দুআ করা। তারা তার জন্য দুআ করে তার প্রতি যেই ইহসান করেছে তার বদলা দেওয়া তার কর্তব্য। উপকারীর উপকার করাও ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কেউ কারও উপকার করলে সে উপকারের বদলা দেওয়া কর্তব্য। বৈষয়িক উপকারও উপকার বটে। তবে কারও জন্য দু'আ করা বা কারও দীনী কল্যাণ সাধন করা আরও বড় উপকার। কাজেই উপস্থিত ব্যক্তিগণ দু'আ দ্বারা হাঁচিদাতার যে বিরাট উপকার করল তার বিনিময়ে কিছু করা তো চাই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হল সেও তাদের জন্য এই বলে দু'আ করবে- (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়া
বিভিন্ন হাদীছে ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা বলা হয়েছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে এ আমলটি অতি সামান্য মনে হলেও হাকীকতের দিক থেকে এটি অনেক বড়। কেননা এ কাজটি করা হয় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে। আল্লাহর বান্দাগণ এ পথে যাতায়াত করতে গিয়ে কষ্ট পেতে পারে, সে চিন্তা থেকেই একজন মু'মিন কষ্টদায়ক বস্তুটি সরিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের দান করেছেন। তিনি এক হাদীছে বলেন-
الْمُسْلِمُوْنَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اشتَكى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ ، وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
‘মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তির মতো, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।(সহীহ মুসলিম: ২৫৮৬, ৬৭)
অবশিষ্ট কাজগুলো কী? এ হাদীছে তার উল্লেখ নেই। উল্লেখ সম্ভবত এ কারণে করা হয়নি যে, লোকে হয়তো মনে করে বসবে এ চল্লিশটি কাজ করাই যথেষ্ট। তখন তারা এর বাইরে আর কোনও নেক আমল করবে না। অথচ নেক আমল কেবল চল্লিশটিই নয়; তার বাইরে অনেক আছে। চল্লিশটির কথা জানিয়ে দেওয়া হলে অবশিষ্টগুলো হয়তো উপেক্ষিত হতো এবং তাতে আল্লাহ ও বান্দার কোনও কোনও হক অনাদায় থেকে যেত। আর তাতে করে সেসব কাজের ছাওয়াব থেকে তো বঞ্চিত থাকা হতোই, তার পাশাপাশি হক অনাদায়ের গুনাহও হয়ে যেত। কাজেই সবগুলোর ফিরিস্তি না দেওয়া আমাদের জন্য কল্যাণকরই হয়েছে।
এ হাদীছে অবশিষ্ট কাজগুলো উল্লেখ না থাকার কারণে সেগুলো যে আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে গেল এমনও নয়। কেননা বিভিন্ন হাদীছে বহু সৎকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, কোনও কারিগরকে তার কাজে সাহায্য করা, অদক্ষ লোকের কাজে সহযোগিতা করা, মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন করা, শোকাগ্রস্ত লোককে সান্ত্বনা দেওয়া, পথ হারানো লোকের পথ দেখিয়ে দেওয়া, উত্তম কথা বলা, গাছ লাগানো, সুপারিশ করা, রোগীর খোঁজখবর নেওয়া, মুসাফাহা করা, আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য কারও প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়া, মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, অন্যের কল্যাণ কামনা করা, কাউকে সুপরামর্শ দেওয়া, অন্যকে নেক কাজের পথ দেখানো, পিপাসার্তকে পানি পান করানো ইত্যাদি। হিসাব করতে থাকলে সংখ্যা চল্লিশের অনেক বেশি হবে এবং সাধারণত আমরা সেগুলো জানিও। এ হাদীছে যে চল্লিশটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তাও সেগুলোর মধ্যেই থাকবে বৈ কি। কাজেই এ হাদীছে তার উল্লেখ না থাকলেও আমাদের কোনও ক্ষতি নেই। উদ্দেশ্য তো আমল করা। বিভিন্ন হাদীছে যেসব নেক কাজের কথা বলা হয়েছে তার উপর আমল করতে থাকলে এ চল্লিশটির উপর আমল হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে আমলের তাওফীক দিন।
যাহোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশটি আমলের প্রত্যেকটি সম্পর্কে ইরশাদ করেন- مَا مِنْ عَامِلٍ يَعْمَلُ بِخَصْلَةٍ مِنْهَا رَجَاءَ ثَوَابِهَا (কোনও আমলকারী তার যে-কোনও একটি যদি ছাওয়াবের আশায় করে)। বোঝা গেল আমল করতে হবে ছাওয়াব পাওয়ার আশায়। ছাওয়াব পাওয়ার আশা না থাকলে কেবল আমল দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যাবে না। এর দ্বারা ইখলাস ও সহীহ নিয়তের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ যে-কোনও নেক আমল করতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ ও তাঁর পক্ষ হতে পুরস্কার পাওয়ার আশায়, দুনিয়াবী কোনও মাকসাদে নয়।
এ বাক্যটি ইঙ্গিত করে, আমলের বিনিময়ে ছাওয়াব দেওয়াটা আল্লাহ তা'আলার দয়া ও অনুগ্রহ। এটা বান্দার প্রাপ্য নয় যে, দিতেই হবে। তিনি না দিলেও সে এখতিয়ার তাঁর আছে। কেন দিলেন না, সে প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই। মানুষ ও মানুষের আমল সবই আল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি নিজ মালিকানায় যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তাতে কারও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।
وَتَصْدِيقَ مَوْعُوْدِهَا (এবং তাতে যে প্রতিদানের ওয়াদা আছে তাতে বিশ্বাস রাখে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে আমলের জন্য যে প্রতিদানের ওয়াদা আছে, তাতে এ বিশ্বাস রাখা যে, তাঁর সে ওয়াদা সত্য এবং তিনি নিজ ওয়াদা অনুযায়ী আমলকারীকে নিজ অনুগ্রহে সে প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। কেননা তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ بِهَا الْجَنَّةَ (তবে আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময়ে তাকে অবশ্যই জান্নাতে দাখিল করবেন)। এটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ওয়াদা যে, যে ব্যক্তি যথাযথ শর্ত পূরণ করে সে চল্লিশটি আমলের যে-কোনও একটি করবে, তিনি তাকে অবশ্যই জান্নাতবাসী করবেন।
প্রশ্ন হয়, তবে কি জান্নাত লাভের জন্য কেবল একটি আমলই যথেষ্ট, আর কিছুই করতে হবে না?
উত্তর হল, না, হাদীছে কেবল এতটুকু বলা হয়েছে যে, এর যে-কোনও একটি আমল করলে জান্নাত লাভ হবে। এ কথা বলা হয়নি যে, তা দ্বারা শুরুতেই জান্নাত পাওয়া যাবে। বস্তুত যে-কোনও আমল কবুল হওয়ার জন্য ঈমান শর্ত। কাজেই জান্নাত পেতে ঈমান লাগবেই। তারপর হাশরের ময়দানে বান্দার সৎকর্ম-পাপকর্মের ওজন করা হবে। তাতে সৎকর্ম বেশি ভারী হলে শুরুতেই জান্নাত লাভ হবে। কিন্তু ভারী যদি হয় অসৎকর্ম, তবে আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করলে ভিন্ন কথা, অন্যথায় প্রথমে পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। শাস্তিভোগের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জান্নাত লাভ হবে। তো আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত আমলসমূহ যদি করা হয় আর ঈমানের বদৌলতে তা কবুলও হয়, তবে জান্নাতলাভে তো তার ভূমিকা অবশ্যই থাকবে। কেননা দাঁড়িপাল্লার নেকীর দিক ওজনদার হওয়ায় এ আমলেরও তো কিছু না কিছু ভূমিকা থাকবে। হয়তো এ আমল না হলে ওজন কিছুটা কম হতো, ফলে শাস্তির মেয়াদ কিছুটা বাড়ত। এ আমলের কারণে সে মেয়াদ বাড়তে পারেনি, ফলে তুলনামূলক কিছুটা আগে জান্নাত লাভ হয়েছে। তো সাব্যস্ত হল হাদীছে বর্ণিত আমলসমূহের প্রতিটি আমল দ্বারাই জান্নাত লাভ হয়। অর্থাৎ যে-কোনও সময় জান্নাতে প্রবেশে এর কিছু না কিছু ভূমিকা থাকেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল নেক আমল আছে নানারকম। সুতরাং বিশেষ কিছু আমল করে সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
খ. নেক আমল যেহেতু বহু রকম, তাই ছোট-বড় সব আমলেই যত্নবান থাকা উচিত। ছোট মনে করে কোনও আমলকে অবহেলা করতে নেই। কে জানে কোনটি আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়।
গ. কাউকে দুধপানের জন্য কোনও পশু সাময়িকভাবে দেওয়াও অনেক বড় নেক কাজ।
ঘ. সাময়িকভাবে পশু দান করাও যখন অনেক বড় নেক কাজ, তখন স্থায়ীভাবে দেওয়া যে আরও বড় নেক কাজ হবে তা বলাই বাহুল্য।
ঙ. যে-কোনও সৎকর্মের ছাওয়াব পাওয়া যায় কেবল তখনই, যখন উদ্দেশ্য থাকে পার্থিব কোনও স্বার্থ হাসিল নয়; বরং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব অর্জন করা।
চ. আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে ছাওয়াব ও প্রতিদানের ওয়াদা করা হয়েছে, তাতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
ছ. সালামের জবাব দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক কাজ।
জ. তাশমীত অর্থাৎ হাঁচিদাতার আলহামদুলিল্লাহ বলার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলাও একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক কাজ।
মানীহা বলা হয় কাউকে দুধপানের জন্য কোনও পশু সাময়িকভাবে দান করা। অর্থাৎ দুধপান শেষে সে পশুটি ফিরিয়ে দেবে। তা বকরি, গাভী, উটনী ইত্যাদি যে-কোনও পশুই হতে পারে। এ হাদীছে সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে বকরির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় গাভী ও উটনী দেওয়ার ছাওয়াব আরও বেশি।
চল্লিশটি আমলের মধ্যে সর্বোচ্চ বলা হয়েছে বকরি দান করাকে। কেননা বকরির দুধ পান করার দ্বারা ক্ষুধা নিবারণ হয়। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের চাহিদাই সবচে' বড়। তাই মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করা সবচে' বড় উপকার। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা মানুষের প্রতি তাঁর নি'আমতসমূহের কথা স্মরণ করাতে গিয়ে খাদ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এবং অন্যকে খাওয়ানোর কাজকে একটি বড় সৎকর্মরূপে দেখিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদীছে খাদ্যদানে উৎসাহিত করেছেন। কোনও কোনও হাদীছে খানা খাওয়ানোকে একটি শ্রেষ্ঠতম আমলরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। মানীহা দ্বারা যেহেতু মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণে সহযোগিতা করা হয়, তাই এ হাদীছে একেও চল্লিশটি নেক কাজের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে।
সালামের জবাব দেওয়া
رد السلام -সালামের জবাব দেওয়া। এক মুসলিমের সঙ্গে আরেক মুসলিমের সাক্ষাত হলে তাদের প্রথম কাজ একজন আরেকজনকে সালাম দেওয়া। যাকে সালাম দেওয়া হবে তার কর্তব্য সালামের জবাব দেওয়া। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا ‘যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম দেয়, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষাও উত্তমরূপে সালাম দিও কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিও। সূরা নিসা (৪), আয়াত নং ৮৬
সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। একাধিক ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া হলে সকলের পক্ষ থেকে একজন উত্তর দিলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। কেউ উত্তর না দিলে সকলেই গুনাহগার হয়। উত্তর না দেওয়া অসৌজন্যমূলক আচরণও বটে। এর দ্বারা সালামদাতাকে অবজ্ঞা করা হয়। সেইসঙ্গে তার মনে দুর্ভাবনাও সৃষ্টি করা হয়। কেননা সালাম মূলত নিরাপত্তাদানের ভাষা। যে ব্যক্তি সালাম দেয় সে সালামের বাক্য দ্বারা আশ্বস্ত করে যে, তোমরা নিরাপদ। আমার দিক থেকে তোমাদের কোনও অনিষ্টের আশঙ্কা নেই। তারপর সে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে যে, তারাও তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে কি না। উত্তর না দিলে তার মনে অনিষ্টের আশঙ্কা দেখা দেয়। সে আশঙ্কা দূর করার জন্য উত্তর দেওয়া অবশ্যকর্তব্য।
সালাম দেওয়া ও তার উত্তর দেওয়া ইসলামের অতি মূল্যবান এক শিক্ষা। এটা ইসলামী তাহযীব ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনও বটে। যেখানে সালামের রেওয়াজ আছে সেখানকার লোকজন যে মুসলিম এবং তারা ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত, তা এই রেওয়াজ দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের কর্তব্য ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটির মূল্য বোঝা এবং সর্বস্তরে এটা বাস্তবায়ন করা।
হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা
হাদীছটিতে বর্ণিত আরেকটি আমল হল تشميت العاطس হাঁচিদাতাকে يرحمك الله বলা, অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। تشميت العاطس অর্থ কল্যাণ ও বরকতের দু'আ করা। শব্দটির উৎপত্তি شماتة থেকে। যার অর্থ অন্যের বিপদে আনন্দিত হওয়া।تشميت অর্থ সেই আনন্দ প্রতিহত করা। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হয় তার বিপদও কেটে যায়। ফলে শত্রুর আনন্দ ঘুচে যায়। যেহেতু এ দু'আটি পরিণামে শত্রুর আনন্দ ঘুচিয়ে দেয় তাই একে تشميت নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কারও মতে تشميت এর উৎপত্তি شواميت থেকে। شواميت অর্থ হাত-পা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সেই হিসেবে تشميت অর্থ স্থিত ও প্রতিষ্ঠিত রাখা। يرحمك الله বলার দ্বারা হাঁচিদাতার জন্য তাকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার দু'আ করা হয়। তাই এ দু'আকে تشميت নাম দেওয়া হয়েছে।
হাঁচি দেওয়া একটি নিআমত। এর দ্বারা আলস্য কাটে ও শরীর ঝরঝরে হয়। ফলে কাজকর্মে স্ফুর্তি আসে। তখন ইবাদত-বন্দেগী করতে ভালো লাগে। তাই হাঁচিদাতার কর্তব্য হাঁচি দেওয়ার পর আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা। অর্থাৎ আলহামদুল্লিাহ বলা আলহামদুল্লিাহ শোকর আদায়ের ভাষা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে হাঁচির এ দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি হাঁচির ব্যাপারে আমাদের জন্য এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা রেখে গেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ- إذا عطس أحدكم، فليقل: الحمد لله، فإذا قال: الحمد لله، قال له أخوه يرحمك الله، فإذا قيل له يرحمك الله : فليقل: يهديكم الله ويصلح بالكم 'তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন বলে الْحَمْدُ لِلَّهِ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)। সে যখন الْحَمْدُ لِلَّهِ বলবে তখন উপস্থিত ভাই যেন বলে يَرْحَمُكَ اللَّهُ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন)। তাকে লক্ষ্য করে يَرْحَمُكَ اللَّهُ বললে সে যেন বলে يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।[১৫]
হাঁচিদাতা আলহামদুল্লিাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা ওয়াজিব। অনেকেই এই ওয়াজিব পালনে অবহেলা করে। তা করা উচিত নয়। তাতে এক তো ওয়াজিব তরকের গুনাহ হয়। দ্বিতীয়ত, হাঁচিদাতাকেও হেলা করা হয়, বিশেষত সে যদি গরীব হয় বা তথাকথিত সামাজিক দৃষ্টিতে নিম্নস্তরের হয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে হেলা করা কঠিন অপরাধ। এ ব্যাপারে সতর্কতা জরুরি। সুতরাং হাঁচিদাতার উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ অবশ্যই বলতে হবে, সে যেই হোক না কেন। অবশ্য যদি বারবার হাঁচি দেয়, তিনবার বা তারও বেশি তবে সেটা সর্দির আলামত। সেক্ষেত্রে বারবার উত্তর দেওয়ার জরুরত নেই।
উপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা হবে তখন আবার হাঁচিদাতার কাজ তাদের জন্য দুআ করা। তারা তার জন্য দুআ করে তার প্রতি যেই ইহসান করেছে তার বদলা দেওয়া তার কর্তব্য। উপকারীর উপকার করাও ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কেউ কারও উপকার করলে সে উপকারের বদলা দেওয়া কর্তব্য। বৈষয়িক উপকারও উপকার বটে। তবে কারও জন্য দু'আ করা বা কারও দীনী কল্যাণ সাধন করা আরও বড় উপকার। কাজেই উপস্থিত ব্যক্তিগণ দু'আ দ্বারা হাঁচিদাতার যে বিরাট উপকার করল তার বিনিময়ে কিছু করা তো চাই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হল সেও তাদের জন্য এই বলে দু'আ করবে- (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়া
বিভিন্ন হাদীছে ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা বলা হয়েছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে এ আমলটি অতি সামান্য মনে হলেও হাকীকতের দিক থেকে এটি অনেক বড়। কেননা এ কাজটি করা হয় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে। আল্লাহর বান্দাগণ এ পথে যাতায়াত করতে গিয়ে কষ্ট পেতে পারে, সে চিন্তা থেকেই একজন মু'মিন কষ্টদায়ক বস্তুটি সরিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের দান করেছেন। তিনি এক হাদীছে বলেন-
الْمُسْلِمُوْنَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اشتَكى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ ، وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
‘মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তির মতো, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।(সহীহ মুসলিম: ২৫৮৬, ৬৭)
অবশিষ্ট কাজগুলো কী? এ হাদীছে তার উল্লেখ নেই। উল্লেখ সম্ভবত এ কারণে করা হয়নি যে, লোকে হয়তো মনে করে বসবে এ চল্লিশটি কাজ করাই যথেষ্ট। তখন তারা এর বাইরে আর কোনও নেক আমল করবে না। অথচ নেক আমল কেবল চল্লিশটিই নয়; তার বাইরে অনেক আছে। চল্লিশটির কথা জানিয়ে দেওয়া হলে অবশিষ্টগুলো হয়তো উপেক্ষিত হতো এবং তাতে আল্লাহ ও বান্দার কোনও কোনও হক অনাদায় থেকে যেত। আর তাতে করে সেসব কাজের ছাওয়াব থেকে তো বঞ্চিত থাকা হতোই, তার পাশাপাশি হক অনাদায়ের গুনাহও হয়ে যেত। কাজেই সবগুলোর ফিরিস্তি না দেওয়া আমাদের জন্য কল্যাণকরই হয়েছে।
এ হাদীছে অবশিষ্ট কাজগুলো উল্লেখ না থাকার কারণে সেগুলো যে আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে গেল এমনও নয়। কেননা বিভিন্ন হাদীছে বহু সৎকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, কোনও কারিগরকে তার কাজে সাহায্য করা, অদক্ষ লোকের কাজে সহযোগিতা করা, মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন করা, শোকাগ্রস্ত লোককে সান্ত্বনা দেওয়া, পথ হারানো লোকের পথ দেখিয়ে দেওয়া, উত্তম কথা বলা, গাছ লাগানো, সুপারিশ করা, রোগীর খোঁজখবর নেওয়া, মুসাফাহা করা, আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য কারও প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়া, মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, অন্যের কল্যাণ কামনা করা, কাউকে সুপরামর্শ দেওয়া, অন্যকে নেক কাজের পথ দেখানো, পিপাসার্তকে পানি পান করানো ইত্যাদি। হিসাব করতে থাকলে সংখ্যা চল্লিশের অনেক বেশি হবে এবং সাধারণত আমরা সেগুলো জানিও। এ হাদীছে যে চল্লিশটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তাও সেগুলোর মধ্যেই থাকবে বৈ কি। কাজেই এ হাদীছে তার উল্লেখ না থাকলেও আমাদের কোনও ক্ষতি নেই। উদ্দেশ্য তো আমল করা। বিভিন্ন হাদীছে যেসব নেক কাজের কথা বলা হয়েছে তার উপর আমল করতে থাকলে এ চল্লিশটির উপর আমল হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে আমলের তাওফীক দিন।
যাহোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশটি আমলের প্রত্যেকটি সম্পর্কে ইরশাদ করেন- مَا مِنْ عَامِلٍ يَعْمَلُ بِخَصْلَةٍ مِنْهَا رَجَاءَ ثَوَابِهَا (কোনও আমলকারী তার যে-কোনও একটি যদি ছাওয়াবের আশায় করে)। বোঝা গেল আমল করতে হবে ছাওয়াব পাওয়ার আশায়। ছাওয়াব পাওয়ার আশা না থাকলে কেবল আমল দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যাবে না। এর দ্বারা ইখলাস ও সহীহ নিয়তের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ যে-কোনও নেক আমল করতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ ও তাঁর পক্ষ হতে পুরস্কার পাওয়ার আশায়, দুনিয়াবী কোনও মাকসাদে নয়।
এ বাক্যটি ইঙ্গিত করে, আমলের বিনিময়ে ছাওয়াব দেওয়াটা আল্লাহ তা'আলার দয়া ও অনুগ্রহ। এটা বান্দার প্রাপ্য নয় যে, দিতেই হবে। তিনি না দিলেও সে এখতিয়ার তাঁর আছে। কেন দিলেন না, সে প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই। মানুষ ও মানুষের আমল সবই আল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি নিজ মালিকানায় যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তাতে কারও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।
وَتَصْدِيقَ مَوْعُوْدِهَا (এবং তাতে যে প্রতিদানের ওয়াদা আছে তাতে বিশ্বাস রাখে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে আমলের জন্য যে প্রতিদানের ওয়াদা আছে, তাতে এ বিশ্বাস রাখা যে, তাঁর সে ওয়াদা সত্য এবং তিনি নিজ ওয়াদা অনুযায়ী আমলকারীকে নিজ অনুগ্রহে সে প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। কেননা তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ بِهَا الْجَنَّةَ (তবে আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময়ে তাকে অবশ্যই জান্নাতে দাখিল করবেন)। এটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ওয়াদা যে, যে ব্যক্তি যথাযথ শর্ত পূরণ করে সে চল্লিশটি আমলের যে-কোনও একটি করবে, তিনি তাকে অবশ্যই জান্নাতবাসী করবেন।
প্রশ্ন হয়, তবে কি জান্নাত লাভের জন্য কেবল একটি আমলই যথেষ্ট, আর কিছুই করতে হবে না?
উত্তর হল, না, হাদীছে কেবল এতটুকু বলা হয়েছে যে, এর যে-কোনও একটি আমল করলে জান্নাত লাভ হবে। এ কথা বলা হয়নি যে, তা দ্বারা শুরুতেই জান্নাত পাওয়া যাবে। বস্তুত যে-কোনও আমল কবুল হওয়ার জন্য ঈমান শর্ত। কাজেই জান্নাত পেতে ঈমান লাগবেই। তারপর হাশরের ময়দানে বান্দার সৎকর্ম-পাপকর্মের ওজন করা হবে। তাতে সৎকর্ম বেশি ভারী হলে শুরুতেই জান্নাত লাভ হবে। কিন্তু ভারী যদি হয় অসৎকর্ম, তবে আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করলে ভিন্ন কথা, অন্যথায় প্রথমে পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। শাস্তিভোগের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জান্নাত লাভ হবে। তো আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত আমলসমূহ যদি করা হয় আর ঈমানের বদৌলতে তা কবুলও হয়, তবে জান্নাতলাভে তো তার ভূমিকা অবশ্যই থাকবে। কেননা দাঁড়িপাল্লার নেকীর দিক ওজনদার হওয়ায় এ আমলেরও তো কিছু না কিছু ভূমিকা থাকবে। হয়তো এ আমল না হলে ওজন কিছুটা কম হতো, ফলে শাস্তির মেয়াদ কিছুটা বাড়ত। এ আমলের কারণে সে মেয়াদ বাড়তে পারেনি, ফলে তুলনামূলক কিছুটা আগে জান্নাত লাভ হয়েছে। তো সাব্যস্ত হল হাদীছে বর্ণিত আমলসমূহের প্রতিটি আমল দ্বারাই জান্নাত লাভ হয়। অর্থাৎ যে-কোনও সময় জান্নাতে প্রবেশে এর কিছু না কিছু ভূমিকা থাকেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল নেক আমল আছে নানারকম। সুতরাং বিশেষ কিছু আমল করে সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
খ. নেক আমল যেহেতু বহু রকম, তাই ছোট-বড় সব আমলেই যত্নবান থাকা উচিত। ছোট মনে করে কোনও আমলকে অবহেলা করতে নেই। কে জানে কোনটি আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়।
গ. কাউকে দুধপানের জন্য কোনও পশু সাময়িকভাবে দেওয়াও অনেক বড় নেক কাজ।
ঘ. সাময়িকভাবে পশু দান করাও যখন অনেক বড় নেক কাজ, তখন স্থায়ীভাবে দেওয়া যে আরও বড় নেক কাজ হবে তা বলাই বাহুল্য।
ঙ. যে-কোনও সৎকর্মের ছাওয়াব পাওয়া যায় কেবল তখনই, যখন উদ্দেশ্য থাকে পার্থিব কোনও স্বার্থ হাসিল নয়; বরং কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব অর্জন করা।
চ. আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যে ছাওয়াব ও প্রতিদানের ওয়াদা করা হয়েছে, তাতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।
ছ. সালামের জবাব দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক কাজ।
জ. তাশমীত অর্থাৎ হাঁচিদাতার আলহামদুলিল্লাহ বলার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলাও একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক কাজ।
