কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

৪৭. ঈমান এবং ঈমানের শাখা প্রশাখার বিবরণ

হাদীস নং: ৫০০৬
আন্তর্জতিক নং: ৫০০৬

পরিচ্ছেদঃ ঈমানের শাখা-প্রশাখার বর্ণনা

৫০০৫. ইয়াহয়া ইবনে হাবীব ইবনে আরাবী (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ লজ্জা ঈমানের একটি শাখা।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এক আনসারী সাহাবী তার ভাইকে লজ্জার বিষয়ে তিরস্কার করছিলেন। অর্থাৎ তার ভাই হয়তো কোনও এক কাজ করতে লজ্জাবোধ করছিল। তাই তিনি তিরস্কার করছিলেন যে, তুমি এটা করতে লজ্জা করছ কেন বা এতে লজ্জার কী আছে! ঠিক এ সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সে আনসারী সাহাবীর তিরস্কারমূলক কথা শুনে ফেলেন। তাই তিনি এই বলে তাকে বারণ করেন যে, তুমি তাকে ছেড়ে দাও। অর্থাৎ তাকে তিরস্কার করো না। কেননা সে যে লজ্জা করছে, এটা খারাপ কিছু নয় যে, এ কারণে তাকে তিরস্কার করা যায়। বরং লজ্জা করাটা ভালো। কেননা এটা ঈমানের অঙ্গ। তাই তাকে তিরস্কার করা তো নয়ই; বরং প্রশংসা করা উচিত যে, তার মধ্যে ঈমানের একটা অঙ্গ আছে এবং সে ঈমানের দাবি অনুযায়ী কাজ করছে। বরং ঈমান রক্ষা করার জন্যই লজ্জাশীলতার চর্চা করা জরুরি। কেননা যে ব্যক্তি লজ্জা হারায়, এক পর্যায়ে সে ঈমানও হারিয়ে ফেলে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত- إِنَّ الْحَيَاءَ وَالْإِيْمَانَ قُرِنَا جَمِيعًا، فَإِذَا رُفِعَ أَحَدُهُمَا رُفِعَ الْآخَرُ হায়া ও ঈমান উভয়টা পরস্পর যুক্ত। যখন এর একটা উঠিয়ে নেওয়া হয়, তখন অপরটাও উঠে যায়। (শু'আবুল ঈমান : ৭৩৩১; আল-আদাবুল মুফরাদ: ১৩১৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৫০) প্রশ্ন হতে পারে যে, লজ্জাশীলতা তো স্বভাবগত বিষয়, যা মানুষের এখতিয়াবহির্ভূত, আর যা মানুষের এখতিয়ারবহির্ভূত, তা করার জন্য আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন না, এ অবস্থায় লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ হয় কী করে? এর উত্তর হল, লজ্জাশীলতা স্বভাবগত বিষয় হলেও এ অনুযায়ী কাজ করা বা না করাটা মানুষের এখতিয়ার ও ইচ্ছাধীন বিষয়। সেদিক থেকে এটা ঈমানের অঙ্গ। তাছাড়া যে লজ্জাশীলতা সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়, অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও তাঁর অনুগ্রহরাজির মধ্যে চিন্তা করার দ্বারা অন্তরে সৃষ্টি হয়, তা মানুষের পুরোপুরি এখতিয়ারাধীন। একে শর'ঈ হায়া বলা হয়ে থাকে। হাদীছে এরূপ হায়াকেই ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। এরূপ হায়া ও লজ্জাশীলতা মানুষকে সৎকর্মে উৎসাহিত করে ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকার হিম্মত যোগায়। আরও প্রশ্ন হতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় লজ্জার কারণে মানুষ কোনও কোনও ভালো কাজ করতে সংকোচবোধ করে, যেমন যে ব্যক্তি কখনও নামায পড়েনি, তার নামায শুরু করতে কেমন যেন লজ্জাবোধ হয়, এমনিভাবে যে নারী পর্দা করত না, তার পর্দা শুরু করতে লজ্জা লাগে, তো দেখা যাচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে লজ্জা সৎকর্মের পক্ষে বাধা হয়, এ অবস্থায় তা কীভাবে ঈমানের অঙ্গ হয়? এর উত্তর হল, যে লজ্জা সৎকর্মের জন্য বাধা হয়, তা আদৌ লজ্জা নয়। বরং তা এক রকম মানসিক দুর্বলতা, যা পুরোনো অভ্যাস বা পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রকৃত লজ্জা কখনও সৎকর্মের জন্য বাধা হয় না। বরং তা সৎকর্মে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এমনকি কোনও ব্যক্তি যদি দীনদারিতে মুখলিস ও নিষ্ঠাবান না হয়, কিন্তু তার মধ্যে লজ্জাশীলতার গুণ থাকে, সেও তার এ গুণের কারণে বহুবিধ গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকে। জনৈক তাবি'ঈ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আমি ৪০ বছর পর্যন্ত কেবল লজ্জাশীলতার কারণে গুনাহ পরিত্যাগ করেছি। পরিশেষে আমার পরহেযগারি অর্জিত হয়েছে। ইবনে সাম‘উন রহ. বলেন, আমি লক্ষ করে দেখলাম পাপকর্ম নির্লজ্জতা। তাই ভদ্রতাবশত আমি তা ত্যাগ করেছি। পরিশেষে তা দীনদারিতে রূপান্তরিত হয়েছে। লক্ষণীয়, হাদীছটিতে লজ্জাশীলতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। বোঝা গেল প্রত্যেক ঈমানদারেরই এ গুণ থাকা উচিত, তা সে নারী হোক বা পুরুষ। এটা যখন ঈমানের অঙ্গ, তখন কেবল নারীর নয়; বরং এটা নারী-পুরুষ সকলেরই ভূষণ। আরও লক্ষণীয়, আনসারী সাহাবী যে কারণে তার ভাইকে তিরস্কার করছিলেন, তা নিজের কাছে তিরস্কারযোগ্য মনে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তা তিরস্কারের যোগ্য কোনও বিষয় ছিল না। বরং তা ছিল প্রশংসনীয় এবং শরী'আতের কাছে কাম্য একটি বিষয়, যে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই সাহাবীকে তিরস্কার করতে নিষেধ করে দেন। এর দ্বারা বোঝা গেল, কাউকে কোনও কাজের জন্য তিরস্কার করার আগে চিন্তা করে দেখতে হবে সে কাজটি শরী'আতের দৃষ্টিতে কেমন। শরী'আতের দৃষ্টিতে যদি তা ভালো ও কাম্য হয়ে থাকে, তবে কেবল পরিবেশ ও প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির বিপরীত হওয়ার কারণে সেজন্য তিরস্কার করা যাবে না। বরং এরূপ ক্ষেত্রে সে তিরস্কারটাই একটা মন্দ কাজ, যা থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর চর্চা করা চাই। খ. যে কাজ দীন ও শরী'আতের অঙ্গ, কিন্তু প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির পরিপন্থী, সেজন্য কাউকে তিরস্কার করা কিছুতেই সমীচীন নয়; বরং সে কাজে উৎসাহ দেওয়াই কর্তব্য। গ. যে কাজ শরী'আতে কাম্য, সে কাজের জন্য কেউ কাউকে তিরস্কার করলে তা একটি গর্হিত কাজ হবে। এজন্য তাকেই সতর্ক করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। ঘ. শরী'আতের কোনও হুকুম পালনে কারও দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিলে তা সত্যিকারের লজ্জাশীলতা নয়; বরং তা শরী'আতের হুকুম পালনে অবহেলাজনিত মানসিক দুর্বলতা। এরূপ দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন

সুনানে নাসায়ী - হাদীস নং ৫০০৬ | মুসলিম বাংলা