কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
৪৭. ঈমান এবং ঈমানের শাখা প্রশাখার বিবরণ
৫০০৩. মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ ঈমানের সত্তরটিরও বেশী শাখা রয়েছে। লজ্জা-শরমও ঈমানের একটি শাখা।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। এতে জানানো হয়েছে ঈমান শাখাপ্রশাখাহীন কোনও বিষয় নয়। এটা সুনির্দিষ্ট একটা জিনিসমাত্র নয় যে, সে একটা জিনিস করল আর তাতেই মু'মিন হয়ে গেল। এমনিতে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তো এ কথা ঠিক যে, ঈমান অন্তরের বিশ্বাসের নাম। আর বিশ্বাস এক অবিভাজ্য জিনিস। কিন্তু সেই বিশ্বাসও কোনও একটা বিষয়ের উপর হলেই যথেষ্ট হয় না। বরং তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখলেই কেউ মু'মিন হতে পারে। কাজেই অন্তরের বিশ্বাসের অনেক শাখাপ্রশাখা আছে। তাছাড়া কুরআন-হাদীছ সাধারণত মু'মিন বলে পূর্ণাঙ্গ মু'মিনকেই বোঝায়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে সাথে শরী'আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধও মেনে চলে। সে হিসেবে শরী'আত যা-কিছু করতে বলেছে তার প্রত্যেকটিই ঈমানের একটি শাখা। এমনিভাবে যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে তার প্রত্যেকটি থেকে বেঁচে থাকাও ঈমানের একেকটি শাখা। যে ব্যক্তি সবগুলো শাখার উপর আমল করবে, সে-ই প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মু'মিন। এ হাদীছে ঈমানের শাখা বলা হয়েছে সত্তরটির কিছু বেশি। এ সংখ্যা দ্বারা মূলত সুনির্দিষ্ট অঙ্ক বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য সংখ্যাধিক্য। অর্থাৎ ঈমানের অনেকগুলো শাখা আছে। সুতরাং সত্তরের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা মেলানোর চেষ্টা বৃথা। অনেকে চেষ্টা করেছে। কেউ কুরআন মাজীদে ঈমানের শাখা খুঁজেছে, কেউ হাদীছে খুঁজেছে, কেউ উভয়ের মধ্যে বর্ণিত সৎকর্মসমূহ যোগ করে দেখেছে। তাতে কারও সংখ্যা কম হয়েছে এবং কারও বেশি হয়ে গেছে। কেউবা কুরআন ও হাদীছের মধ্যে বর্ণিত সৎকর্মসমূহের মধ্যে যার পুনরাবৃত্তি হয়েছে তার পুনরোল্লেখ বাদ দিয়ে দেখেছে। তাতে সংখ্যা মিলে যায় বলে দেখানোর চেষ্টা করেছে। প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি মেলে না কোনও পদ্ধতির হিসাবই। বস্তুত মিলে যাওয়া জরুরিও নয়। এ হাদীছ দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য ঈমানের শাখা অনেকগুলো। সুতরাং তোমরা সামান্য কিছু আমল নিয়ে বসে থেক না; বরং কুরআন-হাদীছে যত সৎকর্মের কথা বলা হয়েছে সবগুলো করার চেষ্টা কর। তবেই পূর্ণাঙ্গ মু'মিন হতে পারবে। কুরআন ও হাদীছে যেসব কাজ সম্পর্কে কোনও ফযীলত ও ছাওয়াবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আগ্রহভরে তা করে যাও। এবং যেসব কাজ সম্পর্কে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর। যদি সারা জীবন এভাবে চলতে পার, তবে আশা করা যায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে এবং মৃত্যুর পর জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। হাদীছে ঈমানের শাখাসমূহের মধ্য থেকে কেবল লজ্জার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লজ্জার এমন কী বিশেষত্ব, যে কারণে অন্যসব শাখা থেকে বাছাই করে কেবল এর কথাই উল্লেখ করা হল? এর উত্তর মেলে অন্য এক হাদীছে। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إن ما أدرك الناس من كلام النبوة الأولى: «إذا لم تستحي فاصنع ما شئت» “মানুষ পূর্ববর্তী নবুওয়াতের যে বাণী লাভ করেছে (অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীদের যে শিক্ষা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে) তা হচ্ছে- তুমি যদি লজ্জাই না কর তবে যা চাও করতে পার।” সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৪৮৩; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭০৯১; মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৫৪৫। সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১৮২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৭৯৭. অর্থাৎ যে ব্যক্তির লজ্জা নেই সে হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যে-কোনও অন্যায়-অপরাধ লজ্জাহীন মানুষ অবলীলায় করতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তির লজ্জা আছে, সে সহজে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। লজ্জা তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই কোনও মন্দ কাজ করার ইচ্ছা জাগে, তখন লোকে দেখলে কী বলবে এই অনুভূতি তাকে সে কাজ করতে দেয় না। সে মনের ইচ্ছা মনেই দমন করে ফেলে। মানুষকে লজ্জা করার কারণেই যখন মানুষ এভাবে পাপ কাজ থেকে দূরে থাকে, তখন যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করবে সে তো কোনওক্রমেই পাপ কাজের ধারেকাছে যাবে না। মূলত আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করাই প্রকৃত লজ্জা। তাই “উলামায়ে কিরাম লজ্জার ব্যাখ্যা দেনঃ- الحياء أن لا يرى مولاك فيما نهاك عنه “লজ্জা হল এই যে, তোমার মাওলা যেন তোমাকে এমন কাজে না দেখেন, যা করতে তিনি তোমাকে নিষেধ করেছেন'।এ হাদীছে সে লজ্জার কথাই বলা হয়েছে। লজ্জা একটি অতি মূল্যবান সৎগুণ। এটা মূলত একটি স্বভাবগত বিষয়। এ স্বভাবগুণের বাস্তব প্রয়োগ শরী'আতে কাম্য। মানুষ চাইলেই এর বাস্তব প্রয়োগ করতে পারে। এর ব্যবহার দ্বারা মানুষ তাকওয়া-পরহেযগারীর উচ্চ শিখরে পৌছতে পারে।নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও অত্যন্ত লাজুক ছিলেন। এক হাদীছে বলা হয়েছেঃ- كان أشد حياء من العذراء في خدرها “তিনি পর্দানশীন কুমারী নারী অপেক্ষাও বেশি লাজুক ছিলেন।” সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬১১৯ যার অন্তরে এ গুণ থাকবে সে শরী'আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলবে আর এভাবে তার ঈমানের সবগুলো শাখা সংরক্ষিত থাকবে। এ কারণেই ঈমানের বাকি সব শাখাসমূহের মধ্য থেকে বিশেষভাবে লজ্জাশীলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, শরীয়াতের আদেশ নিষেধ পালনে যে লজ্জা বাধা হয় তা আদৌ লজ্জা নয়; তা ঈমানের দুর্বলতা। প্রকৃত লজ্জা তো তা-ই, যা লোকে কী বলবে-না বলবে তা উপেক্ষা করে মানুষকে শরী'আতের হুকুম মানতে উৎসাহিত করে। তাই তো হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছেঃ- قال رسول اللہ ﷺ ذات يوم: «استحيوا من الله حق الحياء»، قال: قلنا يا رسول الله! إنا نستحي والحمد لله، قال: «ليس ذاك، ولكن الاستحياء من الله حق الحياء أن تحفظ الرأس وما وعى، والبطن وما حوى، ولتذكر الموت والبلى، ومن أراد الأخرة ترك زينة الدنيا، فمن فعل ذلك فقد استحيى من الله حق الحياء» “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন বললেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর যথার্থ লজ্জার সাথে। হযরত ইব্ন মাসউদ রাযি. বলেন, আমরা বললাম,ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর শোকর যে, আমরা লজ্জা করি। তিনি বললেন, ওই লজ্জা নয়; বরং আল্লাহ তা'আলাকে যথার্থ লজ্জা করা হল এই যে, তুমি হেফাজত করবে নিজ মাথা এবং মাথা যা চিন্তাভাবনা করে, নিজ উদর এবং উদর যা ধারণ করে। আর স্মরণ করবে মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর পচে-গলে যাওয়াকে। যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে সে দুনিয়ার সাজসজ্জা পরিত্যাগ করে। যে ব্যক্তি এসব করল, সে-ই আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করল। "জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৬৭১; তবারানী, আল- মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩১৯২; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭৯১৫; বাগাবী, শারহুস্- সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৩৩. বস্তুত লজ্জা মু'মিনের শোভা। এটা কেবল নারীর নয়; নর-নারী সকলের মধ্যেই থাকা উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেনঃ- ما كان الحياء في شيء إلا زانه، ولا كان الفحش في شيء إلا شانه “যে-কোনও বস্তুতে লজ্জা থাকে, তা তাকে শোভা দান করে। আর যে বস্তুতেই নির্লজ্জতা থাকে, তা তাকে অশোভন করে তোলে। আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬০১: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৬৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৭৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫৯৫. হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল ঈমানের অনেক শাখা আছে। শরী'আতের সমস্ত আদেশ নিষেধ মেনে চলাই হচ্ছে ঈমানের শাখাপ্রশাখা। সুতরাং পরিপূর্ণ মু'মিন হতে হলে শরী'আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। খ. লজ্জাশীলতা যেহেতু ঈমানের অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, তাই মু'মিনের কর্তব্য তার সকল কাজে লজ্জাশীলতার পরিচয় দেওয়া।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন