আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪১- হিবা তথা উপহার প্রদান, এর ফযীলত ও এতে উৎসাহ প্রদান

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৫৯৮
১৬২২. হাদিয়া পাঠিয়ে কিংবা পাঠানোর ওয়াদা করে তা পৌঁছানোর আগেই মারা গেলে। আবীদা (রাহঃ) বলেন, দানকারী ব্যক্তি হাদিয়া সামগ্রী পৃথক করে হাদিয়া প্রাপকের জীবদ্দশায় মারা গেলে তা হাদিয়া প্রাপকের ওয়ারিসদের হক হবে। (যদি প্রাপক ইতিমধ্যে মারা গিয়ে থাকে) আর পৃথক না করে থাকলে হাদিয়া দাতার ওয়ারীসদের হক হবে। আর হাসান (রাহঃ) বলেছেন, উভয়ের যে কোন একজন মারা গেলে এবং প্রাপক কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তি উক্ত হাদিয়া সামগ্রী নিজ অধিকারে নিয়ে নিলে তা প্রপকের ওয়ারীসদের হক হবে।
২৪২৬। আলী ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) .... জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) আমাকে বললেন, বাহরাইন থেকে (জিযিয়া লব্ধ) মাল এসে পৌছলে তোমাকে আমি এভাবে (অঞ্জলী ভরে) তিন বার দিব, কিন্তু বাহরাইনের মাল আসার পূর্বেই নবী (ﷺ) এর ওফাত হল। পরে আবু বকর (রাযিঃ) এর নির্দেশে জনৈক ঘোষক ঘোষণা দিল; নবী (ﷺ) এর পক্ষ থেকে কারো জন্য কোন প্রতিশ্রুতি থাকলে কিংবা কারো কোন ঋণ থাকলে সে যেন আমার কাছে আসে। এ ঘোষণা শুনে আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে নবী (ﷺ) (বাহরাইনের সম্পদ এলে কিছু) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তখন তিনি আমাকে অঞ্জলি ভরে তিনবার দান করলেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জাবির রাযি.-কে ওয়াদা দেন যে لَوْ قَدْ جَاءَ مَالُ الْبَحْرَيْنِ أَعْطَيْتُكَ هكَذَا وَهكَذَا وَهكَذَا (যদি বাহরাইনের মাল আসত, তবে আমি তোমাকে এ পরিমাণ, এ পরিমাণ ও এ পরিমাণ দিতাম)। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, তাঁর জীবদ্দশায় বাহরাইনের মাল আসবে না। বাস্তবে তাই হয়েছিল। সেখানকার মাল আসার আগে আগেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল হয়ে যায়।

প্রকাশ থাকে যে, বাহরাইনবাসী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছিল। তিনি হযরত 'আলা ইবনুল হাযরামী রাযি.-কে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। পরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.-কে সেখানে প্রেরণ করেন। হযরত 'আলা রাযি. তাঁর কাছে খারাজের এক লক্ষ দিরহাম তুলে দেন। তিনি তা নিয়ে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসেন। ততোদিনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে যায়।ওফাতের আগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জাবির রাযি.-কে বলেছিলেন, যদি বাহরাইনের মাল আসত, তবে আমি তোমাকে এ পরিমাণ, এ পরিমাণ ও এ পরিমাণ দিতাম।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত হন। তিনি খলীফা হিসেবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শতভাগ প্রতিনিধিত্ব করার প্রতি মনোযোগী থাকেন। তাঁরই অংশ হিসেবে তিনি ঘোষণা করে দেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি কাউকে কিছু দেওয়ার ওয়াদা করে থাকেন কিংবা তাঁর কাছে যদি কারও কোনওকিছু পাওনা থাকে, তবে সে আমাদের কাছে উপস্থিত হোক।

এ ঘোষণা অনুযায়ী হযরত জাবির রাযি. তাঁর কাছে উপস্থিত হন এবং তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াদা সম্পর্কে অবহিত করেন। সুতরাং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সে ওয়াদা পূরণ করেন। হযরত জাবির রাযি. বলেন-
فَحَثى لِي حَثيَةً فَعَدَدْتُهَا، فَإِذَا هِيَ خَمْسُمِئَةٍ (তখন তিনি আমাকে এক আঁজলা ভরে দিলেন। আমি তা গুনে দেখলাম পাঁচশ দিরহাম)। অর্থাৎ হযরত জাবির রাযি, যে দাবি করলেন, সে বিষয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ চাইলেন না। কেননা এক তো হযরত জাবির রাযি.-এর তাকওয়া-পরহেযগারী এবং তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততার উপর হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর আস্থা ছিল। দ্বিতীয়ত তাঁর দাবি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল নাঃ বরং তার সম্পর্ক ছিল সরকারি সম্পদের সঙ্গে। এরূপ ক্ষেত্রে খলীফা নিজ ইজতিহাদ ও চিন্তা-ভাবনা দ্বারা যা সমীচীন মনে করেন তা করতে পারেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ জরুরি নয়।

যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু আঁজলা ভরে দেওয়ার ওয়াদা করেছিলেন, তাই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ও তাঁকে আঁজলা ভরেই দিলেন। এটা ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুবহু অনুসরণ। তাঁর প্রতিনিধিরূপে তিনি তাঁর ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করেছেন। হযরত জাবির রাযি, গুণে দেখেন যে, সে আঁজলায় যে দিরহাম উঠে এসেছে তার পরিমাণ পাঁচশত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু তিনবার দেওয়ার ওয়াদা করেছেন, তাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁকে আরও দুইবার পাঁচশত দিরহাম করে নেওয়ার জন্য বলেন। এভাবে সর্বমোট পনেরশো দিরহাম তাঁকে প্রদান করেন।

প্রকাশ থাকে যে, বাহরাইন থেকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁর জীবদ্দশায়ও একবার মাল এসেছিল। তিনি হযরত আবু উবায়দা রাযি.-কে জিযয়ার অর্থ নিয়ে আসার জন্য বাহরাইনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যথাসময়ে বাহরাইনে পৌঁছান এবং জিযয়ার অর্থ এনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করেন। তিনি তা মসজিদের এককোণে রেখে দিতে বলেন। ওদিকে আনসারদের মধ্যে প্রচার হয়ে যায় যে, আবু উবায়দা বাহরাইন থেকে প্রচুর অর্থকড়ি নিয়ে এসেছেন। সুতরাং তারা ফজরের নামায মসজিদে নববীতে এসে আদায় করেন। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে দেখতে পান অন্যদিনের তুলনায় আজ মুসল্লীদের সংখ্যা বেশি। তিনি তাদের দেখে মুচকি হেসে দেন এবং বলেন, ধারণা করি তোমরা শুনেছ আবু উবায়দা কিছুটা অর্থকড়ি নিয়ে এসেছে। তারা বললেন, হাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, সুসংবাদ নাও এবং তোমাদেরকে যা আনন্দ দেবে তার আশা করো। তবে আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং ভয় করি এই যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমনটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য। ফলে তোমরা এর আসক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে, যেমন এর আসক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল তারা। পরিণামে এটা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছিল। (সহীহ বুখারী: ৩১৫৮; সহীহ মুসলিম: ২৯৬১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৭১৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪০৫২)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কাউকে কিছু দেওয়ার ওয়াদা করলে সে ওয়াদা পূরণ করা উচিত।

খ. ওয়াদা পূরণের আগে কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার যারা ওয়ারিছ বা স্থলাভিষিক্ত হবে, তাদের কর্তব্য সে ওয়াদা পূরণ করে দেওয়া।

গ. এ হাদীছ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

ঘ. এ হাদীছ প্রমাণ করে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খলীফা হিসেবে তাঁর শতভাগ অনুসরণে সচেষ্ট থাকতেন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন