কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
৩৭. কোন প্রাণের বিনাশ/রক্তপাত অবৈধ হওয়া প্রসঙ্গে
হাদীস নং: ৪০৭৮
আন্তর্জাতিক নং: ৪০৭৮
যাদু প্রসঙ্গ
৪০৭৯. মুহাম্মাদ ইবনে আ’লা (রাহঃ) ......... সফওয়ান ইবনে আসলাম (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ইয়াহূদী নিজ সাথীকে বললোঃ চল এই নবীর কাছে যাই। সাথী ইয়াহুদী বললোঃ তাকে নবী বলো না, যদি সে তোমার কথা শুনতে পায়, তবে খুশিতে তার চার চোখ হয়ে যাবে, (অর্থাৎ খুশিতে আত্মহারা হবে)। এরপর তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর নিকট এসে তাঁকে নয়টি নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো, যা আল্লাহ্ তাআলা মুসা (আলাইহিস সালাম)-কে দান করেছিলেন।
তিনি তাদেরকে বললেনঃ আল্লাহর সাথে কারো শরীক করো না, চুরি করো না, ব্যভিচার করো না, আর যে জীবন আল্লাহ্ তাআলা হারাম করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না, আর অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়ার জন্য কাউকে হাকিমের কাছে নিও না, যাদু করো না, সুদ খাবে না, পবিত্রা নারীদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেবে না, জিহাদের দিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। এই নয়টি আদেশ, আর একটি আদেশ তো তোমরা ইয়াহুদীদের সাথে সম্পর্কিত, তা এই যে, তোমরা শনিবারের ব্যাপারে সীমালংঘন করবে না।
একথা শুনে ঐ ইয়াহূদীদ্বয় তার হস্ত ও পদদ্বয়ে চুমু খেল। আর তারা বললোঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি একজন নবী। তিনি বললেন, তাহলে আমার অনুসরণে তোমাদের বাধা কোথায়? তারা বললোঃ দাউদ (আলাইহিস সালাম) দুআ করেছিলেন যে, তাঁর বংশে সর্বদা একজন নবী হবেন। তাই আমরা ভয় করছি যদি আমরা আপনার অনুসরণ করি, তাহলে ইয়াহুদীরা আমাদেরকে হত্যা করবে।
তিনি তাদেরকে বললেনঃ আল্লাহর সাথে কারো শরীক করো না, চুরি করো না, ব্যভিচার করো না, আর যে জীবন আল্লাহ্ তাআলা হারাম করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না, আর অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়ার জন্য কাউকে হাকিমের কাছে নিও না, যাদু করো না, সুদ খাবে না, পবিত্রা নারীদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেবে না, জিহাদের দিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। এই নয়টি আদেশ, আর একটি আদেশ তো তোমরা ইয়াহুদীদের সাথে সম্পর্কিত, তা এই যে, তোমরা শনিবারের ব্যাপারে সীমালংঘন করবে না।
একথা শুনে ঐ ইয়াহূদীদ্বয় তার হস্ত ও পদদ্বয়ে চুমু খেল। আর তারা বললোঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি একজন নবী। তিনি বললেন, তাহলে আমার অনুসরণে তোমাদের বাধা কোথায়? তারা বললোঃ দাউদ (আলাইহিস সালাম) দুআ করেছিলেন যে, তাঁর বংশে সর্বদা একজন নবী হবেন। তাই আমরা ভয় করছি যদি আমরা আপনার অনুসরণ করি, তাহলে ইয়াহুদীরা আমাদেরকে হত্যা করবে।
السِّحْرُ
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْعَلَاءِ عَنْ ابْنِ إِدْرِيسَ قَالَ أَنْبَأَنَا شُعْبَةُ عَنْ عَمْرِو بْنِ مُرَّةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَلَمَةَ عَنْ صَفْوَانَ بْنِ عَسَّالٍ قَالَ قَالَ يَهُودِيٌّ لِصَاحِبِهِ اذْهَبْ بِنَا إِلَى هَذَا النَّبِيِّ قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ لَا تَقُلْ نَبِيٌّ لَوْ سَمِعَكَ كَانَ لَهُ أَرْبَعَةُ أَعْيُنٍ فَأَتَيَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَسَأَلَاهُ عَنْ تِسْعِ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ فَقَالَ لَهُمْ لَا تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا تَمْشُوا بِبَرِيءٍ إِلَى ذِي سُلْطَانٍ وَلَا تَسْحَرُوا وَلَا تَأْكُلُوا الرِّبَا وَلَا تَقْذِفُوا الْمُحْصَنَةَ وَلَا تَوَلَّوْا يَوْمَ الزَّحْفِ وَعَلَيْكُمْ خَاصَّةً يَهُودُ أَنْ لَا تَعْدُوا فِي السَّبْتِ فَقَبَّلُوا يَدَيْهِ وَرِجْلَيْهِ وَقَالُوا نَشْهَدُ أَنَّكَ نَبِيٌّ قَالَ فَمَا يَمْنَعُكُمْ أَنْ تَتَّبِعُونِي قَالُوا إِنَّ دَاوُدَ دَعَا بِأَنْ لَا يَزَالَ مِنْ ذُرِّيَّتِهِ نَبِيٌّ وَإِنَّا نَخَافُ إِنْ اتَّبَعْنَاكَ أَنْ تَقْتُلَنَا يَهُودُ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এখানে মোট ১০টি বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ৯টি বিধান ইহুদি-মুসলিম সকলের জন্যই সাধারণ। ইহুদি ধর্মেও এগুলো মানা জরুরি ছিল। ইসলাম ধর্মেও জরুরি। সর্বশেষ বিধানটি কেবল ইহুদিদের দেওয়া হয়েছিল। শনিবার তাদের সাপ্তাহিক দিবস। এ দিনটি তাদের ইবাদতের জন্য নির্ধারিত ছিল। এদিন রোজগার করা নিষেধ ছিল। তাদের রোজগারের একটি বিশেষ পন্থা ছিল মাছ শিকার করা। শনিবার যেহেতু রোজগার নিষিদ্ধ ছিল, তাই এদিন তারা মাছ শিকার করতে পারত না। কিন্তু এ দিয়ে তারা ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। ফলে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয় । সূরা আ'রাফের ১৬৩ থেকে ১৬৬ পর্যন্ত আয়াতসমূহে সে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধানসমূহ উল্লেখ করেছেন, সেগুলোকেই 'সুস্পষ্ট নিদর্শন' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। শরী'আতের প্রত্যেকটি বিধানই এক একটি নিদর্শন। তা আল্লাহ তা'আলার পরিচয় বহন করে এবং দীনের সত্যতার নির্দেশ করে। তাছাড়া এগুলো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতারও নিদর্শন। ইহুদিরা তাঁর কাছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল এ উদ্দেশ্যে যে, সঠিক উত্তর দিতে পারলে প্রমাণ হবে তিনি আল্লাহ তা'আলার সত্যনবী। সঠিক উত্তর দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, সত্যিই তিনি আল্লাহ তা'আলার নবী। কেননা আল্লাহ তা'আলার নবী না হলে তিনি এগুলো বলতে পারতেন না, যেহেতু তিনি লেখাপড়া জানতেন না। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে জানা ছাড়া তাঁর জানার অন্য কোনও মাধ্যম ছিল না। তিনি এগুলো বলতে সক্ষম হওয়ায় প্রমাণ হয়ে গেছে যে তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হয়। সুতরাং তিনি একজন নবী। প্রকাশ্য কোনও মাধ্যম ছাড়া কোনও কাজ করতে পারাকে নবীর মু'জিযাও বলা হয়। বাংলা ভাষায় একে 'অলৌকিকত্ব' শব্দে ব্যক্ত করা হয়। যা মু'জিযা তা নিদর্শনও বটে। নবীর সত্যতার নিদর্শন। কাজেই এ ১০টি নিদর্শন বলে দেওয়াটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মু'জিযা ।
ইহুদিরা জিজ্ঞেস করেছিল ৯টি নিদর্শন সম্পর্কে। কিন্তু তিনি বলেছেন ১০টি। এর দ্বারা তাঁর মু'জিযা বা সত্যতার নিদর্শন অধিকতর পরিস্ফুট হয়েছে। কেননা তিনি তাদের প্রশ্নের জবাব তো দিয়েছেনই, তার অতিরিক্তও বলেছেন। এমন একটি বিধান উল্লেখ করেছেন, যা কেবল তাদেরই জন্য নির্ধারিত ছিল। অথচ নবী না হলে ওই ৯টির মতো এই দশমটিও তাঁর জানা সম্ভব ছিল না। এটা তাদের দৃষ্টিতে তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা অধিকতর স্পষ্ট করে তুলল। ফলে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, তিনি সত্যিই আল্লাহর নবী। তারা ভক্তি ও মুগ্ধতার সঙ্গে তাঁর হাতে-পায়ে চুম্বনও করল।
বিস্তারিত বর্ণনায় আছে, তারা যখন বলল আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই আপনি একজন নবী, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন- فما يمنعكم أن تتبعوني؟ (তাহলে আমার অনুসরণ করতে তোমাদের বাধা কী)? অর্থাৎ যখন স্বীকার করছ আমি নবী, তখন তোমরা আমার নিয়ে আসা দীনের মধ্যে প্রবেশ করছ না কেন? কেন ইসলাম গ্রহণ করছ না? তারা বলল, (হযরত) দাউদ (আলাইহিস সালাম) দু'আ করেছিলেন তার বংশধরদের মধ্যে যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে নবী থাকে। এখন আমরা ভয় করি, যদি আপনার দীন গ্রহণ করে নিই, তবে ইহুদিরা আমাদেরকে হত্যা করে ফেলবে। (জামে' তিরমিযী: ২৭৩৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৮৬০২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৬৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৬৬৭৩; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ১২৬০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৬৫৪৩;)
এটা আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমানের দুর্বলতার পরিচায়ক। ঈমান মজবুত থাকলে তারা স্বজাতির ভয়ে সত্যদীন ইসলাম গ্রহণ করা হতে বিরত থাকত না। আল্লাহ তা'আলার প্রতি যার ঈমান দৃঢ়, সে সত্যগ্রহণে কোনওকিছুর ভয় করে না। সে প্রাণ দিয়ে দেয়, কিন্তু ঈমান দিতে রাজি হয় না। এ হাদীছটিতে দেখা যাচ্ছে ইহুদিরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ও পায়ে চুমু খেয়েছে, কিন্তু তিনি বাধা দেননি। এছাড়া সাহাবায়ে কেরামেরও কারও কারও দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ও পায়ে চুমু খাওয়ার প্রমাণ আছে। যেমন আব্দুল কায়স গোত্র সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা মদীনা মুনাউওয়ারায় এসে যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তারাও তাঁর হাতে ও পায়ে চুম্বন করেছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৫২২৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৩১৩; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৭৫; মুসনাদুল বাযযার: ২৭৪৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৯৬৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৭৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৮২৮; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৭২০৩)
হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি.-এর তাওবার ঘটনায় বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তাঁর হাতে ও দুই হাঁটুতে চুম্বন করেছিলেন।
হযরত আলী রাযি.-এর প্রতি কোনও এক কারণে চাচা আব্বাস রাযি. অসন্তুষ্ট হলে তিনি চাচার হাত ও পায়ে চুম্বন করে বলেছিলেন, চাচা! আমার প্রতি খুশি হয়ে যান। (বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৭৬)
ইমাম মুসলিম রহ. সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি ইমাম বুখারী রহ.-এর পায়ে চুমু খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
এর দ্বারা বোঝা যায় এমনিতে এটা জায়েয। অর্থাৎ কোনও বুযুর্গ ও সম্মানী ব্যক্তিকেও সম্মান ও ভক্তিমূলকভাবে চুম্বন করা যায়। তা করা যায় যেমন কপালে, তেমনি হাতে ও পায়েও। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে তা করতে গিয়ে সিজদার মতো না দেখায়। তাই মাথা নত করে চুম্বন করা যাবে না। সম্মানিত ব্যক্তি যদি উঁচু স্থানে থাকে এবংব তার পা চুম্বনকারীর মুখ বরাবর হয়, তখন চুম্বন করলে তা দূষণীয় হবে না। তবে যারা শরী'আতের অনুসরণে অভ্যস্ত নয়, এরকম তথাকথিত পীরদেরকে তাদের মুরীদদের কর্তৃক সিজদা করা বা সিজদার মতো করে পদচুম্বন করার ব্যাপক রেওয়াজ আছে, তাই বর্তমানকালে পায়ে চুমু দেওয়া হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে বিভিন্ন মু'জিযা ও নিদর্শন ছিল। বাহ্যিক কোনও মাধ্যম ছাড়া অজানা বিষয়ে বলতে পারাটাও ছিল তাঁর এক মু'জিযা।
খ. ভক্তি ও মহব্বতের সঙ্গে চুম্বন করা জায়েয। তবে হাতে ও পায়ে চুম্বন করার সময় রুকূ'-সিজদার মতো মাথা নোওয়ানো যাবে না। বর্তমানকালে বিশেষভাবে পায়ে চুম্বন করা হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।
গ. অনেক ইহুদি ছিল, যারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সত্যনবী তা ভালোভাবেই জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈমান আনেনি। আসলে ঈমান আনার জন্য আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাওফীকেরও দরকার হয়।
যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধানসমূহ উল্লেখ করেছেন, সেগুলোকেই 'সুস্পষ্ট নিদর্শন' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। শরী'আতের প্রত্যেকটি বিধানই এক একটি নিদর্শন। তা আল্লাহ তা'আলার পরিচয় বহন করে এবং দীনের সত্যতার নির্দেশ করে। তাছাড়া এগুলো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতারও নিদর্শন। ইহুদিরা তাঁর কাছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল এ উদ্দেশ্যে যে, সঠিক উত্তর দিতে পারলে প্রমাণ হবে তিনি আল্লাহ তা'আলার সত্যনবী। সঠিক উত্তর দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, সত্যিই তিনি আল্লাহ তা'আলার নবী। কেননা আল্লাহ তা'আলার নবী না হলে তিনি এগুলো বলতে পারতেন না, যেহেতু তিনি লেখাপড়া জানতেন না। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে জানা ছাড়া তাঁর জানার অন্য কোনও মাধ্যম ছিল না। তিনি এগুলো বলতে সক্ষম হওয়ায় প্রমাণ হয়ে গেছে যে তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হয়। সুতরাং তিনি একজন নবী। প্রকাশ্য কোনও মাধ্যম ছাড়া কোনও কাজ করতে পারাকে নবীর মু'জিযাও বলা হয়। বাংলা ভাষায় একে 'অলৌকিকত্ব' শব্দে ব্যক্ত করা হয়। যা মু'জিযা তা নিদর্শনও বটে। নবীর সত্যতার নিদর্শন। কাজেই এ ১০টি নিদর্শন বলে দেওয়াটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি মু'জিযা ।
ইহুদিরা জিজ্ঞেস করেছিল ৯টি নিদর্শন সম্পর্কে। কিন্তু তিনি বলেছেন ১০টি। এর দ্বারা তাঁর মু'জিযা বা সত্যতার নিদর্শন অধিকতর পরিস্ফুট হয়েছে। কেননা তিনি তাদের প্রশ্নের জবাব তো দিয়েছেনই, তার অতিরিক্তও বলেছেন। এমন একটি বিধান উল্লেখ করেছেন, যা কেবল তাদেরই জন্য নির্ধারিত ছিল। অথচ নবী না হলে ওই ৯টির মতো এই দশমটিও তাঁর জানা সম্ভব ছিল না। এটা তাদের দৃষ্টিতে তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা অধিকতর স্পষ্ট করে তুলল। ফলে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, তিনি সত্যিই আল্লাহর নবী। তারা ভক্তি ও মুগ্ধতার সঙ্গে তাঁর হাতে-পায়ে চুম্বনও করল।
বিস্তারিত বর্ণনায় আছে, তারা যখন বলল আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই আপনি একজন নবী, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন- فما يمنعكم أن تتبعوني؟ (তাহলে আমার অনুসরণ করতে তোমাদের বাধা কী)? অর্থাৎ যখন স্বীকার করছ আমি নবী, তখন তোমরা আমার নিয়ে আসা দীনের মধ্যে প্রবেশ করছ না কেন? কেন ইসলাম গ্রহণ করছ না? তারা বলল, (হযরত) দাউদ (আলাইহিস সালাম) দু'আ করেছিলেন তার বংশধরদের মধ্যে যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে নবী থাকে। এখন আমরা ভয় করি, যদি আপনার দীন গ্রহণ করে নিই, তবে ইহুদিরা আমাদেরকে হত্যা করে ফেলবে। (জামে' তিরমিযী: ২৭৩৩; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৮৬০২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৬৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৬৬৭৩; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ১২৬০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৬৫৪৩;)
এটা আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমানের দুর্বলতার পরিচায়ক। ঈমান মজবুত থাকলে তারা স্বজাতির ভয়ে সত্যদীন ইসলাম গ্রহণ করা হতে বিরত থাকত না। আল্লাহ তা'আলার প্রতি যার ঈমান দৃঢ়, সে সত্যগ্রহণে কোনওকিছুর ভয় করে না। সে প্রাণ দিয়ে দেয়, কিন্তু ঈমান দিতে রাজি হয় না। এ হাদীছটিতে দেখা যাচ্ছে ইহুদিরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ও পায়ে চুমু খেয়েছে, কিন্তু তিনি বাধা দেননি। এছাড়া সাহাবায়ে কেরামেরও কারও কারও দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ও পায়ে চুমু খাওয়ার প্রমাণ আছে। যেমন আব্দুল কায়স গোত্র সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা মদীনা মুনাউওয়ারায় এসে যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তারাও তাঁর হাতে ও পায়ে চুম্বন করেছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৫২২৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৩১৩; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৭৫; মুসনাদুল বাযযার: ২৭৪৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৯৬৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৭৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৮২৮; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৭২০৩)
হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি.-এর তাওবার ঘটনায় বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তাঁর হাতে ও দুই হাঁটুতে চুম্বন করেছিলেন।
হযরত আলী রাযি.-এর প্রতি কোনও এক কারণে চাচা আব্বাস রাযি. অসন্তুষ্ট হলে তিনি চাচার হাত ও পায়ে চুম্বন করে বলেছিলেন, চাচা! আমার প্রতি খুশি হয়ে যান। (বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৭৬)
ইমাম মুসলিম রহ. সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি ইমাম বুখারী রহ.-এর পায়ে চুমু খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
এর দ্বারা বোঝা যায় এমনিতে এটা জায়েয। অর্থাৎ কোনও বুযুর্গ ও সম্মানী ব্যক্তিকেও সম্মান ও ভক্তিমূলকভাবে চুম্বন করা যায়। তা করা যায় যেমন কপালে, তেমনি হাতে ও পায়েও। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে তা করতে গিয়ে সিজদার মতো না দেখায়। তাই মাথা নত করে চুম্বন করা যাবে না। সম্মানিত ব্যক্তি যদি উঁচু স্থানে থাকে এবংব তার পা চুম্বনকারীর মুখ বরাবর হয়, তখন চুম্বন করলে তা দূষণীয় হবে না। তবে যারা শরী'আতের অনুসরণে অভ্যস্ত নয়, এরকম তথাকথিত পীরদেরকে তাদের মুরীদদের কর্তৃক সিজদা করা বা সিজদার মতো করে পদচুম্বন করার ব্যাপক রেওয়াজ আছে, তাই বর্তমানকালে পায়ে চুমু দেওয়া হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে বিভিন্ন মু'জিযা ও নিদর্শন ছিল। বাহ্যিক কোনও মাধ্যম ছাড়া অজানা বিষয়ে বলতে পারাটাও ছিল তাঁর এক মু'জিযা।
খ. ভক্তি ও মহব্বতের সঙ্গে চুম্বন করা জায়েয। তবে হাতে ও পায়ে চুম্বন করার সময় রুকূ'-সিজদার মতো মাথা নোওয়ানো যাবে না। বর্তমানকালে বিশেষভাবে পায়ে চুম্বন করা হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।
গ. অনেক ইহুদি ছিল, যারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সত্যনবী তা ভালোভাবেই জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈমান আনেনি। আসলে ঈমান আনার জন্য আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাওফীকেরও দরকার হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: