আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৩৮- বন্ধক রাখার অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৫০৮
১৫৭৬. আবাসে থাকা অবস্থায় বন্ধক রাখা। মহান আল্লাহর বাণীঃ যদি তোমরা সফরে থাকো এবং কোন লেখক না পাও, তবে বন্ধক রাখা বৈধ (২ঃ ২৮৩)
২৩৪৩। মুসলিম ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) .... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) যবের বিনিময়ে তাঁর বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন। আমি একবার নবী (ﷺ)- এর খিদমতে যবের রুটি এবং দুর্গন্ধ যুক্ত চর্বি নিয়ে গেলাম, তখন তাঁকে বলতে শুনলাম, মুহাম্মাদ (ﷺ)- এর পরিবার পরিজনের কাছে কোন সকাল বা সন্ধায় এক সা’ এর অতিরিক্ত (কোন খাদ্য) দ্রব্য থাকে না। (আনাস (রাযিঃ) বলেন) সে সময়ে তারা মোট নয় ঘর (নয় পরিবার) ছিলেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ আছে।

(ক) প্রথমে বলা হয়েছে যে, যবের বিনিময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন। অর্থাৎ নগদ মূল্য পরিশোধের সামর্থ্য না থাকায় তিনি বাকিতে যব কিনেছিলেন, আর মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তাস্বরূপ বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন। এটা ওফাতকালীন ঘটনাও হতে পারে, অথবা অন্য কোনও সময়ের কথাও হতে পারে। ওফাতকালীন ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা কোনও কোনও বর্ণনায় এর শেষে আছে-
فَمَا وَجَدَ مَا يَفْتَكهَا بِهِ حَتَّى مَاتَ
তিনি ওফাত পর্যন্ত তা ছাড়িয়ে আনার মত কিছু পাননি।

(খ) হযরত আনাস রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিজ থেকে যবের রুটি ও বাসি চর্বি নিয়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ এমন চর্বি, যা জ্বালানোর পর অনেক দিন গত হওয়ার কারণে ঘ্রাণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। এই বাসি চর্বি দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুটি খেয়েছিলেন। এর দ্বারা খাওয়া-দাওয়ায় যে তিনি কতটা সাদামাটা ছিলেন সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আরাম-আয়েশের প্রতি চাহিদা না থাকায় যে-কোনওভাবে প্রয়োজন পূরণেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন। ব্যস ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটা কিছু খাবার হলেই হল। তা সুস্বাদু না বিস্বাদ, এর প্রতি লক্ষ ছিলনা। তবে হাঁ, মুখ দুর্গন্ধ হয়ে যায় এমন খাবার তিনি কিছুতেই খেতেন না, যেহেতু তাতে ফিরিশতারা কষ্ট পায়।

(গ) হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- (মুহাম্মাদের পরিবারে সকালে এক সা' গমও থাকত না এবং সন্ধ্যায়ও না)। অপর এক বর্ণনায় আছে, এক সা' গমও না এবং অন্য কোনও খাদ্যশস্যও না। অর্থাৎ না যব, না খেজুর, না অন্য কিছু। তাঁদের সারা দিনের খাবারের পরিমাণ থাকত এরচেও কম। তাও যদি পরিবারের লোকসংখ্যা অল্প হতো, তবে সে অল্প খাবার দিয়েই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লোকসংখ্যা তো ছিল অনেক। হযরত আনাস রাযি. বলেন-
(অথচ তাঁরা ছিলেন ৯ ঘর)। অর্থাৎ ৯ স্ত্রীর ৯ ঘর। স্ত্রীগণ হলেন-
১. হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.।
২. হযরত সাওদা বিনতে যাম'আ রাযি.।
৩. হযরত হাফসা বিনতে উমর রাযি.।
৪. হযরত উম্মু সালামা রাযি.।
৫. হযরত সাফিয়্যা রাযি.।
৬. হযরত যায়নাব বিনতে জাহশ রাযি.।
৭. হযরত জুওয়ায়রিয়া বিনতুল হারিছ রাযি.।
৮. হযরত উম্মু হাবীবা বিনতে আবী সুফয়ান রাযি. ও
৯. হযরত মায়মুনা রাযি.।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতকালে তাঁরা সকলেই জীবিত ছিলেন। তাঁদের কারও ছেলে-মেয়ে না থাকলেও মেহমান তো থাকতই। এ অবস্থায় এক সা' এরও কম খাদ্যশস্যে তাদের কী হতো? কিন্তু এ নিয়ে তাঁদের অভিযোগ ছিল এমন কোনও প্রমাণ নেই। তারা খুশিমনেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এহেন অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
প্রকাশ থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বমোট স্ত্রী ছিলেন ১১ জন। তাদের মধ্যে দু'জন তাঁর জীবনকালেই ইন্তিকাল করেছিলেন। প্রথমজন উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রাযি., আর দ্বিতীয়জন হযরত যায়নাব বিনতে খুযায়মা রাযি.।

বলাবাহুল্য, এ খাদ্যাভাব ছিল এ মহান পরিবারবর্গের স্বেচ্ছা অবলম্বনকৃত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাইলে তাঁদেরকে বিলাসিতার মধ্যেই রাখতে পারতেন। কিন্তু না তিনি নিজে তা পসন্দ করেছেন, না তাঁরাও সেরকম জীবন কামনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে যখন ইসলামের দিগ্বিজয় হয়, তখন প্রচুর অর্থ-সম্পদ উম্মাতের হাতে আসে। উম্মাহাতুল মুমিনীনের ঘরে ঘরেও সে প্রাচুর্য পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা তা দিয়ে আরাম-আয়েশ করার পরিবর্তে আল্লাহর পথে খরচ করতেই বেশি ভালোবাসতেন। জীবনভর তাই করে গেছেন।

সা (صاع) সে কালের একটি পরিমাপ। বৃটিশ পদ্ধতি অনুযায়ী এক সা' = ২৭৩ তোলা। মেট্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী এক সা' = ২,১৮৪২৭২ কিলোগ্রাম। আধা সা' = ১৩৬.৫ তোলা = ১.৫৯২১৩৬ কিলোগ্রাম।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের অসামান্য বিনয়, অল্পেতুষ্টি ও ধৈর্য-সহনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদেরও এসব গুণ আত্মস্থ করা উচিত।

খ. এর দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহা দানশীলতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহর পথে দু'হাতে ব্যয় বিতরণ করতে না থাকলে তাঁর এমন খাদ্যাভাব দেখার কথা নয় যে, সেজন্য বর্ম বন্ধক রেখে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে।

গ. আরও শিক্ষা পাওয়া যায়, অমুসলিমদের সঙ্গে লেনদেন করা জায়েয, যতক্ষণ না লেনদেনের বস্তুটি অবৈধ সাব্যস্ত হয়।

ঘ. কারও আকীদা-বিশ্বাস নষ্ট হওয়া তার সঙ্গে লেনদেন বৈধ হওয়ার পক্ষে বাধা নয়, যদি না সে ইসলাম ও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধরত থাকে।

ঙ. যুদ্ধরত নয় এমন অমুসলিমের কাছে যুদ্ধসামগ্রী বা অন্য কোনও জিনিস বন্ধক রাখা যেতে পারে।

চ. যুদ্ধসামগ্রী সংগ্রহ করা ও শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন