আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৩৬- যুলুম - নির্যাতন ও কিসাসের অধ্যায়

হাদীস নং: ২২৮৭
আন্তর্জতিক নং: ২৪৪৯

পরিচ্ছেদঃ ১৫৩৪. মাযলুম জালিমকে মাফ করে দিল; এমতাবস্থায় সে জালিমের যুলমের কথা প্রকাশ করতে পারবে কি?

২২৮৭। আদম ইবনে আবু ইয়াস (রাহঃ) .... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রম হানী বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করায়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন তার কোনো দীনার বা দিরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোনো সৎকর্ম থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট থেকে নেয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম বুখারী) (রাহঃ) বলেন, ইসমাঈল ইবনে উয়াইস (রাহঃ) বলেছেন, সাঈদ আল-মাকবুরী (রাহঃ) কবরস্থানের পার্শ্বে অবস্থান করতেন বলে তাকে আল-মাকবুরী বলা হত। আবু আব্দুল্লাহ (ইমাম বুখারী) (রাহঃ) এও বলেছেন, সাঈদ আল-মাকবুরী হলেন, বনু লাইসের আযাদকৃত গোলাম। ইনি হলেন সাঈদ ইবনে আবু সাঈদ। আর আবু সাঈদের নাম হলো কায়সান।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যের ওপর জুলুম করা কী কঠিন পাপ এবং মজলুম ব্যক্তির থেকে তা মাফ না করিয়ে মারা গেলে আখিরাতে তার কী ভয়াবহ পরিণতি সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ককরতঃ এখনই জীবিত অবস্থায় তা মাফ করিয়ে নেওয়ার তাকিদ করেছেন। তিনি বলেন- مَنْ كَانَتْ عِنْدَهُ مَظْلمَةٌ لأَخِيهِ، مِنْ عِرضِهِ أَوْ مِنْ شَيْءٍ যার কাছে তার ভাইয়ের ইজ্জত-সম্মান বা অন্যকিছু সম্পর্কিত কোনও জুলুন (-এর দাবি) আছে। অন্যকিছু' শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। যে-কোনও রকমের জুলুমই এর মধ্যে এসে যায়। মৌলিকভাবে জুলুম করা হয়ে থাকে হয়তো মানুষের জানের ওপর, নয়তো মালের ওপর, নয়তো ইজ্জতের ওপর। এ হাদীছে প্রথমে ইজ্জতের কথা বলে তারপর 'অন্যকিছু' শব্দটি দ্বারা জান ও মালের প্রতি জুলুমের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এভাবে সর্বপ্রকার জুলুমই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। কাজেই কেউ যদি কারও মাল আত্মসাৎ করে, কারও জমি জবরদখল করে, কারও শরীরে অন্যায়ভাবে আঘাত করে, তা চড়, ঘুসি যাই হোক না কেন তা জুলুম বলে গণ্য হবে। এভাবে বড় বা ছোট যে-কোনও পর্যায়ের জুলুম যদি কেউ কারও প্রতি করে থাকে, তবে তার করণীয় কী, হাদীছটির পরবর্তী বাক্যে তা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। فليتحلله منه اليوم (সে যেন আজই তার কাছ থেকে তা মাফ করিয়ে নেয়)। সে ব্যক্তি যদি জীবিত থাকে আর জুলুম হয় তার জান ও ইজ্জতের ওপর, তবে তো সরাসরি তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাবে। আর যদি মারা গিয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদেরকে খুশি করার চেষ্টা করবে এবং তার মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকবে। যদি কারও মাল আত্মসাৎ করা হয়ে থাকে, তবে তা তাকে ফেরত দিতে হবে। আর সে মারা গিয়ে থাকলে তার ওয়ারিশদের কাছে ফেরত দেবে। যদি তাকে বা তার কোনও ওয়ারিশকে না পাওয়া যায়, তবে তার পক্ষ থেকে তা দান-সদাকা করে দেবে। সে জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এমনিভাবে তার মৃত্যু হয়ে থাকলে তার ওয়ারিশগণ কে কোথায় আছে তাও ভালোভাবে খুঁজে দেখতে হবে। মোটকথা মজলুম ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সকল চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে কোনওরকম অবহেলা করা তো যাবেই না এবং লজ্জা-শরমকেও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। অনেকে ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করে, বিশেষত মজলূম ব্যক্তি যদি সামাজিকভাবে জুলুমকারী অপেক্ষা নিচের হয়। কিন্তু এ লজ্জা শরী'আতসম্মত নয়। যে লজ্জার কারণে শরী'আতের হুকুম পালন বাধাগ্রস্ত হয়, সে লজ্জা লজ্জাই নয়; কাপুরুষতা। বরং লজ্জা তো এই করা উচিত যে, আমি আল্লাহর এক বান্দা হয়ে তাঁর অপর বান্দার প্রতি কিভাবে জুলুম করলাম! আল্লাহ তা'আলা হাজির-নাজির। তিনি সব দেখছেন। তিনি জুলুম করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও কিভাবে তাঁর দৃষ্টির সামনে তা করে ফেললাম! আমার তো অতিদ্রুত তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এ ক্ষমা চাওয়াটাই হল লজ্জার দাবি। তাতে আল্লাহ তা'আলাও খুশি হন। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- رحم الله عبدا كانت لأخيه عنده مظلمة في عرض أو مال, فجاءه, فاستحله قبل أن يؤخذ منه যার কাছে তার ভাইয়ের ইজ্জত-সম্মান বা সম্পদ বা সুনাম-সুখ্যাতি সম্পর্কিত কোনও জুলুম (-এর দাবি) আছে আর সে তার কাছে সে ব্যাপারে তাকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, তার প্রতি আল্লাহ রহম করুন (অথবা এর অর্থ- আল্লাহ তার প্রতি রহমত করেন)। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৪১৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৭৩৬২; আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আউসাত, হাদীস নং ১৬৮৩ মজলুম ব্যক্তির জন্য জুলুমকারীকে ক্ষমা করে দেওয়াই শ্রেয় জুলুমকারী ব্যক্তি যখন লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে মজলুমের কাছে ক্ষমা চায় তখন তার কর্তব্য আন্তরিকভাবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। অন্যকে ক্ষমা করা একটি মহৎ গুণ। এটা আল্লাহ পসন্দ করেন। যে ব্যক্তি অন্যকে ক্ষমা করে দেয় আল্লাহ তা'আলাও তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন। মজলুম ব্যক্তিরও নিশ্চয়ই কোনও না কোনও গুনাহ আছে। সেই গুনাহ যাতে আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করেন সে আশায় আমাদের তো উচিত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জুলুমকারীকে ক্ষমা করে দেওয়া। সে কখন ক্ষমা চাবে সে অপেক্ষায়ই থাকা উচিত নয়। বান্দা যাতে মাগফিরাত লাভের আশায় তার অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয় সেজন্য আল্লাহ তা'আলার উৎসাহমূলক ইরশাদ- الَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ অর্থ : তোমরা কি কামনা কর না যে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের ক্ষমা করুন? সূরা নূর (২৪), আয়াত ২২ আরও ইরশাদ করেন- خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ অর্থ : ক্ষমাশীলতাকে আঁকড়ে ধর, সৎকাজের আদেশ কর এবং অজ্ঞজনদের উপেক্ষা কর। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা তো এরকম যে, একবার তিনি হযরত আলী রাযি. লক্ষ্য করে বলেন, তোমাকে কি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল জাতির শ্রেষ্ঠতম চরিত্র সম্পর্কে বলে দেব না? হযরত আলী বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, تعطي من حرمك وتعفو عمن ظلمك وتصل من قطعك যে ব্যক্তি তোমাকে তোমার প্রাপ্য দেওয়া থেকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে তার প্রাপ্য দেবে, যে ব্যক্তি তোমার ওপর জুলুম করে তুমি তাকে ক্ষমা করবে এবং যে ব্যক্তি তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করে তুমি তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করবে। বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৭৫৮৪; আল-মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৫৬৭ অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ثلاث من كن فيه حاسبه الله حسابا يسيرا وأدخله الجنة برحمته قالوا: وما هي يا رسول الله؟ قال: قال: تعطي من حرمك وتصل من قطعك وتعفو عمن ظلمك তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকবে, আল্লাহ তাআলা তার হিসাব নেবেন সহজভাবে এবং তাকে নিজ রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, তা কী ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তোমাকে তোমার প্রাপ্য দেওয়া থেকে বঞ্চিত রাখবে, তুমি তাকে তার প্রাপ্য দেবে; যে ব্যক্তি তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, তুমি তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করবে আর যে ব্যক্তি তোমার প্রতি জুলুম করবে, তুমি তাকে ক্ষমা করবে। মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীস নং ৩৯১২; আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫০৬৪; মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৮৬৩৫ সাহাবায়ে কিরাম ও তাদের পরবর্তীকালের আল্লাহওয়ালাগণ এ শিক্ষার ওপরই চলতেন। তারা তাদের প্রতি জুলুমকারীকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিতেন না, তার আগেই ক্ষমা করে দিতেন। হযরত হুসাইন রাযি.-এর পুত্র যাইনুল আবেদীন রহ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, কেউ যদি তাঁর পেছনে তাঁর নিন্দা করত আর কোনওভাবে তা তাঁর কানে এসে যেত, তবে তিনি নিজে সেই ব্যক্তির কাছে চলে যেতেন। তাকে বলতেন, ভাই তুমি আমার সম্পর্কে যা বলেছ তা সত্য হলে আল্লাহ তা'আলা আমাকে ক্ষমা করুন, আর যদি অসত্য হয় তবে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। খলিফা হারুনুর রশীদের বিখ্যাত মন্ত্রী জা'ফর ইবন ইয়াহইয়া বারমাকীর কাছে জনৈক ব্যক্তি ক্ষমা চাইলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আল্লাহ তা'আলা তোমাকে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন থেকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন, কারণ আমি আগেই তোমাকে ক্ষমা করেছি। قبل أن لا يكون دينارٌ ولا درهمٌ (ওই দিন আসার আগে, যেদিন কোনও দীনার ও দিরহাম থাকবে না)। এর দ্বারা কিয়ামতের দিনকে বোঝানো হয়েছে। মানুষ দুনিয়ায় টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত যা-কিছুই অর্জন করে মৃত্যুকালে তা দুনিয়ায়ই রেখে যায়। সঙ্গে যায় কেবল নেকী-বদী। কাজেই কেউ যদি কারও জানমাল ও ইজ্জতের ওপর জুলুম করে থাকে আর দুনিয়ায় তার প্রতিকার না করিয়েই মারা যায় তবে আখেরাতে যে টাকা-পয়সা দিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারবে সে উপায় নেই। সেদিন প্রতিকার করা হবে নেকী ও বদী দ্বারাই। যেমন হাদীছের পরবর্তী অংশে তা বর্ণিত হয়েছে। إن كان له عمل صالح أخذ منه بقدر مظلمته (যদি তার নেক আমল থাকে, তবে তার কাছ থেকে তার জুলুম পরিমাণে তা নিয়ে যাওয়া হবে)। অর্থাৎ সে হয়তো প্রচুর নামায, রোযা, হজ্জ, দান-খয়রাত ইত্যাদি নেক আমল নিয়ে হাজির হয়েছে। এতে তার প্রচুর ছাওয়াব অর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে সে বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর নানাভাবে জুলুম করেছে। হয়তো কাউকে হত্যা করেছে, কারও অঙ্গহানি ঘটিয়েছে, কাউকে চড়-থাপ্পর মেরেছে, কারও জমি দখল করেছে, কারও টাকা-পয়সা মেরে দিয়েছে, কাউকে গালাগাল করেছে, কারও গীবত করেছে, কারও নামে অপবাদ দিয়েছে, এভাবে জান, মাল ও ইজ্জত সম্পর্কিত বিভিন্ন রকম জুলুম-অবিচার করে সে মারা গেছে। মৃত্যুর আগে তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়নি। এ অবস্থায় তার ওইসকল জুলুমের প্রতিকার করার জন্য আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক মজলুমকে তার প্রতি যে পরিমাণ জুলুম করা হয়েছে সে অনুযায়ী ওই ব্যক্তির ছাওয়াব থেকে কেটে নিয়ে তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে একেকজন মজলুমের প্রতি করা জুলুমের বদলা দেওয়া হতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে জালেম ব্যক্তির তিন অবস্থা হতে পারে। (ক) হয়তো তার ছাওয়াব থেকে সকল মজলুমকে তাদের প্রতি করা জুলুমের বদলা দেওয়ার পরও এ পরিমাণ ছাওয়াব অবশিষ্ট থাকবে, যার ওজন তার গুনাহ অপেক্ষা বেশি। এ অবস্থায় তো তার জান্নাত লাভের আশা থাকবে। (খ) অথবা তার ছাওয়াব থাকবে সামান্য, যার তুলনায় পাপ অনেক বেশি। এ অবস্থায় তার জন্য জাহান্নামের ফয়সালা হবে। জাহান্নামে তার পাপের শাস্তিভোগের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পর ঈমানের বদৌলতে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং পরিশেষে সে জান্নাত লাভ করবে। (গ) অথবা তার অবশিষ্ট ছাওয়াব ও তার পাপ সমান সমান হবে। যাদের পাপ-পুণ্য সমান, তারা কিছুকাল জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে অবস্থান করবে, যাকে আ'রাফ বলে। সেখানে কিছুকাল কাটানোর পর তাদের ঈমানের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জান্নাতে স্থান দেবেন। তারপর বলা হয়েছে- وإن لم يكن له حسنات أخذ من سيئات صاحبه ، فحمل عليه “আর যদি তার কোনও নেক আমল না থাকে, তবে তার প্রতিপক্ষের গুনাহ থেকে (তার জুলুমের সমপরিমাণ) কেটে নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে।" অর্থাৎ যে ব্যক্তি মানুষজনের ওপর জুলুম করে মারা গেছে, তার নিজের যদি আদৌ কোনও নেক আমল না থাকে অথবা থাকলেও জুলুমের বদলে তার নেক আমলের ছাওয়াব দিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতেও সমস্ত জুলুমের বদলা দেওয়া শেষ হয়নি, এ অবস্থায় মজলুমদের প্রতিকার লাভের কী ব্যবস্থা, হাদীছের এ অংশে তা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এরূপ অবস্থায় এক-এক করে মজলুমদের গুনাহ থেকে তাদের ওপর করা জুলুমের সমপরিমাণ গুনাহ কেটে নিয়ে জুলুমকারীর ওপর চাপানো হতে থাকবে। যখন তাদের সকলের ওপর করা জুলুমের প্রতিকার হয়ে যাবে, তখন নিজের গুনাহ ও জুলুমের প্রতিকার হিসেবে তাদের থেকে চাপানো গুনাহ- এ উভয় গুনাহের বোঝা নিয়ে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কতই না কঠিন জুলুমের এ পরিণতি। এ পরিণতির কথা চিন্তা করে আমাদের সকলেরই উচিত সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কুরআন মাজীদে তো ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى “সে সহীফাসমূহে যা ছিল, তা এই যে, কোনও বহনকারী অন্য কারও গোনাহের বোঝা বহন করতে পারে না”।- সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩৮ অন্যদিকে এ হাদীছে বলা হয়েছে- জালেম ব্যক্তি মজলুমের গুনাহের বোঝা বহন করবে, তাহলে আয়াতের সঙ্গে এ হাদীছের বিরোধ দেখা যাচ্ছে না কি? উত্তর এই যে, উভয়ের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। আয়াতে যে বলা হয়েছে একজন আরেকজনের গুনাহের বোঝা বহন করবে না; বরং প্রত্যেকে বহন করবে নিজ গুনাহের বোঝাই, কথা সেটাই। এ হাদীছেও তার বিপরীত বলা হয়নি। জালেম ব্যক্তি যে মজলুমের গুনাহের বোঝা বইবে তা তো নিজ জুলুমের কারণে। এটা শুধু শুধুই তার ওপর চাপানো হবে না। এটা তার জুলুমের প্রতিকার। আয়াতে যে গুনাহের বোঝা বহন না করার কথা বলা হয়েছে সেটা ওই গুনাহ, যার সঙ্গে বহনকারীর নিজ অপরাধ ও কাজের কোনও সম্পর্ক নেই। এখানে তো স্পষ্টই সম্পর্ক আছে আর তা হচ্ছে জুলুমের প্রতিকার। বস্তুত এ প্রতিকারের মাধ্যমে বান্দার প্রতি আল্লাহ তা'আলার ন্যায়বিচারই পরিস্ফুট হবে। অন্যথায় এটা জুলুম হয়ে যেত যে, মজলূম ব্যক্তি দুনিয়ায়ও তার জুলুমের বদলা পেল না আর আখিরাতেও বিচার পেল না। ইরশাদ হয়েছে- ذٰلِکَ بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡکُمۡ وَاَنَّ اللّٰہَ لَیۡسَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ ۚ এসব তোমাদের নিজ হাতের সেই কৃতকর্মের ফল, যা তোমরা সম্মুখে প্রেরণ করেছিলে। নয়ত আল্লাহ বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নন। সূরা আ-লু ইমরান ( আয়াত নং - ১৮২ ) হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. এ হাদীছ দ্বারা আখিরাত ও আখিরাতের বিচারের সত্যতা প্রমাণিত হয়। খ. এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার ন্যায়বিচার সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যাচ্ছে। গ. জানা যাচ্ছে যে, জুলুম কত কঠিন পাপ এবং তার পরিণাম কী ভয়াবহ। ঘ. প্রত্যেকের উচিত সে কারও প্রতি কোনওভাবে জুলুম করে থাকলে দুনিয়ায় তাকে খুশি করা ও তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া। ঙ. আখিরাতে টাকা-পয়সা কোনও কাজে আসবে না। কাজে আসবে কেবল নেক আমল।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন