কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

২৬. বিবাহ-শাদীর অধ্যায়

হাদীস নং: ৩২৩২
আন্তর্জাতিক নং: ৩২৩২
পুণ্যবতী রমণী
৩২৩৫. মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাযিঃ) সূত্রে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ সমগ্ৰ পৃথিবী মানুষের ভোগ্য-বস্তু, আর পৃথিবীস্হ ভোগ্য বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হলো পুণ্যবতী স্ত্রী।
الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ حَدَّثَنَا أَبِي قَالَ حَدَّثَنَا حَيْوَةُ وَذَكَرَ آخَرَ أَنْبَأَنَا شُرَحْبِيلُ بْنُ شَرِيكٍ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحُبُلِيَّ يُحَدِّثُ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ الدُّنْيَا كُلَّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াকে متاع বলেছেন। متاع অর্থ এমন বস্তু, যা ভোগ-উপভোগ করা হয়, মানুষ যা দ্বারা উপকৃত হয়। দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যে যা-কিছু আছে, সবই মানুষের ভোগ-উপভোগের বস্তু। দুনিয়ার প্রত্যেকটি বস্তু দ্বারাই মানুষ কোনও না কোনওভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। কোনওটির উপকার সকলেই বুঝতে পারে। কোনওটি এমন, যার উপকার অতি সূক্ষ্ম, যা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝে আসে। কোনও কোনও বস্তু এমনও আছে, যার উপকার আমরা বুঝতে পারি না । তা না বুঝলেও কোনও না কোনও উপকার তার মধ্যে অবশ্যই আছে। আল্লাহ তাআলার কোনও সৃষ্টিই নিরর্থক নয়।
একবার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আব্বাসীয় খলিফা আবূ জা'ফর মানসূর (শাসনকাল ১৩৬হি.-১৫৮হি.)-এর নাকে একটি মাছি বারবার এসে বসছিল। তিনি তাড়িয়ে দেন, আবার এসে বসে পড়ে। এমনি মুহূর্তে সেখানে বিখ্যাত আলেম ও মুফাস্সির মুকাতিল ইবন সুলাইমান প্রবেশ করেন। খলিফা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলুন তো এই বস্তুটি কী জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? খলিফার মুখের উপর তিনি বললেন, প্রতাপশালীর দর্প চূর্ণ করার জন্য।
এটাও একটা ফায়দা বটে। একটা তুচ্ছ পোকার কাছে এক মহাপ্রতাপশালী শাসক কেমন অসহায়, এটা তার বোঝার প্রয়োজন আছে বৈকি। দাম্ভিকেরা যে মিছেই অহংকার করে, তা উপলব্ধির অবকাশ না হলে তাদের এ কঠিন আত্মিক ব্যাধির প্রতিকার হবে কি করে?
যাহোক দুনিয়ার প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই কল্যাণ আছে। তার মধ্যে সবচে বেশি কল্যাণকর ও সবচে' বেশি উপভোগ্য বস্তু কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- وَخَيْرُ مَتَاعِهَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ (আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হল নেককার স্ত্রী)। অর্থাৎ একজন পুরুষের জন্য নেককার নারীই সবচে' বেশি উপকারী, বেশি উপভোগ্য। তা নেককার নারী কাকে বলে? কি কি গুণ থাকলে কোনও নারী নেককার হয়? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নেককার নারীর পরিচয় দান করেন-

إِذَا نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ ، وَإِذَا أَمَرَهَا أَطاعَتْهُ ، وَإِذَا غَابَ عَنْهَا حَفِظَتْهُ

‘স্বামী যখন তার দিকে তাকায়, সে তাকে আনন্দ দান করে। যখন তাকে কোনও আদেশ করে, সে তা মান্য করে। যখন সে তার কাছে অনুপস্থিত থাকে, তখন স্বামীর জন্য সে তার নিজেকে ও তার সম্পদের হেফাজত করে ।৩৪২

অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَا أَفَادَ عَبْدٌ بَعْدَ الإِسْلَام خَيْرٌ لَهُ مِنْ زَوْجٍ مُؤْمِنَةٍ : إِذَا نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ، وَإِذَا غَابَ عَنْهَا حَفِظَتْهُ فِي نَفْسِهَا وَمَالِهِ

‘কোনও বান্দা ইসলামের পর তার পক্ষে মুমিন স্ত্রীর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনও কিছু অর্জন করতে পারে না- যার দিকে তাকালে সে তাকে আনন্দ দান করে এবং যার কাছ থেকে অনুপস্থিত থাকলে সে তার জন্য নিজেকে ও তার অর্থ-সম্পদের হেফাজত করে।৩৪৩
কোনও স্বামীর জন্য একজন নেককার স্ত্রীর কল্যাণ বহুবিধ। তার দ্বারা স্বামীর স্বাস্থ্য ও চরিত্রের হেফাজত হয়, সময়ে শৃঙ্খলা আসে, আয়-রোযগারে বরকত লাভ হয়, মানসিক স্বস্তি হাসিল হয়, কাজকর্মে অনুপ্রেরণা লাভ হয়। নেককার স্ত্রী কেবল তার সন্তানের মা-ই নয়; সে সন্তানের দীন ও ঈমানের শিক্ষাদাত্রী ও পরিচর্যাকারিণী এবং একজন জান্নাতী মানুষরূপে গড়ে তোলার কারিগরও বটে। এছাড়াও সে তার কাছ থেকে পেয়ে থাকে বহুবিচিত্র সেবা।
বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর ফারূক রাযি. বলেন, আমি আমার স্ত্রীর অপ্রীতিকর আচরণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি। কারণ তার কাছ থেকে আমি বিভিন্ন রকম উপকার পেয়ে থাকি। সে আমার ও জাহান্নামের মাঝখানে প্রতিবন্ধক। তার দ্বারা আমি হারাম থেকে বাঁচতে পারি। তাতে আমার অন্তর প্রশান্তি পায়। সে আমার খাজাঞ্চি। আমি যখন বাইরে থাকি, তখন ঘরে সে-ই আমার মালামাল হেফাজত করে, আমার কাপড়- চোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। সে আমার সন্তানের পরিচর্যাকারিণী। আমার জন্য রান্নাবান্না করে। আমার খাবারদাবার প্রস্তুত করে দেয়।
মহান ওমর ফারূক রাযি. থেকে এ কথাগুলি বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত না হলেও এমনিতে কথাগুলি যে সত্য ও সঠিক, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এতসব কল্যাণ যার থেকে লাভ হয়, সে যদি কখনও-সখনও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি করে বসে বা মুখঝামটাই দিয়ে ফেলে, তা সহ্য করা যায় না কি? কিংবা তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় কি?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়ার প্রতিটি বস্তুই কোনও-না কোনও কাজের। সুতরাং কোনও বস্তুকে নিরর্থক মনে করতে নেই। বরং তা দ্বারা উপকার পাওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা চাই।

খ. নেককার স্ত্রী আল্লাহ তাআলার অনেক বড় দান। স্বামীর কর্তব্য তাঁর এ দানের মূল্য বোঝা এবং এর জন্য আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা।

গ. এর দ্বারা নেককার স্ত্রীর ফযীলতও বোঝা যায়। সুতরাং প্রত্যেক স্ত্রীর কর্তব্য একজন নেককার স্ত্রীর গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট থাকা।

৩৪২. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৬৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭২৩৫; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৩৫

৩৪৩, তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ২১১৫
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন