কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

২৬. বিবাহ-শাদীর অধ্যায়

হাদীস নং: ৩২১৭
আন্তর্জাতিক নং: ৩২১৭
চির কুমার থাকার নিষিদ্ধতা
৩২২০. ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ......... আনাস (রাযিঃ) বলেন, সাহাবায়ে কিরাম এর একদলের কেউ কেউ বললোঃ আমি স্ত্রী গ্রহণ করবো না, কেউ বললেনঃ আমি আহার করবো না। আর কেউ বললোঃ আমি বিছানায় শয়ন করবো না। আবার কেউ বললো এমন রোযা রাখব, আর কখনও রোযা ভঙ্গ করবো না।

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তা শ্রবণ করে আল্লাহর প্রশংসা করে বললেনঃ এ সকল দলের কি হলো-যারা এমন এমন কথা বলে! কিন্তু আমি (রাত্রির) কিছু অংশে নামায পড়ি, আবার নিদ্রা যাই; রোযা রাখি আবার রোযা ভঙ্গ করি এবং স্ত্রী গ্রহণ করি, যে আমার সুন্নত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।
بَاب النَّهْيِ عَنْ التَّبَتُّلِ
أَخْبَرَنَا إِسْحَقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ قَالَ أَنْبَأَنَا عَفَّانُ قَالَ حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ عَنْ ثَابِتٍ عَنْ أَنَسٍ أَنَّ نَفَرًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَعْضُهُمْ لَا أَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ وَقَالَ بَعْضُهُمْ لَا آكُلُ اللَّحْمَ وَقَالَ بَعْضُهُمْ لَا أَنَامُ عَلَى فِرَاشٍ وَقَالَ بَعْضُهُمْ أَصُومُ فَلَا أُفْطِرُ فَبَلَغَ ذَلِكَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَقُولُونَ كَذَا وَكَذَا لَكِنِّي أُصَلِّي وَأَنَامُ وَأَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে তিনজন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু “আলাইহি ওয়া সাল্লামের 'ইবাদত সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর স্ত্রীগণের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন হযরত আলী রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর রাযি. ও হযরত উছমান ইব্ন মায'ঊন রাযি. যেমনটা ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক'-এর বর্ণনা দ্বারা জানা যায়।

বলাবাহুল্য, সাহাবায়ে কিরামের জানার উদ্দেশ্য ছিল কেবলই আমল করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাইরের জীবন তো তাঁদের চোখের সামনে ছিল, যা দেখে দেখে তাঁরা বাইরের জীবনের করণীয় সম্পর্কে জানতে পারতেন। কিন্তু ঘরের ভেতর ব্যক্তিগতভাবে যেসব ইবাদত-বন্দেগী করতেন, সে সম্পর্কেও জানা দরকার ছিল, যাতে তাঁরা আপন আপন গৃহে তা অনুসরণ করতে পারেন। আর সে সম্পর্কে জানার উপায় ছিল একটাই- উম্মাহাতুল মু'মিনীনের দ্বারস্থ হওয়া। সে লক্ষ্যেই তাঁরা তাঁদের ঘরে ঘরে পৌছে যান এবং তাঁদের কাছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। এর দ্বারা দীন সম্পর্কে জানা ও তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করার প্রতি সাহাবায়ে কিরামের আগ্রহ কত গভীর ছিল তা উপলব্ধি করা যায়।

আমাদের সম্মানিতা সে মায়েরা যখন তাঁদেরকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভেতরের ‘ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে অবহিত করলেন, তখন তাঁদের কাছে যেন তার পরিমাণ খুব কম মনে হল। হয়তো ভাবছিলেন তিনি রাতভর নামায ও তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকেন, একটুও ঘুমান না। কিন্তু জানতে পারলেন তার বিপরীত। তিনি রাতে ঘুমানও এবং ইবাদতও করেন।

কেন তাঁর ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগী তাঁদের ধারণা অপেক্ষা কম, তারা নিজেরা নিজেরা এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। সে ব্যাখ্যা ছিল এই যে, তাঁর যেহেতু আগের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ তিনি এক মা'সূম সত্তা, কোনও গুনাহ করেনই না, তাই তাঁর খুব বেশি ইবাদত-বন্দেগী করার দরকার নেই। হয়তো তাঁরা ভাবছিলেন 'ইবাদত-বন্দেগীর দরকার হয় গুনাহ মাফ করানোর জন্য। তাঁরা চিন্তা করলেন, আমরা তো তাঁর মত নিষ্পাপ নই। অনেক ভুলত্রুটি আমাদের দ্বারা হয়ে যায়। তাই তাঁর সঙ্গে আমাদের তুলনা করলে চলবে কেন? কোথায় মা'সূম নিষ্পাপ নবী, আর কোথায় তাঁর এক পাপী উম্মত! সুতরাং আমাদের অনেক বেশি বেশি 'ইবাদত করা দরকার।

এ চিন্তা মোতাবেক তাঁরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তাঁদের একেকজন কী প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলেন, এ হাদীছে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যে, একজন কোনও রাতে ঘুমাবেন না, রাতভর জেগে নামায পড়বেন; আরেকজন নিয়মিত রোযা রাখবেন, রোযা ছাড়া কোনও দিন কাটাবেন না এবং আরেকজন নারীসঙ্গ হতে দূরে থাকবেন, বিবাহ করবেন না। তাঁরা এসব কথা প্রকাশ্যেই বলাবলি করেছিলেন। ফলে তা কোনও মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কানে পৌঁছে যায়। কাজেই তিনি অবিলম্বে তাঁদের চিন্তাচেতনার সংশোধন করা ও তাঁদের ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। সেমতে তিনি তাঁদের কাছে চলে আসলেন।

তিনি এসে প্রথমে যাচাই করে নিলেন যা শুনেছেন সত্য কি না? তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন তাঁরাই এসব কথা বলেছেন কি না? তাঁরা স্বীকার করলেন যে, হাঁ, তারা তা বলেছেন। তখন তিনি বললেন যে, শোন, আল্লাহ তা'আলাকে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি ভয় করি, তোমাদের চেয়ে তাকওয়া-পরহেযগারীও আমার মধ্যেই বেশি। তা সত্ত্বেও আমি কোনওদিন রোযা রাখি, কোনওদিন রাখি না। রাতে কিছু সময় নামায পড়ি, কিছু সময় ঘুমাই। আবার আমি বিবাহ করেছি।

তিনি তাঁদের বুঝিয়ে দিলেন যে, ইবাদত-বন্দেগীর ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া-পরহেযগারী ও আল্লাহভীতি। যার মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি থাকবে সে অবশ্যই আল্লাহর ‘ইবাদত করবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাকে দুনিয়ার সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে দিতে হবে, শরীরের আরাম সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে এবং ঘর-সংসার থেকে বিমুখ হয়ে যেতে হবে। তাকওয়াভিত্তিক জীবন কিভাবে যাপন করতে হয়, নবীগণ তার নমুনা। সে জীবনে শারীরিক ও স্বভাবগত চাহিদা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার কোনও ব্যাপার নেই। বরং সীমার ভেতর থেকে তা পূরণ করাই বাঞ্ছনীয়, যেমনটা পূরণ আমি করে থাকি। ফরয ইবাদতসমূহের পর নফল ইবাদত-বন্দেগীতেও প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমিকের আগ্রহ-উদ্দীপনা থাকবে বৈ কি। কিন্তু তার পাশাপাশি বৈধ মাত্রার ভেতর স্বভাবগত চাহিদাও পূরণ করতে হবে। অন্যথায় শরীর ভেঙে পড়বে ও শক্তি-সামর্থ্য নিস্তেজ হয়ে যাবে। ফলে 'ইবাদতের ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হবে না। একপর্যায়ে তা ছেড়ে দিতে হবে। আর কোনও ‘ইবাদত শুরু করার পর ছেড়ে দেওয়াটা নিন্দনীয়। তাই 'ইবাদতের এ পদ্ধতি কখনও আদর্শ হতে পারে না এবং এটা আমার আদর্শ ও সুন্নত নয়ও। আমার সুন্নত হল সারারাত নামাযে না কাটিয়ে কিছু সময় ঘুমানোও, প্রত্যেকদিন রোযা না রেখে মাঝেমধ্যে রাখা এবং বিবাহ করে সংসার জীবনও যাপন করা।

তারপর সতর্ক করে বলেন, এটা আমার সুন্নত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হয় সে আমার লোক নয়। অর্থাৎ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে এবং আমার অনুসারী বলে পরিচয় দিতে হলে আমার এ সুন্নত মোতাবেকই চলতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছের প্রধান শিক্ষা হচ্ছে 'ইবাদত-বন্দেগীর ভারসাম্য। অর্থাৎ নফল ইবাদতের পাশাপাশি বৈধ সীমার ভেতর স্বভাবগত চাহিদাসমূহও পূরণ করা। নফল ইবাদতের খাতিরে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা কিছুতেই উচিত নয়।

খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া গেল, বড়দের অনুসরণার্থে তাদের জীবনাচার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। এজন্য যদি তাদের স্ত্রীদের সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হয়, তবে তা করারও অবকাশ আছে।

গ. বড়দের কর্তব্য, তাদের সাথে সম্পৃক্ত লোকদের ইসলাহ ও সংশোধনের কাজে যত্নবান থাকা।

ঘ. কারও সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু শুনলে প্রথমেই তিরস্কার না করে আগে যাচাই করে নেওয়া উচিত অভিযোগ সত্য কি না।

ঙ. এ হাদীছ দ্বারা বিবাহ করার গুরুত্বও জানা গেল।

চ. এর দ্বারা আরও শিক্ষা পাওয়া গেল যে, আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে দেওয়া ও স্বভাবগত চাহিদা পূরণে বিভোর হয়ে থাকা কোনও মু'মিনের উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন