আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৩৩- ঋন গ্রহন,পরিশোধ,নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও দেউলিয়া/নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২৩৮৯
১৪৮৫. ঋণ পরিশোধ করা।
২২৩১। আহমদ ইবনে শাবীব ইবনে সাঈদ (রাহঃ) ....আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমার কাছে যদি উহুদ পাহাড়ের সমান সোনা থাকত, তাহলেও আমার পছন্দ নয় যে, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তার কিছু অংশ আমার কাছে থাকুক। তবে এতটুকু পরিমাণ ব্যতীত, যা আমি ঋণ পরিশোধ করার জন্য রেখে দেই। সালিহ ও উকাইল (রাহঃ) যুহরী (রাহঃ) থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছটিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুহদ (বিষয়বিমুখতা)-এর বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। উহুদ মদীনা মুনাউওয়ারার সবচে' বড় পাহাড়। এত বড় পাহাড় সোনায় পরিণত হলে কী বিপুল সম্পদ হয় তা কি কল্পনা করা সম্ভব? কারও কাছে সামান্য কিছু সম্পদ জমা হয়ে গেলে সে তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করে। কমে যাওয়ার ভয়ে তা থেকে কাউকে কিছু দিতে চায় না। যার যত হয় সে ততো বেশি চায়। কোনও গরীবের হাতে হঠাৎ কিছু টাকা-পয়সা চলে আসলে সে প্রথমেই তা দ্বারা ভালো একটি বাড়ি তৈরির চিন্তা করে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলছেন। তিনি গরীব হালে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর ছিল ছোট্ট কুটির। দিনের পর দিন তাঁর চুলায় আগুন জ্বলত না। কোনওরকম খেজুর ও পানি খেয়ে ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাতেন। তা সত্ত্বেও তিনি বলছেন এত বড় উহুদ পাহাড় পুরোটা সোনা হয়ে গেলেও তিনি তার সবটা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তিন দিনের মধ্যে সব লুটিয়ে দিতেন। এক দীনার পরিমাণও নিজের কাছে রাখতেন না। এক বর্ণনায় একদিনের কথাও আছে। তার মানে সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে তা বিলানোর চেষ্টা করতেন। তিন দিনের বেশি কিছুতেই পার হতে দিতেন না। এটা তাঁর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্মোহ চরিত্রের প্রমাণ বহন করে। দুনিয়ার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না। সঞ্চয়ের পক্ষপাতী ছিলেন না। সম্পদ যত বেশিই হোক না কেন, তা বিলাতেই পসন্দ করতেন। কিছু রেখে কিছু খরচ করা তাঁর ধাতে ছিল না।

হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছিলেন- (কেবল ওই সামান্য কিছু ছাড়া, যা আমি আমার ঋণ পরিশোধের জন্য রাখব)। অর্থাৎ দেনা পরিশোধের সময় হলে তখন যাতে তা পরিশোধ করতে পারি অথবা পাওনাদার যদি হাজির না থাকে আর এখনই তার পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব না হয়, তবে সে ফিরে আসার পর যাতে তা পরিশোধ করতে পারি সেজন্য দেনা পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করে রাখব। এর দ্বারা দেনা পরিশোধের গুরুত্ব বোঝা যায়।

দান-খয়রাত করা নফল ইবাদত। কিন্তু দেনা পরিশোধ করা ফরয। তাই দেনা পরিশোধ না করে সবটা সম্পদ দান করে দেওয়া ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টাকা-পয়সা জমা করে রাখতে পসন্দ করতেন না। কিন্তু এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে, দেনা পরিশোধ করা যায় এ পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলছেন। কেননা এটা বান্দার হক। জীবদ্দশায় আদায় না করে গেলে আখিরাতে নিজের ছাওয়াব দিয়ে তা আদায় করতে হবে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الدَّيْنَ يُقْضَى مِنْ صَاحِبِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا مَاتَ وَلَمْ يَقْضِهِ
“কিয়ামতের দিন দেনাদারের কাছ থেকে দেনা আদায় করিয়ে দেওয়া হবে, যদি সে তা আদায় না করে মারা যায়।'

এক ব্যক্তি দেনাদার অবস্থা মারা গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ভাইকে বলেছিলেন-
إِن أَخَاكَ مُحْتَبَس بِدَيْنِهِ، فَاقْضِ عَنْهُ
'তোমার ভাই তার দেনার দায়ে আটক আছে। তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দাও।'

কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, মায়্যিত দেনাদার হলে তার দেনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা পড়াতেন না। কাজেই দেনাদার ব্যক্তির উচিত সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেনা পরিশোধের চেষ্টা করা, যাতে দেনার দায় নিয়ে কবরে যেতে না হয়।

হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল এমনিতে কারও কাছে অর্থ-সম্পদ থাকা দোষের নয়। দোষের হয় তখনই, যখন তা আল্লাহর পথে খরচ করা না হয়। কেউ যদি আল্লাহর জন্য আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অর্থ-সম্পদ বিতরণে অভ্যস্ত থাকে, তবে এ অবস্থায় তার হাতে উহুদ পাহাড় পরিমাণ টাকা-পয়সা থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই। তবে এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, টাকা-পয়সার আকর্ষণ বড় কঠিন। সে আকর্ষণ উপেক্ষা করে মানুষের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. হাদীছটি দ্বারা যুহদের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

খ. যার অর্থ-সম্পদ আছে তার কর্তব্য তা থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করা।

গ. এ হাদীছ দ্বারা ঋণ পরিশোধের গুরুত্বও উপলব্ধি করা যায়। এ গুরুত্বের কারণেই নিজের কাছে অর্থ-সম্পদ জমা করে রাখা অপসন্দ হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণ পরিশোধ করা যায় এ পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলেছেন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন