আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৩২- সেচকার্য সম্পর্কিত অধ্যায়
২২০৭। আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ....আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা লাগলো। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল যে, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটারও আমার মত পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে উপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ্ পাক তার আমল কবুল করলেন এবং আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের সাওয়াব হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেই সাওয়াব রয়েছে।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে বর্ণিত ঘটনাটি বনী ইসরাঈলের কোনও এক ব্যক্তির। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ উম্মতকে সৎকাজে উৎসাহদানের জন্য কিংবা অসৎকাজের ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য অতীত জাতিসমূহের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এটিও সেরকমই এক ঘটনা। ঘটনাটি অত্যন্ত শিক্ষণীয়। কিভাবে একটি কুকুরকে পানি পান করানোর অছিলায় সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেয়ে জান্নাতের অধিকারী হয়ে গেল! চলতি পথে এ লোকটির নিজেরও পিপাসা পেয়েছিল। পিপাসার কী কষ্ট তা সে অনুভব করতে পারছিল। এ অবস্থায় একটা কুয়ার পানি দ্বারা তার নিজ পিপাসা নিবারণের সুযোগ হয়েছিল। পিপাসা নিবারণের পর যখন চলে যাবে, অমনি দেখতে পায় এক পিপাসার্ত কুকুর, যেটি জিহ্বা দিয়ে কাদা চেটে চেটে পিপাসা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। এ দৃশ্য তার মনে রেখাপাত করে। সে চিন্তা করল ক্ষণিক আগে পিপাসার যে কষ্ট তার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, সেই একই কষ্ট এখন এই কুকুরটি ভোগ করছে। এভাবে কাদামাটি চেটে কি সে তার পিপাসা নিবারণ করতে পারবে? আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে তো সে মারাই যাবে। আহা! এভাবে পিপাসায় একটা জলজ্যান্ত প্রাণী মারা পড়বে? কুকুরটির জন্য তার মন কেঁদে উঠল। সে কালবিলম্ব না করে কুয়ায় নেমে পড়ল এবং নিজ মোজায় পানি ভরে নিল। এখন সে কুয়া থেকে কিভাবে উঠে আসবে? খাড়া কুয়ার নিচ থেকে উঠতে হলে দু' হাত দিয়ে কিছু ধরে ধরেই উঠতে হবে। আবার দু' হাত দিয়ে কিছু ধরলে মোজা তুলবে কী করে? অগত্যা সে মোজাটি মুখ দিয়ে কামড়ে ধরল আর এভাবে কুয়ার দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আসল। তারপর সে পানি পান করিয়ে কুকুরটির পিপাসা নিবারণ করল। কুকুরটি প্রতি তার এ দরদ আল্লাহ তা'আলার কাছে কবূল হয়ে গেল। আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি রাজিখুশি হয়ে গেলেন এবং তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে তাকে জান্নাত দান করলেন। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ- الخلق كلهم عيال الله فأحب الخلق إلى الله أنفعهم لعياله “সমস্ত মাখলূক আল্লাহর পরিবার। সুতরাং আল্লাহর সবচে' প্রিয় মাখলূক সে-ই, যে তার পরিবারবর্গের জন্য বেশি উপকারী। " মুসনাদে হারিছ ইবনে আবী উসামা, বুগয়াতুল বা-হিছ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৫৭, হাদীছ নং ৯১১; ইবনে আ-বিদ-দুন্ইয়া : কাযা-উল হাওয়াইজ, বর্ণনা নং ২৪; মুসনাদে বাযযার, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৩২: তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০০৩৩; আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৫৪১ ইমাম নববী রহ. তাঁর 'ফাতাওয়া' গ্রন্থে এবং ইবনে মুফলিহ রহ. 'আল-আদাবুশ শরইয়্যাহ' গ্রন্থে (৩/২৬৭) এটিকে যঈফ আখ্যায়িত করেছেন। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إرحم من في الارض، يرحمك من في السّماء “পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমার প্রতি দয়া করবেন।" তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৫০২, মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭৬৩১- বাগানী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫২ কুকুর বাহ্যত এক তুচ্ছ প্রাণী হলেও সে আল্লাহ তা'আলারই সৃষ্টি। আল্লাহর যে কোনও সৃষ্টির উপকার করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং তিনি তাকে প্রিয় করে নেন। আল্লাহর সৃষ্টিজীবের যে-কারও প্রতি দয়া করলে সে আল্লাহ তা'আলার দয়া লাভের উপযুক্ত হয়ে যায়। কাজেই এ লোকটি যখন কুকুরটির প্রতি মমতাবশে তাকে পানি পান করাল, তখন আল্লাহ তা'আলাও নিজ মমতায় তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং জান্নাতে স্থান দিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ঘটনা বর্ণনা করলে সাহাবায়ে কিরামের আশ্চর্যবোধ হল যে, একটা কুকুরকে পানি পান করানোর এত ফযীলত! কৌতূহলবশে তাঁরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন। তিনি বললেন, হাঁ। তাজা কলিজাবিশিষ্ট অর্থাৎ জীবিত যে কোনও প্রাণীর সেবাযত্ন করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং তিনি সেবাযত্নকারীকে পুরস্কৃত করেন। বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় এক চরিত্রহীনা নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর অছিলায় আল্লাহ তা'আলা তাকে ক্ষমা করেছিলেন। দু'টি পৃথক ঘটনা, কিন্তু উভয়ের মর্মবস্তু একই। অর্থাৎ যে-কোনও জীবের প্রতি দয়া করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। দ্বিতীয় ঘটনার বাড়তি মহিমা এই যে, যে ব্যক্তি কুকুরটিকে পানি পান করিয়েছিল সে ছিল এক চরিত্রহীনা নারী। সে ব্যভিচার দ্বারা উপার্জন করত। একটা কঠিন পাপকর্মকে সে পেশা বানিয়ে নিয়েছিল । তাহলে কত পাপ তার আমলনামায় জমা হয়েছিল? তা সত্ত্বেও সে যখন একটা তুচ্ছ জীবের প্রতি দয়া দেখাল, তখন আল্লাহ তা'আলাও তার প্রতি দয়া করলেন এবং তার গুরুতর পাপসমূহ ক্ষমা করে দিলেন। চিন্তা করার বিষয়, অতি সাধারণ এক জীবের প্রতি দয়া করার যখন এত ফযীলত, তখন মানুষের সেবাযত্ন করার কী ফযীলত হতে পারে? আমরা বড় কঠিন সময় পার করছি। জীবের কষ্টে কাঁদা তো দূরের কথা, মানুষের কষ্টেও যেন চোখে পানি আসে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবের প্রতি দয়ার ওই ঘটনা বর্ণনা দ্বারা আমাদেরকে কী শিক্ষা দিতে চেয়েছেন? এটাই নয় কি যে, মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের তো কোনও প্রশ্নই আসে না। বিশেষত তুমি যখন একজন মু'মিন, তখন কোনও মানুষ তোমার দ্বারা অহেতুক কোনও কষ্ট পাবে— সে তো সম্ভবই নয়। বরং তোমার মমত্বের ডানা হবে এমন সুদূর বিস্তৃত, যা মানুষকে ছাপিয়ে পশুপাখিকেও সেবা দান করবে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কোনও আমলকে তুচ্ছ মনে করা উচিত নয়। কে জানে কখন কোন্ আমল আল্লাহর কাছে কবূল হয়ে যায়। খ. পশু-পাখির প্রতিও মমত্ববোধের পরিচয় দেওয়া উচিত। গ. অন্যের পিপাসা নিবারণ অনেক বড় পুণ্যের কাজ, তা যদি পশু-পাখিরও হয়। মানুষের ক্ষেত্রে তো তার ছাওয়াব অনেক অনেক বেশি। ঘ. কোনও পাপের কারণে কাউকে হেলা করতে নেই। জানা নেই হয়তো কোনও নেক আমলের অছিলায় তার সমস্ত পাপ মোচন হয়ে যাবে এবং আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভ করবে।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন