কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

২৩. যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ২৪৩৭
আন্তর্জাতিক নং: ২৪৩৭
যাকাত ফরয হওয়া
২৪৩৯. ঈসা ইবনে মুসাবির (রাহঃ) ......... আবু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) উচিত বলেছেনঃ উত্তমভাবে ওষু করা ঈমানের অর্ধেক। আর আলহামদুলিল্লাহ মীযানকে পরিপূর্ণ করে ফেলবে, তাসবীহ এবং তাকবীর আসমান এবং যমীনসমূহকে পরিপূর্ণ করে ফেললে। নামায হল আলো আর যাকাত হল দলীল, ধৈর্য (রোযা) হল নূর এবং কুরআন হল তোমার পক্ষের অথবা বিপক্ষের প্রমাণ।
بَاب وُجُوبِ الزَّكَاةِ
أَخْبَرَنَا عِيسَى بْنُ مُسَاوِرٍ قَالَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ شُعَيْبِ بْنِ شَابُورَ عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ سَلَّامٍ عَنْ أَخِيهِ زَيْدِ بْنِ سَلَّامٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ عَنْ جَدِّهِ أَبِي سَلَّامٍ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ غُنْمٍ أَنَّ أَبَا مَالِكٍ الْأَشْعَرِيَّ حَدَّثَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ شَطْرُ الْإِيمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَأُ الْمِيزَانَ وَالتَّسْبِيحُ وَالتَّكْبِيرُ يَمْلَأُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ وَالصَّلَاةُ نُورٌ وَالزَّكَاةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম তুলে ধরা হয়েছে ' ত্বহারাত' (পবিত্রতা)-এর গুরুত্ব। বলা হয়েছে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক। কি হিসেবে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক, তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন -

পাক-পবিত্রতার ফযীলত
ক. ত্বহারাত ছাড়া ঈমানের আর যত শাখা-প্রশাখা আছে, যেমন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, যিকর তিলাওয়াত, দান-খয়রাত ইত্যাদি, তা মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে। আর ত্বহারাত দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের দেহ। দেহ ও আত্মার সমষ্টিই হল মানুষ । তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের অর্ধাংশ পবিত্র হয় ত্বহারাত দ্বারা আর বাকি অর্ধেক অন্যান্য ইবাদত দ্বারা। এই হিসেবে ঈমান তথা ঈমানের কার্যাবলী দুই ভাগে বিভক্ত হল। একভাগ দ্বারা মানুষের জাহের পবিত্র হয়, অন্যভাগ দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের বাতেন। তাই বলা হয়েছে 'ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক'।

খ. ঈমান দ্বারা নামায বোঝানো হয়েছে, যেমন সুরা বাকারার আয়াত-

وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِيعَ إِيْمَانَكُمْ

*আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমান নিষ্ফল করে দেবেন। - এর ঈমান শব্দ দ্বারা নামায বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কিবলা পরিবর্তনের আগে তোমর বায়তুল মাকদিসের দিকে ফিরে যেসব নামায পড়েছ, আল্লাহ তা নিষ্ফল করবেন না তদ্রূপ এ হাদীছেও ঈমান দ্বারা নামায বোঝানো হয়েছে। অর্থ দাঁড়ায়- ত্বহারাত নামাযের অর্ধেক, যেহেতু ত্বহারাত ছাড়া নামায হয় না।

গ. এক হাদীছে আছে, যে-কোনও মুসলিম পরিপূর্ণ ত্বহারাতের সাথে পাঁচ ওয়া নামায পড়ে, তার ওইসকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়, যা এর ওয়াক্তসমূহের মাঝখানে হ যায়। দেখা যাচ্ছে গুনাহ মাফ হয় ত্বহারাত ও নামায- এ দুইয়ের সমষ্টি দ্বারা। সুতর গুনাহ হতে ক্ষমাপ্রাপ্তির দিক থেকে ত্বহারাত ঈমানের তথা নামাযের অর্ধেক।

ঘ. নামায বেহেশতের চাবি। আবার ওযু নামাযের চাবি। তাহলে ওষু ও নামায এ দুইয়ের সমষ্টি দ্বারা জান্নাতের দুয়ার খোলা হয়, যা কিনা ঈমানের লক্ষবস্ত্র। সেই হিসেবে ত্বহারাত ঈমানের অর্ধেক হল।

ঙ. ত্বহারাত তথা ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা যে ছওয়াব লাভ হয়, সে ছওয়াব বৃদ্ধি পেতে পেতে ঈমান দ্বারা অর্জিত ছওয়াবের অর্ধেক বরাবর হয়ে যায়।

চ. পবিত্রতাকে ব্যাপক অর্থেও ধরা যেতে পারে। তার মানে জাহিরী ও বাহিনী উভয় প্রকার পবিত্রতা। জাহিরী পবিত্রতা অর্জিত হয় ওযু, গোসল ও তায়াম্মুম দ্বারা। আর বাতিনী তথা আত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয় শিরক ও পাপাচার পরিহার দ্বারা। এই উভয়বিধ পবিত্রতা দ্বারা মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিশুদ্ধি লাভ হয়। বাকি থাকল শোভা ও সৌন্দর্যবিধানের ব্যাপার। তা সম্পন্ন হয় নামায, রোযা, যিকর, তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা। এভাবে মানব-জীবনে ঈমানের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।

ছ. আবার এমনও বলা যায়, মানুষের করণীয় কাজ দু'প্রকার। একটা অর্জনমূলক, আরেকটা বর্জনমূলক। এ দুইয়ের সমন্বিত রূপই ঈমান। আল্লাহ তা'আলা যা করার আদেশ করেছেন সেগুলো করাই হল অর্জনমূলক কাজ। আর আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন সেগুলো হতে বিরত থাকা হচ্ছে বর্জনমূলক কাজ। সেই বর্জনমূলক কাজসমূহ দ্বারা মানুষের শরীর ও মন পবিত্র হয়। এই হিসেবেই বলা হয়েছে, পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।

জ. ত্বহারাত দ্বারা ইখলাসও বোঝানো যেতে পারে। অর্থাৎ ঈমানের এক হল। মৌখিক স্বীকৃতি- নিজেকে মু'মিন ও মুসলিমরূপে প্রকাশ করা। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে একজন ব্যক্তি মু'মিনরূপে বিবেচিত হয়, তাতে তার অন্তরে বিশ্বাস থাকুক বা নাই থাকুক। কিন্তু আল্লাহর কাছে মু'মিন সাব্যস্ত হওয়ার জন্যে ইখলাস ও মনের বিশ্বাস ও জরুরি। অন্যথায় সে আখিরাতে মুক্তি পাবে না। তাহলে পরিপূর্ণ ঈমান অর্থাৎ যেই ঈমান দ্বারা আখিরাতে মুক্তিলাভ হবে, তার অর্ধেক হচ্ছে ইখলাস, যাকে 'ত্বহারাত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। ত্বহারাত শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে এ কথা বোঝানোর জন্য যে, তার মুখের স্বীকারোক্তি মুখের কথামাত্র নয়; বরং তার প্রকৃত ঈমান, যা লোকদেখানোর মনোভাব ও মুনাফিকীর আবিলতা থেকে পবিত্র।

‘আলহামদুলিল্লাহ' বলার ফযীলত
হাদীছের দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, 'আলহামদুলিল্লাহ' মীযান ভরে ফেলে। আলহামদুলিল্লাহ অর্থ 'সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর'। একথা বলে আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় গুণাবলীর প্রতি ঈমানের স্বীকারোক্তিদান, তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তাঁর প্রদত্ত নি'আমতসমূহের জন্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়। সমস্ত প্রশংসা বলতে ফিরিশতা, মানুষ ও জিন্নসহ কুল মাখলুকের মুখে আদায়কৃত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমুদয় প্রশংসা বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সরাসরি আল্লাহর যে প্রশংসা করা হয় তা তো আল্লাহরই, আর যে সকল প্রশংসা কোনও সৃষ্টিকে লক্ষ্য করে করা হয়ে থাকে তাও মূলত আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা মানবজগত, জড়জগত ও উদ্ভিতজগত থেকে শুরু করে নভোমণ্ডল, নক্ষত্রমণ্ডল ও ফিরিশতা জগত পর্যন্ত ও প্রতিপালন আল্লাহ তা'আলারই কাজ। সমস্ত মাখলুক আল্লাহরই সৃষ্টি আর তাদের যাবতীয় গুণ তাঁরই প্রদত্ত। কাজেই এর কোনওটির প্রশংসা করলে তাতে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলারই প্রশংসা করা হয়। বস্তুত আল্লাহ তা'আলার যথার্থ প্রশংসা কোনও সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়, যেহেতু আল্লাহ তাআলার যাবতীয় গুণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আয়ত্ত করা আমাদের সাধ্যাতীত এবং তাঁর সৃষ্টির বিপুলতা সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ ধারণালাভ অসম্ভব। এ জন্যেই নবী কারীম সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

اللهم لا تحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك

হে আল্লাহ! আমরা তোমার পুরোপুরি প্রশংসা করতে সক্ষম নই। তুমি নিজে নিজের যেমন প্রশংসা করেছ, তুমি তেমনই।
আল্লাহ তা'আলার যে-কোনও নি'আমত ভোগের পর তাঁর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আলহামদুলিল্লাহ বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হাদীছে এর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যেমন এক হাদীছে আছে- “ যে ব্যক্তি এক লোকমা খাবার খায় বা এক ঢোক পানি পান করে, তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলে, তার অতীতের সমস্ত (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যায়।”
আর এ হাদীছে তো বলাই হয়েছে যে, আলহামদুলিল্লাহ মীযান ভরে ফেলে। মীযান বলতে ওই তুলাদণ্ড বোঝানো হয়েছে, যা দ্বারা বান্দার আমল পরিমাপ করা হবে। সেটি কেমন, কী তার রূপ, ইহজগতে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কুরআন ও হাদীছে আমাদেরকে মীযান দ্বারা পরিমাপ করার কথা অবগত করা হয়েছে। আমরা তাতে বিশ্বাস রাখি। এর বেশি খোঁড়াখুঁড়ি করার কোনও প্রয়োজন আমাদের নেই।
বান্দার আমল বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কোনও আমল হয় অন্তর দ্বারা, যেমন অন্তরের বিশ্বাস। কোনওটি মুখের দ্বারা, যেমন যিকর ও তিলাওয়াত। কোনওটি অন্যান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা, যেমন পা দিয়ে মসজিদের দিকে চলা, হাত দ্বারা এতিমের মাধ্য হাত বুলানো, কান দ্বারা কুরআন তিলাওয়াত শোনা ইত্যাদি। এসব আমল কিভাবে পরিমাপ করা হবে তা আল্লাহ তা'আলাই জানেন। আমরা এর সত্যতায় বিশ্বাস রাখি বিশেষত বর্তমানকালে যখন বাতাসের ওজন মাপা হচ্ছে, শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা যায় এবং শীত ও তাপ পরিমাপের ব্যাপারটাও আমরা সবাই জানি, তখন বান্দার যাবতীয় আমল পরিমাপ করা যায় এমন কোনও যন্ত্র সৃষ্টি করা আল্লাহর পক্ষে কঠিন হবে কেন? 'আলহামদুলিল্লাহ' কিভাবে মীযান ভরে ফেলবে তার স্বরূপও আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। হতে পারে এর ছওয়াব এত বেশি, যা মীযান ভরে ফেলবে। অথবা আলহামদুলিল্লাহকে বিশেষ কোনও রূপ দান করা হবে, যা দ্বারা মীযান ভরে যাবে।

'সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ' বলার ফযীলত
তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে- "সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ' আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্থান ভরে ফেলে। সুবহানাল্লাহ অর্থ 'আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি। অর্থাৎ তিনি যাবতীয় নাম ও গুণাবলী এবং সমস্ত কাজ ও বিধানাবলীতে সর্বপ্রকার দোষ- ত্রুটি থেকে মুক্ত। আর আলহামদুলিল্লাহ দ্বারা জানানো হয় যে, তিনি সমস্ত সৎগুনের অধিকারী। এই উভয়টি দ্বারা আল্লাহ তা'আলার যিকর ও স্মরণ পরিপূর্ণতা লাভ করে। সে কারণেই এর ছওয়াব এত বেশি। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা জানা যায়। আল্লাহ তা'আলার প্রত্যেকটি সৃষ্টি এ যিকর করে থাকে, যেমন ইরশাদ হয়েছে-

تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ

‘সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না।' বনী ইস্রাইল-৪৪

নামায দুনিয়া ও আখিরাতের নূর
তারপর বলা হয়েছে 'নামায নূর'। ইবনে মাজাহ শরীফে আছে, নামায মুমিনের নূর। তার পক্ষে এ নূর যেমন আখিরাতে তেমনি দুনিয়ায়ও। নামায দ্বারা দুনিয়ায় মু'মিনদের আত্মা আলোকিত হয় ও তার অন্তর্দৃষ্টি হয় উদ্ভাসিত। এ কারণেই মুমিন মুত্তাকীগণ সর্বদা নামায আদায়ে যত্নবান থাকতেন। নামাযে তাদের প্রাণ জুড়াত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

جُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ

"নামাযের ভেতর আমার নয়নপ্রীতি রাখা হয়েছে (অর্থাৎ নামায দ্বারা চোখ জুড়ায়)।”

তাছাড়া নামায এই হিসেবেও মু'মিনের নূর যে, নূর বা আলো দ্বারা যেমন পথ দেখা ফলে পথের খানাখন্দ থেকে আত্মরক্ষা করে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছা যায়, তেমনি মা দ্বারাও অন্যায়-অশ্লীল কাজ থেকে হেফাজত করে নিজেকে তাকওয়ার উচ্চস্তরে পৌছানো যায়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

أقم الصلوة إِنَّ الصَّلوةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَ الْمُنكَرِ

অর্থ : নামায কায়েম কর। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।

আখিরাতে যে নামায নূর ও আলো হিসেবে উপকারে আসবে, বিভিন্ন হাদীছে তা বর্ণিত হয়েছে। অন্ধকার কবরে নামায মু'মিনদের আলো দান করবে। কিয়ামতের ময়দানে মুমিন ব্যক্তি নামাযের আলো পাবে। নামাযী ব্যক্তি বিদ্যুতের মত পুলসিরাত পার হবে। বিশেষত অন্ধকার রাতে যে ব্যক্তি যতবেশি নামাযে যাবে, কিয়ামতে সে ততবেশি আলোর অধিকারী হবে। এক হাদীছে ইরশাদ-

بشرِّ المشائينَ في الظلمِ إلى المساجدِ، بالنورِ التامِّ يومَ القيامةِ

"যারা গভীর অন্ধকারেও বেশি বেশি মসজিদে যায়, তাদেরকে কিয়ামতের দিনে পরিপূর্ণ আলোর সুসংবাদ দাও।

সদাকা যাকাত ঈমানের দলীল
তারপরে বলা হয়েছে ‘সদাকা (যাকাত) প্রমাণ' অর্থাৎ ঈমানের দলীল। প্রকৃত মুমিনই তার সম্পদের যাকাত দিয়ে থাকে। যার অন্তরে ঈমানের দুর্বলতা আছে, সে যাকাত দিতে গড়িমসি করে। কেননা অর্থ-সম্পদের প্রতি মানুষের আসক্তি স্বভাবগত। তাই সে অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করে। কিন্তু যার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঈমান আছে, যে তাঁর পুরস্কারের ওয়াদা ও শাস্তির সতর্কবাণীতে বিশ্বাস রাখে, সে স্বেচ্ছায় খুশিমনে যাকাত আদায় করে। সুতরাং যাকাত আদায় করাটা তার ঈমানের প্রমাণ বহন করে। কেউ বলেন , কিয়ামতে যখন জিজ্ঞেস করা হবে সে তার মালের যাকাত আদায় করেছে কি না আর সে উত্তরে যাকাত আদায় করার কথা বলবে, তখন তার প্রদত্ত যাকাত তার কথার সত্যতা প্রমাণ করবে। কারও মতে কিয়ামতে যাকাত আদায়কারী ব্যক্তির এমন কোনও নিদর্শন থাকবে, যা তার যাকাত আদায়ের প্রমাণ বহন করবে। ফলে তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেসই করা হবে না, যেমন হযরত উকবা ইবন আমির রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

كُلِّ امْرِي فِي ظِلٍّ صَدَقَتِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُقْضى بَيْنَ النَّاسِ

'প্রত্যেক ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তার সদাকার (যাকাতের) ছায়াতলে থাকবে, যাবত না মানুষের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়।” তো ওই ছায়া সে ব্যক্তির ঈমান ও ইখলাসের পক্ষে দলীল হবে।

সবর জীবনের আলো
তারপর বলা হয়েছে 'সবর আলো'। এখানে সবর শব্দটি বিশেষ অর্থেও হতে পারে এবং সাধারণ অর্থেও। সাধারণ অর্থে হলে (ক) আল্লাহর ইবাদতে যত্নবান থাকা, (খ) গুনাহ হতে বিরত থাকা এবং (গ) বিপদ-আপদ ও কষ্ট-ক্লেশে আত্মনিয়ন্ত্রণ করায় ধৈর্যধারণ বোঝাবে। এই হিসেবে অর্থ হবে- ধৈর্য ধারণের পরিণতি উত্তম ও আলোময় হয়ে থাকে। বিপদ-আপদ ও কষ্ট-ক্লেশকে অন্ধকারের সংগে তুলনা করা হয়। ঘোর বিপদে বলা হয়ে থাকে চোখে অন্ধকার দেখছি। ধৈর্যধারণ করলে এক পর্যায়ে বিপদ দূর হয়ে অন্ধকার ঘুচে যায়। ধৈর্যের যে তিনটি ক্ষেত্র বলা হল, এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু কষ্ট অবশ্যই আছে। ধৈর্যধারণ করতে থাকলে এক পর্যায়ে তিনওটি বিষয় আসান হয়ে যায় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে এর সুফল লাভ হয়। সেই আসান ও সুফলকেই হাদীছে 'আলো' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
বিশেষ অর্থে সবর দ্বারা রোযাও বোঝানো হয়ে থাকে। কারও মতে এখানে সেই অর্থ বোঝানোই উদ্দেশ্য। তার একটা ইঙ্গিত এর দ্বারাও পাওয়া যায় যে, এর আগে নামায ও যাকাতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তার পাশাপাশি এস্থলে যে রোযার ফযীলত বর্ণিত হয়ে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। রোযার ভেতরে সবরের অর্থও পুরোপুরি বিদ্যমান। সবর মানে আটকে রাখা। রোযায় নিজেকে পানাহার করা ও যৌনচাহিদা পূরণ থেকে আটকে রাখা হয়। এসব কাজের সর্বরকম প্রলোভন সত্ত্বেও নিজেকে সংযত রাখা হয়। সুতরাং রোযা সবরই বটে। রোযায় মনের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। তাই যথাযথ রোযা রাখার জন্যে কঠোর মুজাহাদা ও সাধনা দরকার হয়। সেই হিসেবে রোযার ভেতর সবরের তিনও প্রকারই উপস্থিত থাকে। এক তো ইবাদতের সবর, দ্বিতীয়ত গুনাহ থেকে বাঁচার সবর, তৃতীয়ত কষ্ট-ক্লেশের সবর। সুতরাং রোযা সবরের পূর্ণাঙ্গ রূপ। তাই এর পুরস্কার হচ্ছে আলো। অর্থাৎ রোযার ফলে অন্তরে আলো জন্ম নেয়। এর দ্বারা অন্তদৃষ্টি জ্যোতির্ময় হয়। আর আখিরাতেও রোযা আলো হয়ে বান্দার প্রভূত উপকারে আসবে।
প্রকাশ থাকে যে, নামায দ্বারা যে আলো লাভ হয়, এ হাদীছে তাকে 'নূর' (نُور) বলা হয়েছে। আর সবরের আলোকে বলা হয়েছে 'যিয়া' (ضِيَاء)। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নূর অপেক্ষা যিয়ার আলো বেশি তীব্র ও উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এ জন্যেই কুরআন মাজীদে সূর্যের আলোকে 'যিয়া' এবং চাঁদের আলোকে 'নূর' বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

هو الذي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاء وَ الْقَمَرَ نُورًا

“তিনিই আল্লাহ, যিনি সূর্যকে রশ্মিময় ও চন্দ্রকে জ্যোতিপূর্ণ করেছেন। -ইউনুসঃ ০৫

সবর শব্দটি যদি ব্যাপকার্থে হয়ে থাকে, তবে এর আলো যে নূর হবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ সে ক্ষেত্রে গোটা শরী'আতই সবরের আওতায় এসে পড়ে, রোযাও যার অন্তর্ভুক্ত। আর যদি বিশেষ অর্থে হয় অর্থাৎ এর দ্বারা কেবল রোযা বোঝানো হয়, তবে রোযায় যেহেতু মানুষের স্বভাবগত প্রয়োজন ও চাহিদা বর্জন করা হয়, সেহেতু অন্যান্য ইবাদত অপেক্ষা এতে অধিকতর সাধনা-মুজাহাদা দরকার হয়, ফলে অন্যান্য ইবাদত অপেক্ষা এতে কষ্ট-ক্লেশও বেশি হয়, তাই এর আলোও বেশি উজ্জ্বল হবে। সেই হিসেবে এর জন্যে ‘যিয়া” শব্দের ব্যবহারই বেশি যুক্তিযুক্ত। নামাযে সেই তুলনায় কষ্ট কম। ফলে এর দ্বারা অর্জিত আলোর উজ্জ্বলতাও রোযার আলো অপেক্ষা কম হবে । তাই এর আলোকে নূর বলা হয়েছে।
উলামায়ে কিরাম এ পার্থক্যের আরও বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, নূর ও যিয়া সমার্থবোধক শব্দ। আরবী ভাষায় এর একটির স্থলে অন্যটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং এস্থলে কেবলই শব্দ ব্যবহারের বৈচিত্র্য। মূল উদ্দেশ্য একথা বোঝানো যে, নামায দ্বারা যেমন আলো অর্জিত হয়, তেমনি সবর বা রোযার দ্বারাও তা অর্জিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে নামায-রোযার পরিপূর্ণ আলো দান করুন- আমীন।

কুরআন দীনের প্রধানতম দলীল
তারপর ইরশাদ হয়েছে 'কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলীল'। অর্থাৎ তুমি যদি কুরআনের আদেশ-নিষেধ মেনে চল, তবে কবরে, মীযানে ও পুলসিরাতে যেখানেই তুমি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেখানেই তুমি কুরআন দ্বারা প্রমাণ পেশ করতে পারবে; বরং কুরআনই তোমার পক্ষে প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে এবং সাক্ষ্য দেবে যে, তুমি তার নির্দেশনা মেনে চলেছ। পক্ষান্তরে তুমি যদি তার আদেশ-নিষেধ অমান্য কর, তবে কুরআন তোমার বিপক্ষে প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে। হযরত ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, কুরআন সুপারিশকারী হবে এবং তার সুপারিশ গৃহীত হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে তার সামনে রেখেছে (অর্থাৎ সে কুরআনের অনুসরণ করেছে), কুরআন তাকে জান্নাতে টেনে নিয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআনকে তার পেছনে রেখেছে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
অথবা এর ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, দীনী বিষয়ে যদি কারও সংগে তোমার বিতর্ক হয়, তুমি একরকম দাবি কর আর সে তোমার বিপরীত দাবি করে, তবে বিষয়টিকে কুরআনের সামনে পেশ করবে। কুরআন যার দাবি সমর্থন করবে, তার দাবিই সত্য- সঠিক বলে সাব্যস্ত হবে। সে ক্ষেত্রে কুরআনের ফয়সালা তোমার পক্ষেও হতে পারে, তোমার বিপক্ষেও হতে পারে। তা পক্ষে হোক বা বিপক্ষে, সর্বাবস্থায় কুরআনের ফয়সালা মেনে নেওয়াই জরুরি, যেমন ইরশাদ হয়েছে-

فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ

অর্থ : অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনও বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তোমরা আল্লাহ ও পরকালে সত্যিকারের বিশ্বাসী হয়ে থাকলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসূলের উপর ন্যস্ত কর।- নিসাঃ৫৯

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পবিত্রতা যেহেতু ঈমানের অর্ধেক, তাই সর্বদা এ ব্যাপারে যত্নবান থাকা উচিত । উভয় রকমের পবিত্রতা। অর্থাৎ ওযূ-গোসলের মাধ্যমে শারীরিক পবিত্রতা এবং পাপাচার বর্জনের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা।

খ. এ হাদীছ দ্বারা হামদ ও তাসবীহের যে ফযীলত জানা গেল, তা অর্জনের লক্ষ্যে অবসর সময়ে এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব যিকরে রত থাকা উচিত।

গ. নামাযকে নূর, যাকাতকে ঈমানের প্রমাণ এবং সবরকে যে আলো বলা হয়েছে, দুনিয়া ও আখিরাতে তা পুরোপুরি অর্জনের লক্ষ্যে ঈমানদারের কর্তব্য এ সকল ইবাদতের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।

ঘ. কুরআন পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ হবে। অতি বড় আশা এবং অনেক বড় ভয়ের কথা। কাজেই আখিরাতে যাতে কুরআনের সুপারিশ লাভ করতে পারি, কুরআন আমাদের বিপক্ষে সাক্ষী হয়ে না দাঁড়ায়, সে লক্ষ্যে কর্তব্য নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা এবং কুরআনের হিদায়াত শক্তভাবে আকড়ে ধরা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
সুনানে নাসায়ী - হাদীস নং ২৪৩৭ | মুসলিম বাংলা