কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
২১. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়
হাদীস নং: ১৮৬৮
আন্তর্জাতিক নং: ১৮৬৮
বিপদের সময় সাওয়াবের নিয়তে ধৈর্যধারণ করার আদেশ
১৮৭১। সুওয়ায়দ ইবনে নসর (রাহঃ) ......... উসামা ইবনে যায়দ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) এর কন্যা তার কাছে সংবাদ পৌছালেন যে, আমার এক ছেলে মৃত্যু শয্যায় শায়িত। অতএব আপনি আমাদের এখানে আসুন। তখন তিনি সালাম পাঠিয়ে বললেন, আল্লাহ তাআলা যা নিয়ে যান তা তারই এবং যা দান করেন তাও তারই। আর প্রতিটি বস্তু নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর কাছে পৌছে যায়। অতএব, তুমি ধৈর্যধারণ কর এবং সাওয়াবের আশা রাখ। অতঃপর তিনি কসম দিয়ে তার কাছে পাঠালেন যেন তিনি তার কাছে অবশ্যই আসেন।
তখন তিনি দাড়ালেন; তার সাথে সা’দ ইবনে উবাদাহ (রাযিঃ), মু’আয ইবনে জাবাল (রাযিঃ), উবাই ইবনে ক’ব (রাযিঃ), যায়দ ইবনে সাবিত (রাযিঃ) এবং আরো কিছু লোক ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সামনে ছেলেকে উঠালেন তখন তার হদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এতদদর্শনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর চক্ষুদ্বয় অশ্রু বর্ষন করতে লাগল। তখন সাদ (রাযিঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ কি? তিনি বললেন, এ হল রহমত বিশেষ যা আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের হৃদয়ে রেখে থাকেন। আর আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের মধ্যে দয়াবানদের উপর দয়া করে থাকেন।
তখন তিনি দাড়ালেন; তার সাথে সা’দ ইবনে উবাদাহ (রাযিঃ), মু’আয ইবনে জাবাল (রাযিঃ), উবাই ইবনে ক’ব (রাযিঃ), যায়দ ইবনে সাবিত (রাযিঃ) এবং আরো কিছু লোক ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সামনে ছেলেকে উঠালেন তখন তার হদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এতদদর্শনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর চক্ষুদ্বয় অশ্রু বর্ষন করতে লাগল। তখন সাদ (রাযিঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ কি? তিনি বললেন, এ হল রহমত বিশেষ যা আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের হৃদয়ে রেখে থাকেন। আর আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের মধ্যে দয়াবানদের উপর দয়া করে থাকেন।
باب الأَمْرِ بِالاِحْتِسَابِ وَالصَّبْرِ عِنْدَ نُزُولِ الْمُصِيبَةِ
أَخْبَرَنَا سُوَيْدُ بْنُ نَصْرٍ، قَالَ أَنْبَأَنَا عَبْدُ اللَّهِ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ سُلَيْمَانَ، عَنْ أَبِي عُثْمَانَ، قَالَ حَدَّثَنِي أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ، قَالَ أَرْسَلَتْ بِنْتُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم إِلَيْهِ أَنَّ ابْنًا لِي قُبِضَ فَأْتِنَا . فَأَرْسَلَ يَقْرَأُ السَّلاَمَ وَيَقُولُ " إِنَّ لِلَّهِ مَا أَخَذَ وَلَهُ مَا أَعْطَى وَكُلُّ شَىْءٍ عِنْدَ اللَّهِ بِأَجَلٍ مُسَمًّى فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ " . فَأَرْسَلَتْ إِلَيْهِ تُقْسِمُ عَلَيْهِ لَيَأْتِيَنَّهَا فَقَامَ وَمَعَهُ سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ وَمُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ وَأُبَىُّ بْنُ كَعْبٍ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَرِجَالٌ فَرُفِعَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الصَّبِيُّ وَنَفْسُهُ تَقَعْقَعُ فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ فَقَالَ سَعْدٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذَا قَالَ " هَذَا رَحْمَةٌ يَجْعَلُهَا اللَّهُ فِي قُلُوبِ عِبَادِهِ وَإِنَّمَا يَرْحَمُ اللَّهُ مِنْ عِبَادِهِ الرُّحَمَاءَ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক কন্যার পুত্র মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন। কোন কন্যার পুত্র, তা বলা হয়নি। তাঁর কন্যাসন্তান ছিলেন চারজন। তারা হলেন যথাক্রমে যায়নাব রাযি., রুকাইয়া রাযি. উম্মু কুলসুম রাযি. ও ফাতিমা রাযি.। কোনও কোনও বর্ণনায় হযরত যায়নাব রাযি.-এর কথা বলা হয়েছে। হযরত যায়নাব রাযি.-এর স্বামী ছিলেন আবুল-'আস ইবনুর রাবী' রাযি.। ‘আলী ও আবূ উমামা নামে তাঁদের এক পুত্র ও কন্যাসন্তান ছিল। খুব সম্ভব তাঁদের পুত্র ‘আলী রাযি. মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে অনুরোধ করা হয়েছিল। অপরাপর বর্ণনাদৃষ্টে হাফেজ ইবন হাজার ‘আসকালানী রহ.-এর মতে অসুস্থ ছিলেন হযরত উমামা রাযি.। এ বর্ণনায় পুত্রসন্তানের কথা থাকলেও কোনও কোনও বর্ণনায় শিশুকন্যার উল্লেখ আছে। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় স্পষ্টভাবেই যায়নাব রাযি.-এর কন্যা উমামা রাযি.-এর নাম বলা হয়েছে। এক বর্ণনায় আছে, হযরত উছমান রাযি. ও নবীকন্যা হযরত রুকাইয়া রাযি.-এর পুত্র আব্দুল্লাহ রাযি. শৈশবে মারা গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তখন তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ তা'আলা তাঁর দয়ালু বান্দাদের প্রতি দয়া করে থাকেন। আবার অন্য এক বর্ণনায় হযরত ফাতিমা রাযি.-এর পুত্র মুহাসান ইবন 'আলী রাযি. অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। অসম্ভব নয় ঘটনা একাধিকবার ঘটেছিল। অথবা সঠিক এটাই যে, হযরত উমামা রাযি.-ই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেজন্যে তাঁর মা যায়নাব রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে বলেছিলেন। বর্ণনায় যে পুত্রের কথা বলা হয়েছে, তা হয়তো কোনও বর্ণনাকারীর ভুল।
হযরত যায়নাব রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে অনুরোধ করেছিলেন সম্ভবত এই আশায় যে, হয়তো তাঁর উপস্থিতি ও দু'আর বরকতে আল্লাহ তা'আলা তাকে আরোগ্য দান করবেন। তাছাড়া পিতানবী কাছে থাকলে তিনি মনে শক্তি ও সাহস পাবেন।
কিন্তু প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন না। বরং সবরের উপদেশ দিয়ে পাঠালেন। তাঁর যাতে সবর করা সহজ হয় সেজন্যে বললেন, আল্লাহ তা'আলা যা নিয়ে যান তার মালিক তো তিনিই এবং তিনি যাকে যা দেন নিজ মালিকানা থেকেই দেন। যাকে দেন তার কাছে তা আমানতমাত্র। আমানতের মাল যদি মালিক নিয়ে যান, তাতে দুঃখিত হওয়া উচিত নয়। বরং এই ভেবে সান্ত্বনা বোধ করা উচিত যে, এই সম্পদের তো আমি মালিক ছিলাম না। আল্লাহ তা'আলাই মেহেরবানী করে আমাকে দান করেছিলেন। আমার কাছে যতদিন ছিল আমানতস্বরূপ ছিল। এখন সে সম্পদ তাঁর প্রকৃত মালিকের কাছেই ফিরে গেছে। তা নষ্ট হয়নি বা হারিয়েও যায়নি। কতদিন আমার কাছে তা থাকবে তাও তিনি স্থির করে রেখেছিলেন। সেই স্থিরীকৃত সময়েই তিনি তা নিয়ে নিয়েছেন। কাজেই তার এ যাওয়া অসময়ে যাওয়া নয়, সঠিক সময়েই আপন মালিকের কাছে চলে গেছে। এভাবে চিন্তা করলে সম্পদ ও সন্তান হারানোর কারণে অন্তরে অস্থিরতা থাকে না; বরং সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভ হয় এবং সবরের কারণে ছওয়াবও পাওয়া যায়। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যাকে সেই ছওয়াব লাভের আশায় ধৈর্যধারণের উপদেশ দান করেছেন।
প্রিয় কন্যা যায়নাব রাযি, তাঁর এ উপদেশ অবশ্যই গ্রহণ করেছিলেন এবং নিশ্চয়ই ধৈর্যও ধারণ করেছিলেন। তারপরও তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এবং তিনি যেন অবশ্যই আসেন, কসমের সাথে সেই অনুরোধ জানান। এর কারণ সম্ভবত যেমনটা বলা হয়েছে তাঁর আগমন দ্বারা মনে শক্তি পাওয়া এবং তাঁর দু'আর বরকতে সন্তানের সুস্থ হয়ে উঠার আশা থাকা। এরূপ আশা করা সবরের পরিপন্থী নয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সে আশা পূরণও করেছিলেন। হযরত উমামা রাযি. আরোগ্য লাভ করেন। এমনকি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও তিনি জীবিত থাকেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী ছিলেন। তিনি তাঁকে কোলে নিয়ে নামাযও পড়তেন। হযরত ফাতিমা রাযি.-এর ওফাতের পর তাঁরই অসিয়ত হযরত আলী রাযি. তাঁকে বিবাহ করেন। হযরত আলী রাযি. শহীদ হওয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন। আহত অবস্থায় হযরত আলী রাযি. অসিয়ত করেছিলেন, তিনি বিবাহ করতে চাইলে যেন মুগীরা ইবন নাওফাল রাযি.-কে করেন। মুগীরা রাযি. ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হারিছের পুত্র। অসিয়ত অনুযায়ী হযরত মুগীরা রাযি.-এর সাথে হযরত হাসান রাযি, তাঁর বিবাহ সম্পাদন করেন। মুগীরা রাযি.-এর ঔরসে তিনি এক পুত্রসন্তান জন্ম দেন। তাঁর নাম ইয়াহইয়া। তাঁর বিবাহাধীন থাকা অবস্থায়ই হযরত উমামা রাযি, ইন্তিকাল করেন।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাহাবীকে সংগে নিয়ে হযরত যায়নাব রাযি.-এর বাড়িতে আসলেন। অসুস্থ শিশুকে তাঁর কোলে তুলে দেওয়া হল। শিশুটির মুমূর্ষু অবস্থা। নিঃশ্বাস চড়ে গিয়েছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মমতাময় প্রাণ বিগলিত হল। আদরের নাতনীর কষ্টে তাঁরও মন কষ্টে ভরে গেল। তাঁর থেকে পানি ঝরতে লাগল।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোকে-দুঃখে সবর করতে বলতেন। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তিনি কাঁদতে নিষেধ করেছেন। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে তিনি নিজেই কাঁদছেন। এতে হযরত সা'দ ইবন ‘উবাদা রাযি.-এর মনে খটকা জাগল। তাই তিনি প্রশ্নই করে বসলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে কাঁদছেন? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, এ কান্না হল রহমত ও দয়ার প্রকাশ, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানবমনে যেহেতু সৃষ্টিগতভাবেই দয়া মায়া আছে, তাই শোকে-দুঃখে কাঁদা স্বাভাবিক। এ কান্না সে দয়া-মায়ারই প্রকাশ। এতে কোনও দোষ নেই এবং এটা সবরেরও পরিপন্থী নয়। দোষ হচ্ছে বিলাপ করা ও সীমালংঘন করা। বুক চাপড়ানো, জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, নিয়তিকে গালমন্দ করা ইত্যাদি কাজগুলোই সীমালংঘন ও সবরের পরিপন্থী। এসব না করে যদি কেউ ব্যথিতের বেদনায় অশ্রু প্রবাহিত করে, সেটা দোষের তো নয়ই; বরং প্রসংশনীয় কাজ হবে। কেননা অন্যের বেদনায় ব্যথিত হওয়া আল্লাহর কাছে পসন্দনীয়, যেমন এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাঁর ওই বান্দাদের প্রতি দয়া করেন, যারা অন্যের প্রতি দয়াশীল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় বুযুর্গানে দীনের উপস্থিতির বরকত ও তাদের দুয়া লাভের জন্যে মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট নিয়ে আসা ভালো। তাদের কষ্ট না হলে। এজন্য তাদেরকে পীড়াপীড়ি করারও অবকাশ আছে।
খ. অসুস্থ ও শোকার্ত ব্যক্তিকে দেখার জন্যে অনুমতি ছাড়াও যাওয়া জায়েয আছে। এ ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে যারা ছিলেন, তারা অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন।
গ. বিপন্ন ও শোকার্ত ব্যক্তিকে সবরের উপদেশ দেওয়া উচিত। সবর করলে কী লাভ তাও শোনানো চাই।
ঘ. কাউকে নিজ বাড়িতে আসার আহ্বান জানালে কী উদ্দেশ্যে তাকে আসতে বলা হচ্ছে, তা জানানো উচিত।
ঙ. কথা বলার আগে সালাম দেওয়া কর্তব্য।
চ. বড় ব্যক্তির কোনও কাজে মনে খটকা জাগলে সেই খটকা দূর করার লক্ষ্যে ছোটর উচিত সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা।
ছ. অসুস্থ ব্যক্তি ছোট বা অধীনস্থ হলেও তাকে দেখতে যাওয়া উচিত।
জ. শোকে-দুঃখে সীমার ভেতর কান্নাকাটি করা দূষণীয় নয়।
ঝ. অন্যের দুঃখে-কষ্টে সমবেদনা প্রকাশ করা প্রসংশনীয় কাজ।
এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে তা উপলব্ধি করা যায়।
হযরত যায়নাব রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসতে অনুরোধ করেছিলেন সম্ভবত এই আশায় যে, হয়তো তাঁর উপস্থিতি ও দু'আর বরকতে আল্লাহ তা'আলা তাকে আরোগ্য দান করবেন। তাছাড়া পিতানবী কাছে থাকলে তিনি মনে শক্তি ও সাহস পাবেন।
কিন্তু প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন না। বরং সবরের উপদেশ দিয়ে পাঠালেন। তাঁর যাতে সবর করা সহজ হয় সেজন্যে বললেন, আল্লাহ তা'আলা যা নিয়ে যান তার মালিক তো তিনিই এবং তিনি যাকে যা দেন নিজ মালিকানা থেকেই দেন। যাকে দেন তার কাছে তা আমানতমাত্র। আমানতের মাল যদি মালিক নিয়ে যান, তাতে দুঃখিত হওয়া উচিত নয়। বরং এই ভেবে সান্ত্বনা বোধ করা উচিত যে, এই সম্পদের তো আমি মালিক ছিলাম না। আল্লাহ তা'আলাই মেহেরবানী করে আমাকে দান করেছিলেন। আমার কাছে যতদিন ছিল আমানতস্বরূপ ছিল। এখন সে সম্পদ তাঁর প্রকৃত মালিকের কাছেই ফিরে গেছে। তা নষ্ট হয়নি বা হারিয়েও যায়নি। কতদিন আমার কাছে তা থাকবে তাও তিনি স্থির করে রেখেছিলেন। সেই স্থিরীকৃত সময়েই তিনি তা নিয়ে নিয়েছেন। কাজেই তার এ যাওয়া অসময়ে যাওয়া নয়, সঠিক সময়েই আপন মালিকের কাছে চলে গেছে। এভাবে চিন্তা করলে সম্পদ ও সন্তান হারানোর কারণে অন্তরে অস্থিরতা থাকে না; বরং সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভ হয় এবং সবরের কারণে ছওয়াবও পাওয়া যায়। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যাকে সেই ছওয়াব লাভের আশায় ধৈর্যধারণের উপদেশ দান করেছেন।
প্রিয় কন্যা যায়নাব রাযি, তাঁর এ উপদেশ অবশ্যই গ্রহণ করেছিলেন এবং নিশ্চয়ই ধৈর্যও ধারণ করেছিলেন। তারপরও তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এবং তিনি যেন অবশ্যই আসেন, কসমের সাথে সেই অনুরোধ জানান। এর কারণ সম্ভবত যেমনটা বলা হয়েছে তাঁর আগমন দ্বারা মনে শক্তি পাওয়া এবং তাঁর দু'আর বরকতে সন্তানের সুস্থ হয়ে উঠার আশা থাকা। এরূপ আশা করা সবরের পরিপন্থী নয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সে আশা পূরণও করেছিলেন। হযরত উমামা রাযি. আরোগ্য লাভ করেন। এমনকি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও তিনি জীবিত থাকেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী ছিলেন। তিনি তাঁকে কোলে নিয়ে নামাযও পড়তেন। হযরত ফাতিমা রাযি.-এর ওফাতের পর তাঁরই অসিয়ত হযরত আলী রাযি. তাঁকে বিবাহ করেন। হযরত আলী রাযি. শহীদ হওয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন। আহত অবস্থায় হযরত আলী রাযি. অসিয়ত করেছিলেন, তিনি বিবাহ করতে চাইলে যেন মুগীরা ইবন নাওফাল রাযি.-কে করেন। মুগীরা রাযি. ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হারিছের পুত্র। অসিয়ত অনুযায়ী হযরত মুগীরা রাযি.-এর সাথে হযরত হাসান রাযি, তাঁর বিবাহ সম্পাদন করেন। মুগীরা রাযি.-এর ঔরসে তিনি এক পুত্রসন্তান জন্ম দেন। তাঁর নাম ইয়াহইয়া। তাঁর বিবাহাধীন থাকা অবস্থায়ই হযরত উমামা রাযি, ইন্তিকাল করেন।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাহাবীকে সংগে নিয়ে হযরত যায়নাব রাযি.-এর বাড়িতে আসলেন। অসুস্থ শিশুকে তাঁর কোলে তুলে দেওয়া হল। শিশুটির মুমূর্ষু অবস্থা। নিঃশ্বাস চড়ে গিয়েছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মমতাময় প্রাণ বিগলিত হল। আদরের নাতনীর কষ্টে তাঁরও মন কষ্টে ভরে গেল। তাঁর থেকে পানি ঝরতে লাগল।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোকে-দুঃখে সবর করতে বলতেন। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তিনি কাঁদতে নিষেধ করেছেন। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে তিনি নিজেই কাঁদছেন। এতে হযরত সা'দ ইবন ‘উবাদা রাযি.-এর মনে খটকা জাগল। তাই তিনি প্রশ্নই করে বসলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে কাঁদছেন? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, এ কান্না হল রহমত ও দয়ার প্রকাশ, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানবমনে যেহেতু সৃষ্টিগতভাবেই দয়া মায়া আছে, তাই শোকে-দুঃখে কাঁদা স্বাভাবিক। এ কান্না সে দয়া-মায়ারই প্রকাশ। এতে কোনও দোষ নেই এবং এটা সবরেরও পরিপন্থী নয়। দোষ হচ্ছে বিলাপ করা ও সীমালংঘন করা। বুক চাপড়ানো, জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, নিয়তিকে গালমন্দ করা ইত্যাদি কাজগুলোই সীমালংঘন ও সবরের পরিপন্থী। এসব না করে যদি কেউ ব্যথিতের বেদনায় অশ্রু প্রবাহিত করে, সেটা দোষের তো নয়ই; বরং প্রসংশনীয় কাজ হবে। কেননা অন্যের বেদনায় ব্যথিত হওয়া আল্লাহর কাছে পসন্দনীয়, যেমন এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাঁর ওই বান্দাদের প্রতি দয়া করেন, যারা অন্যের প্রতি দয়াশীল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় বুযুর্গানে দীনের উপস্থিতির বরকত ও তাদের দুয়া লাভের জন্যে মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট নিয়ে আসা ভালো। তাদের কষ্ট না হলে। এজন্য তাদেরকে পীড়াপীড়ি করারও অবকাশ আছে।
খ. অসুস্থ ও শোকার্ত ব্যক্তিকে দেখার জন্যে অনুমতি ছাড়াও যাওয়া জায়েয আছে। এ ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে যারা ছিলেন, তারা অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন।
গ. বিপন্ন ও শোকার্ত ব্যক্তিকে সবরের উপদেশ দেওয়া উচিত। সবর করলে কী লাভ তাও শোনানো চাই।
ঘ. কাউকে নিজ বাড়িতে আসার আহ্বান জানালে কী উদ্দেশ্যে তাকে আসতে বলা হচ্ছে, তা জানানো উচিত।
ঙ. কথা বলার আগে সালাম দেওয়া কর্তব্য।
চ. বড় ব্যক্তির কোনও কাজে মনে খটকা জাগলে সেই খটকা দূর করার লক্ষ্যে ছোটর উচিত সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা।
ছ. অসুস্থ ব্যক্তি ছোট বা অধীনস্থ হলেও তাকে দেখতে যাওয়া উচিত।
জ. শোকে-দুঃখে সীমার ভেতর কান্নাকাটি করা দূষণীয় নয়।
ঝ. অন্যের দুঃখে-কষ্টে সমবেদনা প্রকাশ করা প্রসংশনীয় কাজ।
এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে তা উপলব্ধি করা যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
