আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১- ঈমানের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২১
১৪. কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার ন্যায় অপছন্দ করা ঈমানের অঙ্গ
২০। সুলাইমান ইবনে হারব (রাহঃ) ......... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেনঃ তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে, সে ঈমানের স্বাদ পায়—(১) যার কাছে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল অন্য সব কিছু থেকে প্রিয়;
(২) যে একমাত্র আল্লাহরই জন্য কোন বান্দাকে মুহব্বত করে এবং
(৩) আল্লাহ্ তাআলা কুফর থেকে মুক্তি দেওয়ার পর যে কুফর-এ ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতোই অপছন্দ করে।
(২) যে একমাত্র আল্লাহরই জন্য কোন বান্দাকে মুহব্বত করে এবং
(৩) আল্লাহ্ তাআলা কুফর থেকে মুক্তি দেওয়ার পর যে কুফর-এ ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতোই অপছন্দ করে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ইবাদত-আনুগত্যে মজা পাওয়া, দীনের জন্য কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করতে প্রস্তুত থাকা এবং দুনিয়ার ধন-সম্পদের উপর দীনদারীকে প্রাধান্য দিতে পারা। কারও মধ্যে তিনটি গুণ থাকলে ঈমানের এ স্বাদ ও মিষ্টতা সে অনুভব করতে পারে। অর্থাৎ ঈমানের স্বাদ পেতে চাইলে এ তিনটি গুণের অধিকারী হওয়া শর্ত।
ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য প্রথম গুণ
তার মধ্যে প্রথম গুণ হলো-
أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما
(আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বেশি প্রিয় হওয়া তাঁদের ছাড়া আর সবকিছু অপেক্ষা)। আল্লাহ তাআলাকে প্রিয় জানা ও তাঁকে ভালোবাসার দাবি হলো তাঁর যাবতীয় আদেশ মেনে চলা, তিনি যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, তাঁর নির্ধারিত তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা এবং তাঁর পসন্দ ও অপসন্দকে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও ভালোবাসার দাবি হলো দীনের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও শরীআতের যাবতীয় শিক্ষা তাঁর থেকেই গ্রহণ করা, তিনি যে পথ দেখিয়েছেন কেবল সে পথেই চলা, যাবতীয় কাজে তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা, দান-খয়রাত, ত্যাগ ও কুরবানী, বিনয়, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, সৎসাহস প্রভৃতি সদগুণে তিনি ভূষিত ছিলেন, অনুরূপ গুণাবলী আত্মস্থ করতে সচেষ্ট থাকা।
ইশক ও মহব্বতের এ দাবি পূরণে যে যতবেশি সচেষ্ট থাকবে, তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতও ততবেশি বদ্ধমূল হবে। এরূপ ব্যক্তি যে-কোনও ত্যাগ ও যে-কোনও মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার ফরমাবরদারি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সবকিছু খুশিমনে পরিহার করতে প্রস্তুত থাকে। তার সম্পর্কেই বলা যায় যে, সে অন্য সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই বেশি ভালোবাসে।
অনেকে বলেন, এ ভালোবাসা দ্বারা 'আকলী' বা যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক ভালোবাসা বোঝানো উদ্দেশ্য। এর অর্থ সুষ্ঠু ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির দাবিকে প্রাধান্য দেওয়া, যদিও তা নিজ খেয়াল-খুশির বিরোধী হয়। যেমন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে ঔষধ খেতে ভালো লাগে না, তা সত্ত্বেও সে বিবেক-বুদ্ধির দাবিতে তা খেয়ে নেয়। ঠিক এরকমই কেউ যখন চিন্তা করবে যে, শরীআতদাতা কেবল এমন কাজেরই আদেশ-নিষেধ করতে পারেন, যাতে মানুষের দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের নাজাত লাভ হয়, আর সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি তো তাই কামনা করে, তখন সে নিজের নফস ও খেয়াল-খুশির বিপরীতে শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানাকেই প্রাধান্য দেয়। একপর্যায়ে তার নফস ও খেয়াল-খুশি তার বশীভূত হয়ে যায়। তখন সে শরীআতপালনে মানসিক তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে। সেই মানসিক তৃপ্তি ও আনন্দের অনুভবকেই 'ঈমানের স্বাদ পাওয়া' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীআত পালন করাকে সুমিষ্ট ফলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তারপর ফল খেলে যে মিষ্টতা অনুভব হয়, তাকে শরীআত পালনজনিত আনন্দ বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু সুফী-সাধকগণ এ স্বাদ ও মিষ্টতাকে কেবল আকলী ও বৌদ্ধিক নয়; বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও মনে করে থাকেন। তাদের মতে স্বাদ ও মিষ্টতা দ্বারা স্বাভাবিকভাবে যেহেতু বাহ্যিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্বাদ-মিষ্টতা বোঝানো হয়ে থাকে, তাই হাদীছে শব্দটিকে সে অর্থেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ না হলেও সূফী সাধকগণ তা ঠিকই উপলব্ধি করে থাকেন। সুতরাং জুনায়দ বাগদাদী রহ. বলেন, রাত্রি জাগরণকারীগণ রাত জেগে যে মজা পান তা খেলোয়াড়দের খেলাধুলার মজার চেয়ে অনেক বেশি।
ইবরাহীম ইবন আদহাম রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা যে স্বাদ ও মজার মধ্যে আছি, রাজা-বাদশারা তা জানতে পারলে তরবারির জোরে আমাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নিতে চাইত। এ সম্পর্কিত একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এক ঘাঁটিতে পাহারাদারিতে নিযুক্ত দুই সাহাবীর ঘটনা।
দুই সাহাবীর ঈমানোদ্দীপক ঘটনা
যাতুর রিকা যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক গিরিপথে যাত্রা বিরতি দেন। এ সময় হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইবন বিশর রাযি.- এ দু'জনকে পাহারায় নিযুক্ত করেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথমার্ধে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. জেগে থাকবেন এবং শেষার্ধে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. তাঁর নিজের পালায় নামাযে রত ছিলেন। এ অবস্থায় এক কাফের তাঁকে লক্ষ্য করে তির ছুঁড়ল এবং তা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হলো। তিনি সেটি বের করে ফেলে দিলেন, কিন্তু নামায় ছাড়লেন না। সে আবার তির মারল। এভাবে পরপর তিনটি। কিন্তু তিনি নামাযে অবিচল থাকলেন। নামায শেষ হওয়ার পর তিনি সঙ্গীকে জাগালেন এবং অবস্থা বিবৃত করলেন। ইতোমধ্যে শত্রু পালিয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। হযরত আম্মার রাযি. সঙ্গীর রক্ত দেখে আঁতকে উঠলেন। বললেন, সুবহানাল্লাহ! আপনি প্রথমবারেই আমাকে জাগালেন না কেন? তিনি বলেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পাহারাদারিতে নিযুক্ত করেছেন তাতে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা না থাকলে লোকটা আমার জান নিয়ে নিত, তবুও আমি তিলাওয়াত বন্ধ করতাম না।
এই যে কুরআন তিলাওয়াতের মজার কাছে জখমের কষ্ট তুচ্ছ হয়ে গেল, এটা কি কেবলই বৌদ্ধিক আস্বাদ?
আরেক সাহাবী রাতের বেলা নামাযরত ছিলেন। এ অবস্থায় এক চোর তার ঘোড়াটি নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে ফেলা সত্ত্বেও তিনি নামায় ছাড়েননি। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, আমি যাতে ব্যস্ত ছিলাম তার স্বাদ আরও বেশি ছিল। বলাবাহুল্য এ স্বাদ কেবলই বুদ্ধিগত হলে তিনি ঘোড়া হারানোর উপর তাকে প্রাধান্য দিতে পারতেন না।
ঈমান আনার অপরাধে হযরত বিলাল রাযি.-কে উত্তপ্ত বালুর উপর পাথরচাপা দিয়ে ফেলে রাখা হতো। এ অবস্থায় তিনি 'আহাদ আহাদ' জপতে থাকতেন। তা ঈমানের কী আস্বাদ পেয়েছিলেন, যার সামনে জানের এ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল?
সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহওয়ালাদের এরকম হাজারও ঘটনা আছে, যা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় ঈমান ও ইবাদতের স্বাদ তারা বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারাই অনুভব করতেন। ফলে এর বিপরীতে কঠিন থেকে কঠিনতর দুঃখ-কষ্ট তারা হাসিমুখে বরণ করে নিতেন। তাদের মত গভীর ঈমানের অধিকারী নই বলে আমরা ঈমানের সে ইন্দ্ৰিয়গত সুখ অনুভব করতে পারি না এবং সে সুখ কী রকম হতে পারে তা বোঝার মত ক্ষমতাও আমরা রাখি না। কিন্তু তাই বলে যে সূফী-সাধকগণ বাস্তবিকভাবেই তা অনুভব করতেন, তাদের অভিজ্ঞতা তো আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমি ঈদের চাঁদ দেখতে পারিনি বলে অন্যদের দেখাকে কি অস্বীকার করব?
ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য দ্বিতীয় গুণ
দ্বিতীয় গুণ হলো وان يحب المرء لا يحبه الا لله (কোনও ব্যক্তিকে কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই ভালোবাসা)। যারা সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিক, তারা কাউকে ভালোবাসলে সে ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই হয়। বরং সে ভালোবাসা আল্লাহপ্রেমেরই ফলস্বরূপ। কেউ কাউকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসলে সে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসতে থাকে। বন্ধুর বন্ধুজনও বন্ধু হয়ে যায়। বাকিয়্যাহ ইবনুল ওয়ালীদ রহ. বলেন, কোনও মুমিন যখন অপর মুমিনকে ভালোবেসে ফেলে, তখন সে তার কুকুরটিকেও ভালোবাসে। আশেক-প্রেমিকদের দেখা যায় তারা তাদের প্রিয়জনের মহল্লা, ঘরবাড়ি ও প্রতিবেশীদেরও মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখে। বনু আমিরের বিখ্যাত আশেক কায়স ওরফে মজনূর কবিতায় আছে
أمر على الديار ديار ليلى
أقبل ذا الجدار وذا الجدارا
وما حب الديار شغفن قلبي
ولكن حب من سكن الديارا
'আমি লায়লার বাসভূমির উপর দিয়ে যাই
আর এ দেওয়ালে ওই দেওয়ালে চুমু খাই।
ঘরবাড়ির প্রেম আমার হৃদয় কাড়েনি মোটে;
এ কেবল তারই প্রেম করত বসত যে জন তাতে।
আল্লাহপ্রেমও এ রকমই। অন্তরে যখন তা প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তার আবেগ উচ্ছ্বাস সমগ্র মাখলূকের উপর ছাপিয়ে যায়। কেননা সমস্ত মাখলূক তাঁর কুদরতেরই প্রকাশ। সবকিছুতেই তাঁর ইলম ও হিকমতের ছাপ। আল্লাহপ্রেমিকের চোখে সে ছাপ ও প্রকাশই ধরা পড়ে। হৃদয়মন দিয়ে তাতে সে তার মাহবূবের স্পর্শ অনুভব করে। অমনি জাগে ইশক ও মহব্বতের কলরোল। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যখনই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনও নতুন ফল আনা হত, তিনি তা চোখেমুখে লাগাতেন আর বলতেন, আমার রব্বের কাছ থেকে এটি তাজা তাজা এসেছে। বৃষ্টি নামলেই তিনি কাপড় গুটিয়ে পবিত্র দেহে তা লাগাতেন। বলতেন, এ ফোঁটাগুলো সদ্য আমার রব্বের কাছ থেকে আসল। অর্থাৎ কোনও পাপী হাত এ পানি স্পর্শ করেনি। যে মাটিতে গায়রুল্লাহ'র পূজা করা হয়, তার ছোঁয়ায় এখনও এ পানি মলিন হয়নি। এসব ছিল তাঁর গভীর আল্লাহপ্রেমের প্রকাশ। এভাবেই আল্লাহপ্রেম যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন মাহবুব ও মা'শূকের সঙ্গে যা-কিছুরই সম্পর্ক আছে, সে সবকিছুতেই ওই প্রেমের স্রোত ধাবিত হয়। এমনকি তা ধাবিত হয় অপ্রিয় ও কষ্টদায়ক বস্তুতেও। কিন্তু আল্লাহপ্রেমের উচ্ছ্বাসে তার কষ্ট ও অপ্রিয়তা ম্লান হয়ে যায়। এমনকি কখনও কখনও তা অনুভব পর্যন্ত করা যায় না।
মোটকথা প্রবল আল্লাহপ্রেমের ফলে আল্লাহপ্রেমিক আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসে। সে ভালোবাসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীকারীদের, আল্লাহর দীন প্রচারকদের, উলামা ও মাশায়েখদের। সে ভালোবাসে আল্লাহর পসন্দনীয় আমল আখলাক। সে ওই আমল-আখলাক আত্মস্থ করতে সচেষ্ট হয়।
ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য তৃতীয় গুণ
আর তৃতীয় গুণ হলো-
وأن يكره ان يعود في الكفر بعد أن أنقذه الله منه ، كما يكره أن يقذف في النار
(আল্লাহ তা'আলা কাউকে কুফর থেকে মুক্তিদানের পর তার সেদিকে ফিরে যাওয়াটা এমন অপসন্দ করা যেমনটা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে)। 'কুফর থেকে মুক্তিদান' কথাটি ব্যাপক অর্থে বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি আগে কাফের ও মুশরিক ছিল, তাকে ঈমান ও ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দেওয়া যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি যে ব্যক্তি আগে কখনও কাফের-মুশরিক ছিল না, তার জন্মই হয়েছে মুসলিম বাবা-মায়ের ঘরে, তারপর সে ঈমান ও ইসলামকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে, কখনও তা থেকে বিচ্যুত হয়নি, সেও এর শামিল। কুফরী পরিবেশে জন্ম না দেওয়া ও দীনের উপর অবিচলিত রাখাটাও কুফর থেকে মুক্তিদানই বটে। এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া'-এর অর্থ হবে কাফের হয়ে যাওয়া।
তো কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া বা কাফের হয়ে যাওয়াকে যে মুমিন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপসন্দ করবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হবে। ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন, এর দ্বারা বোঝা যায়, যাকে কুফরী বাক্য বলতে বাধ্য করা হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তা না বলে, এমনকি অন্তরে ঈমান ধারণ করেও মুখে কৃত্রিমভাবে সে বাক্য উচ্চারণে সম্মত না হয়, ফলে তাকে হত্যা করে ফেলা হয়, সে ব্যক্তি কৃত্রিমভাবে কুফরী বাক্য উচ্চারণকারী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বলাবাহুল্য, একটু চিন্তা করলেই তার উৎকৃষ্টতা উপলব্ধিও করা যায়। কেননা যে কুফরীর কারণে আখেরাতে জাহান্নামের শাস্তিভোগ অনিবার্য হয়ে যায়, সে কোনওক্রমেই মুখে তা উচ্চারণ করাকেও মেনে নিতে পারছে না। সে দুনিয়ার আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে প্রস্তুত থাকে, কিন্তু কুফরী কথার কালিমায় নিজের জবান কলঙ্কিত করতে প্রস্তুত নয়। কত উঁচু তার ঈমান, কী গভীর তার ঈমানী মূল্যবোধ!
এ তিনটি বিষয়কে ঈমানের স্বাদ অনুভব করার জন্য শর্ত সাব্যস্ত করার দ্বারা বোঝা যায়, যে ব্যক্তি এগুলো পূর্ণ করতে সক্ষম হয়, তার ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করে। কেননা কোনও ব্যক্তি যখন চিন্তা করে যে, প্রকৃত অনুগ্রহকর্তা আল্লাহ তাআলাই, তিনিই সকল ইষ্ট-অনিষ্টের মালিক, তিনি ছাড়া অন্য যে-কারও দিক থেকে কোনও উপকার বা ক্ষতির প্রকাশ লক্ষ করা যায় তা আসবাব উপকরণের বেশি কিছু নয়, মূল কর্তা আল্লাহ তাআলাই, তখন প্রকৃত মহব্বত ও ভালোবাসা সে কেবল আল্লাহ তাআলাকেই নিবেদন করতে পারে। আল্লাহ তাআলা যা ভালোবাসেন, সে কেবল তা-ই ভালোবাসে, তাছাড়া অন্যকিছু নয়। আর সে যাকে বা যা-কিছুকেই ভালোবাসে, কেবল আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে।
এমনিভাবে যখন চিন্তা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা-অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উপায় সম্পর্কে তাকে অবগত করেছেন, তাঁর গযব ও আযাব থেকে বাঁচার উপায় বাতলে দিয়েছেন, কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার শিক্ষা দান করেছেন আর এভাবে অন্য সকলের চেয়ে অনেক বড় ও অনেক বেশি উপকার তিনিই করেছেন, তখন সে আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তাঁরও প্রেমিক হয়ে ওঠে। এতে করে তার অন্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন গভীর আস্থা জন্মায় যে, সে তাঁর প্রতিটি কথা সত্য বলে বিশ্বাস করে, তাঁর প্রতিটি হুকুম মানতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
এরূপ ব্যক্তির কাছে আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি ভবিষ্যৎ-ওয়াদা ও প্রতিটি শাস্তির বাণী ঘটমান বাস্তবতা বলে মনে হয়, যেন সে তা নিজ চোখে দেখতে পায়। ইবাদত-বন্দেগী, যিকর ও তিলাওয়াত ইত্যাদিকালে মনে হয় সে জান্নাতের উদ্যানে বিরাজ করছে। এমনিভাবে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়াকে তার কাছে মনে হয় আগামীতে নয়; বরং নগদই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। ফলে কোনওক্রমেই সেদিকে সে ফিরে যেতে পারে না। বরং তার থেকে আত্মরক্ষার উপায় যে ঈমান ও সৎকর্ম, তা আঁকড়ে ধরে রাখে। বড় মজা নিয়ে সে তাতে নিয়োজিত থাকে। জান্নাতের সুখ ও আনন্দের অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল, সুমিষ্ট ফল বা সুস্বাদু খাবারের মত ঈমানেরও স্বাদ ও মিষ্টতা আছে।
খ. ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা অনুভব করতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্য সকলের ও সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে।
গ. সে-ই প্রকৃত মুমিন, যে কাউকে ভালোবাসলে আল্লাহরই জন্য ভালোবাসে এবং কাউকে ঘৃণা করলেও আল্লাহ তাআলার জন্যই ঘৃণা করে।
ঘ. প্রকৃত মুমিন কোনও অবস্থায়ই কুফর ও কুফরীকর্মের দিকে ফিরতে প্রস্তুত হয় না, এমনকি তাকে যদি অগ্নিকুণ্ডেও নিক্ষেপ করা হয়।
ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য প্রথম গুণ
তার মধ্যে প্রথম গুণ হলো-
أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما
(আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বেশি প্রিয় হওয়া তাঁদের ছাড়া আর সবকিছু অপেক্ষা)। আল্লাহ তাআলাকে প্রিয় জানা ও তাঁকে ভালোবাসার দাবি হলো তাঁর যাবতীয় আদেশ মেনে চলা, তিনি যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, তাঁর নির্ধারিত তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা এবং তাঁর পসন্দ ও অপসন্দকে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও ভালোবাসার দাবি হলো দীনের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও শরীআতের যাবতীয় শিক্ষা তাঁর থেকেই গ্রহণ করা, তিনি যে পথ দেখিয়েছেন কেবল সে পথেই চলা, যাবতীয় কাজে তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা, দান-খয়রাত, ত্যাগ ও কুরবানী, বিনয়, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, সৎসাহস প্রভৃতি সদগুণে তিনি ভূষিত ছিলেন, অনুরূপ গুণাবলী আত্মস্থ করতে সচেষ্ট থাকা।
ইশক ও মহব্বতের এ দাবি পূরণে যে যতবেশি সচেষ্ট থাকবে, তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতও ততবেশি বদ্ধমূল হবে। এরূপ ব্যক্তি যে-কোনও ত্যাগ ও যে-কোনও মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার ফরমাবরদারি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সবকিছু খুশিমনে পরিহার করতে প্রস্তুত থাকে। তার সম্পর্কেই বলা যায় যে, সে অন্য সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই বেশি ভালোবাসে।
অনেকে বলেন, এ ভালোবাসা দ্বারা 'আকলী' বা যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক ভালোবাসা বোঝানো উদ্দেশ্য। এর অর্থ সুষ্ঠু ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির দাবিকে প্রাধান্য দেওয়া, যদিও তা নিজ খেয়াল-খুশির বিরোধী হয়। যেমন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে ঔষধ খেতে ভালো লাগে না, তা সত্ত্বেও সে বিবেক-বুদ্ধির দাবিতে তা খেয়ে নেয়। ঠিক এরকমই কেউ যখন চিন্তা করবে যে, শরীআতদাতা কেবল এমন কাজেরই আদেশ-নিষেধ করতে পারেন, যাতে মানুষের দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের নাজাত লাভ হয়, আর সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি তো তাই কামনা করে, তখন সে নিজের নফস ও খেয়াল-খুশির বিপরীতে শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানাকেই প্রাধান্য দেয়। একপর্যায়ে তার নফস ও খেয়াল-খুশি তার বশীভূত হয়ে যায়। তখন সে শরীআতপালনে মানসিক তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে। সেই মানসিক তৃপ্তি ও আনন্দের অনুভবকেই 'ঈমানের স্বাদ পাওয়া' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীআত পালন করাকে সুমিষ্ট ফলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তারপর ফল খেলে যে মিষ্টতা অনুভব হয়, তাকে শরীআত পালনজনিত আনন্দ বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু সুফী-সাধকগণ এ স্বাদ ও মিষ্টতাকে কেবল আকলী ও বৌদ্ধিক নয়; বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও মনে করে থাকেন। তাদের মতে স্বাদ ও মিষ্টতা দ্বারা স্বাভাবিকভাবে যেহেতু বাহ্যিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্বাদ-মিষ্টতা বোঝানো হয়ে থাকে, তাই হাদীছে শব্দটিকে সে অর্থেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ না হলেও সূফী সাধকগণ তা ঠিকই উপলব্ধি করে থাকেন। সুতরাং জুনায়দ বাগদাদী রহ. বলেন, রাত্রি জাগরণকারীগণ রাত জেগে যে মজা পান তা খেলোয়াড়দের খেলাধুলার মজার চেয়ে অনেক বেশি।
ইবরাহীম ইবন আদহাম রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা যে স্বাদ ও মজার মধ্যে আছি, রাজা-বাদশারা তা জানতে পারলে তরবারির জোরে আমাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নিতে চাইত। এ সম্পর্কিত একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এক ঘাঁটিতে পাহারাদারিতে নিযুক্ত দুই সাহাবীর ঘটনা।
দুই সাহাবীর ঈমানোদ্দীপক ঘটনা
যাতুর রিকা যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক গিরিপথে যাত্রা বিরতি দেন। এ সময় হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইবন বিশর রাযি.- এ দু'জনকে পাহারায় নিযুক্ত করেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথমার্ধে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. জেগে থাকবেন এবং শেষার্ধে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. তাঁর নিজের পালায় নামাযে রত ছিলেন। এ অবস্থায় এক কাফের তাঁকে লক্ষ্য করে তির ছুঁড়ল এবং তা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হলো। তিনি সেটি বের করে ফেলে দিলেন, কিন্তু নামায় ছাড়লেন না। সে আবার তির মারল। এভাবে পরপর তিনটি। কিন্তু তিনি নামাযে অবিচল থাকলেন। নামায শেষ হওয়ার পর তিনি সঙ্গীকে জাগালেন এবং অবস্থা বিবৃত করলেন। ইতোমধ্যে শত্রু পালিয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। হযরত আম্মার রাযি. সঙ্গীর রক্ত দেখে আঁতকে উঠলেন। বললেন, সুবহানাল্লাহ! আপনি প্রথমবারেই আমাকে জাগালেন না কেন? তিনি বলেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পাহারাদারিতে নিযুক্ত করেছেন তাতে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা না থাকলে লোকটা আমার জান নিয়ে নিত, তবুও আমি তিলাওয়াত বন্ধ করতাম না।
এই যে কুরআন তিলাওয়াতের মজার কাছে জখমের কষ্ট তুচ্ছ হয়ে গেল, এটা কি কেবলই বৌদ্ধিক আস্বাদ?
আরেক সাহাবী রাতের বেলা নামাযরত ছিলেন। এ অবস্থায় এক চোর তার ঘোড়াটি নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে ফেলা সত্ত্বেও তিনি নামায় ছাড়েননি। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, আমি যাতে ব্যস্ত ছিলাম তার স্বাদ আরও বেশি ছিল। বলাবাহুল্য এ স্বাদ কেবলই বুদ্ধিগত হলে তিনি ঘোড়া হারানোর উপর তাকে প্রাধান্য দিতে পারতেন না।
ঈমান আনার অপরাধে হযরত বিলাল রাযি.-কে উত্তপ্ত বালুর উপর পাথরচাপা দিয়ে ফেলে রাখা হতো। এ অবস্থায় তিনি 'আহাদ আহাদ' জপতে থাকতেন। তা ঈমানের কী আস্বাদ পেয়েছিলেন, যার সামনে জানের এ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল?
সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহওয়ালাদের এরকম হাজারও ঘটনা আছে, যা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় ঈমান ও ইবাদতের স্বাদ তারা বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারাই অনুভব করতেন। ফলে এর বিপরীতে কঠিন থেকে কঠিনতর দুঃখ-কষ্ট তারা হাসিমুখে বরণ করে নিতেন। তাদের মত গভীর ঈমানের অধিকারী নই বলে আমরা ঈমানের সে ইন্দ্ৰিয়গত সুখ অনুভব করতে পারি না এবং সে সুখ কী রকম হতে পারে তা বোঝার মত ক্ষমতাও আমরা রাখি না। কিন্তু তাই বলে যে সূফী-সাধকগণ বাস্তবিকভাবেই তা অনুভব করতেন, তাদের অভিজ্ঞতা তো আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমি ঈদের চাঁদ দেখতে পারিনি বলে অন্যদের দেখাকে কি অস্বীকার করব?
ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য দ্বিতীয় গুণ
দ্বিতীয় গুণ হলো وان يحب المرء لا يحبه الا لله (কোনও ব্যক্তিকে কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই ভালোবাসা)। যারা সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিক, তারা কাউকে ভালোবাসলে সে ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই হয়। বরং সে ভালোবাসা আল্লাহপ্রেমেরই ফলস্বরূপ। কেউ কাউকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসলে সে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসতে থাকে। বন্ধুর বন্ধুজনও বন্ধু হয়ে যায়। বাকিয়্যাহ ইবনুল ওয়ালীদ রহ. বলেন, কোনও মুমিন যখন অপর মুমিনকে ভালোবেসে ফেলে, তখন সে তার কুকুরটিকেও ভালোবাসে। আশেক-প্রেমিকদের দেখা যায় তারা তাদের প্রিয়জনের মহল্লা, ঘরবাড়ি ও প্রতিবেশীদেরও মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখে। বনু আমিরের বিখ্যাত আশেক কায়স ওরফে মজনূর কবিতায় আছে
أمر على الديار ديار ليلى
أقبل ذا الجدار وذا الجدارا
وما حب الديار شغفن قلبي
ولكن حب من سكن الديارا
'আমি লায়লার বাসভূমির উপর দিয়ে যাই
আর এ দেওয়ালে ওই দেওয়ালে চুমু খাই।
ঘরবাড়ির প্রেম আমার হৃদয় কাড়েনি মোটে;
এ কেবল তারই প্রেম করত বসত যে জন তাতে।
আল্লাহপ্রেমও এ রকমই। অন্তরে যখন তা প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তার আবেগ উচ্ছ্বাস সমগ্র মাখলূকের উপর ছাপিয়ে যায়। কেননা সমস্ত মাখলূক তাঁর কুদরতেরই প্রকাশ। সবকিছুতেই তাঁর ইলম ও হিকমতের ছাপ। আল্লাহপ্রেমিকের চোখে সে ছাপ ও প্রকাশই ধরা পড়ে। হৃদয়মন দিয়ে তাতে সে তার মাহবূবের স্পর্শ অনুভব করে। অমনি জাগে ইশক ও মহব্বতের কলরোল। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যখনই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনও নতুন ফল আনা হত, তিনি তা চোখেমুখে লাগাতেন আর বলতেন, আমার রব্বের কাছ থেকে এটি তাজা তাজা এসেছে। বৃষ্টি নামলেই তিনি কাপড় গুটিয়ে পবিত্র দেহে তা লাগাতেন। বলতেন, এ ফোঁটাগুলো সদ্য আমার রব্বের কাছ থেকে আসল। অর্থাৎ কোনও পাপী হাত এ পানি স্পর্শ করেনি। যে মাটিতে গায়রুল্লাহ'র পূজা করা হয়, তার ছোঁয়ায় এখনও এ পানি মলিন হয়নি। এসব ছিল তাঁর গভীর আল্লাহপ্রেমের প্রকাশ। এভাবেই আল্লাহপ্রেম যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন মাহবুব ও মা'শূকের সঙ্গে যা-কিছুরই সম্পর্ক আছে, সে সবকিছুতেই ওই প্রেমের স্রোত ধাবিত হয়। এমনকি তা ধাবিত হয় অপ্রিয় ও কষ্টদায়ক বস্তুতেও। কিন্তু আল্লাহপ্রেমের উচ্ছ্বাসে তার কষ্ট ও অপ্রিয়তা ম্লান হয়ে যায়। এমনকি কখনও কখনও তা অনুভব পর্যন্ত করা যায় না।
মোটকথা প্রবল আল্লাহপ্রেমের ফলে আল্লাহপ্রেমিক আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসে। সে ভালোবাসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীকারীদের, আল্লাহর দীন প্রচারকদের, উলামা ও মাশায়েখদের। সে ভালোবাসে আল্লাহর পসন্দনীয় আমল আখলাক। সে ওই আমল-আখলাক আত্মস্থ করতে সচেষ্ট হয়।
ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য তৃতীয় গুণ
আর তৃতীয় গুণ হলো-
وأن يكره ان يعود في الكفر بعد أن أنقذه الله منه ، كما يكره أن يقذف في النار
(আল্লাহ তা'আলা কাউকে কুফর থেকে মুক্তিদানের পর তার সেদিকে ফিরে যাওয়াটা এমন অপসন্দ করা যেমনটা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে)। 'কুফর থেকে মুক্তিদান' কথাটি ব্যাপক অর্থে বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি আগে কাফের ও মুশরিক ছিল, তাকে ঈমান ও ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দেওয়া যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি যে ব্যক্তি আগে কখনও কাফের-মুশরিক ছিল না, তার জন্মই হয়েছে মুসলিম বাবা-মায়ের ঘরে, তারপর সে ঈমান ও ইসলামকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে, কখনও তা থেকে বিচ্যুত হয়নি, সেও এর শামিল। কুফরী পরিবেশে জন্ম না দেওয়া ও দীনের উপর অবিচলিত রাখাটাও কুফর থেকে মুক্তিদানই বটে। এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া'-এর অর্থ হবে কাফের হয়ে যাওয়া।
তো কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া বা কাফের হয়ে যাওয়াকে যে মুমিন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপসন্দ করবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হবে। ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন, এর দ্বারা বোঝা যায়, যাকে কুফরী বাক্য বলতে বাধ্য করা হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তা না বলে, এমনকি অন্তরে ঈমান ধারণ করেও মুখে কৃত্রিমভাবে সে বাক্য উচ্চারণে সম্মত না হয়, ফলে তাকে হত্যা করে ফেলা হয়, সে ব্যক্তি কৃত্রিমভাবে কুফরী বাক্য উচ্চারণকারী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বলাবাহুল্য, একটু চিন্তা করলেই তার উৎকৃষ্টতা উপলব্ধিও করা যায়। কেননা যে কুফরীর কারণে আখেরাতে জাহান্নামের শাস্তিভোগ অনিবার্য হয়ে যায়, সে কোনওক্রমেই মুখে তা উচ্চারণ করাকেও মেনে নিতে পারছে না। সে দুনিয়ার আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে প্রস্তুত থাকে, কিন্তু কুফরী কথার কালিমায় নিজের জবান কলঙ্কিত করতে প্রস্তুত নয়। কত উঁচু তার ঈমান, কী গভীর তার ঈমানী মূল্যবোধ!
এ তিনটি বিষয়কে ঈমানের স্বাদ অনুভব করার জন্য শর্ত সাব্যস্ত করার দ্বারা বোঝা যায়, যে ব্যক্তি এগুলো পূর্ণ করতে সক্ষম হয়, তার ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করে। কেননা কোনও ব্যক্তি যখন চিন্তা করে যে, প্রকৃত অনুগ্রহকর্তা আল্লাহ তাআলাই, তিনিই সকল ইষ্ট-অনিষ্টের মালিক, তিনি ছাড়া অন্য যে-কারও দিক থেকে কোনও উপকার বা ক্ষতির প্রকাশ লক্ষ করা যায় তা আসবাব উপকরণের বেশি কিছু নয়, মূল কর্তা আল্লাহ তাআলাই, তখন প্রকৃত মহব্বত ও ভালোবাসা সে কেবল আল্লাহ তাআলাকেই নিবেদন করতে পারে। আল্লাহ তাআলা যা ভালোবাসেন, সে কেবল তা-ই ভালোবাসে, তাছাড়া অন্যকিছু নয়। আর সে যাকে বা যা-কিছুকেই ভালোবাসে, কেবল আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে।
এমনিভাবে যখন চিন্তা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা-অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উপায় সম্পর্কে তাকে অবগত করেছেন, তাঁর গযব ও আযাব থেকে বাঁচার উপায় বাতলে দিয়েছেন, কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার শিক্ষা দান করেছেন আর এভাবে অন্য সকলের চেয়ে অনেক বড় ও অনেক বেশি উপকার তিনিই করেছেন, তখন সে আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তাঁরও প্রেমিক হয়ে ওঠে। এতে করে তার অন্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন গভীর আস্থা জন্মায় যে, সে তাঁর প্রতিটি কথা সত্য বলে বিশ্বাস করে, তাঁর প্রতিটি হুকুম মানতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
এরূপ ব্যক্তির কাছে আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি ভবিষ্যৎ-ওয়াদা ও প্রতিটি শাস্তির বাণী ঘটমান বাস্তবতা বলে মনে হয়, যেন সে তা নিজ চোখে দেখতে পায়। ইবাদত-বন্দেগী, যিকর ও তিলাওয়াত ইত্যাদিকালে মনে হয় সে জান্নাতের উদ্যানে বিরাজ করছে। এমনিভাবে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়াকে তার কাছে মনে হয় আগামীতে নয়; বরং নগদই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। ফলে কোনওক্রমেই সেদিকে সে ফিরে যেতে পারে না। বরং তার থেকে আত্মরক্ষার উপায় যে ঈমান ও সৎকর্ম, তা আঁকড়ে ধরে রাখে। বড় মজা নিয়ে সে তাতে নিয়োজিত থাকে। জান্নাতের সুখ ও আনন্দের অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল, সুমিষ্ট ফল বা সুস্বাদু খাবারের মত ঈমানেরও স্বাদ ও মিষ্টতা আছে।
খ. ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা অনুভব করতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্য সকলের ও সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে।
গ. সে-ই প্রকৃত মুমিন, যে কাউকে ভালোবাসলে আল্লাহরই জন্য ভালোবাসে এবং কাউকে ঘৃণা করলেও আল্লাহ তাআলার জন্যই ঘৃণা করে।
ঘ. প্রকৃত মুমিন কোনও অবস্থায়ই কুফর ও কুফরীকর্মের দিকে ফিরতে প্রস্তুত হয় না, এমনকি তাকে যদি অগ্নিকুণ্ডেও নিক্ষেপ করা হয়।
