আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

ওহীর সূচনা অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং:
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি কিভাবে ওহী শুরু হয়েছিল
২। আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ......... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, হারিস ইবনে হিশাম (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার প্রতি ওহী কিভাবে আসে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ কোন কোন সময় তা ঘন্টাধ্বনির ন্যায় আমার নিকট আসে। আর এটি-ই আমার উপর সবচাইতে কষ্টদায়ক হয় এবং তা সমাপ্ত হতেই ফিরিশতা যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নিই, আবার কখনো ফিরিশতা মানুষের আকৃতিতে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে ফেলি। আয়েশা (রাযিঃ) বলেন, আমি প্রচন্ড শীতের দিনে ওহী নাযিলরত অবস্থায় নবীজীকে দেখেছি। ওহী শেষ হলেই তাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ত।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মূলপাঠের (আপনার কাছে ওহী কিভাবে আসে?) ব্যাখ্যা:
ওহী আগমনের সাতটি পদ্ধতি প্রসিদ্ধ।
তন্মধ্যে একটি প্রকার হল صلصلة الجرس 'ঘণ্টা ধ্বনি' |
জিনজিরকে লোহার উপর টানা বা মারাকে صلصلة الجرس বলে তবে এ ধ্বনিটা কিসের হত?
এ বিষয়ে হাদীসের ভাষ্যকারদের সাতটি উক্তি রয়েছে।

১. এটা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ব্যক্তিগত কথোপকথনের প্রকৃত ধ্বনি।

২. ওহীকৃত বস্তুর মাঝে সৃষ্টির রূপ ধারণকৃত এক ধরনের ধ্বনি।

৩. জিবরাঈল আলাইহিস সালাম যখন পৃথিবীতে মানবাকৃতিতে আগমন করতেন, তখন তার আগমনের ফলে যে প্রকৃত ধ্বনির সৃষ্টি হত, এটা ছিল হুবহু তাই। আর নিয়ম হল, যখন কোন বস্তু অপর কোন বস্তুর আকৃতি ধারণ করে, তখন সে বস্তুর গুণাবলী স্বয়ং এ বস্তুটিতে স্থানান্তরিত হয়। যেমন একটি জিন চাইলে প্রচণ্ড শক্তিতে একটি মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করতে পারে; কিন্তু সে যদি সাপের আকৃতি ধারণ করে তা হলে লাঠির একটিমাত্র আঘাতেই সে মরে যাবে। সুতরাং তদানুরূপ জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মানবাকৃতিতে আসার কারণে صلصلة الجرس তথা ঘণ্টাধ্বনির মত ধ্বনি হওয়াটাই স্বাভাবিক।

৪. অথবা ঘণ্টা ধ্বনি নয়; বরং এটা ছিল হুবহু জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর আগমনের কারণে সৃষ্ট ধ্বনি। যেমন রেলগাড়ির আগমনের ধ্বনি দূর থেকেই বোঝা যায় ।

৫. অথবা এটা হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-এর পালক থেকে নির্গত ধ্বনি। এ

কথাকেই আলেমগণ অধিকতর সঠিক বলেছেন। কেননা তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় আছে
إذا قضى الله في السماء أمرا ضربت الملئكة بأجنحتها خضعا لقوله كأنها سلسلة على صفوان.الخ

অর্থ : যখন আল্লাহ তাআলা আসমানে কোন বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন, তখন ফেরেশতাগণ জ্ঞান হারিয়ে নত হয়ে আপন পালক বিছিয়ে নেন। এর ফলে এমন আওয়াজ হয় যেমনিভাবে খালি পাথরের উপর শিকল টানলে আওয়াজ হয়। (আল-আবওয়াব ওয়াত তারাজিম, বুখারী, খণ্ড ০২, পৃষ্ঠা ১১১৪)

এর পর যখন ফেরেশতাদের জ্ঞান ফিরে আসে, তখন সর্বোচ্চ সভাষদ অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদেরকে তারা জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা বলুন, আমাদের পালনকর্তা কি ঘোষণা করেছেন? তখন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ বলেন, আমাদের মহান পালনকর্তা; যা ঘোষণা করেছেন। তা যথার্থই ঘোষণা করেছেন। আর তিনি হচ্ছেন সর্বোন্নত, সর্বমহান।

৬. ওহী অবতীর্ণের সময় নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক ইন্দ্রিয়গুলো বস্তু জগত থেকে সম্পর্কহীন এবং নির্জীব হয়ে অন্য জগতে চলে যেত। এতে যে অবস্থা দাঁড়াত, তাকে ঘণ্টাধ্বনি নামে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বুখারী শরীফের তাওহীদ পর্বে’ ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর ঝোঁক প্রবণতা এদিকেই মনে হয়।

৭. হযরত মাওলানা নসীর আহমদ খান সাহেব আরেকটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তা হল, صلصلة الجرس (ঘণ্টাধ্বনি) হল ওহী আগমনের পূর্বে সতর্কসঙ্কেত। এর অর্থ, আপনি প্রস্তুত হোন, ওহী আসন্ন। যেমন মোবাইল/টেলিফোন আসার পূর্বে সতর্ক সঙ্কেতস্বরূপ একটি ধ্বনি সৃষ্টি হয় অথবা এ ধ্বনির উদ্দেশ্য ছিল ওহীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করা। তা ছাড়া এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস রাযিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত রয়েছে

قال سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقول يحشر الله العبـادفيناديهم بصوت يسمعه من بعد كما يسمعه من قرب الخ

অর্থ- তিনি বলেন, আমি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহ বান্দাদেরকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করবেন। তখন এমন একটি আওয়াজ দ্বারা ডাকবেন, যা নিকটবর্তী বড় এবং দূরবর্তী সকল লোক একই রকম শুনবে।

মূলপাঠ (আর কখনো ফেরেশতা একজন পুরুষের আকৃতিতে আমার কাছে আসতেন)।
নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয় প্রকার ওহী সম্বন্ধে বলেছেন, يتمثل لي الملك رجلا

এখানে ফেরেশতা দ্বারা হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম উদ্দেশ্য। এটা ওহী আসার দ্বিতীয় পদ্ধতি।

উলামায়ে কেরাম লিখেন, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আসতেন হযরত দিহইয়াতুল কালবী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আকৃতি ধারণ করে। হযরত দিহয়াতুল কালবী রাযিয়াল্লাহু আনহু রূপ সৌন্দর্যে ফেরেশতা সদৃশ ছিলেন।

বাকী কথা থাকল, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম অন্য সকল নবী-রাসূল অপেক্ষা আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অধিক মাত্রায় এসেছিলেন।

এখানে উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ওহীর এ পদ্ধতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অতি কষ্টকর ছিল যদ্দরুণ শীতকালেও তিনি ঘর্মাক্ত হয়ে পড়তেন। এতে জানা গেল, ওহীর কাঠিন্য ছিল অসাধারণ । কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
لَوْ أَنزَلْنَا هَـٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۚ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থ- যদি আমি এ কুরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, হে দর্শক! তাহলে তুমি দেখতে পাহাড় আল্লাহর ভয়ে ধুলিস্যাত হয়ে যেত । (সূরা হাশর, ২১)

কিন্তু আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে মানুষকে বরদাশত করার শক্তি দান করেছেন । অন্যথায় ওহীর ভার সহ্য করা মানুষের সাধ্যে ছিল না। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
إنا عرضنا الأمانة على السموات والأرض والجبال فأبين أن يحملنها وأشفقن منها وحملها الإنسان إنه كان ظلوما جهولا.

অর্থ- আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত (কুরআন মাজীদ) পেশ করেছিলাম। অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয় সে জালিম অজ্ঞ। (সূরা আহযাব, আয়াত ৭২)

ওহীর ওজন :
ওহীর ওজনের কথা দ্বিতীয় হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআন কারীমে ইরশাদ হল, “নিশ্চয়ই আমি আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী।” (সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত ৫)

বুখারী শরীফের একাধিক স্থানে এ রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে, যাইদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন غير اولي الضرر নাযিল হল, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঊরু আমার উরুর উপর ছিল । মনে হল যেন আমার উরু টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন তা নবীর ওপর কত ভারীবহ ছিল। আলোচ্য আয়াত বদর যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত। মক্কা শরীফে তের বছর পর্যন্ত ওহী নাযিল হল। আর বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মদীনা মুনাওয়ারায়।

যখন বদর যুদ্ধের সময় ওহীর অবস্থাই এরূপ, তখন প্রথমবারের ওহী কেমন ভারীবহ মনে হয়েছিল? উম্মতের কেউই সে পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হবে না। প্রকৃতপক্ষে, বিশেষ প্রজ্ঞা ও কৌশলবশত আল্লাহ্ তাআলা তাঁর পবিত্র কালামের মাহাত্ম্য-মর্যাদা গোপন রেখেছেন। অন্যথায় কুরআনে হাকীমের তেলাওয়াত মুশকিল হয়ে যেত। আল্লাহ্ তাআলার কালামের রূহানী ওজন সম্পর্কে উম্মতের কারো ধারণা নেই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন