আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
২৬- ক্রয় - বিক্রয়ের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২১১৪
১৩২২. বিক্রেতার ইখতিয়ার থাকলে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হবে কি?
১৯৮৪. ইসহাক (রাহঃ) ......... হাকীম ইবনে হিযাম (রাযিঃ) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ক্রেতা-বিক্রেতার ইখতিয়ার থাকবে উভয়ের বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে এবং (পণ্যের দোষগুণ) যথাযথ বর্ণনা করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দেওয়া হবে, আর যদি তারা মিথ্যা বলে এবং গোপন করে, তবে হয়ত খুব লাভ করবে কিন্তু তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত মুছে যাবে। অপর সনদে হাম্মাম ......... আব্দুল্লাহ ইবনে হারিছ (রাহঃ) হাকীম ইবনে হিযাম (রাযিঃ) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনায় সততা অবলম্বনের সুফল ও অসততার কুফল বর্ণিত হয়েছে। বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয় সম্পর্কে বলা হয়েছে- তারা যদি সত্য বলে, তবে তাদের বেচাকেনায় বরকত হয়। বিক্রেতা কর্তৃক সত্য বলার অর্থ সে তার পণ্যের গুণ ও মান ঠিক যা আছে তাই বলবে। বাড়িয়ে-কমিয়ে বলবে না। কোনওরকম চাতুর্যের আশ্রয় নেবে না। অনেকের অভ্যাস আছে দুই নম্বরের মালকে এক নম্বর বলে চালিয়ে দেয়। এক কোম্পানির মাল অন্য কোম্পানির নামে বিক্রি করে। পুরাতন মালকে নতুন বলে চালায়। এক জায়গার উৎপন্ন মালকে অন্য জায়গার উৎপাদন বলে প্রকাশ করে ৷ টক ফল সম্পর্কে বলে মধুর মত মিষ্টি। এরকম আরও বিভিন্ন গড়মিল কথা বলে থাকে। সকলেরই তা জানা আছে। তো যে বিক্রেতা এরকম গড়মিল কথা না বলে, তার পণ্য ঠিক যা তাই বলে, সে তার বিক্রয়ে সত্যবাদী। এ হাদীছের বক্তব্যমতে বিক্রিতে বরকত লাভের জন্য সত্যবাদী হওয়া শর্ত। আর দ্বিতীয় শর্ত হল পণ্যের মধ্যে দোষ ত্রুটি থাকলে তা প্রকাশ করে দেওয়া, যেমন পণ্যটি পুরানো হলে বলে দেওয়া যে, এটি পুরানো। কোনও ভেজাল মেশানো থাকলে বলে দেওয়া যে, এর ভেতর এই মিশ্রণ আছে। কোন্ মালে কী রকমের খুঁত থাকতে পারে, সাধারণত বিক্রেতার তা জানা থাকে। কোনও ত্রুটি অজানা থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু যতদূর জানা আছে, তা বিক্রেতাকে বলে দেওয়া যে, এর ভেতর এই এই ত্রুটি আছে। আপনি ভালোভাবে বুঝে দেখুন। এটাও ব্যবসায়ে সততার অংশ। যে বিক্রেতা এই সততা অবলম্বন করবে অর্থাৎ তার মালের প্রকৃত মান বলে দেবে এবং কোনও খুঁত থাকলে তাও প্রকাশ করবে, তার বিক্রিতে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করবেন।
একই কথা বলা হয়েছে ক্রেতা সম্পর্কেও। ক্রেতাও যদি তার ক্রয়ে বরকত লাভ করতে চায়, তবে তার কর্তব্য সততা অবলম্বন করা। কোনও কোনও ক্রেতা অসত্য কথা বলে বিক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে, যেমন বলে আপনি এত দাম চাচ্ছেন কেন? অন্য দোকানে তো এরচে' কম দামে বিক্রি করে। হয়তো একটা অংকও বলে দিল যে, সে এত টাকা দাম চেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা তার মনগড়া কথা। স্রেফ মিথ্যা বলে তাকে ধোঁকা দেওয়াই উদ্দেশ্য। কখনও কখনও নিজের কাছে অত টাকা নেই বলে বিক্রেতার মন গলানোর চেষ্টা করে। বাকিতে কিনলে ঠিক যেদিন তার পক্ষে টাকা পরিশোধ করা সম্ভব তারচে’ আরও কম দিনের কথা বলে, যাতে বিক্রেতা বাকিতে দিতে সহজেই রাজি হয়ে যায়। এ জাতীয় আরও নানা অসৎপন্থা ক্রেতা অবলম্বন করে থাকে। যে ক্রেতা এরকম কোনও অসৎপথ অবলম্বন করে না, নগদ বা বাকিতে ক্রয়ের ক্ষেত্রে যা-কিছু বলার দরকার তা সবই সত্য বলে এবং যা-কিছু প্রকাশ করা উচিত তাও প্রকাশ করে, কিছুই গোপন করে না, তার ক্রয়ে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করে থাকেন।
পক্ষান্তরে ক্রেতা ও বিক্রেতা যে-কেউ অসৎপন্থা অবলম্বন করলে সে বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। বিক্রেতা যদি মিথ্যা বলে ও দোষ-ত্রুটি গোপন করে যে-কোনও কৌশলে তার মাল ক্রেতাকে গছিয়ে দেয়, তবে তার সে বিক্রিতে কোনও বরকত থাকবে না। অনুরূপ ক্রেতাও যদি চালাকি করে অবাস্তব ও অসত্য কথা বলে বিক্রেতাকে ঠকানোর চেষ্টা করে, তবে সেও তার ক্রয়ে বরকত পাবে না।
বরকত কাকে বলে
প্রশ্ন হচ্ছে, বরকত কী এবং বেচাকেনায় বরকত বলতে কী বোঝায়?
‘বরকত’-এর শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি। পরিভাষায় বরকত বলতে কোনও বস্তুতে আল্লাহপ্রদত্ত কল্যাণকে বোঝায়। কোনও বস্তুতে আল্লাহপ্রদত্ত কল্যাণ সাধিত হয় অদৃশ্যভাবে এবং তা হয় অগণিত ও অভাবনীয় পন্থায়। যে বস্তুতে এরূপ অদৃশ্য বৃদ্ধি ও কল্যাণ পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় মুবারক এবং বলা হয় এ বস্তুতে বরকত আছে। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে বরকত দান করেন ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। কুরআন মাজীদে হয়েছে-
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ
‘যদি সে সকল জনপদবাসী ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে কল্যাণধারা উম্মুক্ত করে দিতাম।”
অর্থাৎ সবদিক থেকে সবরকম কল্যাণ খুলে দেওয়া হত। আকাশ থেকে প্রয়োজনমাফিক বৃষ্টি বর্ষিত হত। ভূমি থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। তা দ্বারা মানুষ সত্যিকারভাবে উপকৃত হত। জীবনে শান্তি লাভ হত। অশান্তি ও পেরেশানি থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। এটাই বরকত।
দুনিয়ায় বস্তুসামগ্রীর ভেতর বরকত হয় দু'ভাবে। কখনও মূল বস্তুই বৃদ্ধি পায় এবং সে বৃদ্ধি চোখে দেখা যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের জীবনে এমন বরকত অনেক দেখা গিয়েছে। আবার কখনও বস্তু বৃদ্ধি পায় না, কিন্তু তার উপকার ও ফল বৃদ্ধি পায়, যেমন অল্প খাদ্যে বহু লোকের তৃপ্ত হয়ে যাওয়া। একগ্লাস দুধ দ্বারা বহুজনের পেট ভরে যাওয়া। সাহাবায়ে কিরামের জীবনে এরও বহু দৃষ্টান্ত আছে। কোনও পোশাক দীর্ঘ দিনেও না ছেড়া, কোনও ঘর বহুকাল টিকে থাকা, কোনও আসবাবপত্র দীর্ঘকাল ব্যবহার করতে পারা ইত্যাদি ব্যাপারগুলোও এ জাতীয় বরকতের অন্তর্ভুক্ত।
বরকত হয় মানুষের জীবনে তার অর্থ-সম্পদে, তার সময়ে ও কাজকর্মে ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু মহামনীষীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের একেকজনের দ্বারা এত কাজ হয়েছে, যা শতজনের পক্ষেও সাধারণত সম্ভব হয় না। এটা তাদের জীবনের বরকত ছাড়া কিছুই নয়। অনেকে তাদের অল্পজীবনে এত কাজ করেছে, বহু দীর্ঘজীবী লোকের পক্ষেও তা করা কঠিন। এটা সময়ের বরকত। এমনও লক্ষ করা যায় যে, সামান্য একটু খাবার খেয়ে শরীরে এমন শক্তি আসে, যা দ্বারা বিস্তর কাজ করা যায়। আবার দামী ও স্বাস্থ্যকর বিপুল খাবার খাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ উপকার দেখা যায় না। এটা খাদ্যের ভেতর বরকত থাকা না থাকার ব্যাপার। অল্প আয়-রোজগার, ছোট্ট বাসগৃহ ও সামান্য আসবার-উপকরণের ভেতর স্বস্তিকর ও শান্তিময় জীবন দুনিয়ায় অনেকেই যাপন করে থাকে। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহপ্রদত্ত বরকতেরই ফল। আবার বিপুল অর্থবিত্ত ও পর্যাপ্ত বিলাসসামগ্রী থাকা সত্ত্বেও কত মানুষ অসহ্য যন্ত্রণার ভেতর জীবন কাটায়। কী এর রহস্য? আসলে তাদের জীবনে বরকতের স্পর্শ নেই। ঈমানের অভাব ও তাকওয়ার কমতির কারণে তারা আল্লাহর বরকত থেকে বঞ্চিত। তাই তাদের ইহজীবনও যন্ত্রণাময়।
সততা তাকওয়ারই একটা অংশ। এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় বেচাকেনায় সততা অবলম্বন করলে বরকত লাভ হয়। তা বেচাকেনায় বরকত কী?
বেচাকেনায় বরকত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত সুফল লাভ করা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া, যেমন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে বিক্রির উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন করা,ব্যবসায়ে উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করা, মুনাফার অর্থ উপকারে আসা, ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতিমান হওয়া, সুখে-শান্তিতে জীবন কাটানো ইত্যাদি। সেইসংগে দীনদার ব্যক্তির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য থাকে আখিরাতের কল্যাণ লাভ করা। ব্যবসা দ্বারা যদি তার এ উদ্দেশ্য সাধিত হয়, তবে বলা হবে তার ব্যবসায়ে বরকত হয়েছে। ব্যবসা দ্বারা যদি অর্থসমাগম হয়, কিন্তু সে অর্থের সঠিক ব্যবহার না হয়, উল্টাপাল্টা খরচ হয়ে যায়, কিংবা সে অর্থই অনাকাঙ্ক্ষিত অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অর্থের কারণে জীবন অর্থহীন ও অশান্তিময় হয়ে যায়, তবে বলা হবে তার ব্যবসায়ে বরকত হয়নি।
অনুরূপ ক্রেতা যে উদ্দেশ্যে মাল কেনে, কেনা মাল দ্বারা যদি সে উদ্দেশ্য সাধিত হয় এবং তা দ্বারা তার কোনওরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়, বলা হবে তার কেনায় বরকত হয়েছে। অন্যথায় তা বেবরকতী।
আসলে বরকতের আছে নানা বৈচিত্র্য। অল্প খাদ্য অনেক লোকে মিলে খেল এবং সকলেই পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। এটাও বরকত। খাওয়ার পর খাদ্য হজম হল ও তা দ্বারা শরীর পুষ্টি লাভ করল। এটাও একরকম বরকত। অল্প খাদ্য খাওয়ার পর অনেক সময় পর্যন্ত উদ্যম-উদ্দীপনার সাথে কাজ করা গেল, খুব শীঘ্র ক্ষুধা লাগল না। এটাও বরকত বৈকি।
বরকত হয়েছে কি হয়নি তা বোঝার জন্য দীনী বুঝ থাকা জরুরি। অন্যথায় কেবল টাকা-পয়সার বৃদ্ধিকেই সাফল্য মনে করা হবে। টাকা-পয়সা বৃদ্ধির পাশাপাশি যেসব অনর্থ দেখা দিয়েছে সেদিকে নজর থাকবে না। এমনও দেখা যায় যে, একজন পুরোপুরি অসৎ ব্যবসায়ী। কিন্তু কাড়িকাড়ি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় তাকে সফল ব্যবসায়ী মনে করা হচ্ছে। তার অসাধুতাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এটা দীনী চিন্তা-ভাবনার দৈন্য ছাড়া কিছু নয়। সে সফল তো হবে তখনই, যখন তার ব্যবসায়ে কোনও অসাধুতার স্পর্শ থাকবে না, তার অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে এবং আখিরাতের জবাবদিহিতা থেকেও বেঁচে যাবে।
সৎপথে বেচাকেনার পরও ক্রেতা-বিক্রেতার বাহ্যিক কোনও বিপদ বা ক্ষতি দেখা যেতে পারে। সেটা বরকতহীনতা নয়, আল্লাহর পরীক্ষা। তাতে সবর করা জরুরি। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। আর্থিক ক্ষতি বা ব্যবসায়ে লোকসানও অনেক সময় পরীক্ষা হয়ে থাকে। তাতে সবর করলে আল্লাহ তা'আলা অপরিমিত পুরস্কার দান করে থাকেন। সুতরাং সে লোকসান বরকতহীনতা নয়; বরং এক প্রকার আত্মিক বরকতই বটে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বেচাকেনায় সততা অবলম্বনের শিক্ষা পাওয়া যায়।
খ. ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের কর্তব্য বেচাকেনায় সর্বপ্রকার মিথ্যা পরিহার করে। সত্য কথা বলা ও সততার পরিচয় দেওয়া।
গ. বেচাকেনায় সততা অবলম্বন করলে বরকত লাভ হয়।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা বরকতের সত্যতা জানা যায়। জান-মালে বরকত হওয়া একটি সত্য ও বাস্তব বিষয়। কোনও ঈমানদার ব্যক্তি তা অস্বীকার করতে পারে না।
একই কথা বলা হয়েছে ক্রেতা সম্পর্কেও। ক্রেতাও যদি তার ক্রয়ে বরকত লাভ করতে চায়, তবে তার কর্তব্য সততা অবলম্বন করা। কোনও কোনও ক্রেতা অসত্য কথা বলে বিক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে, যেমন বলে আপনি এত দাম চাচ্ছেন কেন? অন্য দোকানে তো এরচে' কম দামে বিক্রি করে। হয়তো একটা অংকও বলে দিল যে, সে এত টাকা দাম চেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা তার মনগড়া কথা। স্রেফ মিথ্যা বলে তাকে ধোঁকা দেওয়াই উদ্দেশ্য। কখনও কখনও নিজের কাছে অত টাকা নেই বলে বিক্রেতার মন গলানোর চেষ্টা করে। বাকিতে কিনলে ঠিক যেদিন তার পক্ষে টাকা পরিশোধ করা সম্ভব তারচে’ আরও কম দিনের কথা বলে, যাতে বিক্রেতা বাকিতে দিতে সহজেই রাজি হয়ে যায়। এ জাতীয় আরও নানা অসৎপন্থা ক্রেতা অবলম্বন করে থাকে। যে ক্রেতা এরকম কোনও অসৎপথ অবলম্বন করে না, নগদ বা বাকিতে ক্রয়ের ক্ষেত্রে যা-কিছু বলার দরকার তা সবই সত্য বলে এবং যা-কিছু প্রকাশ করা উচিত তাও প্রকাশ করে, কিছুই গোপন করে না, তার ক্রয়ে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করে থাকেন।
পক্ষান্তরে ক্রেতা ও বিক্রেতা যে-কেউ অসৎপন্থা অবলম্বন করলে সে বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। বিক্রেতা যদি মিথ্যা বলে ও দোষ-ত্রুটি গোপন করে যে-কোনও কৌশলে তার মাল ক্রেতাকে গছিয়ে দেয়, তবে তার সে বিক্রিতে কোনও বরকত থাকবে না। অনুরূপ ক্রেতাও যদি চালাকি করে অবাস্তব ও অসত্য কথা বলে বিক্রেতাকে ঠকানোর চেষ্টা করে, তবে সেও তার ক্রয়ে বরকত পাবে না।
বরকত কাকে বলে
প্রশ্ন হচ্ছে, বরকত কী এবং বেচাকেনায় বরকত বলতে কী বোঝায়?
‘বরকত’-এর শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি। পরিভাষায় বরকত বলতে কোনও বস্তুতে আল্লাহপ্রদত্ত কল্যাণকে বোঝায়। কোনও বস্তুতে আল্লাহপ্রদত্ত কল্যাণ সাধিত হয় অদৃশ্যভাবে এবং তা হয় অগণিত ও অভাবনীয় পন্থায়। যে বস্তুতে এরূপ অদৃশ্য বৃদ্ধি ও কল্যাণ পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় মুবারক এবং বলা হয় এ বস্তুতে বরকত আছে। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে বরকত দান করেন ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। কুরআন মাজীদে হয়েছে-
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ
‘যদি সে সকল জনপদবাসী ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী থেকে কল্যাণধারা উম্মুক্ত করে দিতাম।”
অর্থাৎ সবদিক থেকে সবরকম কল্যাণ খুলে দেওয়া হত। আকাশ থেকে প্রয়োজনমাফিক বৃষ্টি বর্ষিত হত। ভূমি থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়। তা দ্বারা মানুষ সত্যিকারভাবে উপকৃত হত। জীবনে শান্তি লাভ হত। অশান্তি ও পেরেশানি থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। এটাই বরকত।
দুনিয়ায় বস্তুসামগ্রীর ভেতর বরকত হয় দু'ভাবে। কখনও মূল বস্তুই বৃদ্ধি পায় এবং সে বৃদ্ধি চোখে দেখা যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের জীবনে এমন বরকত অনেক দেখা গিয়েছে। আবার কখনও বস্তু বৃদ্ধি পায় না, কিন্তু তার উপকার ও ফল বৃদ্ধি পায়, যেমন অল্প খাদ্যে বহু লোকের তৃপ্ত হয়ে যাওয়া। একগ্লাস দুধ দ্বারা বহুজনের পেট ভরে যাওয়া। সাহাবায়ে কিরামের জীবনে এরও বহু দৃষ্টান্ত আছে। কোনও পোশাক দীর্ঘ দিনেও না ছেড়া, কোনও ঘর বহুকাল টিকে থাকা, কোনও আসবাবপত্র দীর্ঘকাল ব্যবহার করতে পারা ইত্যাদি ব্যাপারগুলোও এ জাতীয় বরকতের অন্তর্ভুক্ত।
বরকত হয় মানুষের জীবনে তার অর্থ-সম্পদে, তার সময়ে ও কাজকর্মে ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু মহামনীষীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের একেকজনের দ্বারা এত কাজ হয়েছে, যা শতজনের পক্ষেও সাধারণত সম্ভব হয় না। এটা তাদের জীবনের বরকত ছাড়া কিছুই নয়। অনেকে তাদের অল্পজীবনে এত কাজ করেছে, বহু দীর্ঘজীবী লোকের পক্ষেও তা করা কঠিন। এটা সময়ের বরকত। এমনও লক্ষ করা যায় যে, সামান্য একটু খাবার খেয়ে শরীরে এমন শক্তি আসে, যা দ্বারা বিস্তর কাজ করা যায়। আবার দামী ও স্বাস্থ্যকর বিপুল খাবার খাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ উপকার দেখা যায় না। এটা খাদ্যের ভেতর বরকত থাকা না থাকার ব্যাপার। অল্প আয়-রোজগার, ছোট্ট বাসগৃহ ও সামান্য আসবার-উপকরণের ভেতর স্বস্তিকর ও শান্তিময় জীবন দুনিয়ায় অনেকেই যাপন করে থাকে। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহপ্রদত্ত বরকতেরই ফল। আবার বিপুল অর্থবিত্ত ও পর্যাপ্ত বিলাসসামগ্রী থাকা সত্ত্বেও কত মানুষ অসহ্য যন্ত্রণার ভেতর জীবন কাটায়। কী এর রহস্য? আসলে তাদের জীবনে বরকতের স্পর্শ নেই। ঈমানের অভাব ও তাকওয়ার কমতির কারণে তারা আল্লাহর বরকত থেকে বঞ্চিত। তাই তাদের ইহজীবনও যন্ত্রণাময়।
সততা তাকওয়ারই একটা অংশ। এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় বেচাকেনায় সততা অবলম্বন করলে বরকত লাভ হয়। তা বেচাকেনায় বরকত কী?
বেচাকেনায় বরকত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত সুফল লাভ করা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া, যেমন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে বিক্রির উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন করা,ব্যবসায়ে উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করা, মুনাফার অর্থ উপকারে আসা, ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতিমান হওয়া, সুখে-শান্তিতে জীবন কাটানো ইত্যাদি। সেইসংগে দীনদার ব্যক্তির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য থাকে আখিরাতের কল্যাণ লাভ করা। ব্যবসা দ্বারা যদি তার এ উদ্দেশ্য সাধিত হয়, তবে বলা হবে তার ব্যবসায়ে বরকত হয়েছে। ব্যবসা দ্বারা যদি অর্থসমাগম হয়, কিন্তু সে অর্থের সঠিক ব্যবহার না হয়, উল্টাপাল্টা খরচ হয়ে যায়, কিংবা সে অর্থই অনাকাঙ্ক্ষিত অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অর্থের কারণে জীবন অর্থহীন ও অশান্তিময় হয়ে যায়, তবে বলা হবে তার ব্যবসায়ে বরকত হয়নি।
অনুরূপ ক্রেতা যে উদ্দেশ্যে মাল কেনে, কেনা মাল দ্বারা যদি সে উদ্দেশ্য সাধিত হয় এবং তা দ্বারা তার কোনওরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়, বলা হবে তার কেনায় বরকত হয়েছে। অন্যথায় তা বেবরকতী।
আসলে বরকতের আছে নানা বৈচিত্র্য। অল্প খাদ্য অনেক লোকে মিলে খেল এবং সকলেই পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। এটাও বরকত। খাওয়ার পর খাদ্য হজম হল ও তা দ্বারা শরীর পুষ্টি লাভ করল। এটাও একরকম বরকত। অল্প খাদ্য খাওয়ার পর অনেক সময় পর্যন্ত উদ্যম-উদ্দীপনার সাথে কাজ করা গেল, খুব শীঘ্র ক্ষুধা লাগল না। এটাও বরকত বৈকি।
বরকত হয়েছে কি হয়নি তা বোঝার জন্য দীনী বুঝ থাকা জরুরি। অন্যথায় কেবল টাকা-পয়সার বৃদ্ধিকেই সাফল্য মনে করা হবে। টাকা-পয়সা বৃদ্ধির পাশাপাশি যেসব অনর্থ দেখা দিয়েছে সেদিকে নজর থাকবে না। এমনও দেখা যায় যে, একজন পুরোপুরি অসৎ ব্যবসায়ী। কিন্তু কাড়িকাড়ি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় তাকে সফল ব্যবসায়ী মনে করা হচ্ছে। তার অসাধুতাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এটা দীনী চিন্তা-ভাবনার দৈন্য ছাড়া কিছু নয়। সে সফল তো হবে তখনই, যখন তার ব্যবসায়ে কোনও অসাধুতার স্পর্শ থাকবে না, তার অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে এবং আখিরাতের জবাবদিহিতা থেকেও বেঁচে যাবে।
সৎপথে বেচাকেনার পরও ক্রেতা-বিক্রেতার বাহ্যিক কোনও বিপদ বা ক্ষতি দেখা যেতে পারে। সেটা বরকতহীনতা নয়, আল্লাহর পরীক্ষা। তাতে সবর করা জরুরি। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। আর্থিক ক্ষতি বা ব্যবসায়ে লোকসানও অনেক সময় পরীক্ষা হয়ে থাকে। তাতে সবর করলে আল্লাহ তা'আলা অপরিমিত পুরস্কার দান করে থাকেন। সুতরাং সে লোকসান বরকতহীনতা নয়; বরং এক প্রকার আত্মিক বরকতই বটে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা বেচাকেনায় সততা অবলম্বনের শিক্ষা পাওয়া যায়।
খ. ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের কর্তব্য বেচাকেনায় সর্বপ্রকার মিথ্যা পরিহার করে। সত্য কথা বলা ও সততার পরিচয় দেওয়া।
গ. বেচাকেনায় সততা অবলম্বন করলে বরকত লাভ হয়।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা বরকতের সত্যতা জানা যায়। জান-মালে বরকত হওয়া একটি সত্য ও বাস্তব বিষয়। কোনও ঈমানদার ব্যক্তি তা অস্বীকার করতে পারে না।


বর্ণনাকারী: