কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

৩৬. ইসলামী শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫০৪৮
আন্তর্জাতিক নং: ৫১৩৮
১২৮. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা- সম্পর্কে।
৫০৪৮. মুসাদ্দাদ (রাহঃ) ..... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমার একজন স্ত্রী ছিল, যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু (আমার পিতা) উমর (রাযিঃ) তাকে খারাপ জানতেন। তিনি আমাকে বলেনঃ তুমি তাকে তালাক দাও। কিন্তু আমি তা অস্বীকার করি। তখন উমর (রাযিঃ) নবী (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে এ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। তখন নবী (ﷺ) বলেনঃ তুমি তাকে তালাক দাও।
باب فِي بِرِّ الْوَالِدَيْنِ
حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى، عَنِ ابْنِ أَبِي ذِئْبٍ، قَالَ حَدَّثَنِي خَالِي الْحَارِثُ، عَنْ حَمْزَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ كَانَتْ تَحْتِي امْرَأَةٌ وَكُنْتُ أُحِبُّهَا وَكَانَ عُمَرُ يَكْرَهُهَا فَقَالَ لِي طَلِّقْهَا فَأَبَيْتُ فَأَتَى عُمَرُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم " طَلِّقْهَا " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে তাঁর পিতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর নির্দেশ পালনার্থে তালাক দিতে বলা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর এ স্ত্রীর নাম-পরিচয় জানা যায় না। হাদীছে উল্লেখ আছে যে, তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর পিতা তাকে অপসন্দ করতেন। কী কারণে তাকে অপসন্দ করতেন তা উল্লেখ করা হয়নি। তাঁর মত মহান ব্যক্তি শুধু শুধুই তাকে অপসন্দ করবেন এবং সে অপসন্দের কারণে তাকে তালাক দিতে চাপ দিবেন এমনটা ধারণা করা যায় না। নিশ্চয়ই যৌক্তিক ও শরীআতসম্মত কোনও কারণ ছিল।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা আল্লাহ তাআলার কুদরতের নিদর্শন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেইসব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে।১১৫

তো আল্লাহপ্রদত্ত এ ভালোবাসার কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. প্রথমে স্ত্রীকে তালাক দিতে সম্মত হননি। শেষে হযরত উমর ফারূক রাযি. এ ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নালিশ জানান। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে তালাক দিতে আদেশ করেন।

এ আদেশ অনুযায়ী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন কি না, হাদীছটিতে তার উল্লেখ নেই। উল্লেখ না থাকলেও প্রকাশ এটাই যে, তিনি তালাক দিয়ে দিয়েছিলেন। কেননা কোনও সাহাবীই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম অমান্য করতেন না। তাঁরা তাঁর ইশারা-ইঙ্গিতও গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন। এ ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর বিশিষ্টতা সকলেরই জানা। কাজেই তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্পষ্ট আদেশ সত্ত্বেও স্ত্রীকে তালাক দেবেন না, এটা কল্পনাও করা যায় না।

প্রকাশ থাকে যে, অন্যের প্রতি জুলুম করা কোনওক্রমেই জায়েয নয়। তালাকের বিষয়টি দেশ ও কালভেদে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে নারীর পক্ষে তালাক কলঙ্ক বয়ে আনে। তালাকপ্রাপ্তা নারীর পুনর্বিবাহ কঠিন হয়ে যায়। কাজেই বিনাদোষে তাকে তালাক দেওয়া উচিত নয় এবং পিতা-মাতারও উচিত না নিজ ছেলে-মেয়েকে তালাকে উৎসাহিত করা। কিন্তু আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকায় এটাকে বিশেষ দোষের মনে করা হয় না। তৎকালীন আরব পরিবেশেও তালাকপ্রাপ্তা নারীর পুনর্বিবাহ আটকাত না। একাধিকবার তালাকপ্রাপ্তা নারীরও সহজেই বিয়ে হয়ে যেত। কাজেই তখনকার সে পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সমাজবাস্তবতাকে তুলনা করা যাবে না। সুতরাং তাড়াহুড়া করে তালাক পর্যন্ত পৌঁছা ঠিক হবে না। এটা সর্বশেষ ব্যবস্থা। তাই সবশেষেই এটা বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, হাদীছের দৃষ্টিতে বৈধ কাজসমূহের মধ্যে আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাপেক্ষা অপসন্দ হলো তালাক।

ইমাম ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, পিতার প্রতি সন্তানের আনুগত্য প্রদর্শনের একটা দিক এইও যে, পিতা যা অপসন্দ করবে সন্তানও তা অপসন্দ করবে, যদিও তা সন্তানের প্রিয় হয়। অবশ্য এটা তখনই, যখন পিতা দীনদার ও নেককার হবেন এবং কার ভালো লাগা ও নালাগা সবই আল্লাহ তাআলার জন্য হবে; নিজের খেয়াল-খুশিমত কিছু করবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. স্বামীর পসন্দের স্ত্রী তার পিতার কাছে অপসন্দেরও হতে পারে। তাই এরূপ ক্ষেত্রে ধৈর্য ও সহশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।

খ. বিশেষ কোনও অবস্থা পুত্র বুঝতে সক্ষম না হলে পিতার কর্তব্য সকলের যিনি মুরুব্বি ও গুরুজন এমন কোনও দীনদার জ্ঞানী ব্যক্তির শরণাপন্ন হওয়া।

গ. জায়েয ও বৈধ কাজে পিতার আনুগত্য করা সন্তানের অবশ্যকর্তব্য।

ঘ. পিতা যা অপসন্দ করে সন্তানেরও তা অপসন্দ করা পিতৃআনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত।

১১৫. সূরা রূম (৩০), আয়াত ২১
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
সুনানে আবু দাউদ - হাদীস নং ৫০৪৮ | মুসলিম বাংলা