আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

২৬- ক্রয় - বিক্রয়ের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ২০৬৭
১২৮৯. যে ব্যক্তি জীবিকায় বৃদ্ধি কামনা করে
১৯৩৭. মুহাম্মাদ ইবনে আবু ইয়াকুব কিরমানী (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তার মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষার দু'টি সুফল বলা হয়েছে- ক. রিযিক বৃদ্ধি এবং খ. আয়ু বৃদ্ধি। ইরশাদ হয়েছে যাকে এটা আনন্দ দেয় যে, তার রিযিক প্রশস্ত করা হোক। রিযিক প্রশস্ত করার এক অর্থ আয়-রোজগার বৃদ্ধি পাওয়া, আরেক অর্থ বরকত লাভ হওয়া। বরকত লাভ হওয়াটাও একরকম বৃদ্ধিই বটে। কেননা তাতে অল্প দ্বারা বেশি প্রয়োজন মিটে যায়। আয়-রোজগারের মূল্য উদ্দেশ্য প্রয়োজন পূরণ হওয়াই। বিপুল আয় হওয়া সত্ত্বেও যদি প্রয়োজন না মেটে, তবে সে আয়ের কোনও সার্থকতা নেই। অপরদিকে অল্প আয় দ্বারাও যদি প্রয়োজন মিটে যায়,তবে সে অল্পকে অপর্যাপ্ত বলা যায় না। মোটকথা আয় বৃদ্ধি দ্বারা হোক বা বরকত দান দ্বারা হোক, যে-কোনও অবস্থায় প্রয়োজন মিটে যাওয়া আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমত লাভের একটি বড় উপায় হচ্ছে আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়বর্গের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা।

দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- (এবং তার আয়ু বৃদ্ধি করা হোক, সে যেন তার আত্মীয়তা রক্ষা করে)। أثر দ্বারা আয়ু বোঝানো হয়েছে। এর মূল অর্থ পায়ের ছাপ। মানুষ যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন মাটির উপর তার চলাফেরার চিহ্ন ও ছাপ পড়ে। যখন সে মারা যায় তখন চলাফেরাও বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মাটির উপর তার পায়ের ছাপ পড়তে পারে না। বোঝা গেল মাটিতে পায়ের ছাপ পড়াটা বেঁচে থাকার নিদর্শন। এ কারণেই পায়ের ছাপ দ্বারা রূপকার্থে আয়ু বোঝানো হয়ে থাকে। এ হাদীছে জানানো হয়েছে আত্মীয়তা রক্ষার দ্বারা আয়ু বৃদ্ধি পায়।

এ হাদীছটির প্রতি লক্ষ করে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, কুরআন মাজীদের বক্তব্য দ্বারা তো আমরা জানতে পারি যে, কারও আয়ু বাড়ে কমে না। যেমন ইরশাদ হয়েছে فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ (যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না) অর্থাৎ যার যখন মৃত্যু স্থির করা আছে ঠিক তখনই মৃত্যু হবে, তার আগেও হবে না, পরেও না। এ অবস্থায় আত্মীয়তা রক্ষা দ্বারা আয়ু বৃদ্ধির কথা বলাটা এ আয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি?

এর উত্তর এই যে, হাদীছে মূলত আয়ুর সময়কাল বৃদ্ধির কথা বোঝানো হয়নি; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য আয়ুতে বরকত লাভ হওয়া। অর্থাৎ অল্প সময়ে বিস্তর আমল করতে পারা। যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ তাআলা তার আয়ুতে এত বরকত দান করবেন যে, সে অল্প সময়ের মধ্যেই এতবেশি আমল করতে পারবে, যা অন্যরা অনেক অনেক দীর্ঘ সময়েও করতে সক্ষম হয় না। আমরা আল্লাহ তাআলার এমন বহু বান্দা সম্পর্কে জানতে পারি, যাদের একেকজন জীবনে এত কাজ করে গেছেন, যা একটি দল বা সংঘের পক্ষেও করা কঠিন। ইমাম আবূ হানীফা রহ., ইমাম তাবারী রহ. ইমাম যাহাবী রহ., হাফেয ইবন হাজার আসকালানী রহ., হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. প্রমুখ ছিলেন এমনই ক্ষণজন্মা মনীষী। তাদের একেকজন উম্মতের ইলমী ও আমলী যে বিপুল খেদমত করে গেছেন, বহু লোকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও তা সম্ভব নয়। এটিকে তাদের সময়ের বরকত ছাড়া আর কিছু দ্বারাই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

হাদীছটির মর্ম এই যে, আত্মীয়তা রক্ষা আল্লাহ তাআলার তাওফীক লাভের একটি বড় মাধ্যম। এর দ্বারা সহজে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং অনর্থক ও বেহুদা কাজ থেকে সময়ের হেফাজত হয়।

কারও কারও মতে আয়ু বৃদ্ধি দ্বারা নেক বংশধর বোঝানো হয়েছে। কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন মেলে, যাতে বলা হয়েছে- আত্মীয়তা রক্ষা করলে যে আয়ু বৃদ্ধি হয় তার অর্থ মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া নয়; বরং নেক সন্তান দান করা।

ইবন ফুওয়াররাক রহ. বলেন, আয়ু বৃদ্ধি দ্বারা মূলত আত্মীয়তা রক্ষাকারীর বুঝ-বুদ্ধিকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত তার বুদ্ধি-বিবেক সুস্থ থাকবে, কখনও অপ্রকৃতিস্থ হবে না।

আয়ু বৃদ্ধিকে কীর্তিময় জীবনলাভ দ্বারাও ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করে, তার জীবন হবে এমনই কীর্তিময় ও কর্মবহুল, যে কারণে সে মরেও অমর হয়ে থাকবে। সে তার কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার দেহ মাটির নিচে চলে যাবে বটে, কিন্তু তার কর্ম বহুদিন বেঁচে থাকবে। এর সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নবী-রাসূলগণ। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কত হাজার বছর আগে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, অথচ সারা জাহানের মানুষ আজও তাঁর কথা স্মরণ করে। কুরআন মাজীদে তাঁর দুআ বর্ণিত হয়েছে وَاجْعَلْ لِي لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِينَ (এবং পরবর্তীকালীন লোকদের মধ্যে আমার পক্ষে এমন রসনা সৃষ্টি করুন, যা আমার সততার সাক্ষ্য দেবে)।

অর্থাৎ এমন সৎকর্ম ও সুকীর্তির তাওফীক দান করুন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম আমার সুখ্যাতি করে ও আমার অনুসরণ করতে আগ্রহী হয় এবং শেষ জমানায় যেন আমার বংশধরদের মধ্যে নবী-রাসূলের আগমন ঘটে, যারা আমার দীনকে নবজীবন দান করবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর এ দুআ এমনভাবে কবুল করেছেন যে, আজ সকল আসমানী ধর্মের অনুসারীরা এমনকি যারা তাঁর আদর্শ হতে বিচ্যুত, তারা পর্যন্ত তার অকুন্ঠ প্রশংসা করে এবং নিজেদেরকে তাঁর দীনের পরিচয়ে পরিচিত করতে গর্ববোধ করে। শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো নিজেকে তাঁরই দুআর ফসল বলে প্রকাশ করতেন এবং তিনি ও তার অনুসারীগণ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এমনই স্মৃতিচারণকারী যে, পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে তারা নিত্যদিন উচ্চারণ করেন-

كما صليت على إبراهيم ……. كما باركت على إبراهيم

উপরে যে মহান ব্যক্তিবর্গের কথা বলা হলো, তাঁদেরও রেখে যাওয়া কীর্তি আজও পর্যন্ত মানুষের মাঝে জীবন্ত হয়ে আছে। থাকবে আরও বহুকাল। প্রকৃতপক্ষে এ জীবনই তো মানুষের কাম্য। কর্মহীন শতবর্ষী জীবনের চেয়ে কর্মময় অল্প আয়ুও অনেক অনেক ভালো।

কেউ কেউ হাদীছে বর্ণিত আয়ু বৃদ্ধিকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছেন। উলামায়ে কেরাম বলেন, আয়ু দুই রকম- চূড়ান্ত স্থিরীকৃত আয়ু ও শর্তযুক্ত আয়ু। লাওহে মাহফুযে শর্তযুক্ত আয়ু লেখা আছে। যেমন তাতে লেখা আছে, অমুক ব্যক্তি যদি পিতা-মাতার আনুগত্য করে তবে তার আয়ু হবে এই, অন্যথায় তার আয়ু হবে এই। এটা হচ্ছে শর্তযুক্ত আয়ু। এটাই ফিরিশতাদের জানানো হয় এবং এটাই আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আরেক হচ্ছে শর্তহীন চূড়ান্ত আয়ু। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি পিতা-মাতার আনুগত্য করবে কি করবে না তা আল্লাহ তাআলার জানা আছে। আল্লাহ তাআলার সেই জ্ঞান অনুযায়ী তার যে আয়ু, সেটাই চূড়ান্ত আয়ু। উপরে বর্ণিত আয়াতে এ আয়ুর কথাই বলা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার মাহাত্ম্য জানা গেল যে, এর জন্য পরকালীন যে পুরস্কার নির্ধারিত আছে তা তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে এতে দুনিয়ারও লাভ আছে। আর তা হলো এর দ্বারা রিযিকের প্রশস্ততা ও আয়ুতে বরকত লাভ হয়।

খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা লাভ হলো যে, শরীআতসম্মত পার্থিব কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যেও নেক আমল করা যেতে পারে।

৭৭. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৩৪

৭৮. সূরা শু'আরা (২৬), আয়াত ৮৪
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন