কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

২৮. চিরুনি ইত্যাদি ব্যবহারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৪১১৪
আন্তর্জাতিক নং: ৪১৬১
শিরোনামবিহীন পরিচ্ছেদ।
৪১১৪. নুফায়লী (রাহঃ) .... আবু উমামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা নবী (ﷺ) এর সাহাবীগণ তাঁর নিকট দুনিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তখন তিনি বলেনঃ তোমরা কি শোন না! তোমরা কি শোন না! সরলভাবে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করাই ঈমানের চিহ্ন। সরলভাবে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করাই ঈমানের দলীল।

ইমাম আবু দাউদ (রাহঃ) বলেনঃ ইনি হলেন আবু উমামা ইবনে ছা’লাবা আনসারী (রাযিঃ)।
حَدَّثَنَا النُّفَيْلِيُّ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي أُمَامَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، قَالَ ذَكَرَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا عِنْدَهُ الدُّنْيَا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أَلاَ تَسْمَعُونَ أَلاَ تَسْمَعُونَ إِنَّ الْبَذَاذَةَ مِنَ الإِيمَانِ إِنَّ الْبَذَاذَةَ مِنَ الإِيمَانِ " . يَعْنِي التَّقَحُّلَ . قَالَ أَبُو دَاوُدَ هُوَ أَبُو أُمَامَةَ بْنُ ثَعْلَبَةَ الأَنْصَارِيُّ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

البذاذة এর অর্থ জীবনযাপনে সাদামাটা থাকা। পানাহার, পোশাক-আশাক ও ঘর-বাড়ির ক্ষেত্রে যতটুকু না হলেই নয় ততটুকুতে ক্ষান্ত ও সন্তুষ্ট থাকা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি নিজেও এভাবেই চলতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও এরই শিক্ষা দিতেন।

একদা তাঁর মজলিসে উপস্থিত সাহাবীগণ দুনিয়ার শোভা ও চাকচিক্য নিয়ে কথা বলছিলেন। তখন তিনি তাদের সতর্ক করে বলেন- أَلا تَسْمَعُوْنَ؟ أَلَا تَسْمَعُوْن (তোমরা কি শুনছ না, তোমরা কি শুনছ না)। কথাটি দু'বার বলেছেন তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য, যাতে তিনি যে কথা বলতে যাচ্ছেন তা যেন তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে শোনেন। বলাবাহুল্য, সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথাই গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন। তিনি যখন কিছু বলতেন, তখন পিনপতন স্তব্ধতা বিরাজ করত। এমন শান্তভাবে বসতেন, মনে হতো যেন মাথার উপর পাখি বসতে পারবে এবং নড়াচড়া না করার কারণে সেটি উড়ে যাবে না। তা সত্ত্বেও গুরুত্বের সঙ্গে শুনতে বলেছেন কথাটির বাড়তি গুরুত্বের কারণে। অর্থাৎ যদিও তাঁর সব কথাই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এখন যে কথাটি তিনি বলতে চাচ্ছেন সেটি তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই কথাটির মূল্য উপলব্ধি করা চাই, যাতে জীবনযাপনে সেটিকে মাইলফলকরূপে গ্রহণ করা হয়। তাঁর সে মূল্যবান কথাটি হল-
إنَّ البَذَاذَةَ مِنَ الإِيمَانِ، إنَّ البَذَاذَةَ مِنَ الإِيمَانِ (নিশ্চয়ই কৃচ্ছতা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, নিশ্চয়ই কৃচ্ছ্রতা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত)। অর্থাৎ পরিপক্ক ও পরিপূর্ণ ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। যায়দ ইবনে ওহাব বলেন, একদা আমি উমর ইবনে খাত্তাব রাযি.-কে দেখলাম বাজারের দিকে যাচ্ছেন। তাঁর হাতে দোররা এবং পরিধানে একটি লুঙ্গি। সে লুঙ্গিতে লক্ষ করে দেখলাম ১৪টি তালি লাগানো। তার কোনও কোনওটি তালি চামড়ার।

হযরত আলী রাযি.-ও তালি লাগানো লুঙ্গি পরতেন। তিনি যখন জুমু'আর খুতবা দিতে দাঁড়াতেন, তখনও তাঁর পরিধানে তালিযুক্ত লুঙ্গি দেখা যেত।

সাদামাটা চালচলনকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে এ কারণে যে, এতে মন নরম থাকে। অহংকার থেকে বাঁচা যায়। তবে অনেকের বেলায় তালিযুক্ত পোশাকও অহংকারের কারণ হয়ে যায়। সুতরাং সকলের ক্ষেত্রে নিয়ম এক নয়। সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন শুদ্ধ-পবিত্র অন্তরের অধিকারী। অহংকার-অহমিকা তাঁদের স্পর্শ করতে পারত না। তালিযুক্ত পোশাকে তাঁদের মনের যে হাল থাকত, দামি পোশাকে তার পরিবর্তন ঘটত না। তা সত্ত্বেও তাঁরা সাদামাটাভাবে চলতেন। তালি দিয়ে ছেঁড়া পোশাক ব্যবহার করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদেরকে এরূপ চালচলনেই উৎসাহ দিতেন। এর কারণ— তাঁরা পরবর্তীকালের জন্য আদর্শ। তাঁদের লেবাস-পোশাক দামি হলে পরবর্তীকালের মানুষ তা দেখে বিলাসিতার দিকে ঝুঁকতে পারে। দুনিয়ার চাকচিক্যে তারা পথ হারাতে পারে।

হযরত আলী রাযি.-কে জনৈক ব্যক্তি তালিযুক্ত পোশাক পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, যাতে মুমিনগণ এর অনুসরণ করে এবং মন নরম থাকে।

আমাদের অন্তর যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের মতো পরিশুদ্ধ নয়, তাই আমাদের পক্ষে জীবনমানে পরিমিতি রক্ষাই শ্রেয়। না বিলাসিতা, না অতিরিক্ত সাদামাটা। কেননা বিলাসিতা তো আদৌ পসন্দনীয় নয়, আর বেশি সাদামাটা হলেও দূষিত অন্তর হয়তো অহমিকার শিকার হবে, নয়তো ফকিরী হাল দ্বারা ধনীর কাছে কিছু পাওয়ার আশা করবে। সাহাবা ও তাবিঈনের অবস্থা তো ছিল এই যে, দুনিয়াদারগণ পোশাক-আশাক দিয়ে অহমিকা দেখালে তাঁরা নিজেদের কৃচ্ছ্রতা দ্বারা তাদের সামনে দুনিয়ার হীনতা তুলে ধরতেন। এখন অবস্থা বদলে গেছে। অন্তর পরিশুদ্ধ না হওয়ায় অনেক সময় কৃচ্ছ্রতাকে দুনিয়া অর্জনের বাহানা বানানো হয়।

ইমাম শাযিলী রহ, ভালো পোশাক পরতেন। তাই সাদামাটা পোশাকওয়ালা এক ব্যক্তি তাঁর প্রতি আপত্তি তুললে তিনি বলেছিলেন, ওহে! আমার এই বেশভূষা আল্লাহর শোকর আদায় করে বলে আলহামদুলিল্লাহ। আর তোমার ওই অবস্থা অব্যক্তভাবে বলে, তোমরা তোমাদের দুনিয়ার কিছুটা আমাকে দাও।

সুতরাং আমাদের পক্ষে পরিমিতিই শ্রেয়। ব্যক্তিভেদে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে কর্তব্য উপযুক্ত শায়খ ও মুসলিহের পরামর্শ গ্রহণ করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ ও দুনিয়াদারদের শান-শৌকত নিয়ে আলোচনা করা সমীচীন নয়।

খ. দুনিয়া নিয়ে আলোচনা হতে দেখলে সামর্থ্য অনুযায়ী তাতে বাধা দেওয়া উচিত এবং তার বিপরীতে কবর ও হাশরের বিভীষিকা ও জান্নাতের নি'আমত সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত।

গ. ঈমানদারগণ কখনও বিলাসিতায় নিমজ্জিত হয় না। কৃচ্ছ্রতা ও সাদামাটা চালচলনই তাদের ভূষণ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
সুনানে আবু দাউদ - হাদীস নং ৪১১৪ | মুসলিম বাংলা