কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

১৬. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১১০
আন্তর্জাতিক নং: ৩১২৪
২০৬. মুসীবতের সময় সবর করা।
৩১১০. মুহাম্মাদ ইবনে মুছান্না (রাহঃ) ..... আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা নবী (ﷺ) এমন একজন মহিলার কাছে গেলেন, যে তার বাচ্চার শোকে ক্রন্দন করছিল। তখন তিনি তাকে বললেনঃ তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং সবর কর। সে মহিলা বলেঃ আপনি তো আমার মত মুসীবতে পতিত হননি। তখন তাকে বলা হলোঃ ইনি তো নবী (ﷺ)! তখন সে মহিলা তাঁর নিকট উপস্থিত হলো এবং তাঁর দরওয়াযায় কোন দারোয়ান পেল না। এরপর সে বলেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো আপনাকে চিনতে পারিনি, (কাজেই আমার বেয়াদবী নেবেন না)। তখন নবী (ﷺ) বলেনঃ দুঃখ-বেদনা শুরু হলে অথবা শোকের প্রথম হতে সবর করা প্রয়োজন।
باب الصَّبْرِ عِنْدَ الصَّدْمَةِ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ أَتَى نَبِيُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى امْرَأَةٍ تَبْكِي عَلَى صَبِيٍّ لَهَا فَقَالَ لَهَا " اتَّقِي اللَّهَ وَاصْبِرِي " . فَقَالَتْ وَمَا تُبَالِي أَنْتَ بِمُصِيبَتِي فَقِيلَ لَهَا هَذَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم . فَأَتَتْهُ فَلَمْ تَجِدْ عَلَى بَابِهِ بَوَّابِينَ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَعْرِفْكَ فَقَالَ " إِنَّمَا الصَّبْرُ عِنْدَ الصَّدْمَةِ الأُولَى " . أَوْ " عِنْدَ أَوَّلِ صَدْمَةٍ " .

حدَّثنا محمد بن المُصفّى، حدَّثنا بقيّةُ، عن إسماعيلَ بن عياشٍ، عن عاصم بن رجاء بن حيوةَ، عن أبي عمران، عن أبي سلّام الحبشي، عن ابن غنم عن أبي موسى، قال: سمعتُ رسولَ الله -صلَّى الله عليه وسلم- يقول: "الصبر رضاً

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কবরের পাশে যে মহিলা কাঁদছিল, তার নাম-পরিচয় জানা যায় না। তেমনি কবরবাসীর নামও অজ্ঞাত। হাঁ, মুসলিম শরীফের বর্ণনা দ্বারা এতটুকু জানা যায় যে, সে ছিল ওই মহিলার পুত্র। পুত্রের শোকে অধীর হয়ে মহিলা যখন কবরের পাশে বসে কাঁদছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে গমন করছিলেন। তিনি তাকে বললেন, হে আল্লাহর দাসী! আল্লাহকে ভয় কর এবং সবর কর। খুব সম্ভব সে কাঁদছিল বিলাপ করে এবং অনুচিত কোনও কথা বলছিল। এ বর্ণনায় আছে, তিনি তার থেকে এমন কিছু শুনেছিলেন, যা তিনি পসন্দ করছিলেন না। সে কারণেই তাকে এ উপদেশ দেন। নয়তো কেবল কান্না দূষণীয় নয়। পুত্রশোকে কান্নাকাটি করা যে-কোনও পিতামাতার পক্ষে স্বাভাবিক। শরী'আত তাতে বাধা দেয় না।

তিনি সবরের উপদেশ দিতে গিয়ে প্রথমে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর। কেননা সবর না করলে আখিরাতে শাস্তির আশংকা আছে। কারও মৃত্যুতে বিলাপ করা জায়েয নয়। তাকদীরকে দোষারোপ করা ও আল্লাহর ফয়সালা অমান্য করা কঠিন গুনাহ। অনেকেই অধৈর্য হয়ে এরকম গুনাহ করে ফেলে। যে মারা গেছে তাকে তো আর ফিরে পাওয়া যায় না, উল্টো এসব করে নিজের জন্যে আল্লাহর গযব ও আযাব টেনে আনা হয়। তাই প্রথমে আল্লাহর ভয় দেখানো হয়েছে যে, অধৈর্য হয়ে তার গযব টেনে এনো না। বস্তুত আল্লাহভীতি এমন এক শক্তি, যা অন্তরে এসে গেলে শরী'আতের সমস্ত হুকুম পালন করা সহজ হয়ে যায়। তখন সবর অবলম্বন করাও কঠিন হয় না।

সে মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনতে পারেনি। হয়তো সে মদীনার বাসিন্দাই ছিল না এবং মদীনা মুনাওয়ারায় তার খুব বেশি যাতায়াতও ছিল না। কাজেই সে বিরক্ত হয়ে বলল, আমার কাছ থেকে দূর হও। এক বর্ণনায় আছে, সে বলেছিল- হে আল্লাহর বান্দা! সবেমাত্র আমি পুত্রসন্তান হারিয়েছি। আমার মত বিপদে পড়লে তুমি আমার দুঃখ বুঝতে। যাহোক নবী সাল্লাল্লাহু'আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। তাকে আর কিছু বললেন না। অতঃপর মহিলাটিকে কেউ তাঁর পরিচয় বলে দিল। এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাত ভাই হযরত ফাযল ইবন আব্বাস রাযি. মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি জান ইনি কে? সে বলল, না। তিনি বললেন, ইনি তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে, তখন যেন মহিলাটির মরণদশা দেখা দিল। ভয়ে, লজ্জায় তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগে সে যে ব্যবহার করেছে, সেজন্যে একদিকে তার ভয় নাজানি এর কী পরিণাম তাকে ভোগ করতে হয়। সেইসংগে এই লজ্জা যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সদুপদেশ দিয়েছেন আর তার বিপরীতে সে কিনা তাঁর সংগে এমন অশোভন আচরণ করেছে। মোটকথা সে যারপরনাই অনুতপ্ত হল। তাই ক্ষমা চাওয়ার জন্য খুব দ্রুত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল, দুনিয়ার রাজা-বাদশার মত তাঁরও অনেক শান-শওকত থাকবে। থাকবে সুউচ্চ প্রাসাদ। দরজায় থাকবে সতর্ক প্রহরী। কিন্তু এরকম কিছুই সেখানে পেল না।

একজন দারোয়ান পর্যন্ত না। কাজেই সোজা তাঁর কাছে পৌঁছে গেল। গিয়ে ওজর পেশ করল, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।
কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে একটুও তিরস্কার করলেন না। বিষয়টাই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন। বরং তিনি মূল কথায় আসলেন। তাকে সবরের শিক্ষা দান করলেন। বললেন, প্রকৃত সবর সেটাই, যা শোক-দুঃখ পাওয়ার সংগে সংগে অবলম্বন করা হয়। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, সে বলেছিল, আমি ধৈর্য ধরছি, আমি ধৈর্য ধরছি। কিন্তু তার এ ধৈর্য ছিল বিলম্বে। সময় গড়ানোর সংগে সংগে মূলত শোকের মাত্রাও কমতে থাকে। তখন ধৈর্য ধরা সহজ হয়ে যায়। প্রথমে যখন শোক দেখা দেয়, তখনকার ধৈর্যই আসল ধৈর্য। কারণ তখন ধৈর্য ধরা খুব সহজ হয় না। উথলে ওঠা শোক দমন করতে মানসিক শক্তি প্রয়োগের দরকার হয়। ব্যাপারটা একটু কঠিনই। সেজন্যেই এই সবরকে প্রকৃত সবর বলা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এই হাদীছেরও প্রধান শিক্ষা সবর সম্পর্কেই। প্রত্যেকের কর্তব্য, যখন বিপদ আপদ ও শোক-দুঃখ দেখা দেয়, তখন বিচলিত না হয়ে প্রথমেই সবর অবলম্বন করা।

খ. এ হাদীছ দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়-নম্রতারও পরিচয় পাওয়া যায়। আরও জানা যায় তিনি কত সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন।

গ. কারও সামনে কোনও অনুচিত কাজ হতে দেখা গেলে তার কর্তব্য তাতে বাধা দেওয়া ও সদুপদেশ প্রদান করা।

ঘ. সদুপদেশ দান করতে গিয়ে দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হলে তা বরদাশত করা উচিত।

ঙ. কেউ ক্ষমা চাইতে আসলে তার প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করা উচিত এবং অবশ্যই ক্ষমা করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সুনানে আবু দাউদ - হাদীস নং ৩১১০ | মুসলিম বাংলা