কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ
১৫. কর-খাজনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংক্রান্ত
হাদীস নং: ২৯৩৮
আন্তর্জাতিক নং: ২৯৪৮
১৫১. রাষ্ট্রনায়কের উপর নাগরিকদের অধিকার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব।
২৯৩৮. সুলাইমান ইবনে আব্দুর রহমান দিমাশকী (রাহঃ) ..... আবু মারয়াম আযদী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা আমি মুআবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানের নিকট গমন করি। তখন তিনি বলেনঃ আমাদের কাছে তোমার আগমনে স্বাগতম, হে অমুক! আরবরা মেহমানদের এভাবে খোশ আমদেদ জানাত। তখন আমি তাকে বলিঃ আমি একটা হাদীস শুনেছি, যা আমি আপনাকে অবহিত করছি। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ কোন কাজের দায়িত্বে নিয়োগ করেছেন, সে যদি লোকদের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে তাদের জরুরী ব্যাপারগুলি পূর্ণ করে, তবে আল্লাহও তার প্রয়োজনের সময় সাড়া দিয়ে তার কাজকে পূর্ণ করে দেন। রাবী বলেনঃ এ কথা শোনার পর তিনি মুআবিয়া (রাযিঃ) লোকদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য একজন লোক নিয়োগ করেন।
باب فِيمَا يَلْزَمُ الإِمَامَ مِنْ أَمْرِ الرَّعِيَّةِ وَالْحَجَبَةِ عَنْهُ
حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الدِّمَشْقِيُّ، حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ حَمْزَةَ، حَدَّثَنِي ابْنُ أَبِي مَرْيَمَ، أَنَّ الْقَاسِمَ بْنَ مُخَيْمِرَةَ، أَخْبَرَهُ أَنَّ أَبَا مَرْيَمَ الأَزْدِيَّ أَخْبَرَهُ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى مُعَاوِيَةَ فَقَالَ مَا أَنْعَمَنَا بِكَ أَبَا فُلاَنٍ . وَهِيَ كَلِمَةٌ تَقُولُهَا الْعَرَبُ فَقُلْتُ حَدِيثًا سَمِعْتُهُ أُخْبِرُكَ بِهِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " مَنْ وَلاَّهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ شَيْئًا مِنْ أَمْرِ الْمُسْلِمِينَ فَاحْتَجَبَ دُونَ حَاجَتِهِمْ وَخَلَّتِهِمْ وَفَقْرِهِمُ احْتَجَبَ اللَّهُ عَنْهُ دُونَ حَاجَتِهِ وَخَلَّتِهِ وَفَقْرِهِ " . قَالَ فَجَعَلَ رَجُلاً عَلَى حَوَائِجِ النَّاسِ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- مَنْ وَلَّاهُ اللَّهُ شَيْئًا مِنْ أُمُورِ الْمُسْلِمِينَ (আল্লাহ যাকে মুসলিমদের কোনও বিষয়ে কর্তৃত্বদান করেন)। 'কোনও বিষয়ে কর্তৃত্বদান'-এর দ্বারা ক্ষুদ্র-বৃহৎ যে-কোনও পরিসরের কর্তৃত্বের প্রতি ইশারা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যাকে মুসলিম জনসাধারণের যে-কোনও পর্যায়ের শাসক ও প্রশাসক বানান, তা প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী হোক বা সাধারণ মন্ত্রী, এমপি, জেলা প্রশাসক ইত্যাদি যাই হোক না কেন।
فَاحْتَجَبَ دُوْنَ حَاجَتِهِمْ وَخَلَّتِهِمْ وَفَقْرِهِمْ (আর সে তাদের প্রয়োজন, তাদের চাহিদা ও তাদের অভাব-অনটন পূরণ করা হতে বিরত থাকে)। احْتَجَبَ এর মূল অর্থ আত্মগোপন করল, পর্দার ভেতর থাকল, বিরত থাকল। পাহারাদার ও দ্বাররক্ষীকে حَاجِبٌ বলে। احْتَجَبَ এর মূল অক্ষর حَاجِبٌ। حَجَبَ এরও তাই। শাসকবর্গ তাদের বাড়ি ও কার্যালয়ের দুয়ারে রক্ষী ও পাহারাদার নিযুক্ত করে। উদ্দেশ্য, যাতে সাধারণ জনগণ যখন-তখন তাদের কাছে পৌঁছতে না পারে এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় কথা সরাসরি গিয়ে বলতে না পারে। সে হিসেবে পাহারাদার তাদের জন্য এক রকম পর্দা ও আড়ালস্বরূপ। তারা এর মাধ্যমে নিজেদের আড়াল ও গোপন করে রাখে। এভাবে যেন তারা জনগণের কথা শোনা ও তাদের প্রয়োজন পূরণ করা হতে এক রকম বিরত থাকে।
মানুষের প্রয়োজন বোঝানোর জন্য এখানে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে- ،خَلَّةٌ، حَاجَةُ ও فَقرٌ । সাধারণভাবে তিনওটি সমার্থবোধক। তবে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্যও রয়েছে। حَاجَةُ বলা হয় সাধারণ প্রয়োজনকে, যা পূরণ না হলে বড় ধরনের সমস্যা হয় না। خَلَّةٌ তারচে' বড় প্রয়োজনকে বলা হয়, যা পূরণ না হলে জীবন কঠিন হয়ে যায়। আর فَقرٌ বলা হয় তারচে'ও বড় প্রয়োজনকে, যা পূরণ না হলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। তবে অনেক সময় সাধারণ প্রয়োজন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। خَلَّةٌ-ও সেরকম।
তো হাদীছে বলা হয়েছে, কোনও শাসকের জনগণের প্রয়োজন পূরণ করা হতে বিরত থাকা উচিত নয় এবং যাতে করে মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ে সহজে তার কাছে পৌঁছতে না পারে সে লক্ষ্যে নিজ কার্যালয়ে প্রহরী নিযুক্ত করাও বাঞ্ছনীয় নয়। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রহরী নিযুক্ত করলে তা ভিন্ন কথা।
যে শাসক জনগণের প্রয়োজন পূরণ করা হতে বিরত থাকে, তার পরিণাম সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- احتَجَبَ اللَّهُ دُونَ حَاجَتِهِ وَخَلَّتِهِ وَفَقْرِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার প্রয়োজন, তার চাহিদা ও তার অভাবপূরণ হতে বিরত থাকবেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার দু'আ কবুল করবেন না এবং তার কোনও আশা পূরণ করবেন না। ফলে যেদিন মানুষের প্রয়োজন পূরণের দরকার হবে সবচে' বেশি, সেদিন তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হবে না। সেদিনকার প্রয়োজন হল হাশরের বিভীষিকায় আল্লাহর রহমতের ছায়ায় স্থান পাওয়া, হিসাব-নিকাশ সহজ হওয়া, ডানহাতে আমলনামা পাওয়া এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করা। সেদিন মানুষের এসব প্রয়োজন পূরণ না হলে তারচে' বড় দুর্ভাগ্য ও বঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং এটা কী কঠিন সতর্কবাণী যে, জনগণের শাসক যদি জনগণের প্রয়োজনপূরণ থেকে বিরত থাকে, তবে তাকে কিয়ামতে এ দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হবে।
فَجَعَلَ مُعَاوِيَةُ رَجُلًا عَلَى حَوَائِجِ النَّاسِ (অতঃপর হযরত মু'আবিয়া রাযি. মানুষের প্রয়োজনাদি দেখভালের জন্য এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন)। হযরত মু'আবিয়া রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মহান সাহাবী। এ হাদীছের সতর্কবাণী যে কত কঠিন তা বুঝতে তাঁর বিলম্ব হয়নি। সুতরাং এর উপর আমল করার জন্য অবিলম্বেই তিনি এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করেন যে, মানুষের অভাব-অভিযোগের খোঁজখবর নিয়ে তা তাঁকে জানাবে, যাতে তাঁর পক্ষে সহজে তা মেটানো সম্ভব হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যে-কোনও পর্যায়ের শাসক-প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিকে অবশ্যই জনগণের প্রয়োজনপূরণে তৎপর থাকতে হবে।
খ. জনগণের প্রয়োজন পৌছানোকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য প্রহরী নিয়োগ করা জায়েয নয়।
গ. জনগণের প্রয়োজনপূরণে অবহেলা করলে শাসকবর্গকে কিয়ামতে তার খেসারত দিতে হবে।
ঘ. কুরআন-হাদীছে বর্ণিত কোনও সতর্কবাণী কানে আসামাত্র তা আমলে নিতে হবে।
ঙ. দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের উচিত শাসকশ্রেণির প্রতি কল্যাণকামী থাকা এবং তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া।
فَاحْتَجَبَ دُوْنَ حَاجَتِهِمْ وَخَلَّتِهِمْ وَفَقْرِهِمْ (আর সে তাদের প্রয়োজন, তাদের চাহিদা ও তাদের অভাব-অনটন পূরণ করা হতে বিরত থাকে)। احْتَجَبَ এর মূল অর্থ আত্মগোপন করল, পর্দার ভেতর থাকল, বিরত থাকল। পাহারাদার ও দ্বাররক্ষীকে حَاجِبٌ বলে। احْتَجَبَ এর মূল অক্ষর حَاجِبٌ। حَجَبَ এরও তাই। শাসকবর্গ তাদের বাড়ি ও কার্যালয়ের দুয়ারে রক্ষী ও পাহারাদার নিযুক্ত করে। উদ্দেশ্য, যাতে সাধারণ জনগণ যখন-তখন তাদের কাছে পৌঁছতে না পারে এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় কথা সরাসরি গিয়ে বলতে না পারে। সে হিসেবে পাহারাদার তাদের জন্য এক রকম পর্দা ও আড়ালস্বরূপ। তারা এর মাধ্যমে নিজেদের আড়াল ও গোপন করে রাখে। এভাবে যেন তারা জনগণের কথা শোনা ও তাদের প্রয়োজন পূরণ করা হতে এক রকম বিরত থাকে।
মানুষের প্রয়োজন বোঝানোর জন্য এখানে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে- ،خَلَّةٌ، حَاجَةُ ও فَقرٌ । সাধারণভাবে তিনওটি সমার্থবোধক। তবে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্যও রয়েছে। حَاجَةُ বলা হয় সাধারণ প্রয়োজনকে, যা পূরণ না হলে বড় ধরনের সমস্যা হয় না। خَلَّةٌ তারচে' বড় প্রয়োজনকে বলা হয়, যা পূরণ না হলে জীবন কঠিন হয়ে যায়। আর فَقرٌ বলা হয় তারচে'ও বড় প্রয়োজনকে, যা পূরণ না হলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। তবে অনেক সময় সাধারণ প্রয়োজন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। خَلَّةٌ-ও সেরকম।
তো হাদীছে বলা হয়েছে, কোনও শাসকের জনগণের প্রয়োজন পূরণ করা হতে বিরত থাকা উচিত নয় এবং যাতে করে মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ে সহজে তার কাছে পৌঁছতে না পারে সে লক্ষ্যে নিজ কার্যালয়ে প্রহরী নিযুক্ত করাও বাঞ্ছনীয় নয়। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রহরী নিযুক্ত করলে তা ভিন্ন কথা।
যে শাসক জনগণের প্রয়োজন পূরণ করা হতে বিরত থাকে, তার পরিণাম সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- احتَجَبَ اللَّهُ دُونَ حَاجَتِهِ وَخَلَّتِهِ وَفَقْرِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তার প্রয়োজন, তার চাহিদা ও তার অভাবপূরণ হতে বিরত থাকবেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার দু'আ কবুল করবেন না এবং তার কোনও আশা পূরণ করবেন না। ফলে যেদিন মানুষের প্রয়োজন পূরণের দরকার হবে সবচে' বেশি, সেদিন তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হবে না। সেদিনকার প্রয়োজন হল হাশরের বিভীষিকায় আল্লাহর রহমতের ছায়ায় স্থান পাওয়া, হিসাব-নিকাশ সহজ হওয়া, ডানহাতে আমলনামা পাওয়া এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করা। সেদিন মানুষের এসব প্রয়োজন পূরণ না হলে তারচে' বড় দুর্ভাগ্য ও বঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং এটা কী কঠিন সতর্কবাণী যে, জনগণের শাসক যদি জনগণের প্রয়োজনপূরণ থেকে বিরত থাকে, তবে তাকে কিয়ামতে এ দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হবে।
فَجَعَلَ مُعَاوِيَةُ رَجُلًا عَلَى حَوَائِجِ النَّاسِ (অতঃপর হযরত মু'আবিয়া রাযি. মানুষের প্রয়োজনাদি দেখভালের জন্য এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন)। হযরত মু'আবিয়া রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মহান সাহাবী। এ হাদীছের সতর্কবাণী যে কত কঠিন তা বুঝতে তাঁর বিলম্ব হয়নি। সুতরাং এর উপর আমল করার জন্য অবিলম্বেই তিনি এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করেন যে, মানুষের অভাব-অভিযোগের খোঁজখবর নিয়ে তা তাঁকে জানাবে, যাতে তাঁর পক্ষে সহজে তা মেটানো সম্ভব হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যে-কোনও পর্যায়ের শাসক-প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিকে অবশ্যই জনগণের প্রয়োজনপূরণে তৎপর থাকতে হবে।
খ. জনগণের প্রয়োজন পৌছানোকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য প্রহরী নিয়োগ করা জায়েয নয়।
গ. জনগণের প্রয়োজনপূরণে অবহেলা করলে শাসকবর্গকে কিয়ামতে তার খেসারত দিতে হবে।
ঘ. কুরআন-হাদীছে বর্ণিত কোনও সতর্কবাণী কানে আসামাত্র তা আমলে নিতে হবে।
ঙ. দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের উচিত শাসকশ্রেণির প্রতি কল্যাণকামী থাকা এবং তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: