কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

১৫. কর-খাজনা, প্রশাসনিক দায়িত্ব ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংক্রান্ত

হাদীস নং: ২৯২২
আন্তর্জাতিক নং: ২৯৩২
১৪২. উযীর (মন্ত্রী) নিয়োগ করা সস্পর্কে।
২৯২২. মুসা ইবনে আমির মুররী (রাহঃ) .... আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা কোন নেতার জন্য যখন কল্যাণের ফয়সালা করেন, তখন তিনি তাকে সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ উযীর প্রদান করেন। যদি তিনি (নেতা) কিছু ভুলে যান, তখন সে (উযীর) তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর আমীর যদি তা স্মরণ রাখেন, তখন উযীর তাকে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা কোন নেতার জন্য যখন অকল্যাণের ফয়সালা করেন, তখন তিনি তাকে অযোগ্য উযীর প্রদান করেন। ফলে যখন তিনি (আমীর) কিছু ভুলে যান, তখন সে (উযীর) তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর আমীর যদি স্মরণ রাখেন, তখন সে তাকে সাহায্য করে না।
باب فِي اتِّخَاذِ الْوَزِيرِ
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ عَامِرٍ الْمُرِّيُّ، حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ، حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِالأَمِيرِ خَيْرًا جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ صِدْقٍ إِنْ نَسِيَ ذَكَّرَهُ وَإِنْ ذَكَرَ أَعَانَهُ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهِ غَيْرَ ذَلِكَ جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ سُوءٍ إِنْ نَسِيَ لَمْ يُذَكِّرْهُ وَإِنْ ذَكَرَ لَمْ يُعِنْهُ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে 'আমীর' বলে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার প্রতিনিধি বা আঞ্চলিক শাসনকর্তাদের বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ যদি তার কল্যাণ চান। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার যদি ইচ্ছো হয় সে ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে রাষ্ট্র পরিচালনা করে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুক আর এভাবে আখিরাতের জবাবদিহিতা থেকে বেঁচে যাক, তবে তার জন্য উত্তম মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এখানে মন্ত্রী বলে কেবল প্রচলিত অর্থের মন্ত্রী নয় অর্থাৎ মন্ত্রণালয়সমূহে দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রীবর্গকেই বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং এরূপ মন্ত্রীসহ আরও যারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে সরকারের সহযোগিতা করে থাকে, তাদের সকলকেই বোঝানো উদ্দেশ্য। একজন ভালো মন্ত্রীর করণীয় কী, সে সম্পর্কে হাদীছটিতে বলা হয়েছে-
إن نسي ذكره (যে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যা সে ভুলে যায়)। অর্থাৎ শরী'আতের কোনও বিধান প্রতিষ্ঠা করা, মজলুমকে সাহায্য করা, জনকল্যাণমূলক কোনও কাজ সম্পাদন করা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পর্কিত কোনও কাজের কথা যদি আমীর ভুলে যায়, তবে উত্তম মন্ত্রী তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সে বিষয়ে তাকে উপযুক্ত পরামর্শ দেয়।

وَإِنْ ذكر أعانه (এবং তা স্মরণ থাকলে তাতে তাকে সাহায্য করে)। অর্থাৎ আমীরের যদি তার কর্তব্যকর্মের কথা মনে থাকে, কিন্তু তা সম্পাদনের জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে, তখন একজন ভালো মন্ত্রী নিজ মতামত দ্বারা, কথা দ্বারা, কায়িক শ্রম দ্বারা তথা যেভাবেই প্রয়োজন পড়ে সেভাবেই তাকে তা সম্পাদনের জন্য সহযোগিতা করে থাকে। এজন্য একজন মন্ত্রীর কর্তব্য নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকা। রাষ্ট্রীয় যে-কোনও পদে নিযুক্ত ব্যক্তির দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সাধারণত লিখিত নিয়ম-নীতি থাকে। সরকার বা আমীরের সহযোগিতা করার জন্য তা ভালোভাবে পড়ে, বুঝে ও উত্তমরূপে জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করা বাঞ্ছনীয়।

তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَإِذَا أَرَادَ بِهِ غَيْرَ ذَلِكَ جَعَلَ لَهُ وَزِير سُوء (পক্ষান্তরে তিনি যখন আমীরের জন্য অন্য কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন তার জন্য মন্দ মন্ত্রী নিযুক্ত করেন)। ‘অন্য কিছুর ইচ্ছা করেন’ মানে তার অকল্যাণের ইচ্ছা করেন। হাদীছে এটা স্পষ্টভাবে না বলে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে। এর দ্বারা পরোক্ষভাবে অকল্যাণ এড়িয়ে চলতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যে জিনিসের নামটি পর্যন্ত পরিহার করা হয়, খোদ সে জিনিসটি পরিহার করা যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মন্দ জিনিসের নাম এড়িয়ে যাওয়াই ভালো আর ভালো জিনিসের নাম উচ্চারণ করাই শ্রেয়।

إِنْ نَسِيَ لَمْ يُذَكِّرْهُ، وَإِنْ ذَكَرَ لَمْ يُعِنْهُ (যে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় না সে ভূলে যায় এবং তা তার স্মরণে থাকলে তাতে তাকে সাহায্য করে না)। অর্থাৎ তার দ্বারা আমীরের সত্যিকারের কোনও সহযোগিতা হয় না। বরং এরূপ মন্ত্রী উপকারের তুলনায় অপকারই বেশি করে। তাই মন্ত্রী নিয়োগে খুব সতর্কতা দরকার। যার মধ্যে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা আছে, সেইসঙ্গে আছে সততা ও আল্লাহভীরুতা, এরকম লোককেই বেছে নেওয়া চাই।

আহনাফ ইবন কায়স রহ. বলেন, মন্ত্রী ও সহযোগী ছাড়া রাষ্ট্রীয় কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া যায় না। এজন্য মন্ত্রী ও সহযোগীদের মধ্যে আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতা থাকা জরুরি। আবার আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়ার জন্য দরকার বুদ্ধি-বিবেচনা ও সততা (সুতরাং মন্ত্রী ও সহযোগী নির্বাচনে এদিকে লক্ষ রাখা দরকার)। যোগ্য ও উপযুক্ত মন্ত্রী-সহযোগী না পাওয়া গেলে তাতে রাষ্ট্রপ্রধান তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই, সাধারণভাবে জনগণেরও অশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। এমনিভাবে যেসকল মন্ত্রী ও সহযোগীর ভদ্রতা ও লজ্জাশরমের বালাই না থাকে, তারাও সকলের পক্ষে ক্ষতিকর।

তিনি আরও বলেন, একজন শাসকের পক্ষে সবচে' বড় ক্ষতিকর হল এমন মন্ত্রী ও এমন পারিষদ, যে কথা তো খুব ভালো বলে, কিন্তু কাজে তার উল্টো।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আমীর ও রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার কাছে কল্যাণ কামনা করা এবং অকল্যাণ থেকে মুক্তি চাওয়া।

খ. মন্ত্রী ও সহযোগী নির্বাচনে সতর্কতা জরুরি, যাতে তারা সুযোগ্য, সৎ ও আল্লাহভীরু হয়।

গ. মন্ত্রী ও সহযোগীর কর্তব্য আমীর প্রয়োজনীয় কোনও বিষয় ভুলে গেলে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং তাতে পূর্ণ সহযোগিতা করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
সুনানে আবু দাউদ - হাদীস নং ২৯২২ | মুসলিম বাংলা