কিতাবুস সুনান - ইমাম আবু দাউদ রহঃ

৬. বিবাহ-শাদীর অধ্যায়

হাদীস নং: ২১৩৭
আন্তর্জাতিক নং: ২১৪০
১৩৫. স্ত্রীর উপর স্বামীর হক (অধিকার)।
২১৩৭. আমর ইবনে আওন .... কায়স ইবনে সা‘দ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হিরা শহরে আগমন করে সেখানকার লোকদেরকে মারযুবানকে সিজদা করতে দেখি। আমি (মনে মনে) বলি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ই তো সিজদার অধিকতর হকদার। তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলি, আমি হিরাতে গমন করে সেখানকার লোকদেরকে মারযুবানকে সিজদা করতে দেখেছি। আর হে আল্লাহর রাসুল! আপনিতো এর অধিক হকদার যে, আমরা আপনাকে সিজদা করি? তিনি বলেন, তুমি বল, যদি (আমার ইন্‌তিকালের পর) তুমি আমার কবরের পাশ দিয়ে গমন কর, তবে কি তুমি সেখানে সিজদা করবে? তিনি বলেন, আমি বললাম, না। তিনি বলেন, তোমরা সেরূপ করবে না। আর যদি আমি কাউকে সিজদা করতে বলতাম, তবে আমি স্ত্রীলোকদেরকে তাদের স্বামীদেরকে সিজদা করতে বলতাম। আর তা এইজন্য যে, আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে (স্বামীকে) তাদের (স্ত্রীদের) উপর হক প্রদান করেছেন।
باب فِي حَقِّ الزَّوْجِ عَلَى الْمَرْأَةِ
حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ عَوْنٍ، أَخْبَرَنَا إِسْحَاقُ بْنُ يُوسُفَ، عَنْ شَرِيكٍ، عَنْ حُصَيْنٍ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ قَيْسِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ أَتَيْتُ الْحِيرَةَ فَرَأَيْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِمَرْزُبَانٍ لَهُمْ فَقُلْتُ رَسُولُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُسْجَدَ لَهُ قَالَ فَأَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ إِنِّي أَتَيْتُ الْحِيرَةَ فَرَأَيْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِمَرْزُبَانٍ لَهُمْ فَأَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ نَسْجُدَ لَكَ . قَالَ " أَرَأَيْتَ لَوْ مَرَرْتَ بِقَبْرِي أَكُنْتَ تَسْجُدُ لَهُ " . قَالَ قُلْتُ لاَ . قَالَ " فَلاَ تَفْعَلُوا لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لأَزْوَاجِهِنَّ لِمَا جَعَلَ اللَّهُ لَهُمْ عَلَيْهِنَّ مِنَ الْحَقِّ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি স্বামীর আনুগত্য করা ও তার হক আদায় করার বিষয়টিকে অত্যন্ত কঠোরভাবে ব্যক্ত করছে। কারও প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সর্বোচ্চ পন্থা তাকে সিজদা করা। এভাবে আনুগত্য প্রকাশ কেবল আল্লাহ তা'আলার প্রতিই করা যায়। তিনি বান্দার সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। বান্দার প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগানদাতা। তার পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তাই ইবাদত ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের আনুগত্য, যা কিনা সিজদার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, কেবল তাঁরই জন্য সংরক্ষিত। অন্য কাউকে সিজদা করলে শিরক হয়ে যায়। শিরক মহাপাপ।
হাঁ, আরেকরকম সিজদা আছে, যাকে সম্মানসূচক সিজদা বলা হয়ে থাকে। ফিরিশতাগণ হযরত আদম আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে এরূপ সিজদা করেছিলেন। হযরত ইয়ুসুফ আলাইহিস সালামকে এরূপ সিজদা করেছিল তাঁর ভাইয়েরা। ইসলামে এটাও নাজায়েয। তাওহীদের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ দীনে এমন কোনও কিছুর সুযোগ রাখা হয়নি, যা দ্বারা তাওহীদের গায়ে আঁচড় লাগতে পারে। সম্মানসূচক সিজদা বাহ্যদৃষ্টিতে ইবাদত-আনুগত্যমূলক সিজদার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এরূপ সিজদার অবকাশ থাকলে তা আনুগত্যমূলক সিজদায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট। ফলে ব্যাপকভাবেই মানুষের তাওহীদ থেকে সরে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ইসলাম সে ঝুঁকি নেয়নি। অতএব আল্লাহ তা'আলা ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার সিজদাই হারাম ও নাজায়েয।

যারা কবরে সিজদা করে বা তথাকথিত পীরদের উদ্দেশ্যে সিজদা করে, তাদের ভেবে দেখা উচিত তারা আসলে কী করছে। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজেকে লক্ষ্য করে কারও সিজদা অনুমোদন করেননি এবং সিজদা করাকে কেবলই আল্লাহ তা'আলার জন্য নির্দিষ্ট রেখেছেন, সেখানে পীর-ফকীর ও কবরকে সিজদা করার কতটুকু বৈধতা থাকতে পারে? যে আমল কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নির্দিষ্ট, তাতে পীর-ফকীরদের ভাগ বসিয়ে তারা কি গুরুতর শিরকে লিপ্ত হচ্ছে না? তাওহীদী ধর্ম ইসলামের নামে এ জাতীয় শির্কী কর্মকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে চরম গোমরাহী। নিজেদেরকে যারা মুসলিম বলে বিশ্বাস করে এবং তা সত্ত্বেও এহেন শিরকী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছে, তাদের অবশ্যকর্তব্য এর থেকে তাওবা করা এবং সর্বপ্রকার শিরক ও বিদআত পরিহার করে চলা।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. বর্ণনা করেন, আনসারদের কোনও এক পরিবারের একটি উট ছিল। সে উটটি তারা সেচকার্যে ব্যবহার করত। হঠাৎ সেটি অবাধ্য হয়ে উঠল। সেটি তার নিজ পিঠ আর তাদেরকে ব্যবহার করতে দেয় না। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বিষয়টি জানাল। তারা বলল, (পানির অভাবে) তাদের ফসল ও খেজুর বাগান শুকিয়ে গেছে। তিনি সাহাবীগণকে নিয়ে সেখানে চলে গেলেন এবং বাগানের ভেতর ঢুকলেন। উটটি বাগানের এক কিনারায়। তিনি সেটির দিকে এগুতে থাকলেন। আনসারগণ বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটি কুকুরের মত হয়ে গেছে। আমাদের আশঙ্কা, আপনার উপর হামলা চালাতে পারে। তিনি বললেন, ওটি আমার কোনও ক্ষতি করবে না। তারপর উটটি যখন তাঁকে দেখল অমনি তাঁর দিকে এগিয়ে আসল এবং তাঁর সামনে সিজদায় পড়ে গেল। তিনি সেটির ললাট ধরে কাজে লাগিয়ে দিলেন। তখন সাহাবীগণ বললেন, এটি একটি অবোধ পশু। তা সত্ত্বেও আপনাকে সিজদা করেছে। আমরা বুদ্ধিমান মানুষ। আমাদেরই তো বেশি উচিত আপনাকে সিজদা করা। তিনি বললেন, কোনও মানুষের অপর কোনও মানুষকে সিজদা করা জায়েয নেই। তা জায়েয হলে আমি স্ত্রীকে আদেশ করতাম যেন তার স্বামীকে সিজদা করে। কারণ, তার উপর তার স্বামীর হক অনেক বড়।৩৫৬

যাহোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন যে, কোনও মানুষকে লক্ষ্য করে সিজদা দেওয়া যায় না। যদি তা জায়েয হত তবে স্বামীর হক আদায়ার্থে স্ত্রীকে নির্দেশ দেওয়া হত যেন সে তাকে সিজদা করে। এভাবে তিনি স্ত্রীর পক্ষে স্বামী যে কত বড় মান্যজন এবং তার অধিকার কত উচ্চ, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর বার্তা হচ্ছে, স্ত্রীর কর্তব্য শরীআতের সীমারেখার ভেতর স্বামীকে মেনে চলা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বান্দার সিজদা কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নির্দিষ্ট। গাইরুল্লাহকে সিজদা করা শিরক ও মহাপাপ। অতএব পীর বা কবরকে সিজদা করার কোনও বৈধতা নেই।

খ. এ হাদীছ দ্বারা স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায় এবং স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমান করা যায়। কাজেই প্রত্যেক স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা ও তার আনুগত্য বজায় রাখা।

৩৫৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৬১৪; মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৬৪৫২; আসবাহানী, দালাইলুন নুবুওয়াহ, হাদীছ নং ২৮৭
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান