মা'আরিফুল হাদীস

কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৪
কিতাবুল আযকার ওয়াদ-দাওয়াত অধ্যায়
কুরআন মজীদ তিলাওয়াত

উপরে বলা হয়েছে যে, কুরআন মজীদ তিলাওয়াতও অন্যতম যিকর। কোন কোন হিসাবে তা হচ্ছে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির। বান্দার এ ব্যস্ততা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয় ও পছন্দনীয়।

নিঃসন্দেহে আল্লাহর তা'আলা সকল উপমা ও উদাহরণের উর্ধ্বে। কিন্তু এ দীনাতি দীন লেখক এ সত্যটি নিজ অভিজ্ঞতায় সম্যক উপলদ্ধি করেছে যে, যখন কাউকে নিজের লিখিত কোন পুস্তক মনোযোগ সহকারে পাঠে লিপ্ত দেখেছি, তখনই আনন্দে হৃদয়-মন ভরে উঠেছে এবং সে ব্যক্তির সাথে এক বিশেষ আন্তরিক সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। সে ঘনিষ্ঠতা এতই নিবিড়, যা অনেক নিকটাত্মীয়ের সাথেও নেই। এ অভিজ্ঞতার আলোকে আমি তো এতটুকু বুঝেছি যে, যখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর কোন বান্দাকে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতে শুনতে পান ও দেখতে পান, তখন তিনি ঐ বান্দার প্রতি কতটুকু প্রীত হয়ে থাকবেন। (যদি না তার কোন গুরুতর অপরাধের দরুন সে তাঁর সদয় দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত থাকে)

রসূলুল্লাহ ﷺ উম্মতকে কুরআন মজীদের মাহাত্ম্য বুঝানোর জন্যে এবং এর তিলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করার জন্যে বিভিন্ন শিরোনাম ব্যবহার করেছেন। আমরাও এ সংক্ষিপ্ত হাদীস সমূহ বর্ণনার বিভিন্ন শিরোনাম ব্যবহার করেছি।

আল্লাহ তা'আলা নবী করীম ﷺ এর এ সব বাণী থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দিন- যা এ বাণী গুলোর উদ্দিষ্ট।

কুরআন মজীদের মাহাত্ম্য ও ফযীলত
কুরআন মজীদের মাহাত্ম্যের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট যে, এটি আল্লাহর কালাম। এটি আল্লাহ তা'আলার হাকীকী সিফাত বা প্রকৃত গুণ। প্রকৃত পক্ষে এ দুনিয়ায় যা কিছুই রয়েছে এমনকি যমীনের মখলুক সমূহের মধ্যে আল্লাহর কা'বা, নবী-রসূলগণের পবিত্র সত্তাসমূহ এবং ঊর্ধ্ব জগতের সৃষ্টি সমূহের মধ্যে আরশ, কুরসী, লাওহ ও কলম জান্নাত এবং তার নিয়ামত সমূহ, আল্লাহর নৈকট্যধন্য ফিরিশতাগণ এসব কিছুই স্ব-স্ব স্থানে অতীব মাহাত্ম্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এ সবই হচ্ছে মখলুক বা সৃষ্টি। পক্ষান্তরে কুরআন মজীদ আল্লাহর এরূপ সৃষ্টি যা তাঁর পবিত্র সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু নয় বরং তাঁর হাকীকী সিফাত বা সত্তাগত গুণ বিশেষ। এটা তাঁর সত্তার সাথে ওৎপ্রোত ভাবে জড়িত ও অবিচ্ছিন্ন ভাবে কায়েম রয়েছে। এটা আল্লাহর তা'আলার সবচাইতে বড় দয়া ও দান যে, তিনি তাঁর রসূলে আমীন মারফত তাঁর পবিত্র কালাম আমাদের নিকট পৌছিয়ে দিয়েছেন এবং যেন আমাদের তিলাওয়াত করতে, নিজ রসনায় তা উচ্চারণ করতে, তা উপলদ্ধি করতে এবং নিজেদের জীবনে এ পবিত্র গ্রন্থকে দিকদিশারীরূপে গ্রহণ করতে পারি।

কুরআন মজীদে আছে যে, আল্লাহর তাআ'লা তুয়ার পবিত্র প্রান্তরে একটি বরকতময় বৃক্ষ থেকে হযরত মূসা আলাইহিস্সালামকে আপন পবিত্র কালাম শুনিয়েছিলেন। কতই না সৌভাগ্যবান ছিল সেই বৃক্ষটি, যাকে আল্লাহর তা'আলা তাঁর পবিত্র বাণী শুনানোর জন্যে মাধ্যমরূপে ব্যবহার করেছিলেন। যে বান্দা ইখলাস এবং ভক্তিসহকারে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে সে তখন মূসা আলাইহিস সালামের সে বৃক্ষের মর্যাদা ও গৌরব লাভে ধন্য হয়। সে যেন তখন আল্লাহর পবিত্র কালামের রেকর্ড স্বরূপ হয়ে যায়। সত্য কথা হলো, মানুষ তার চাইতে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার কথা কল্পনাও করতে পারে না।

এ ভূমিকা পাঠের পর কুরআন মজীদের মাহাত্ম্য ও ফযীলতের বিবরণ সম্বলিত রসূলুল্লাহ ﷺ এর কয়েকখানা হাদীস নিম্নে পাঠ করুন।
৩৪. হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, মহামহিমান্বিত আল্লাহর তা'আলা বলেন, যে ব্যক্তিকে কুরআনের ব্যস্ততা আমার যিকর ও আমার কাছে বান্দার যাচ্ঞা করা থেকে বিরত রেখেছে, আমি তাকে দু'আকারী ও যাচ্ঞা কারীদেরকে প্রদত্ত দানের চাইতে উত্তম দান করে থাকি। মর্যাদার দিক থেকে আল্লাহর কালামের মর্যাদা অন্যান্য কথাবার্তার চাইতে ঠিক সে রূপ বেশি, যেরূপ বেশি মর্যাদা আল্লাত তা'আ'লার তাঁর সমগ্র সৃষ্টকূলের তুলনায়। (জামে' তিরমিযী, সুনানে দারেমী ও শু'আবুল ঈমান বায়হাকী)
کتاب الاذکار والدعوات
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقُولُ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: مَنْ شَغَلَهُ الْقُرْآنُ عَنْ ذِكْرِي وَمَسْأَلَتِي أَعْطَيْتُهُ أَفْضَلَ مَا أُعْطِي السَّائِلِينَ، وَفَضْلُ كَلاَمِ اللهِ عَلَى سَائِرِ الكَلاَمِ كَفَضْلِ اللهِ عَلَى خَلْقِهِ. (رواه الترمذى والدارمى والبيهقى فى شعب الايمان)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মাআ'রিফুল হাদীসের পূর্ববর্তী পৃষ্ঠা সমূহে বলে আসা হয়েছে যে, যখন কোন হাদীসে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা'আলার বরাতে কোন কথা বলেন অথচ তা' কুরআন মজীদে না থাকে, হাদীসের পরিভাষায় এরূপ হাদীসকে হাদীসে কুদসী বলা হয়ে থাকে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত এ হাদীসও এধরনের হাদীসে কুদসী।

এ হাদীসে দু'টি কথা বলা হয়েছে:
এক. আল্লাহর যে বান্দা কুরআন নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে যে, দিন-রাত তার ঐ একটিই ব্যস্ততা অর্থাৎ কুরআনের তিলাওয়াত কুরআন মুখস্থ করা তার চিন্তা-গবেষণা বা পঠন-পাঠনে ইখলাসের সাথে মশগুল-বিভোর থাকে যে, কুরআনের এ চর্চা বন্ধ করে সে আল্লাহর হামদ-তসবীহ করার বা তাঁর দরবারে দু'আ করার পর্যন্ত অবসর করে উঠতে পারে না, সে যেন মনে না করে যে, তার বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। কেননা, আল্লাহর তাআ'লা যিকরকারী ও যাচ্ঞাকারীকে যা দান করবেন তার চেয়ে অনেকগুণ উত্তম তাকে দান করবেন। অন্য কথায়, সে আল্লাহর দরবার থেকে যে মহাদান লাভ করবে, যিকরকারী ও যাচ্ঞাকারীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। রাসূলূল্লাহ ﷺ বলেন, এটা আল্লাহর তা'আলার অকাট্য ফয়সালা, আমি আমার এমন বান্দাকে তা থেকে অধিক ও উত্তম দান করবো, যা আমি কোন যিকিরকারী ও যাচ্ঞাকারীকে দান করে থাকি।
দ্বিতীয় যে কথাটি এ হাদীসে বিবৃত হয়েছে তা হলো, আল্লাহর কালাম অন্যদের কালাম থেকে ঠিক তেমনি মর্যাদাপূর্ণ, যেমন মর্যাদাপূর্ণ স্বয়ং তিনি তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকুলের তুলনায়। আর তার কারণও এটাই যে, কুরআন আল্লাহ তা'আলার কালাম এবং তাঁর অবিচ্ছিন্ন গুণ বিশেষ, যা' তাঁরই সত্তার মত অবিনশ্বর।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান