মা'আরিফুল হাদীস

যাকাত অধ্যায়

হাদীস নং:
যাকাত অধ্যায়
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব ও এর অবস্থান
এটা সুবিদিত সত্য যে, তওহীদ ও রেসালতের সাক্ষ্যদান এবং নামায কায়েমের পর যাকাত ইসলামের তৃতীয় রোকন ও মূল স্তম্ভ। কুরআন মজীদে সত্তরেরও অধিক স্থানে নামায প্রতিষ্ঠা ও যাকাত আদায় একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে—যা প্রমাণ করে, দ্বীন ইসলামে এ দু’টির মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রায় সমান।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ওফাতের পর যখন আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু লোক—যারা বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং নামাযও পড়ত—যাকাত দিতে অস্বীকার করল, তখন খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কারণ, তারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছিল—যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ারই শামিল।

বুখারীও মুসলিমের হাদীসে রয়েছে, তিনি হযরত উমর (রাযি.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—
وَاللّٰهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ
অর্থাৎ— “আল্লাহর কসম! যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব।”

পরে সকল সাহাবায়ে কেরাম তাঁর এই অবস্থানের সাথে একমত হন এবং এ বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়।

মা’আরিফুল হাদীস গ্রন্থেও প্রথম খণ্ডের শুরুতেই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সেইসব হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি ইসলামের মূল রোকনসমূহের আলোচনা করতে গিয়ে তওহীদ ও রেসালতের পর নামায ও যাকাতের কথাই উল্লেখ করেছেন।

যাহোক—কুরআন ও হাদীসে বারবার নামায ও যাকাতকে পাশাপাশি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, এ দু’টির মাঝে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসলামে এ দু'টির অবস্থান অত্যন্ত সম্মানজনক।

যাকাতের তিনটি দিক
যাকাতের মধ্যে পুরস্কার ও উপকারিতার তিনটি বিশেষ দিক রয়েছে—

১) আল্লাহর দরবারে দাসত্বের প্রকাশ

যেভাবে মুমিন বান্দা নামাযের কিয়াম, রুকূ ও সেজদার মাধ্যমে দেহ, মন ও মুখের সাহায্যে আল্লাহর সামনে দীনতা প্রকাশ করে—
তেমনি যাকাত হলো তাঁর পথে বান্দার আর্থিক কুরবানী। এর মাধ্যমে সে প্রমাণ করে—তার মাল-সম্পদকে সে নিজের বলে মনে করে না; বরং আল্লাহর আমানত মনে করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তা বিলিয়ে দেয়। এই দিক থেকেই যাকাত এবাদতের অন্তর্ভুক্ত।

২) দরিদ্র ও অভাবীদের সাহায্য
যাকাতের দ্বিতীয় দিক হলো—এটি অভাবী, দুস্থ ও অসহায় মানুষের সহায়তায় ব্যয় হয়। এই দিক থেকে যাকাত নৈতিকতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

৩) আত্মার পরিশুদ্ধি ও সম্পদের পবিত্রতা
অর্থের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ও সম্পদপূজা একটি ভয়ংকর ঈমান-নাশকারী রোগ।
যাকাত হলো এই রোগের চিকিৎসা—এটি অন্তরকে পবিত্র করে, লোভ দূর করে এবং সম্পদকে বরকতময় করে।

এ কারণেই কুরআনে বলা হয়েছে—

خُذۡ مِنۡ اَمۡوَالِہِمۡ صَدَقَۃً تُطَہِّرُہُمۡ وَتُزَکِّیۡہِمۡ بِہَا
অর্থ: “তাদের সম্পদ থেকে সদাকা গ্রহণ করুন; এর মাধ্যমে তাদের অন্তর পবিত্র হবে ও আত্মা পরিশুদ্ধ হবে।” (সূরা তওবা)

আরও বলা হয়েছে—
وَسَیُجَنَّبُہَا الۡاَتۡقَی، الَّذِیۡ یُؤۡتِیۡ مَالَہٗ یَتَزَکّٰی
অর্থ: “জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে সেই মুত্তাকী ব্যক্তিকে, যে তার সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে—এবং এর দ্বারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করে।” (সূরা লাইল)

আসলে যাকাত শব্দের অর্থই “পবিত্রতা” ও “পরিশুদ্ধি”—এ কারণে হয়তো যাকাতের এই নামকরণ।

যাকাতের বিধান: পূর্ববর্তী শরীআতসমূহে
যাকাতের এ অসাধারণ গুরুত্ব ও উপকারিতার কারণে এর নির্দেশ পূর্ববর্তী নবী–রাসূলদের শরীআতেও নামাযের সাথে সাথেই ছিল। সূরা আম্বিয়ায় হযরত ইবরাহীম (আঃ), তাঁর পুত্র ইসহাক (আঃ) এবং তাঁর পরবর্তী পুত্র ইয়াকুব (আঃ)-এর আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:

وَاَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡہِمۡ فِعۡلَ الۡخَیۡرٰتِ وَاِقَامَ الصَّلٰوۃِ وَاِیۡتَآءَ الزَّکٰوۃِ ۚ وَکَانُوۡا لَنَا عٰبِدِیۡنَ
অর্থাৎ, আমি তাদেরকে আদেশ দিলাম পুণ্য কাজের, (বিশেষ করে) নামায কায়েমের এবং যাকাত আদায়ের। আর তারা আমার এবাদতগুযার বান্দা ছিল। (সূরা আম্বিয়া)

সূরা মারয়ামে হযরত ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে:

وَکَانَ یَاۡمُرُ اَہۡلَہٗ بِالصَّلٰوۃِ وَالزَّکٰوۃِ
অর্থাৎ, তিনি তাঁর পরিবারের লোকদেরকে নামায ও যাকাতের নির্দেশ দিতেন। (সূরা মারয়াম)

ইসরাঈল ধারার শেষ পয়গম্বর হযরত ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের বলতেন:

قَالَ اِنِّیۡ عَبۡدُ اللّٰہِ ۟ؕ اٰتٰنِیَ الۡکِتٰبَ وَجَعَلَنِیۡ نَبِیًّا، وَّجَعَلَنِیۡ مُبٰرَکًا اَیۡنَ مَا کُنۡتُ ۪  وَاَوۡصٰنِیۡ بِالصَّلٰوۃِ وَالزَّکٰوۃِ مَا دُمۡتُ حَیًّا
অর্থাৎ, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দান করেছেন এবং নবী বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি, সেখানেই তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। আর যতদিন জীবিত থাকি, আমাকে নামায ও যাকাতের হুকুম দিয়েছেন।

সূরা বাকারায় বনী ইসরাঈলের ঈমানী অঙ্গীকারের উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে:

وَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتُوا الزَّکٰوۃَ
অর্থাৎ, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে।

অনুরূপভাবে সূরা মায়িদায় আরও বলা হয়েছে:

وَقَالَ اللّٰہُ اِنِّیۡ مَعَکُمۡ ؕ لَئِنۡ اَقَمۡتُمُ الصَّلٰوۃَ وَاٰتَیۡتُمُ الزَّکٰوۃَ وَاٰمَنۡتُمۡ بِرُسُلِیۡ
অর্থাৎ, আল্লাহ বলেছেন: আমি তোমাদের সাথে আছি — যদি তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আমার রাসূলদের প্রতি ঈমান আন…।

এ সকল আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, নামায ও যাকাত সব সময়ই আসমানী শরীআতসমূহের বিশেষ রোকন ও প্রতীক ছিল।

পূর্ববর্তী শরীআতে ও প্রাথমিক ইসলামী যুগে বিধান বৈচিত্র্য
হ্যাঁ, রূপরেখা, বিস্তারিত বিধান এবং পরিমাণ নির্ধারণে পার্থক্য ছিল। আমাদের শরীআতের নিজস্ব ইতিহাসেও বিধান ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হয়েছে। উদাহরণ—
১. নামায প্রথমে তিন ওয়াক্ত ছিল, পরে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়।
২. প্রথমে ফরয নামায কেবল দু' রাকআত ছিল; পরে ফজর ছাড়া অন্যান্য সালাতে রাকআত সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।
৩. প্রাথমিক যুগে নামাযের ভিতরে সালাম–কালামের অবকাশ ছিল; পরে তা নিষিদ্ধ হয়।

অনুরূপভাবে হিজরতের পূর্বে মক্কা যুগেই যাকাতের সাধারণ নির্দেশ ছিল।
মক্কী সূরাগুলো— সূরা মু’মিনুন, সূরা নামল, সূরা লুকমান— এসবের শুরুতেই নামায ও যাকাতের উল্লেখ আছে।
তখন যাকাত বলতে বোঝানো হতো— অভাবী, দরিদ্র ও কল্যাণমূলক কাজে নিজের সম্পদ ব্যয় করা।
কিন্তু বিস্তারিত বিধান, হার ও পরিমাণ নির্ধারণ হিজরতের পর মদীনায় নাযিল হয়।
এ কারণেই অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন যে, যাকাতের হুকুম দ্বিতীয় হিজরীতে বা তার পরে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো— বিশদ বিধান, পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তখন নাযিল হয়েছে। অথচ যাকাতের সাধারণ হুকুম মক্কা যুগেই ছিল।

সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্যে যাকাতের পূর্বমক্কী যুগের প্রমাণ

এ বিষয়টি শুধু উপরের মক্কী সূরাগুলোর আয়াতেই নয়, বরং হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)-এর বর্ণিত ঘটনাতেও প্রমাণিত হয়। তিনি আবিসিনিয়া হিজরতের বর্ণনায় হযরত জাফর তাইয়ার (রাঃ)-এর নাজ্জাশীর সাথে কথোপকথন উল্লেখ করেন, যেখানে জাফর (রাঃ) বলেন:
ويأمرنا بالصلوة والزكوة
তিনি (রাসূলে আকরাম ﷺ) আমাদের নামায ও যাকাতের হুকুম দেন। এটি ছিল হিজরতের বহু পূর্বের ঘটনা।

আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ইমাম বুখারী ও অন্যান্যের বর্ণনায়—
রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের প্রশ্নের জবাবে (সেই সময়কার শত্রু) আবু সুফিয়ান বলেছিলেন:
ويأمرنا بالصلوة والزكوة والصلة والعفاف
অর্থাৎ, তিনি আমাদের নামায, যাকাত, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা ও পবিত্রতার নির্দেশ দেন।

এটি স্পষ্ট প্রমাণ যে, হিজরতের পূর্বে মক্কা যুগেই রাসূলুল্লাহ ﷺ যাকাতের শিক্ষা দিতেন।
হ্যাঁ, পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় যাকাত সংগ্রহের প্রশাসনিক কাঠামো ৮ হিজরীর পর প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ ভূমিকার পর এখন যাকাত প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীসমূহ পাঠ করুন:

ঈমান ও নামাযের পর যাকাতের দাওয়াত
১. হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মু’আয ইবনে জাবাল (রাযিঃ) কে ইয়ামানের (শাসক নিয়োগ করে) পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বলেছিলেনঃ তুমি আহলে কিতাবের কাছে যাচ্ছ। কাজেই তাদের কাছে যখন পৌঁছবে, তখন তাদেরকে এ কথার দিকে দাওয়াত দিবে তারা যেন সাক্ষ্য দিয়ে বলে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তোমার এ কথা মেনে নেয় তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা এ কথাও মেনে নেয় তবে তাদের বলবে যে, আল্লাহ তাদের উপর সাদ্‌কা (যাকাত) ফরয করেছেন- যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হবে। তোমার এ কথা যদি তারা মেনে নেয়, তবে (কেবল) তাদের উত্তম মাল গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে এবং মযলুমের বদদুআকে ভয় করবে। কেননা, তার (বদদুআ) এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। সহীহ বুখারী
کتاب الزکوٰۃ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ ، ‏‏‏‏‏‏فَقَالَ : ‏‏‏‏ " إِنَّكَ تَأْتِي قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّداً رَسُولُ اللَّهِ ، ‏‏‏‏‏‏فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ ، ‏‏‏‏‏‏فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ ، ‏‏‏‏‏‏فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ ، ‏‏‏‏‏‏فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِي أَمْوَالِهِمْ ، ‏‏‏‏‏‏تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ ، ‏‏‏‏‏‏فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ ، ‏‏‏‏‏‏فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ ، ‏‏‏‏‏‏وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ ، ‏‏‏‏‏‏فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ ".
(رواه البخارى ومسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসটি যদিও মা'আরিফুল হাদীসের প্রথম খণ্ডে বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করা হয়েছে, তবুও ইমাম বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিসদের রীতি অনুসারে কিতাবুয যাকাত—এর সূচনা এ হাদীস দিয়েই করা সমীচীন বলে বিবেচিত হয়েছে।

হযরত মো‘আয ইবনে জাবাল (রাযিঃ)-কে ইয়ামনের শাসক ও বিচারক নিযুক্ত করে পাঠানোর ঘটনা অধিকাংশ আলেম ও সীরাতবিদদের মতে হিজরীর নবম সনের। তবে ইমাম বুখারী ও কিছু আলেমের মতে এটি দশম হিজরীর ঘটনা। সে সময় ইয়ামনে আহলে কিতাবের পাশাপাশি বহু মূর্তিপূজারীও ছিল; কিন্তু আহলে কিতাবের বিশেষ গুরুত্বের কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদের কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ দাওয়াত ও দ্বীন প্রচারের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি শিক্ষা দিয়েছেন—তা হলো, ইসলামের সমস্ত বিধি-বিধান একসাথে মানুষের সামনে উপস্থাপন না করা। কারণ, এতে ইসলাম তাদের কাছে জটিল ও দুর্বহ মনে হতে পারে। তাই প্রথমে ইসলামের আকীদাগত মূলভিত্তি—তওহীদ ও রেসালতের সাক্ষ্যদান—এটিই তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। যুক্তিসম্পন্ন, সুস্থ বিবেকের অধিকারী মানুষ সহজেই এটি গ্রহণ করতে পারে, বিশেষত আহলে কিতাব সম্প্রদায় তো এ বিষয়ে আরও অবগত।
এরপর যখন তাদের মন এ মৌলিক আকীদাটি গ্রহণ করবে, তখন তাদের সামনে নামাযের বিধান তুলে ধরতে হবে—যা শারীরিক ও মৌখিক এক সুন্দর সমষ্টিগত ‘ইবাদত। তারা যখন নামাযকে গ্রহণ করবে, তখন তাদের সামনে যাকাতের বিধান উপস্থাপন করতে হবে। এ সময় বিশেষভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, যাকাত আদায় করা দাঈ বা প্রচারকের ব্যক্তিগত কোনো দাবি নয়; বরং নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে ধনীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা এ যাকাত একই এলাকার দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যেই বণ্টন করা হবে।

ইসলামের প্রতি দাওয়াতের এই প্রজ্ঞাপূর্ণ নীতির পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ ﷺ হযরত মো‘আযকে আরও শিক্ষা দিয়েছেন যে, যাকাত সংগ্রহে সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার বজায় রাখতে হবে। মানুষের গবাদিপশু বা উৎপন্ন ফসল থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু বেছে নেওয়া যাবে না।

সবশেষে তিনি উপদেশ দিয়েছেন—“তুমি একটি অঞ্চলের শাসক হিসেবে যাচ্ছ, তাই জুলুম ও বাড়াবাড়ি থেকে নিজেকে কঠোরভাবে দূরে রাখবে। কোনো মজলুম যখন জালেমের বিরুদ্ধে দো‘আ করে, তা সরাসরি আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়।” একজন কবির বাণীও এখানে উল্লেখযোগ্য—
“মজলুমের আর্তনাদকে ভয় কর; তার দো‘আ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া পায়।”
এই হাদীসে দাওয়াতের বেলায় কেবল তওহীদ ও রেসালতের সাক্ষ্যদান, নামায এবং যাকাতের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। রোযা ও হজ্জ—যেগুলো নামায ও যাকাতের মতোই ইসলামের পঞ্চ মূল ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত—সেগুলোর উল্লেখ এখানে করা হয়নি। অথচ হযরত মো‘আয (রাযিঃ) যে সময়ে ইয়ামনে প্রেরিত হন তখন রোযা ও হজ্জ দু’টোই ফরয হয়ে গিয়েছিল।

এ কারণ যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের দাওয়াতের মূলনীতি ও প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া। তাই এখানে কেবল তিনটি বুনিয়াদ উল্লেখ করা হয়েছে। যদি সব বুনিয়াদের শিক্ষা দেওয়া উদ্দেশ্য হতো, তবে তিনি বাকিগুলোও উল্লেখ করতেন। কিন্তু হযরত মো‘আয (রাযিঃ)-এর নিকট এর প্রয়োজন ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন ইলমে-দ্বীনে অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান