মা'আরিফুল হাদীস

সলাত অধ্যায়

হাদীস নং: ২৮৪
সলাত অধ্যায়
বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত (সালাতুল ইস্তিসকা)

সকল প্রাণীর জীবন জীবিকা পানির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কাজেই কোন এলাকায় দুর্ভিক্ষ ও খরা দেখা দিলে তা সাধারণ বিপদের রূপ নেয়। বরং বলাচলে, এক ধরনের সাধারণ শাস্তির রূপ ধারণ করে। ব্যক্তিগত সমস্যা উত্তরনের লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ যেমন সালাতুল হাজতের (প্রয়োজন পূরনের সালাত) শিক্ষা দিয়েছেন যা ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে, ঠিক একইভাবে সামষ্টিক বিপদ উত্তরনের লক্ষ্যেও একটি সালাত শিক্ষা দিয়েছেন যা সালাতুল ইস্তিসকা (বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত) নামে পরিচিত। ইস্তিসকার আভিধানিক অর্থ পানি প্রার্থনা করা এবং পানি দ্বারা যমীন প্লাবিত করার দু'আ করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্ধশায় একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তখন বৃষ্টিও বর্ষিত। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস থেকে উক্ত ঘটনার সবিস্তার বিবরণ পাঠ করা যেতে পারে।
২৮৪. হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকেরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে অনাবৃষ্টির অভিযোগ করে। তিনি দিন ক্ষণ ঠিক করে সকলকে ঈদগাহের ময়দানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি মাঠে মিম্বর স্থাপানের নির্দেশ দিলে তা স্থাপিত হয়। আয়েশা (রা.) বলেন, সে দিন সূর্য উঠার সাথে সাথে নবী কারীম ﷺ ময়দানে গিয়ে উক্ত মিম্বরে আরোহন করে সর্বপ্রথম তাকবীর বলেন। তারপর আল্লাহ্ তা'আলার প্রশংসা করেন। এরপর তিনি বলেন, তোমরা সময়মত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দুর্ভিক্ষের অভিযোগ করছ অথচ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন: যদি তোমরা তাঁর নিকট দু'আ কর, তবে তিনি তা কবুল করবেন। এরপর তিনি বলেন: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমস্ত বিশ্বজগতের প্রতিপালক। তিনি পরমদাতা, মেহেরবান, কিয়ামতের দিনের একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন। হে আল্লাহ্! তুমি আল্লাহ্! তুমি ছাড়া অপর কেউ স্বয়ং সম্পূর্ণ নেই। এবং আমরা তো তোমার মুখাপেক্ষী। তুমি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর এবং তার সাহায্যে খাদ্য শস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা কর। তার পর তিনি উভয় হাত এত উপরে উঠান যে, তাঁর বগলের সাদা অংশ দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তিনি লোকদের প্রতি পিঠ ফিরিয়ে স্বীয় চাদর মুবারক উল্টিয়ে দেন এবং ঐ সময়েও তাঁর হাত উপরে ছিল। অবশেষে তিনি লোকদের দিকে ফিরে মিম্বর হতে অবতরণের পর দুই রাক'আত সালাত আদায় করেন। এই সময় আল্লাহ্ তা'আলা আকাশে মেঘ সঞ্চার করেন এবং মেঘের গর্জন ও ঘনঘটা শুরু হয়ে যায়। তার পর আল্লাহর হুকুমে এমন বৃষ্টিপাত হতে থাকে যে, নবী কারীম ﷺ মসজিদে নববীতে আসার পূর্বেই সমস্ত এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। এর পর তিনি যখন তাদেকে আর্দ্রতা হতে আত্মরক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখেন, তখন এমনভাবে হেসে দেন যে, তাঁর দাঁত মুবারক দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর তিনি বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা'আলা সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। (আবূ দাউদ)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ : شَكَا النَّاسُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُحُوطَ الْمَطَرِ ، فَأَمَرَ بِمِنْبَرٍ ، فَوُضِعَ لَهُ فِي الْمُصَلَّى ، وَوَعَدَ النَّاسَ يَوْمًا يَخْرُجُونَ فِيهِ ، قَالَتْ عَائِشَةُ : فَخَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، حِينَ بَدَا حَاجِبُ الشَّمْسِ ، فَقَعَدَ عَلَى الْمِنْبَرِ ، فَكَبَّرَ وَحَمِدَ اللَّهَ ، ثُمَّ قَالَ : « إِنَّكُمْ شَكَوْتُمْ جَدْبَ دِيَارِكُمْ ، وَاسْتَخَارَ الْمَطْرِ عَنْ إِبَّانِ زَمَانِهِ عَنْكُمْ ، وَقَدْ أَمَرَكُمُ اللَّهُ أَنْ تَدْعُوهُ ، وَوَعَدَكُمْ أَنْ يَسْتَجِيبَ لَكُمْ » ، ثُمَّ قَالَ : « الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مَلِكِ يَوْمِ الدِّينِ ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ، يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ ، اللَّهُمَّ أَنْتَ اللَّهُ ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ الْغَنِيُّ وَنَحْنُ الْفُقَرَاءُ ، أَنْزِلْ عَلَيْنَا الْغَيْثَ ، وَاجْعَلْ مَا أَنْزَلْتَ لَنَا قُوَّةً وَبَلَاغًا إِلَى حِينٍ » ، ثُمَّ رَفَعَ يَدَيْهِ ، فَلَمْ يَتْرُكِ الرَّفْعِ حَتَّى بَدَا بَيَاضُ إِبِطَيْهِ ، ثُمَّ حَوَّلَ إِلَى النَّاسِ ظَهْرَهُ ، وَقَلَّبَ ، أَوْ حَوَّلَ رِدَاءَهُ ، وَهُوَ رَافِعٌ يَدَيْهِ ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ وَنَزَلَ ، فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ ، فَأَنْشَأَ اللَّهُ سَحَابَةً فَرَعَدَتْ وَبَرِقَتْ ، ثُمَّ أَمْطَرَتْ بِإِذْنِ اللَّهِ ، فَلَمْ يَأْتِ مَسْجِدَهُ حَتَّى سَالَتِ السُّيُولُ ، فَلَمَّا رَأَى سُرْعَتَهُمْ إِلَى الْكِنِّ ضَحِكَ ، حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ ، فَقَالَ : « أَشْهَدُ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ، وَأَنِّي عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ » (رواه ابوداؤد)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

'সালাতুল ইস্তিসকা' মূলতঃ সাধারণ দুর্ভিক্ষ ও সামষ্টিক বিপদ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আদায় করা হয় এবং এত দু'আ করা হয়, উপরে বর্ণিত হাদীস এবং অন্যান্য হাদীসসমূহের আলোকে এই সালাত সম্পর্কিত কতিপয় বিষয় জানা যায়। যথাঃ- ১. সালাতুল ইস্তিসকা উন্মুক্ত মাঠে আদায় করা উচিত, কারণ বৃষ্টি প্রার্থনার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত মাঠই যোগ্য স্থান এবং সেখানে মূলতঃ নিজ আকুতি অধিক প্রকাশ পায়।
২. জুমু'আ ও ঈদের সালাত আদায়ের জন্য যেমন গোসল করা হয় ও উত্তম পোশাক পরিধান করা হয় তদ্রূপ এ সালাতের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই। বরং এর বিপরীত সম্পূর্ণ সাধারণ পোশাক পরে দুঃস্থ ও ফকীরের বেশে আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়া উচিত। যাচ্ঞাকারীর জন্য ছেঁড়া কাপড় এবং দুঃস্থ অবস্থা বহাল রাখাই সমীচীন।
৩. নাচোড় বাঁন্দার ন্যায় দু'আ করা উচিত এবং এ উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে হাত অধিক উত্তোলন করা চাই।
এ হাদীসে চাদর পরিবর্তন করার বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ নবী কারীম ﷺ কিবলামুখী হয়ে নিজ চাদর পরিবর্তন করে নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, হে আল্লাহ্! আমি যেভাবে চাদর উল্টিয়ে নিয়েছি তুমি তেমনি বৃষ্টি বর্ষণ করে অনাবৃষ্টির অবস্থা পরিবর্তন করে দাও। সম্ভবত হাত উঠানোর ন্যায় একাজও আমলের অংশ ছিল।

এ ছাড়া হাদীসটিতে আরও বলা হয়েছে যে, রাসূল্লাল্লাহ্ ﷺ যখন সালাতুল ইস্তিসকা আদায় করেন তখন আকাশে মেঘের সঞ্চার হয় এবং তা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়, অন্যান্য সাহাবীর রিওয়ায়াতেও এ বিষয় বর্ণনা পাওয়া যায়।
আল-হামদুলিল্লাহ্! এবিষয়ে উম্মাতেরও সাধারণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। অধম তার জীবনে কমপক্ষে তিনবার এই সালাত আদায় করেছে, প্রথম শৈশবে, দ্বিতীয়বার পনের বছর বয়সে লাখনৌতে এবং তৃতীয়বার ১৯৫১ সালে পবিত্র মদীনায়। তিন বারই আল্লাহর মেহেরবাণীতে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়।

হাদীসে আরও আছে, যখন সালাত ও দু'আর ফলে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হলো তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন: أَشْهَدُ أَنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ ‌قَدِيرٌ، ‌وَأَنِّي ‌عَبْدُ ‌اللهِ ‌وَرَسُولُهُ আল্লাহ্ তা'আলা সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।"
পূর্ণ দাসত্বের দাবি হিসেবে নবী কারীম ﷺ-এর সালাত এবং দু'আর ফলস্বরূপ মু'জিযারূপে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ ﷺ এ ঘোষণা দেওয়া জরুরী মনে করেন যে এসব যা হয়েছে তা মূলতঃ আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও ইচ্ছারই অভিব্যক্তি। তাই তিনিই সার্বিক হামদ ও শুকরের মালিক, আর আমি কেবল আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। হে আল্লাহ্! তোমার বান্দা ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি রহমত বর্ষণ কর।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান