মা'আরিফুল হাদীস

সলাত অধ্যায়

হাদীস নং: ৭৩
সলাত অধ্যায়
জামা'আতের গুরুত্ব

সালাত অধ্যায়ের শুরুতে একথা পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, সালাত কেবল ফরয ইবাদতই নয় বরং ঈমান ও ইসলামের অন্যতম প্রতীক। যথাযথভাবে সালাত আদায় করা মুসলিম হওয়ার প্রমাণ এবং তা বর্জন দীনের প্রতি উদাসীনতার নামান্তর ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সম্পর্কহীনতার লক্ষণ। সালাত আদায়ের অনিবার্য দাবি হচ্ছে, বান্দা যেন লোকচক্ষুর সামনে তা আদায় করে। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর এই নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে জামা'আতের সাথে সালাত আদায়ের সুব্যবস্থা করেন এবং অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন উযর না থাকা পর্যন্ত জামা'আতে সালাত আদায় অপরিহার্য ঘোষণা করেন। আমার মতে, জামা'আতে সালাত আদায়ের বিশেষ রহস্য হচ্ছে এই যে, এর দ্বারা বান্দার পাঁচবার হিসাব গ্রহণ করা হয়। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যেতে পারে যে, যারা নিজ ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা কাটিয়ে নিয়মিত সালাত আদায় করতে পারে না তারাও জামা'আতবদ্ধভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার মধ্য দিয়ে নিয়মিত মুসল্লী হয়ে যায়। তাছাড়া জামা'আতের সালাত আদায়ের পদ্ধতি মুসলিম উম্মাহর দীনী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের একটি বিশেষ দিকও বটে। অনুরূপভাবে এটা পারস্পরিক খোঁজ নেয়ার এক অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি যার বিকল্প অচিন্তনীয়।
জামা'আতের সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহর ইবাদতে অধিক মশগুল হয়। এতে সে আল্লাহ্ অভিমুখী হয় এবং তার অন্তরে এর বিশেষ প্রভাব পড়ে। ফলে আসমানী রহমত প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর সাথে তার আন্তরিক বন্ধন স্থাপিত হয় এবং (রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিভিন্ন হাদীসের বর্ননা অনুযায়ী) সালাতে ফিরিশতাদের অংশগ্রহণের ফলে মানুষ ও ফিরিশতাদের সহাবস্থান ও সান্নিধ্য লাভ ঘটে। এও হচ্ছে জামা'আতে সালাত আদায়ের অন্যতম বরকত। এতদ্ব্যতীত জামা'আতের সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত' সালাত, সপ্তাহান্তে জুমু'আর সালাত এবং বছরে দুই বার ঈদের সালাত জামা'আতের সাথে আদায়ের মধ্য দিয়ে যে আরো বৃহত্তর ধর্মীয় ঐক্য ও সংহতির ব্যাপক উপকার লাভ করা যায়, তা অনুধাবন করা বর্তমান কালের প্রত্যেকটি মানুষের পক্ষেই অত্যন্ত সহজ। মোটকথা জামা'আতে সালাত আদায়ে এহেন বরকত ও উপকারিত নিহিত থাকায় প্রত্যেকের উপর জামা'আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, যতক্ষণ না এমন কোন উযর পরিদৃষ্ট হয় যা জামা'আতে সালাত আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জামা'আতে সালাত আদায়ের যে শিক্ষা রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছেন মানুষ যত দিন যথাযথভাবে কার্যকারী ছিল ততদিন পর্যন্ত মুনাফিক অথবা অপারগ ব্যক্তি ছাড়া প্রত্যেকেই জামা'আতে সালাত আদায়ে করতেন এবং এতে অসতর্কতাকে মুনাফিকের লক্ষণ বলে মনে করতেন। এই ভূমিকার পর জামা'আতে সম্পর্কিত কতিপয় হাদীস পাঠ করে নেয়া যেতে পারে।
৭৩. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা দেখছি যে, সেই সকল মুনাফিক যাদের মুনাফিকী জানাজানি হয়ে গিয়েছিল এবং রোগী ব্যক্তিরা ব্যতীত (মুসলমানদের) অন্য কেউ জামা'আতে অনুপস্থিত থাকে না, এমন কি যেসব রোগী দুই জনের কাঁধে ভর করে চলতে সক্ষম, তারাও জামা'আতে শরীক হত। তারপর তিনি (আবদুল্লাহ্) বলেন, রাসূলূল্লাহ্ ﷺ আমাদেরকে (দীন ও শরী'আতের) সত্যপথ প্রদর্শন করেছেন। এ সকল পথের একটি হলো, সেই মসজিদে সালাত আদায় করা যেখানে আযান দেওয়া হয়। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের নবীকে হিদায়াতের সকল পথ বাতলে দিয়েছেন আর পাঁচ ওয়াক্তের সালাত মসজিদে আদায় করা এ সব হিদায়াতের পথসমূহের অন্যতম। তোমরা যদি এই সকল
সালাত (ঐ ব্যক্তির মত জামা'আত থেকে পৃথক) কর তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নাতকেই ছেড়ে দিলে। তোমরা যদি নবীর সুন্নাত ছেড়ে দাও, তাহলে তোমরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। (মুসলিম)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ : « لَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنِ الصَّلَاةِ إِلَّا مُنَافِقٌ قَدْ عُلِمَ نِفَاقُهُ ، أَوْ مَرِيضٌ ، إِنْ كَانَ الْمَرِيضُ لَيَمْشِي بَيْنَ رَجُلَيْنِ حَتَّى يَأْتِيَ الصَّلَاةِ » ، وَقَالَ : « إِنْ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَّمَنَا سُنَنَ الْهُدَى ، وَإِنَّ مِنْ سُنَنَ الْهُدَى الصَّلَاةَ فِي الْمَسْجِدِ الَّذِي يُؤَذَّنُ فِيهِ » .....وَفِىْ رِوَايَةٍ ..... إِنَّ اللهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ سُنَنَ الْهُدَى ، وَإِنَّهُنَّ (اَىِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنَّ) مَنْ سُنَنَ الْهُدَى ، وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّي هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِي بَيْتِهِ ، لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ ، وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ. (رواه مسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামা'আতের সাথে আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন মূলত রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পথ নির্দেশনা ও শিক্ষার অন্যতম দিক, যার মাধ্যমে উম্মাত সৎপথ লাভ করতে পারে। আলোচ্য হাদীসের শেষ দিকে তিনি বলেছেন: জামা'আত ছেড়ে ঘরে সালাত আদায় করা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আদর্শ ত্যাগ করারই নামান্তর। তিনি আরো বলেছেন: এই উম্মাতের প্রাথমিক পর্যায়ের লোকেরা যেহেতু আমাদের আদর্শ ছিলেন তাই মুনাফিক ও রোগের কারণে অপারগ ব্যক্তি ছাড়া সকল মুসলমানই জামা'আতের সাথে সালাত আদায় করতেন। আল্লাহর কোন কোন বান্দা অসুস্থ হলেও লোকের সাহায্যে জামা'আতে শরীক হতেন।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা)-এর এই বর্ণনা থেকে একথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠে যে, তাঁর এবং সাধারণ সাহাবীদের দৃষ্টিতে জামা'আতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব। যারা হাদীসে উদ্ধৃত سُنَنُ الْهُدَى " দ্বারা জামা'আতকে ফিকহের পরিভাষায় 'সুন্নাত' বলেন তাঁরা সম্ভবত হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা)-এর কথা সার্বিকভাবে তলিয়ে দেখেন নি। পরবর্তী হদীসসমূহ থেকে এ বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান