মা'আরিফুল হাদীস

সালাত অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৫
সালাত অধ্যায়
আবূ মাহযূরা (রা) কে আযান শিক্ষাদান
৩৫. হযরত আবু মাহযূরা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী কারীম ﷺ তাঁকে উনিশ বাক্যে আযান শিক্ষা দিয়েছেন এবং ইকামত শিক্ষা দিয়েছেন সতের বাক্যে। (আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, দারিমী ও ইবনে মাজাহ)
کتاب الصلوٰۃ
عَنْ أَبِي مَحْذُورَةَ ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَّمَهُ الأَذَانَ تِسْعَ عَشْرَةَ كَلِمَةً ، وَالإِقَامَةَ سَبْعَ عَشْرَةَ كَلِمَةً. (رواه احمد والترمذى وابوداؤد والنسائى والدارمى وابن ماجه)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আবূ মাহযূরা (রা) বর্ণিত এ রিওয়ায়েতে আযানের বাক্য উনিশটি বলে উল্লেখ রয়েছে। কারণ শাহাদাত সম্বলিত বাক্য অতিরিক্ত চার বার এসেছে। ইকামতে শাহাদাত সম্বলিত বাক্য অতিরিক্ত চার বার না আসায় এবং ক্বাদ কামসিত সালাহ্ দু'বার আসায় সতেরটি বাক্য হয়েছে। এই কম বেশির কারণে ইকামতের বাক্য সংখ্যা হয়েছে সতেরটি। রাসূলুল্লাহ ﷺ অষ্টম হিজরীতে হুনায়ন যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে আবু মাহযূরাকে আযান শিক্ষাদান সম্বলিত ঘটনা সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে এঘটনার যে সবিস্তার বিবরণ পাওয়া যায় তা খুবই হৃদয়গ্রাহী ও মনোমুগ্ধকর এবং ঈমানের জ্যোতি বর্ধনে সহায়ক। এজন্য তা উল্লেখ করা আমি সমীচীন মনে করি। রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা বিজয় সম্পন্ন করেন। মক্কা বিজয় কালীন সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্ত একদল লোক নিয়ে হুনায়নের উদ্দেশ্যে মদীনা ত্যাগ করেন। আবূ মাহযূরা (রা) তখন একজন উদ্ধত যুবক। তখনো তিনি ইসলামে দীক্ষিত হননি। তিনি তাঁর সমবয়সী নয়জন বন্ধু নিয়ে হুনায়নের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ হুনায়ন থেকে প্রত্যাবর্তন কালে পথিমধ্যে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়।

সালাতের সময় হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মু'আযযিন আযান দেন। কিন্তু আমরা সবাই আযানকে (বরং আযান সম্বলিত দীনকেও) ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতাম। আমি আমার সাথীদের নিয়ে ঠাট্টা উপহাস ছলে আযান দিচ্ছিলাম এবং আমি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মু'আযযিনের ন্যায় উচ্চকণ্ঠে আযান দিতে শুরু করি। রাসূলুল্লাহ ﷺ আযানের শব্দ শুনে আমাদের ডেকে পাঠান। আমরা তাঁর সামনে উপস্থিত হলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কার কন্ঠ স্বর ছিল সবচাইতে উচু? আবূ মাহযূরা (রা) বলেন, আমার সাথীরা আমার দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জানিয়ে দিল। আর তাদের একথা ছিল নির্ঘাত সত্য। তিনি আমি ছাড়া সবাইকে চলে যাবার অনুমতি দেন এবং আমাকে বলেন, হে আবূ মাহযূরা! তুমি আযান দাও। বলাবাহুল্য, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন আমাকে আযান দেওয়ার নির্দেশ দেন তখন আযানের উপর ছিল আমার এমন তীব্র ঘৃণা ও অপসন্দের ভাব যা অন্য কোন বস্তুর উপর ছিল না। আল্লাহর পানাহ। তাঁর প্রতিও ছিল আমার তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ। তবে আমি তখন একান্ত নিরুপায়। তাই বাধ্য হয়ে তাঁর হুকুম তামিল করে দাঁড়িয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে আযানের তালকীন (প্রশিক্ষণ) দেন এবং বলেন: তুমি বল, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার…….. থেকে শেষ পর্যন্ত (যেমনটি পূর্ববর্তী হাদীসে হযরত আবূ মাহযূরা (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে)। আমি যখন আযান শেষ করলাম তখন তিনি আমাকে রূপা ভর্তি একটি থলে উপহার দেন এবং তাঁর মুবারক হাত আমার মাথার সম্মুখ ভাগে রাখেন। তারপর তাঁর মুবারক হাত আমার মুখমণ্ডল ও বুকের উপর রাখেন। এরপর তিনি তাঁর মুবারক হাত নাভি পর্যন্ত মুছে এই দু‘আ পাঠ করেন بَارَكَ اللهُ فِيكَ وَبَارَكَ اللهُ عَلَيْكَ "আল্লাহ্ তোমার মধ্যে বরকাত দান করুন এবং তোমার উপর বরকত নাযিল করুন।" তিনি তিনবার আমার জন্য এই দু'আ করেন। (রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই দু'আ ও মুবারক হাতের স্পর্শে আমার অন্তর থেকে কুফর ও ঘৃণা চিরতরে দূর হয়ে যায় এবং তাতে ঈমান ও ভালবাসা স্থান লাভ করে। আমি তাঁর কাছে এই বলে আরয করলাম যে, আমাকে যেন মক্কা নগরীর মসজিদুল হারামের মু'আযযিন নিয়োগ করা হয়। তিনি বললেন: যাও আজ থেকে তুমি মসজিদুল হারামে আযান দিবে।

এ বিস্তারিত বিবরণ থেকে একথা খুব সহজেই বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ কেন তাঁকে দিয়ে শাহাদাতাইন (আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ এবং আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ ﷺ) দুই দুই বারের পরিবর্তে চারচার বার বলিয়েছিলেন। সম্ভবত এর কারণ ছিল এই যে, তখনো তাঁর অন্তরে ঈমানের জ্যোতি সৃষ্টি হয়নি বরং বাধ্য হয়ে নির্দেশ পালন করেন মাত্র। তিনি তাঁর তখনকার আকীদার পরিপন্থী আযান দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য আযানের বাক্য সমূহের মধ্যে তাঁর কাছে শাহাদাতাইন ছিল সবচেয়ে কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যখন তিনি তা একবার বলে তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মত উচ্চকণ্ঠে বলার নির্দেশ দেন। অধমের ধারণা, তিনি তাঁর যবান থেকে শাহাদাতের বাক্য উচ্চারণ করানোর ব্যাপারে অটল ছিলেন এবং আল্লাহ্ যাতে উক্ত বাক্য তাঁর অন্তরে দৃঢ়মূল করে দেন, সেজন্য সর্বতোভাবে আল্লাহ্ তা'আলার দিকে তাওয়াজ্জুহ করেন। মোটকথা খুব সম্ভব রাসূলুল্লাহ ﷺ আবু মাহযূরা (রা)-এর সে সময়কার বিশেষ মানসিক অবস্থার কারণে শাহাদাতের বাক্য, বার বার পাঠ করান। নতুবা কোন বিশুদ্ধ রিওয়ায়াত দ্বারা একথা জানা যায় না যে, তিনি তাঁর মু'আযযিন বিলাল (রা) কে শাহাদাতের বাক্য চার বার বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতদ্ব্যতীত আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়িদ (রা)-এর বিশুদ্ধ বর্ণনায় ও কেবল দু'বার করে শাহাদাতের কথা জানা যায়। তবে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, আবূ মাহযূরা (রা) মাসজিদুল হারামে সর্বদা এরূপ আযান দিতেন। অর্থাৎ শাহাদাতের বাক্যসমূহ চার বার করে পাঠ করতেন। হাদীস বিশারদদের পরিভাষায় এই প্রক্রিয়াকে 'তারজী' বলে। তবে তার এ তারজী করার কারণ এই হয়ে থাকবে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে যেরূপ আযানের শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং যার বদৌলতে তাঁর দীন নসীব হয়েছিল সেজন্য গভীর শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ তিনি 'তারজী" করতেন। অন্যথায় তিনি হযরত বিলাল (রা)-এর আযান সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। ঘটনার ধারাবাহিকতায় এও পাওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর মুবারক হাত দ্বারা আবূ মাহযূরা (রা) সম্মুখ ভাগের যে চুলগুচ্ছ স্পর্শ করেন তা তিনি কখনো কাটতেন না, তবে এই অধমের মতে, এও যেমন তাঁর অপূর্ব প্রীতির লক্ষণ, তেমনি আযানে তারজীও ছিল অনুরূপ ব্যাপার। তাই তিনি সর্বদা তারজী সহকারে আযান দিতেন। নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সবিশেষ অবহিত ছিলেন। কিন্তু তথাপিও তিনি কখনো নিষেধ করেননি। তাই এ প্রক্রিয়া জায়িয হওেয়ার ব্যাপারে কোনরূপ সন্দেহের আবকাশ নেই। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (র) এ বিষয়ে যে সমাধান দিয়েছেন তা মূলতঃ এরূপ যে, আযান ও ইকামতের শব্দমালার পার্থক্য মূলত আল কুরআনের বিভিন্ন কিরা'আতের পার্থক্যের অনুরূপ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান