মা'আরিফুল হাদীস

পবিত্রতা অধ্যায়

হাদীস নং:
পবিত্রতা অধ্যায়
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার হাকীকত এবং ইসলামে এর স্থান

ইসলামের দৃষ্টিতে সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, কা'বাঘর তাওয়াফ ইত্যাদি ইবাদাত আদায়ের ক্ষেত্রে পবিত্রতা অর্জন কেবল অত্যাবশ্যক শর্তই নয় বরং কুরআন হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, তা দীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও অন্যতম উদ্দেশ্যও বটে। কুরআন মাজীদে তাই তো ইরশাদ হয়েছে:

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ

আল্লাহ্ তাওবাকারীদের ভালবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরকেও ভালবাসেন। (২ সূরা বাকারা: ২২২)
কুবা পল্লীতে বসবাসকারী মু'মিনদের প্রশংসায় কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে:

فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُوا ۚ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ

সেখানে এমন লোক আছে যারা পবিত্রতা অর্জনকে ভালবাসে এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে আল্লাহ্ পসন্দ করেন।" (৯ সূরা তাওবা: ১০৮)

উল্লিখিত আয়াত দু'টি থেকেই বুঝা যায় ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব কত বেশী। আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম ক্রমিকে সহীহ মুসলিমের বর্ণিত হাদীসখানার অংশ الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيْمَانِ এর শাব্দিক অনুবাদেই এরূপ ইংগিত রয়েছে তাহারাত বা পবিত্রতা অর্জন ইসলামের একটি বিধান মাত্র নয় বরং ধর্মের ও ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে।

অন্যান্য হাদীসে একে "ঈমানের অর্ধেক" বলেও উল্লেখ রয়েছে।
আমাদের মুহতারাম উস্তাদ শায়খুল মাশায়িখ হযরত শাহওয়ালী উল্লাহ্ (র) এর একটি মূল্যায়ন এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা'য় তিনি বলেন: "আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে এ কথার হাকীকত বুঝিয়েছেন যে, কল্যাণ লাভের রাজপথ হল শরী'আত, যার দিকে আহবান করার লক্ষ্যে নবী-রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছে। এর (শরী'আত) অনেক শাখা রয়েছে এবং প্রত্যেক শাখার শত শত প্রশাখা রয়েছে। কিন্তু একে মোটামুটি চারটি শিরোনামে একত্র করা যেতে পারে। যথা ১. তাহারাত (পবিত্রতা). ২. বিনয় ৩. উদারতা ৪. ন্যায়নিষ্ঠা”।

এরপর শাহওয়ালী উল্লাহ (র) প্রত্যেকটির হাকীকত বর্ণনা করেছেন যা গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলে একথা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, নিঃসন্দেহে সমগ্র শরী'আতকে এই চার ভাগে ভাগ করা যায়।
আমি এখানে শাহ সাহেব (র)-এর কেবল সে প্রসঙ্গই আলোচনা করব যাতে তিনি পবিত্রতার হাকীকত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: "কোনো সুস্থ মননের ও পরিচ্ছন্ন মানসিকতার মানুষ যার অন্তর পাশবিকতার দাবি পূরণ করেনি এবং তাতে জড়িয়েও পড়েনি, সে যখন কোনভাবে অপবিত্র হয়ে পড়ে চাই তা পেশাব পায়খানা দ্বারা হোক কি স্ত্রী সম্ভোগ দ্বারা সে নিশ্চয়ই নিজের মধ্যে এক প্রকার সংকোচ, রুচিহীনতা, মালিনতা, গ্লানি এবং অস্বচ্ছতা অনুভব করবে। তারপর যদি সে পেশাব পায়খানা সেরে নেয় এবং ভালভাবে ইস্তিঞ্জা ও উযু করে অথবা যদি সে স্ত্রী সম্ভোগ করে গোসল করে নেয় এবং ভাল কাপড় চোপড় পরে নেয় এবং সুগন্ধি মাখে তবে সে সংকোচ গ্লানি ও অস্বচ্ছতা থেকে সহসা মুক্ত হতে পারে। এছাড়াও সে তার নিজ স্বভাবে প্রবল আনন্দও অনুভব করে। সুতরাং বলা যায়, উপরে বর্ণিত দুই অবস্থার প্রথমটি অপবিত্রতা এবং দ্বিতীয়টি পবিত্রতা নামে পরিচিত। মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি সুস্থ স্বভাব ও প্রকৃতির অধিকারী, সে এ দুই অবস্থার মধ্যেকার ব্যবধান পরিষ্কারভাবে অনুভব করে এবং স্বভাবের দাবি হিসেবে অপবিত্রতা অপসন্দ করে এবং পবিত্রতা পসন্দ করে।"

মানুষের এই পবিত্রাবস্থার সাথে আল্লাহর ফিরিশতাদের সাথে রয়েছে কতই না অপূর্ব মিল। কারণ তাঁরা সর্বদা অপবিত্রতা থেকে পবিত্র ও জ্যোতির্ময় অবস্থায় দিন কাটান। তাই সর্বক্ষণ পবিত্রাবস্থায় থাকা মানুষকে এনে দেয় ফিরিশতা সূলভমাহাত্ম্য। ফলে মানুষ ও উর্ধ্ব জগতে অবস্থানকারীদের (নৈকট্য প্রাপ্ত ফিরিশতাদের) থেকে উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে। পক্ষান্তরে মানুষ যখন অপবিত্র অবস্থায় বিচরণ করে তখন তার সাথে শয়তানের অপূর্ব মিল লক্ষ্য করা যায়। আর তখন তার মধ্যে শয়তানী কুমন্ত্রণা গ্রহণের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। ফলে তার অন্ধকারের গভীর কুঠরীতে তলিয়ে যায়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৪

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ্ (র)-এর উল্লিখিত বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, অপবিত্রতা ও পবিত্রতা মানুষের আত্মিক ও সহজাত দু'টি অবস্থার নাম। আমরা যে সকল বস্তুকে নাপাকী এবং পবিত্রতা বলি তা প্রকৃতপক্ষে তার কারণসমূহ মাত্র এবং শরী'আত এই কারণসমূহের উপরই বিধান আরোপ করে এবং তা নিয়ে আলোচনা করে।

আশা করা যায় যে, তাহারাতের হাকীকত এবং মানবাত্মার জন্য তার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে হযরত শাহ সাহেব (র)-এর এই ভাষ্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে। এ থেকে আরো বুঝা যায় যে, পবিত্রতা গোটা শরী'আতের এক চতুর্থাংশ বটে।

হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থের অন্য একস্থানে তাহারাতের বিধান এবং এর তাৎপর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- "তাহারাত তিন প্রকার। যথা ১. অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়া অর্থাৎ যে সকল অবস্থায় গোসল অথবা উযূ ওয়াজিব কিংবা মুস্তাহাব ঐ সকল অবস্থায় গোসল অথবা উযূ করে পবিত্রতা অর্জন করা।
২. প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান অপবিত্রতা এবং নাপাকী থেকে শরীর, কাপড় চোপড় বা কোন স্থানকে পবিত্র করা এবং ৩. শরীরের যে সকল স্থান থেকে দুর্গন্ধময় বস্তু অথবা ময়লা বের হয়-তা পরিষ্কার করা, যেমন, দাঁত পরিষ্কার করা, নাকের ময়লা পরিষ্কার করা, নখ কাটা এবং নাভীর নিচের চুল কর্তন করা।" (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, তাওরাত অধ্যায়, ১ম ২য় খণ্ড, পৃ.১৭৩)

নিম্নে সে সব হাদীস উপস্থাপিত হবে তার কিছু অংশ হবে সাধারণভাবে তাহারাতের সাথে সংশ্লিষ্ট যা উল্লিখিত তিন প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। আর কিছু অংশে ঐ তিন প্রকারের কোন এক প্রকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই ভূমিকার পর তাহারাত সম্পর্কীয় কতিপয় হাদীস পাঠ করা যায়।
১. হযরত আবূ মালিক আশ'আরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: তাহারাত-পবিত্রতা হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ। আল-হামদু লিল্লাহ্ আমলের পাল্লা ভরে দেয় এবং সুবহানাল্লাহ্ ও আল-হামদু লিল্লাহ্ পাল্লা ভরে দেয়, কিংবা রাসূলল্লাহ্ বলেন: আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থান ভরে দেয়। সালাত হচ্ছে নূর বা আলো, দান-সাদাকা হচ্ছে দলীল, ধৈর্য হচ্ছে জ্যোতি, কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে দলীল। প্রত্যেকে ভোর উঠে আপন আত্মাকে ক্রয়-বিক্রয় করে, ফলে সে হয় নিজের মুক্তিদাতা কিংবা ধ্বংসকারী। (মুসলিম)
کتاب الطہارت
عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « الطُّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَأُ الْمِيزَانَ ، وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَآَنِ - أَوْ تَمْلَأُ - مَا بَيْنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ، وَالصَّلَاةُ نُورٌ ، وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ ، وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ ، كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَايِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا » (رواه مسلم)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

স্পষ্টতই এ হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটি ভাষণ। এতে তিনি দীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনা করেছেন। এর প্রথম অংশ - الطُّهُورُ شَطْرُ الايمان পবিত্রতার সাথে সংশ্লিষ্ট। এ কারণেই হাদীস গ্রন্থ সমূহের তাহারাত অধ্যায়ে এ হাদীস অন্তর্ভুক্ত থাকে।

বক্ষ্যমান হাদীসে উদ্ধৃত " شطر " শব্দের অর্থ 'অর্ধেক'। কেননা এ মর্মে ইমাম তিরমিযী (র) সূত্রে অন্য একটি হাদীসে شطر শব্দের স্থলে نصف অর্থাৎ (الطهور نصف الايمان) তাহারাত ঈমানের অর্ধেক) বলে বর্ণনা করেছেন। জামে তিরমিযী, দাওয়াত অধ্যায়, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯০

কিন্তু আমার (গ্রন্থকার) মতে, نصف ও شطر শব্দদ্বয়ের অর্থ হচ্ছে তাহারাত ও পবিত্রতা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ্ (র)-এর যে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে তাতেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কাজেই এর বেশী বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ পবিত্রতার গুরুত্ব বর্ণনা করে আল্লাহর তাসবীহ্ ও তাহমীদের সাওয়াব এবং ফযীলত বর্ণনা করেছেন। তাসবীহ্ অর্থাৎ 'সুবহানাল্লাহ্' বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের দৃঢ়-বিশ্বাসের প্রকাশ ও সাক্ষ্যদান যে আল্লাহর সত্তা অত্যন্ত পবিত্র এবং তাঁর জন্য যা অশোভন ও অসমীচীন তা থেকে তিনি পবিত্র।
তাহমীদ অর্থাৎ 'আল-হামদুলিল্লাহ্' বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের দৃঢ় প্রত্যয়ের ঘোষণা ও সাক্ষ্য দান যে সার্বিক কল্যাণ ও মাহাত্ম্যের জন্য যাঁর প্রশংসা করা যায় তিনি কেবল সেই আল্লাহ্ তা'আলারই পবিত্র সত্তা। আর এজন্যেই সার্বিক প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য। উল্লেখ্য যে তাসবীহ্ ও তাহমীদ আল্লাহর নিষ্পাপ ফিরিশতাদের বিশেষ ওয়াযীফা। কুরআন মাজীদে ফিরিশতাদের যাবানেই তার প্রমাণ মিলে- نَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ আমরাই তো তোমার স্তুতিগান ও সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি)। সুতরাং দু'টি বাক্য মানুষের জন্য ও উত্তম ওয়াযীফা বিবেচিত হতে পারে। কারণ সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টার স্তুতি ও গুণগানে মানুষের নিরত থাকা চাই। তাই তো রাসূলুল্লাহ ﷺ এ হাদীসে মানুষকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে বলেছেন, 'সুবহানাল্লাহ্' মানুষের আমলের পাল্লা ভরে দেয়। সুবহানাল্লাহর সাথে যদি 'আল-হামদুল্লিাহ্' মিলিয়ে পাঠ করা হয় তবে উভয়ের জ্যোতিতে আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী অংশ আলোকময় হয়ে ওঠে। 'সুবহানাল্লাহ্' বলায় আমলের পাল্লা ভরে যাওয়া এবং 'সুবহানাল্লাহ্ ও আল-হামদু লিল্লাহ' একত্রে বলায় আসমান-যমীন জ্যোতির্ময় হওয়ার মর্ম সম্পর্কিত উপলব্ধি আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর বিশেষ বিশেষ বান্দাদের দান করেন এবং আসমান-যমীন পূর্ণ জ্যোতি কেবল তাঁদের সামনেই ভেসে উঠে। আমাদের মত সাধারণ লোকদের জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ যা বর্ণনা করেছেন তার উপর অবিচল আস্থা রাখা এবং কাজে পরিণত করে উপকৃত হওয়া উচিৎ। তাসবীহ ও তাহমীদের ফযীলত অনুপ্রেরণা দান করার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাতের ব্যাপারে বলেন, 'সালাত আলো সদৃশ'। পৃথিবীতে সালাতের কার্যকর বৈশিষ্ট্যর বহিঃপ্রকাশ হয় তার বরকতে অন্তরে জ্যোতি সৃষ্টি হবার মধ্য দিয়ে। কাজেই যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে সালাত আদায় করে সে অন্তরে তা অনুভব করে। আর এ জ্যোতির প্রভাবে যাবতীয় অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে নিজকে রক্ষা করতে পারে। তাই তো কুরআন ইরশাদ হয়েছে আমাদের মত সাধারণ যা বর্ণনা করেছেন তার উপর অবিচল আস্থা إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ "সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে।" (২৯ সূরা আনকাবূত : ৪৫)

আখিরাতের বিভিন্ন মনযিলে সালাতের জ্যোতির প্রভাব এমনি হবে যাতে অন্ধকারের ঘনঘটা দূর হয়ে যাবে আর জ্যোতি মুসল্লীর সাথী হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে: نُورُهُمْ يَسْعَىٰ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ তাদের জ্যোতি তাদের সামনে ও দক্ষিণ পাশে ধাবিত হবে।" (৬৬ সূরা তাহরীম: ৮)

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ দান খায়রাত সম্পর্কে বলেন যে, এটা হচ্ছে প্রমাণ স্বরূপ। এ দুনিয়ায় দান সাদাকা প্রমাণ হওয়ার মর্ম হচ্ছে এটা প্রমাণ করে যে দাতা একজন মু'মিন ও মুসলিম। কারণ তাঁর অন্তরে যদি ঈমান না থাকত তবে নিজের উপার্জন থেকে দান করা তার পক্ষে কোন সহজ ব্যাপার ছিলনা। কেননা- گرزر طلبی سخن دریں است যদি সোনা চাও তবে তাতে বলার আছে।" আখিরাতে এ বৈশিষ্টের প্রকাশ ঘটবে এভাবে যে, একনিষ্ঠদাতার দান খায়রাতকে তাঁর ঈমানের ও আল্লাহর ইবাদতকারী হওয়ার প্রমাণরূপে গ্রহণ করে। তাঁকে পর্যাপ্ত পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ ধৈর্য সম্পর্কে বলেন: ধৈর্য হচ্ছে এক প্রকার জ্যোতি। কোন কোন বিশেষজ্ঞ আলিম সালাত ও সাদাকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে এখানে 'সবর' এর অর্থ করেছেন সিয়াম। কিন্তু এই অধমের (গ্রন্থকার) মতে গ্রহণযোগ্য অভিমত হল, সবর বা ধৈর্য শব্দটি এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে 'সবর' এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি সত্তাকে আল্লাহর আইনের অধীন করা এবং এ পথের যাবতীয় দুঃখ যাতনা ভোগ করতে থাকা। তাই এখানে 'সবর' অর্থ হচ্ছে, নিজেকে পুরোপুরি দীনের মধ্যে প্রবিষ্ট করা। এতে সালাত, দান-সাদাকা, সিয়াম, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি ছাড়াও আল্লাহ্ এবং তাঁর দীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে সর্ববিধ কষ্ট মেনে নেয়া এবং নিজ প্রবৃত্তিকে প্রদমিত রাখা, এসব বিষয়ই এর আওতাভুক্ত। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ এ সম্পর্কে বলেছেন, 'সবর জ্যোতি সদৃশ'। কুরআন মাজীদে চাঁদের আলোকে 'নূর' এবং সূর্যের আলোকে 'যিয়া' বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا "তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চাঁদকে জ্যোতির্ময় করেছেন।" (১০ সূরা ইউনুস: ৫)
সবর ও সালাত থেকে নির্গত জ্যোতির সম্পর্ক হবে সূর্য ও চাঁদের মধ্যে যেরূপ সম্পর্ক রয়েছে অনুরূপ। আল্লাহ্ তা'আলাই সর্বজ্ঞ।

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ কুরআন মাজীদ সম্পর্কে ইরশাদ করেন: "কুরআন মাজীদ হয় তোমাদের পক্ষে, নয় তোমাদের বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ হবে।" একথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কুরআন মাজীদ আল্লাহর বাণী ও তাঁর পথনির্দেশ। সুতরাং এর সাথে যদি তোমাদের ভাল সম্পর্ক থাকে এবং তোমরা যদি তার অনুসারী হও যেমনটি মু'মিনের ঈমানের দাবি, তাহলে তা হবে তোমাদের পক্ষে প্রমাণ আর বিপরীত হলে তা হবে তোমাদের বিপক্ষে পমাণ।

উল্লিখিত সতর্কবাণী ও অনুপ্রেরণামূলক বাণী প্রদানের পর রাসূলুল্লাহ ﷺ হাদীসের শেষাংশে ইরশাদ করেন: 'এ দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ব্যস্ততার মাঝে দিন কাটায় এবং সে প্রত্যহ নিজ সত্তাকে বেচাকেনা করে।

কখনো তা তাকে মুক্তি দেয়, আবার কখনো তা তাকে ধ্বংসের মুখোমুখি করে। এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মানব জীবন একজন ব্যবসায়ীর ধারাবাহিক বেচাকেনার সাথে তুলনীয়। যদি সে আল্লাহর ইবাদাত এবং সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে, তবে সে নিজ জীবনের জন্য উত্তম বস্তুই উপার্জন করল এবং তার মুক্তির পথ সুগম করল। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে সে যদি প্রবৃত্তির দাস হয় আল্লাহকে ভুলে জীবন অতিবাহিত করে, তবে সে নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনে এবং নিজকে জাহান্নামী করে তোলে।

আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের সকলকে এসব তাৎপর্যের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই সতর্কবাণী ও অনুপ্রেরণা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দিন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান