মা'আরিফুল হাদীস

আখলাক অধ্যায়

হাদীস নং: ১২৪
আখলাক অধ্যায়
আবু বকর (রা) গালির জবাব দিলে রাসূল ﷺ রাগান্বিত হলেন
১২৪. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আবূ বকর (রা)-কে গালি দিল। নবী ﷺ বসে হাসছিলেন এবং বিস্মিত হচ্ছিলেন। অতঃপর সে খুব বেশি গালি দিল। আবু বকর (রা) তার কতিপয় গালির জবাব দিলেন। নবী ﷺ রাগান্বিত হলেন এবং উঠে গেলেন। অতঃপর আবু বকর (রা) তাঁর কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে গালি দিচ্ছিল, আপনি বসেছিলেন। কিন্তু আমি তার কতিপয় গালির উত্তর দিলাম। আপনি রাগান্বিত হলেন এবং উঠে গেলেন। নবী ﷺ বললেন : ফেরেশতা তোমার সাথে থেকে তার গালির জবাব দিচ্ছিলেন। যখন তুমি তাকে গালির জবাব দিলে, তখন শয়তান সে স্থান দখল করল। অতঃপর নবী ﷺ বললেন: হে আবু বকর! তিনটি জিনিস পুরোপুরি সত্য। যখন কোন বান্দার উপর যুলম করা হয় এবং সে ইযযত ও জালালের অধিকারী আল্লাহর খাতিরে তার প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ না করে, তখন আল্লাহ প্রতিদান হিসেবে তার সাহায্যের জন্য তাকে শক্তিশালী ও সম্মানিত করেন। যখন কোন ব্যক্তি সিলায়ে রেহেমী বা আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য দান-খয়রাতের দরজা উন্মুক্ত করে, তখন আল্লাহ তার প্রতিদান হিসেবে তাকে অনেকগুণ দান করেন। যখন কোন ব্যক্তি সম্পদ বৃদ্ধির জন্য সওয়ালের দরজা উন্মুক্ত করে, তখন আল্লাহ তা (তার ধন) হ্রাস করে দেন। (মুসনাদে আহমদ)
کتاب الاخلاق
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، أَنَّ رَجُلًا شَتَمَ أَبَا بَكْرٍ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَالِسٌ ، يَتَعَجَّبُ وَيَتَبَسَّمُ فَلَمَّا أَكْثَرَ رَدَّ عَلَيْهِ بَعْضَ قَوْلِهِ ، فَغَضِبَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَامَ ، فَلَحِقَهُ أَبُو بَكْرٍ ، وَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ كَانَ يَشْتُمُنِي وَأَنْتَ جَالِسٌ ، فَلَمَّا رَدَدْتُ عَلَيْهِ بَعْضَ قَوْلِهِ ، غَضِبْتَ وَقُمْتَ ، قَالَ : "كَانَ مَعَكَ مَلَكٌ يَرُدُّ عَنْكَ ، فَلَمَّا رَدَدْتَ عَلَيْهِ وَقَعَ الشَّيْطَانُ ، ثُمَّ قَالَ : " يَا أَبَا بَكْرٍ ثَلَاثٌ كُلُّهُنَّ حَقٌّ : مَا مِنْ عَبْدٍ ظُلِمَ بِمَظْلَمَةٍ فَيُغْضِي عَنْهَا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ، إِلَّا أَعَزَّ اللهُ بِهَا نَصْرَهُ ، وَمَا فَتَحَ رَجُلٌ بَابَ عَطِيَّةٍ ، يُرِيدُ بِهَا صِلَةً ، إِلَّا زَادَ اللهُ بِهَا كَثْرَةً ، وَمَا فَتَحَ رَجُلٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ ، يُرِيدُ بِهَا كَثْرَةً ، إِلَّا زَادَ اللهُ بِهَا قِلَّةً " (رواه احمد)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসলাম তার অনুসারীদেরকে উত্তম আখলাকের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম কখনো মন্দের দ্বারা মন্দ জিনিসের প্রতিরোধ করতে চায় না। ইসলাম অশ্লীল কথাবার্তার জবাব অশ্লীল কথাবার্তার দ্বারা বা গালির জবাব গালির দ্বারা দিতে চায় না। উত্তম আচরণের দ্বারা মন্দ জিনিসের প্রতিরোধ করা উচিত। উত্তম আখলাকের দ্বারা মন্দ আখলাকের মোকাবিলা করা হলে মন্দ আচরণকারী তার বিবেকের কাছে লজ্জিত হয় এবং উত্তম আচরণকারীর প্রতি তার মনে সমীহ ও শ্রদ্ধার সৃষ্টি হয়।

শয়তানের প্ররোচনায় যখন কোন ব্যক্তি অন্যকে গালি দেয়, তার কোন জবাব না দেয়াই শ্রেয়। কারণ তাতে সমস্যার সমাধান হয় না; বরং অভদ্র ও অশ্লীল বাক্য প্রয়োগকারীর সাথে তর্কবিতর্ক করলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ভবিষ্যতে তাকে সংশোধন করার যাবতীয় সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়, আশেপাশের মানুষ তামাশা দেখার জন্য উপস্থিত হয়। তাই কুরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
-"জাহিল ব্যক্তিদের সম্মুখীন হলে আল্লাহর ইবাদতকারিগণ তাদেরকে সালাম বলে-অর্থাৎ তাদের থেকে দূরে সরে যায়।"

হাদীসে বলা হয়েছে, গালির জবাবে গালি না দেয়া পর্যন্ত ফেরেশতা হযরত আবূ বকর (রা)-এর পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছিলেন। জবাব দান দু'ভাবে হতে পারে: হয় তো ফেরেশতা গালিদানকারীর বিরুদ্ধে মন্দ দু'আ করছিলেন কিংবা সম্ভবত ফেরেশতা হযরত আবূ বকর (রা)-এর জন্য বরকতের দু'আ করছিলেন এবং তাঁর আমলনামায় সওয়াব লিখছিলেন।

হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক গালির জবাব গালির যারা দেয়া হলে ফেরেশতা খায়ের ও বরকতের দু'আ বন্ধ করে দিলেন। তার পরিবর্তে শয়তান এসে হাযির হল এবং তার কাজ শুরু করে দিল। অর্থাৎ শয়তান উভয় পক্ষকে উত্তেজিত করার সুযোগ লাভ করল।

যদি মযলুম ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যুলমের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে, তাহলে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যালিমকে সংশোধন করার উদ্দেশ্য ছাড়া ঈমানদার ব্যক্তি যুলমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না। ঈমানদারগণ কখনো যুলমের কাছে নতি স্বীকার করেন না বা যালিমকে আরো যুলম করার সুযোগ দান করেন না, যালিমের যুলম বন্ধ করার জন্য ঈমানদারগণ সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। ঈমানদার বিজয়ী হলে বিজিতদের অপরাধ মাফ করে দেন। প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হলেও প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না। অধীনস্থদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমার চোখে দেখেন। কিন্তু তিনি যালিমের যুলমকে ভয় করেন না। অহংকারীর কাছে মাথা নত করেন না, বরং যালিমের বিষদাঁত ভাঙ্গবার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে মাঠে নেমে পড়েন। অবশ্য যালিমকে তিনি তার যুলমের চেয়ে বেশি শাস্তি দান করেন না বা যালিম গর্হিত পন্থা অবলম্বন করে থাকলেও তিনি কোন গর্হিত, নাজায়েয বা মানবতা বিবর্জিত পন্থা অবলম্বন করেন না। মোটকথা ঈমানদার যখন যালিমকে মাফ করেন তখন তাকে সংশোধন করার জন্যই তা করে থাকেন। আর যখন যালিমকে শাস্তি দান করেন তখন তার যুলমকে বন্ধ করার জন্য তা করে থাকেন। তিনি যালিমের উপর বিন্দুমাত্রও যুলম করেন না। ঈমানদারদের চরিত্রের এ দিকটির উপর আলোপাত করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُونَ وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ.

"যখন তাদের উপর অন্যায় করা হয় তারা তার মুকাবিলা করে। আর মন্দের প্রতিদান অনুরূপ মন্দ। অতঃপর যে মাফ করে দেয় এবং আপোস-নিষ্পত্তি করে, তার প্রতিদান আল্লাহর যিম্মায় রয়েছে। আল্লাহ যালিমদের পসন্দ করেন না।" (সূরা শূরা: ৩৯-৪০)

আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সাহায্য-সহানুভূতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে যে সম্পদ ব্যয় করা হয়, তাতে ব্যয়কারীর সম্পদ বিনষ্ট হয় না, বরং আল্লাহ তার সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন।

সম্পদ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে যে মানুষের কাছে হাত সম্প্রসারণ করে, তার ভাগ্যে আল্লাহ অভাব-অনটন লিখে দেন এবং তার সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান