মা'আরিফুল হাদীস

রিকাক অধ্যায়

হাদীস নং: ৭৪
রিকাক অধ্যায়
রাসূল ﷺ-এর শপথকৃত তিনটি জিনিস
৭৪. হযরত আবু কাবশাহ আল-আনমারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসুল ﷺ-কে বলতে শুনেছেন: আমি তিনটি জিনিসের শপথ করছি এবং এ ছাড়া আরো একটা কথা বলছি, তোমরা তা স্মরণ রেখো। যে সব জিনিসের শপথ করছি, সেগুলো হল দান-খয়রাতের দ্বারা বান্দার সম্পদ হ্রাস পায় না, যুলমে ধৈর্যধারণকারী কোন মযলুম বান্দা নেই যার ইযযত আল্লাহ বৃদ্ধি করেন না এবং এমন কোন বান্দা নেই যে সওয়ালের দরজা খুলেছে অথচ আল্লাহ তার উপর দারিদ্র্যের দরজা খুলে দেননি। অতঃপর নবী ﷺ বললেনঃ তোমাদের যা বলছি তোমরা তা স্বরণ রেখ। নিশ্চয়ই দুনিয়া চার প্রকার ব্যক্তির জন্য। (এক) যে বান্দাকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম দিয়েছেন এবং এজন্য সে আল্লাহকে ভয় করে তা দিয়ে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করে এবং তাতে আল্লাহর যে হক রয়েছে তা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করে। সে শ্রেষ্ঠ মনযিলের অধিকারী। (দুই) যে বান্দাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন সম্পদ দেননি; কিন্তু তার সৎ নিয়্যত রয়েছে। সে বলে, আমার সম্পদ থাকলে আমিও অমুক ব্যক্তির মত করতাম। তাদের উভয়ের সমান সওয়াব হবে। (তিন) যে বান্দাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, ইলম দেননি এবং সে মূর্খের ন্যায় আল্লাহকে ভয় না করে নিজের সম্পদ যথেচ্ছভাবে ব্যয় করে, তা দিয়ে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি রহম করে না এবং যেভাবে ব্যয় করা দরকার সেভাবে ব্যয় করে না, সে নিকৃষ্ট মনযিলের অধিকারী। (চার) যে বান্দাকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম কোনটাই দেননি এবং সে বলে, যদি আমার সম্পদ থাকত তাহলে আমি অমুক ব্যক্তির মত ব্যয় করতাম। সুতরাং এটাই তার নিয়্যত এবং তাদের উভয়ের সমান গুনাহ হবে। (তিরমিযী)
کتاب الرقاق
عَنْ أَبِىْ كَبْشَةَ الأَنَّمَارِيُّ ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : « ثَلَاثٌ أُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ وَأُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ » فَامَّا الَّذِىْ اُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ فَاِنَّهُ « مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ ، وَلَا ظُلِمَ عَبْدٌ مَظْلِمَةً صَبَرَ عَلَيْهَا إِلَّا زَادَهُ اللَّهُ بِهَا عِزًّا ، وَلَا فَتَحَ عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلَّا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْهَا بَابَ فَقْرٍ وَاَمَّا الَّذِىْ أُحَدِّثُكُمْ فَقَالَ : حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ » "إِنَّمَا الدُّنْيَا لِأَرْبَعَةِ نَفَرٍ ، عَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ ، وَيَصِلُ رَحِمَهُ ، وَيَعْمَلُ لِلَّهِ فِيهِ بِحَقِّهِ ، فَهَذَا بِأَفْضَلِ المَنَازِلِ ، وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالًا فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ : لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلَانٍ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ ، وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا ، فَهُوَ يَتَخَبَّطُ فِي مَالِهِ لِغَيْرِ عِلْمٍ لَا يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ ، وَلَا يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ ، وَلَا يَعْمَلُ فِيْهِ بِحَقٍّ ، فَهَذَا بِأَخْبَثِ المَنَازِلِ ، وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللَّهُ مَالًا وَلَا عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ أَنَّ لِي مَالًا لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلَانٍ فَهُوَ نِيَّتُهُ وَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ " (رواه الترمذى)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীসের প্রথম অংশে নবী ﷺ তিনটি জিনিসের প্রতি তাঁর উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দান-খয়রাতের দ্বারা সম্পদ হ্রাস পায় না। দানের মাধ্যমে সম্পদ এক হাত হতে অন্য হাতে পৌছে। অর্থের হস্তান্তরের মাধ্যমে সমাজের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হয়, বহু লোক তাতে লাভবান হয়, সমাজের সমষ্টিগত সম্পদ বৃদ্ধি পায়। দানকারী ব্যক্তি সমাজের একজন সদস্য বিধায় সমাজের বর্ণিত সম্পদের হিসসা সে সরাসরি না পেলেও পরোক্ষভাবে লাভ করে থাকে। অধিকন্তু আল্লাহ দাতা ব্যক্তির সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন এবং আখিরাতেও তাকে বহুগুণ সওয়াব দেবেন। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে:
يُرْبِي الصَّدَقَاتِ “আল্লাহ দানকে বৃদ্ধি করেন।"
অন্যের মুখাপেক্ষী বান্দাকে আল্লাহ পসন্দ করেন না। যে বান্দা অন্যের নিকট হাত সম্প্রসারণ করে, সে নিজের ব্যক্তিত্বকে মানুষের কাছে খর্ব করে এবং যেহেতু সে আল্লাহর কাছে না চেয়ে মানুষের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চায়, তাই সে আল্লাহর সহানুভূতির দৃষ্টি লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। অধিকন্তু সওয়ালের মাধ্যমে যে প্রয়োজন পূরণ করে, সে কখনো নিজের শ্রম ও যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। এ কারণে সে দারিদ্র্যের অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে পারে না। অপরপক্ষে যে নিজের অভাব গোপন রাখে এবং প্রফুল্ল চিত্তে তা বরদাশত করে, আল্লাহ তার এক বছরের রিযকের ব্যবস্থা করে দেন।

মযলুমকে আল্লাহ ভালবাসেন। তাদের ও আসমানের মাঝে কোন পর্দা নেই। মযলুম বান্দা যে দু'আ করে, আল্লাহ তা কবুল করেন। বিনীত সবরকারী মযলুম বান্দার হিসসা কখনো বিনষ্ট করেন না। বিলম্বে হলেও আল্লাহ অহঙ্কারীর অহঙ্কার খর্ব করেন, যালিমকে শাস্তি দেন এবং সবরকারী মযলূমের মর্যাদা উন্নত করেন।

হাদীসের শেষাংশে চার প্রকারের লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এক: যাদের সম্পদের সাথে ইলম ও আল্লাহ-ভীতি রয়েছে এবং যাদের সম্পদ থেকে আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের হক সম্পূর্ণরূপে আদায় হয়, তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি।

দুই: যাদের ইলম রয়েছে, হক-হালালের জ্ঞান রয়েছে, যাদের জ্ঞান ও আমলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং যাদের অন্তরে আল্লাহ-ভীতি রয়েছে, তাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন। শুধু ইলম থাকলে চলবে না, ইলমের সঙ্গে আমলও থাকতে হবে। এ ধরনের সৎকর্মশীল ব্যক্তি ধনী না হলেও তাকে আল্লাহ তার নিয়্যতের জন্য ধনী ব্যক্তির দান-খয়রাতের সমতুল্য সওয়াব দিয়ে থাকেন।

আল্লাহ-ভীরু ব্যক্তির সৎ নিয়্যতের জন্যও আল্লাহ তাকে অজস্র পূণ্য দান করে থাকেন। মুত্তাকী বান্দার প্রতি আল্লাহ অশেষ মেহেরবান।

তিন : আল্লাহ যাদের সম্পদ দিয়েছেন, ইলম দেননি এবং তারা তাদের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যয় করে না, আল্লাহ ও তাঁর বান্দার হক আদায় করে না। আল্লাহ তাদেরকে পসন্দ করেন না। তারা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট মর্যাদার অধিকারী। তারা তাদের অন্যায় আচরণের জন্য শাস্তি পাবে।

চার : যাদেরকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম কোনটাই দেননি এবং যাদের অন্তরে খারাপ পথে অর্থ ব্যয়ের বাসনা রয়েছে। আর মুখ থেকে তার ঘোষণাও প্রচারিত হয় যে. মালদার হলে অমুক ব্যক্তির মত সম্পদ ব্যয় করতাম; তাহলে তাদের গুনাহ তৃতীয় পর্যায়ে বর্ণিত ব্যক্তির ন্যায় হবে।

এক্ষেত্রে স্বভাবতই পাঠকদের মনে একটা প্রশ্ন জাগবে, যারা প্রকৃতপক্ষে গুনাহ করল না এবং অসৎ পথে সম্পদ খরচ করতে সমর্থও নয়, তারা কেন মাল খরচ করে গুনাহ উপার্জনকারী ব্যক্তিদের ন্যায় গুনাহগার হবে? তাছাড়া শুধু নিয়্যতের জন্য বান্দার আমলনামায় কোন গুনাহ লেখা হবে না। গুনাহ না করা পর্যন্ত কারও আমলনামায় কোন গুনাহ লিখা হয় না। গুনাহর নিয়্যত করার পর গুনাহ থেকে বিরত থাকলে এক সওয়াব লিখা হয়। তা অপর সহীহ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। এ সম্পর্কিত একটি সহীহ হাদীস আল্লামা ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। নবী করীম ﷺ বলেন: আমার উম্মতের অন্তরের চিন্তা-ভাবনা মাফ করে দেয়া হয়েছে। যা বলা হবে ও করা হবে, তার হিসাব গ্রহণ করা হবে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছে: নবী ﷺ বলেছেন: আল্লাহ বলেন, মন্দকাজ না করা পর্যন্ত শুধু মন্দকাজের বাসনা মনে পোষণ করার জন্য আমার বান্দার নামে কিছু লিখো না। মন্দকাজ করলে এক গুনাহ লিখো। কিন্তু নেকীর নিয়্যত পোষণ করলে এক নেকী লিখো এবং নিয়্যত মোতাবিক সৎকর্ম করলে দশ নেকী লিখো। আল্লাহ উন্মতে মুহাম্মদীর জন্য এ খাস মেহেরবানী করেছেন। এমতাবস্থায় আলোচ্য হাদীসে মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা বা চিন্তা-ভাবনার জন্য শাস্তি দেয়ার তাৎপর্য কী?

সম্ভবত আলোচ্য হাদীসটি প্রথমদিকের। পরবর্তীতে আল্লাহ তা'আলা উম্মতে মুহাম্মদিয়ার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। তিনি তাদের মনের কুধারণা ও চিন্তা-ভাবনার জন্য শাস্তি দেয়া থেকে অব্যাহতি দান করেন। আর আল্লাহ তা'আলার এই বিশেষ অনুগ্রহের কথাই নবী করীম ﷺ-এর পরবর্তী বিভিন্ন হাদীসে প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ উক্ত বান্দাকে তাঁর মনের গোপন বাসনার জন্য গুনাহ দিবেন না, বরং নিজের ইচ্ছা মুখে প্রকাশের দরুন গুনাহ দিবেন। আমরা সহীহ হাদীসের যে হাওয়ালা উপরে দিয়েছি, তাতেও বলা হয়েছে: যা বলা হবে এবং করা হবে, তার হিসাব গ্রহণ করা হবে। এসব হাদীসের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বিশেষ অবগত রয়েছেন। তবে মন্দ বাসনা মনে স্থান দেয়া উচিত নয়। শয়তান মনে কুবাসনা নিক্ষেপ করলে তা দূরে নিক্ষেপ করা মু'মিনের কর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান