মা'আরিফুল হাদীস
রিকাক অধ্যায়
হাদীস নং: ২৫
রিকাক অধ্যায়
দুনিয়ার তুচ্ছতা ও এর নিন্দাবাদ
"রেকাক” সংক্রান্ত যেসব হাদীস সামনে আসবে, এগুলোতে রাসূলুল্লাহ ﷺ দুনিয়ার অসারতা ও এর নিন্দাবাদ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলে দিয়েছেন যে, আখেরাতের তুলনায় আল্লাহর নিকট এ দুনিয়া কত তুচ্ছ ও মূল্যহীন।
যেহেতু আমাদের এ যুগে দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক ও এর প্রতি তাদের আসক্তি সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে এবং নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক উন্নতির ব্যাপারকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যে, সম্ভবতঃ ইতঃপূর্বে কখনো এটা এত গুরুত্ব লাভ করেনি। তাই বর্তমানে অবস্থা এই যে, দুনিয়ার তুচ্ছতা ও এর নিন্দাবাদের বিষয়টি অনেক মুসলমানের অন্তরেও সহজে আসতে চায় না; বরং অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, অনেক এমন লোক, যাদেরকে মুসলমানদের পথপ্রদর্শক ও সংস্কারক মনে করা হয়, তারাও দুনিয়ার অসারতা ও এর স্থায়িত্বহীনতার আলোচনা শুনলে অবলীলায় মন্তব্য করে বসে যে, “এটা হচ্ছে বৈরাগ্যবাদ ও ভ্রান্ত তাসাওউফের প্রচার।" তারপর যখন তাদের সামনে এ প্রসঙ্গের হাদীসসমূহ উল্লেখ করা হয়, তখন হাদীস অস্বীকারকারীদের মত তারাও এসব হাদীসের ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করে। এ জন্য এ প্রসঙ্গের হাদীসসমূহ সংকলন করার পূর্বে আমরা ভূমিকা হিসাবে ঈমানের স্বীকৃত বিষয়াদি এবং কুরআন মজীদের আলোকে এ বিষয়টির উপর কিছু মৌলিক আলোচনার প্রয়াস পাব। আর আল্লাহই হচ্ছেন তওফীকদাতা।
দুনিয়া ও আখেরাত
(১) এই যে দুনিয়া যেখানে আমরা নিজেদের জীবন অতিবাহিত করছি, আর যেটা নিজেদের চোখ, কান ইত্যাদি অনুভূতি শক্তি দ্বারা অনুভব করছি, এটা যেমন এক বাস্তব সত্য, তেমনিভাবে আখেরাত- যার সংবাদ আল্লাহর সকল নবীরাই দিয়েছেন সেটাও এক নিশ্চিত ও বাস্তব সত্য। আমরা যে দুনিয়ায় থাকাবস্থায় সেটা দেখতে পাচ্ছি না এবং অনুভব করতে পারছি না, এটা ঠিক তেমনই, যেমন মাতৃগর্ভে থাকাকালীন আমরা এ দুনিয়াকে দেখতে পাইনি এবং এর কোন কিছুই অনুভব করতে পারিনি। তারপর যেভাবে আমরা এখানে এসে দুনিয়াকে দেখে নিয়েছি এবং আসমান যমীনের ঐসব লক্ষ লক্ষ জিনিস আমাদের চোখের সামনে এসে গিয়েছে, যেগুলোর কল্পনাও আমরা মাতৃগর্ভে থাকার সময় করতে পারতাম না। ঠিক তেমনিভাবে মৃত্যুর পর আখেরাত জগতে গিয়ে আমরা জান্নাত ও জাহান্নাম এবং ঐ জগতের সকল বস্তু দেখে নিতে পারব, যেগুলোর সংবাদ আল্লাহর নবীগণ এবং আল্লাহর কিতাবসমূহ দিয়েছে। সারকথা, আমাদের এ দুনিয়া যেমন এক বাস্তব সত্য, তদ্রূপ মৃত্যুর পর আখেরাতও আসন্ন এক বাস্তব জগত। আমাদের এর উপর ঈমান রয়েছে এবং কুরআন-হাদীস ও যুক্তির আলোকে এ ব্যাপারে আমাদের পূর্ণ আস্থা ও দ্বিধাহীন বিশ্বাস রয়েছে।
(২) দুনিয়ার ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস যে, এটা এবং এর সমুদয় জিনিস অস্থায়ী ও ধ্বংসশীল। কিন্তু আখেরাত এর ব্যতিক্রম। কেননা, আখেরাত অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। সেখানে পৌঁছার পর মানুষও চিরন্তন জীবনের অধিকারী হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে সেখানে আল্লাহর ভাগ্যবান ও পুণ্যবান বান্দাদেরকে যেসব নেয়ামত দান করা হবে, এগুলোর ধারাও চিরকাল অব্যাহত থাকবে, কখনো বন্ধ হবে না। এটাকেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছে "এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।"
অনুরূপভাবে যেসব হতভাগাদের উপর- তাদের অবাধ্যতা, কুফর ও অহংকারের কারণে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ পড়বে, তাদের দুঃখ-কষ্ট ও আযাবের ধারাও কখনো বন্ধ হবে না। যেমন, জাহান্নামীদের সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে: "তারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে।” “তারা জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না।” “জাহান্নামীদের মৃত্যুও আসবে না যে, মরে গিয়েও আযাব থেকে বেঁচে যাবে, আর তাদের শাস্তি হ্রাসও করা হবে না।"
আমরা আল্লাহর কিতাব ও নবীগণ কর্তৃক বর্ণিত এ বাস্তবতার উপরও বিশ্বাস রাখি যে, দুনিয়ার নেয়ামত ও আনন্দ-উপভোগের তুলনায় আখেরাতের আনন্দ ও নেয়ামতসমূহ অনেকগুণে উৎকৃষ্ট; বরং আখেরাতের সুখ ও নেয়ামতই প্রকৃত সুখ ও নেয়ামত। এর সাথে দুনিয়ার জিনিসের তুলনাই হয় না। তদ্রূপভাবে দুনিয়ার কোন কঠিনতর কষ্ট এবং বিরাট দুঃখেরও জাহান্নামের লঘুতর কোন শাস্তির সাথেও তুলনা হয় না।
একথা স্পষ্ট যে, এসব বিষয়ের দাবী এটাই হওয়া উচিত, মানুষের চিন্তা ও চেষ্টা-সাধনার কেন্দ্রবিন্দু হবে আখেরাত। দুনিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কেবল এতটুকুই থাকবে, যতটুকু না হলেই নয়।
(৩) কিন্তু মানুষের সাধারণ অবস্থা এই যে, দুনিয়া যেহেতু সর্বদা তাদের চোখের সামনে, আর আখেরাত সম্পূর্ণ অদৃশ্য ও চোখের অন্তরালে, এ জন্য এসব বাস্তবতায় বিশ্বাসী মানুষের উপরও অনেক সময় দুনিয়ার চিন্তা ও এর সন্ধান প্রবল হয়ে থাকে। এটা যেন মানুষের এক ধরনের সহজাত দুর্বলতা। এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা ঐ ছোট্ট শিশুদের মত, যারা বাল্যকালে তাদের খেলাধুলা ও খেলার সামগ্রী নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর ও উন্নত করতে সহায়ক শিক্ষা ও জীবন গঠনের কর্মসূচী তাদের জন্য সবচেয়ে অনাকর্ষণীয়; বরং চরম
কঠিন মনে হয়। যাদের পিতা-মাতা তাদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঐ জীবন উন্নতকারী বিষয়সমূহের দিকে তাদেরকে আকৃষ্ট করে তুলতে পারে, তারাই সুন্দর জীবনের অধিকারী হয়ে আদর্শ মানুষ হতে পারে এবং সম্মান ও সুখের জীবন লাভ করতে পারে।
(৪) আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূল এবং তাঁর অবর্তীর্ণ কিতাবসমূহের দ্বারা সর্বযুগেই মানুষের এ ভ্রান্তি ও দুর্বলতার সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ও আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার যে অবস্থান এবং দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের যে মর্যাদা তা স্পষ্টভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ ক্ষেত্রে ঐ শিশুসুলভ ভুলই পরিলক্ষিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন: তোমাদের অবস্থা এই যে, তোমরা (আখেরাতের তুলনায়) দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছ, অথচ আখেরাত (দুনিয়ার তুলনায় বহুগুণ) উত্তম ও স্থায়ী। এ কথাটি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও বলা হয়েছে, অর্থাৎ ইবরাহীম ও মূসা (আঃ)-এর সহীফাসমূহে।
(৫) কুরআন পাক যেহেতু পৃথিবীর জন্য সর্বশেষ হেদায়াতনামা, এ জন্য এর মধ্যে আরো সবিশেষ জোর দিয়ে এবং অধিক গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শিরোনামে এ দুনিয়ার অসারতা ও অস্থায়িত্বকে এবং আখেরাতের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, কোথাও বলা হয়েছে: "আপনি বলে দিন যে, দুনিয়ার উপকরণ তো খুবই সামান্য। আর পরকালই হচ্ছে উত্তম, পরহেযগারদের জন্য।" (সূরা নিসা) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: "দুনিয়ার এ জীবন তো কেবল (কয়েক দিনের) ক্রীড়া-কৌতুক। আর পরকালের আবাসই হচ্ছে উত্তম, পরহেযগারদের জন্য। তোমরা কি এ বিষয়টি বুঝ না?" (সূরা আন'আম) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: "এ দুনিয়ার জীবন (এবং এখানকার উপকরণ) তো কেবল কয়েক দিনের ভোগের বস্তু। আর আখেরাতই হচ্ছে স্থায়ী আবাস।" (সূরা মু'মিন)
আরেক জায়গায় বলা হয়েছে: "আখেরাতে (অপরাধীদের জন্য) রয়েছে কঠিন শাস্তি। আর (যারা ক্ষমার যোগ্য, তাদের জন্য) রয়েছে ক্ষমা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর এ দুনিয়ার জীবন তো হচ্ছে কেবল প্রতারণার সামগ্রী।" (সূরা হাদীদ)
(৬) সারকথা, আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূলগণ এবং তাঁর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাবসমূহ মানুষের হেদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য এবং আখেরাতের অনন্ত অসীমকালের জীবনে তাদেরকে চরম সাফল্যের স্তরে পৌঁছানোর জন্য যে কয়টি বিষয়ের উপর বেশী জোর দিয়েছে, এগুলোর মধ্যে একটি বিষয় এও যে, মানুষ যেন দুনিয়াকে খুবই তুচ্ছ ও মূল্যহীন মনে করে, তারা যেন এর প্রতি মন না লাগায় এবং এটাকে নিজেদের উদ্দেশ্য ও কাঙ্ক্ষিত বস্তু মনে না করে; বরং তারা যেন আখেরাতকে নিজেদের মনযিলে মকসুদ এবং স্থায়ী আবাস বলে বিশ্বাস করে সেখানের সফলতা অর্জনের চিন্তাকে নিজেদের পার্থিব সকল চিন্তার উপর প্রাধান্য দেয়। অতএব, মানুষের সৌভাগ্য এবং আখেরাতে তার সফলতা লাভের জন্য এটা যেন শর্ত যে, দুনিয়া তার দৃষ্টিতে তুচ্ছ ও মূল্যহীন হবে এবং তার মনোযোগ আখেরাতের দিকে থাকবে, আর তার অন্তরের ধ্বনি হবে এইঃ হে আল্লাহ! জীবন তো কেবল আখেরাতের জীবনই। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের ভাষণ-বক্তৃতা এবং মজলিসী আলোচনাসমূহ দ্বারাও এর শিক্ষাদান করতেন এবং ঈমানদারদের অন্তরে নিজের বাস্তব আমল ও অবস্থা দ্বারাও এরই চিত্র অংকন করতেন। সারকথা, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যেসব হাদীস এখানে আনা হবে- যেগুলোর মধ্যে দুনিয়ার তুচ্ছতা ও এর নিন্দাবাদ বর্ণনা করা হয়েছে, এগুলোর মর্ম ও উদ্দেশ্য এ আলোকেই বুঝতে হবে।
(৭) এ কথাটিও স্মরণ রাখতে হবে যে, কুরআন হাদীসে যে দুনিয়াদারীর নিন্দাবাদ করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে আখেরাতের বিপরীত দুনিয়া। তাই দুনিয়ার কাজের যে ব্যস্ততা এবং দুনিয়া থেকে যে উপকার লাভ আখেরাত-চিন্তার অধীনে হবে এবং আখেরাতের পথ যার দ্বারা বিঘ্নিত না হবে, সেটা নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ নয়; বরং সেটা তো হবে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছার সোপান।
এ ভূমিকামূলক বিষয়টি মনের কোণে উপস্থিত রেখে এখন এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো পাঠ করুন:
আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া
"রেকাক” সংক্রান্ত যেসব হাদীস সামনে আসবে, এগুলোতে রাসূলুল্লাহ ﷺ দুনিয়ার অসারতা ও এর নিন্দাবাদ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলে দিয়েছেন যে, আখেরাতের তুলনায় আল্লাহর নিকট এ দুনিয়া কত তুচ্ছ ও মূল্যহীন।
যেহেতু আমাদের এ যুগে দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক ও এর প্রতি তাদের আসক্তি সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে এবং নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক উন্নতির ব্যাপারকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যে, সম্ভবতঃ ইতঃপূর্বে কখনো এটা এত গুরুত্ব লাভ করেনি। তাই বর্তমানে অবস্থা এই যে, দুনিয়ার তুচ্ছতা ও এর নিন্দাবাদের বিষয়টি অনেক মুসলমানের অন্তরেও সহজে আসতে চায় না; বরং অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, অনেক এমন লোক, যাদেরকে মুসলমানদের পথপ্রদর্শক ও সংস্কারক মনে করা হয়, তারাও দুনিয়ার অসারতা ও এর স্থায়িত্বহীনতার আলোচনা শুনলে অবলীলায় মন্তব্য করে বসে যে, “এটা হচ্ছে বৈরাগ্যবাদ ও ভ্রান্ত তাসাওউফের প্রচার।" তারপর যখন তাদের সামনে এ প্রসঙ্গের হাদীসসমূহ উল্লেখ করা হয়, তখন হাদীস অস্বীকারকারীদের মত তারাও এসব হাদীসের ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করে। এ জন্য এ প্রসঙ্গের হাদীসসমূহ সংকলন করার পূর্বে আমরা ভূমিকা হিসাবে ঈমানের স্বীকৃত বিষয়াদি এবং কুরআন মজীদের আলোকে এ বিষয়টির উপর কিছু মৌলিক আলোচনার প্রয়াস পাব। আর আল্লাহই হচ্ছেন তওফীকদাতা।
দুনিয়া ও আখেরাত
(১) এই যে দুনিয়া যেখানে আমরা নিজেদের জীবন অতিবাহিত করছি, আর যেটা নিজেদের চোখ, কান ইত্যাদি অনুভূতি শক্তি দ্বারা অনুভব করছি, এটা যেমন এক বাস্তব সত্য, তেমনিভাবে আখেরাত- যার সংবাদ আল্লাহর সকল নবীরাই দিয়েছেন সেটাও এক নিশ্চিত ও বাস্তব সত্য। আমরা যে দুনিয়ায় থাকাবস্থায় সেটা দেখতে পাচ্ছি না এবং অনুভব করতে পারছি না, এটা ঠিক তেমনই, যেমন মাতৃগর্ভে থাকাকালীন আমরা এ দুনিয়াকে দেখতে পাইনি এবং এর কোন কিছুই অনুভব করতে পারিনি। তারপর যেভাবে আমরা এখানে এসে দুনিয়াকে দেখে নিয়েছি এবং আসমান যমীনের ঐসব লক্ষ লক্ষ জিনিস আমাদের চোখের সামনে এসে গিয়েছে, যেগুলোর কল্পনাও আমরা মাতৃগর্ভে থাকার সময় করতে পারতাম না। ঠিক তেমনিভাবে মৃত্যুর পর আখেরাত জগতে গিয়ে আমরা জান্নাত ও জাহান্নাম এবং ঐ জগতের সকল বস্তু দেখে নিতে পারব, যেগুলোর সংবাদ আল্লাহর নবীগণ এবং আল্লাহর কিতাবসমূহ দিয়েছে। সারকথা, আমাদের এ দুনিয়া যেমন এক বাস্তব সত্য, তদ্রূপ মৃত্যুর পর আখেরাতও আসন্ন এক বাস্তব জগত। আমাদের এর উপর ঈমান রয়েছে এবং কুরআন-হাদীস ও যুক্তির আলোকে এ ব্যাপারে আমাদের পূর্ণ আস্থা ও দ্বিধাহীন বিশ্বাস রয়েছে।
(২) দুনিয়ার ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস যে, এটা এবং এর সমুদয় জিনিস অস্থায়ী ও ধ্বংসশীল। কিন্তু আখেরাত এর ব্যতিক্রম। কেননা, আখেরাত অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। সেখানে পৌঁছার পর মানুষও চিরন্তন জীবনের অধিকারী হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে সেখানে আল্লাহর ভাগ্যবান ও পুণ্যবান বান্দাদেরকে যেসব নেয়ামত দান করা হবে, এগুলোর ধারাও চিরকাল অব্যাহত থাকবে, কখনো বন্ধ হবে না। এটাকেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছে "এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।"
অনুরূপভাবে যেসব হতভাগাদের উপর- তাদের অবাধ্যতা, কুফর ও অহংকারের কারণে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ পড়বে, তাদের দুঃখ-কষ্ট ও আযাবের ধারাও কখনো বন্ধ হবে না। যেমন, জাহান্নামীদের সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে: "তারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে।” “তারা জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না।” “জাহান্নামীদের মৃত্যুও আসবে না যে, মরে গিয়েও আযাব থেকে বেঁচে যাবে, আর তাদের শাস্তি হ্রাসও করা হবে না।"
আমরা আল্লাহর কিতাব ও নবীগণ কর্তৃক বর্ণিত এ বাস্তবতার উপরও বিশ্বাস রাখি যে, দুনিয়ার নেয়ামত ও আনন্দ-উপভোগের তুলনায় আখেরাতের আনন্দ ও নেয়ামতসমূহ অনেকগুণে উৎকৃষ্ট; বরং আখেরাতের সুখ ও নেয়ামতই প্রকৃত সুখ ও নেয়ামত। এর সাথে দুনিয়ার জিনিসের তুলনাই হয় না। তদ্রূপভাবে দুনিয়ার কোন কঠিনতর কষ্ট এবং বিরাট দুঃখেরও জাহান্নামের লঘুতর কোন শাস্তির সাথেও তুলনা হয় না।
একথা স্পষ্ট যে, এসব বিষয়ের দাবী এটাই হওয়া উচিত, মানুষের চিন্তা ও চেষ্টা-সাধনার কেন্দ্রবিন্দু হবে আখেরাত। দুনিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কেবল এতটুকুই থাকবে, যতটুকু না হলেই নয়।
(৩) কিন্তু মানুষের সাধারণ অবস্থা এই যে, দুনিয়া যেহেতু সর্বদা তাদের চোখের সামনে, আর আখেরাত সম্পূর্ণ অদৃশ্য ও চোখের অন্তরালে, এ জন্য এসব বাস্তবতায় বিশ্বাসী মানুষের উপরও অনেক সময় দুনিয়ার চিন্তা ও এর সন্ধান প্রবল হয়ে থাকে। এটা যেন মানুষের এক ধরনের সহজাত দুর্বলতা। এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা ঐ ছোট্ট শিশুদের মত, যারা বাল্যকালে তাদের খেলাধুলা ও খেলার সামগ্রী নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর ও উন্নত করতে সহায়ক শিক্ষা ও জীবন গঠনের কর্মসূচী তাদের জন্য সবচেয়ে অনাকর্ষণীয়; বরং চরম
কঠিন মনে হয়। যাদের পিতা-মাতা তাদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঐ জীবন উন্নতকারী বিষয়সমূহের দিকে তাদেরকে আকৃষ্ট করে তুলতে পারে, তারাই সুন্দর জীবনের অধিকারী হয়ে আদর্শ মানুষ হতে পারে এবং সম্মান ও সুখের জীবন লাভ করতে পারে।
(৪) আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূল এবং তাঁর অবর্তীর্ণ কিতাবসমূহের দ্বারা সর্বযুগেই মানুষের এ ভ্রান্তি ও দুর্বলতার সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ও আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার যে অবস্থান এবং দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের যে মর্যাদা তা স্পষ্টভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ ক্ষেত্রে ঐ শিশুসুলভ ভুলই পরিলক্ষিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন: তোমাদের অবস্থা এই যে, তোমরা (আখেরাতের তুলনায়) দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছ, অথচ আখেরাত (দুনিয়ার তুলনায় বহুগুণ) উত্তম ও স্থায়ী। এ কথাটি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও বলা হয়েছে, অর্থাৎ ইবরাহীম ও মূসা (আঃ)-এর সহীফাসমূহে।
(৫) কুরআন পাক যেহেতু পৃথিবীর জন্য সর্বশেষ হেদায়াতনামা, এ জন্য এর মধ্যে আরো সবিশেষ জোর দিয়ে এবং অধিক গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শিরোনামে এ দুনিয়ার অসারতা ও অস্থায়িত্বকে এবং আখেরাতের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, কোথাও বলা হয়েছে: "আপনি বলে দিন যে, দুনিয়ার উপকরণ তো খুবই সামান্য। আর পরকালই হচ্ছে উত্তম, পরহেযগারদের জন্য।" (সূরা নিসা) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: "দুনিয়ার এ জীবন তো কেবল (কয়েক দিনের) ক্রীড়া-কৌতুক। আর পরকালের আবাসই হচ্ছে উত্তম, পরহেযগারদের জন্য। তোমরা কি এ বিষয়টি বুঝ না?" (সূরা আন'আম) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: "এ দুনিয়ার জীবন (এবং এখানকার উপকরণ) তো কেবল কয়েক দিনের ভোগের বস্তু। আর আখেরাতই হচ্ছে স্থায়ী আবাস।" (সূরা মু'মিন)
আরেক জায়গায় বলা হয়েছে: "আখেরাতে (অপরাধীদের জন্য) রয়েছে কঠিন শাস্তি। আর (যারা ক্ষমার যোগ্য, তাদের জন্য) রয়েছে ক্ষমা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর এ দুনিয়ার জীবন তো হচ্ছে কেবল প্রতারণার সামগ্রী।" (সূরা হাদীদ)
(৬) সারকথা, আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূলগণ এবং তাঁর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাবসমূহ মানুষের হেদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য এবং আখেরাতের অনন্ত অসীমকালের জীবনে তাদেরকে চরম সাফল্যের স্তরে পৌঁছানোর জন্য যে কয়টি বিষয়ের উপর বেশী জোর দিয়েছে, এগুলোর মধ্যে একটি বিষয় এও যে, মানুষ যেন দুনিয়াকে খুবই তুচ্ছ ও মূল্যহীন মনে করে, তারা যেন এর প্রতি মন না লাগায় এবং এটাকে নিজেদের উদ্দেশ্য ও কাঙ্ক্ষিত বস্তু মনে না করে; বরং তারা যেন আখেরাতকে নিজেদের মনযিলে মকসুদ এবং স্থায়ী আবাস বলে বিশ্বাস করে সেখানের সফলতা অর্জনের চিন্তাকে নিজেদের পার্থিব সকল চিন্তার উপর প্রাধান্য দেয়। অতএব, মানুষের সৌভাগ্য এবং আখেরাতে তার সফলতা লাভের জন্য এটা যেন শর্ত যে, দুনিয়া তার দৃষ্টিতে তুচ্ছ ও মূল্যহীন হবে এবং তার মনোযোগ আখেরাতের দিকে থাকবে, আর তার অন্তরের ধ্বনি হবে এইঃ হে আল্লাহ! জীবন তো কেবল আখেরাতের জীবনই। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের ভাষণ-বক্তৃতা এবং মজলিসী আলোচনাসমূহ দ্বারাও এর শিক্ষাদান করতেন এবং ঈমানদারদের অন্তরে নিজের বাস্তব আমল ও অবস্থা দ্বারাও এরই চিত্র অংকন করতেন। সারকথা, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যেসব হাদীস এখানে আনা হবে- যেগুলোর মধ্যে দুনিয়ার তুচ্ছতা ও এর নিন্দাবাদ বর্ণনা করা হয়েছে, এগুলোর মর্ম ও উদ্দেশ্য এ আলোকেই বুঝতে হবে।
(৭) এ কথাটিও স্মরণ রাখতে হবে যে, কুরআন হাদীসে যে দুনিয়াদারীর নিন্দাবাদ করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে আখেরাতের বিপরীত দুনিয়া। তাই দুনিয়ার কাজের যে ব্যস্ততা এবং দুনিয়া থেকে যে উপকার লাভ আখেরাত-চিন্তার অধীনে হবে এবং আখেরাতের পথ যার দ্বারা বিঘ্নিত না হবে, সেটা নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ নয়; বরং সেটা তো হবে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছার সোপান।
এ ভূমিকামূলক বিষয়টি মনের কোণে উপস্থিত রেখে এখন এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো পাঠ করুন:
আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া
২৫. হযরত মুসতাওরিদ ইবন শাদ্দাদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল ﷺ-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হল, তোমাদের কোন ব্যক্তি সমুদ্রের মধ্যে তার আঙ্গুল ডুবিয়ে দেখল যে, তাতে কত পানি লেগে এসেছে। (মুসলিম)
کتاب الرقاق
عَنْ مُسْتَوْرِدِ بْنِ شَدَّادٍ قَالَ ، قَالَ سَمِعْتُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَقُولُ : « وَاللهِ مَا الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِي الْيَمِّ ، فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ؟ » (رواه مسلم)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
আখিরাতের জীবন কামিয়াব ও রওশন করতে যে নিরলস ও অবিরাম প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তা মানুষ করতে সক্ষম হবে যখন সে আখিরাতের লোমহর্ষক ভয়াবহতা ও চোখ শীতলকারী অফুরন্ত নিয়ামতসমূহের সঠিক জ্ঞান হাসিল করতে সক্ষম হবে। আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত দু'চোখে দেখার পর দুনিয়ার সবচেয়ে অভাবী মানুষ তাঁর দারিদ্র্যের আঘাতের নির্মম স্মৃতি ভুলে যাবে। সত্য পথে দৃঢ়পদ থাকার ও আল্লাহর হুকুম-আহকাম পুরোপুরি পালন করার জন্য দুনিয়ার জীবনে মানুষ যত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করুক না কেন, আখিরাতের নিয়ামত তাকে অফুরন্ত তৃপ্তি ও শান্তি দান করবে। দুনিয়াতে সে যা কষ্ট করেছে, আখিরাতে তা নগণ্য মনে হবে। সে ভাববে দুনিয়াতে আরও পরিশ্রম করলে মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেত। দুনিয়াতে যে আকণ্ঠ প্রাচুর্যে নিমজ্জিত ছিল, যে কোনদিন অভাবের মুখে দেখেনি, আখিরাতের অবস্থা অবলোকন করে সে তার দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ভুলে যাবে। মনে হবে সে দুনিয়ায় যে আরাম উপভোগ করেছে, আখিরাতের কষ্টের তুলনায় তা খুবই সামান্য। সারা দুনিয়ার প্রাচুর্য আখিরাতের ব্যর্থতার তুলনায় কিছুই নয়। দুনিয়ার সারা রাজ্যের ব্যর্থতা আখিরাতের সাফল্যের কাছে খুবই নগণ্য মনে হবে। তাই নবী করীম ﷺ আখিরাতের বাস্তব চিত্র অংকন করে আমাদেরকে আখিরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)