মা'আরিফুল হাদীস
ঈমান অধ্যায়
হাদীস নং: ১৮
ঈমান অধ্যায়
পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে কালেমার সাক্ষ্য দানকারীর জন্য বেহেশতের সুসংবাদ
১৮. হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত ছিলাম এবং তাঁর চারপাশে বসাছিলাম। হযরত আবু বকর এবং ওমর (রা)-ও আমাদের সাথে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্য থেকে উঠে দাড়ালেন (এবং কোথাও চলে গেলেন)। তাঁর ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় আমরা শংকিত হলাম যে, না জানি তিনি আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোথাও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন (অর্থাৎ না জানি আমাদের অনুপস্থিতিতে তিনি শত্রুর দ্বারা কোন উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন)। এই চিন্তা করে আমরা শংকিত হলাম এবং ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাঁর খুঁজে বের হলাম। সকলের আগে আমিই আশংকা বোধ করে তাঁর খোজে বের হলাম। এমন কি তালাশ করতে করতে আমি নাজ্জার গোত্রের এক আনসার ব্যক্তির প্রাচীর বেষ্টিত বাগানের নিকটে পৌঁছলাম। আমি বাগানের চার দিকে ঘুরে দেখলাম ভেতরে প্রবেশের কোন পথ পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু তা পেলাম না। হঠাৎ দেখি বাইরের একটি রূপ থেকে একটি ছোট্ট নালা এসে বাগানের ভেতরে প্রবেশ করেছে। আমি জড়সড় হয়ে নালার ভেতর দিয়ে বাগানে ঢুকলাম এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম। তিনি বললেন: আবু হুরায়রা? আমি বললাম, হাঁ আমি হে আল্লাহর রাসূল! তিনি জিজ্ঞেস করলেন। কি ব্যাপার, তুমি কিভাবে এলে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের মাঝে ছিলেন এবং সেখান থেকে উঠে চলে এলেন। আপনার ফিরতে বিলম্ব দেখে আমরা আতংকিত হলাম, না জানি আপনি আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোথাও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এই আশংকায় আমরা সকলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আপনার খুঁজে বেরিয়েছি। আমিই সর্বপ্রথম শংকিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছি, অবশেষে এই বাগানে এসে পৌছলাম এবং (ভেতরে প্রবেশের কোন দরজা না পেয়ে) খেকশিয়ালের মত জড়সড় হয়ে (ঐ নালার মধ্য দিয়ে কোন রকমে) বাগানে ঢুকেছি। অন্যরা আমার পেছনে আসছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে তাঁর জুতা জোড়া দিয়ে বললেনঃ আমার জুতা জোড়া নিয়ে যাও এবং বাগান থেকে বের হয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই-এই বাক্যের পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষ্যদানকারী যে কোন লোকের সাথে তোমার মোলাকাত হবে, তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দাও। অতঃপর ওমর (রা)-এর সাথে আমার প্রথম দেখা হল। তিনি বললেন: হে আবু হুরায়রা। তোমার হাতে এ জুতা কেন? আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর জুতা। তিনি আমাকে তা দিয়ে বলেছেন: যে ব্যক্তির সাথেই মোলাকাত হবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করার জন্য, যিনি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে এ সাক্ষ্য দান করেন যে, 'আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই'। ওমর (রা) আমার বুকে সজোরে আঘাত করলেন এবং আমি পেছনের দিকে পড়ে গেলাম। ওমর আমাকে বললেন, ফিরে যাও। আমি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে ফিরে এলাম এবং ওমর (রা)-ও আমার অনুসরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হে আবু হুরায়রা। তোমার কি হয়েছে? আমি বললাম, ওমরের সাথে আমার দেখা হলে আপনার দেয়া পয়গাম আমি তাকে দিয়েছিলাম। তিনি আমার বুকে সজোরে আঘাত করলে আমি পেছন দিকে পড়ে যাই। তিনি বললেন, ফিরে যাও। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হে ওমর! কিসে তোমাকে এরূপ করতে উত্তেজিত করেছে? ওমর (রা) বললেনঃ হে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)! আমার মা-বাপ আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি কি আপনার জুতা জোড়াসহ আবু হুরায়রাকে এমন লোকের সাথে দেখা হলে বেহেশতের সুসংবাদ দান করতে পাঠিয়েছিলেন, যিনি পরিপূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষ্য দান করেন যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হাঁ। ওমর (রা) আরয করলেন, এরূপ করবেন না। আমার ভয় হয় মানুষ এর উপরই ভরসা করে বসে থাকবে তাদেরকে আমল করতে দিন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তবে তাদের তা-ই করতে দাও।- সহীহ মুসলিম
کتاب الایمان
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: كُنَّا قُعُودًا حَوْلَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَعَنَا أَبُو بَكْرٍ، وَعُمَرُ فِي نَفَرٍ، فَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ بَيْنِ أَظْهُرِنَا، فَأَبْطَأَ عَلَيْنَا، وَخَشِينَا أَنْ يُقْتَطَعَ دُونَنَا، وَفَزِعْنَا، فَقُمْنَا، فَكُنْتُ أَوَّلَ مَنْ فَزِعَ، فَخَرَجْتُ أَبْتَغِي رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى أَتَيْتُ حَائِطًا لِلْأَنْصَارِ لِبَنِي النَّجَّارِ، فَدُرْتُ بِهِ هَلْ أَجِدُ لَهُ بَابًا؟ فَلَمْ أَجِدْ، فَإِذَا رَبِيعٌ يَدْخُلُ فِي جَوْفِ حَائِطٍ مِنْ بِئْرٍ خَارِجَةٍ - وَالرَّبِيعُ الْجَدْوَلُ - فَاحْتَفَزْتُ، فَدَخَلْتُ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: «أَبُو هُرَيْرَةَ» فَقُلْتُ: نَعَمْ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: «مَا شَأْنُكَ؟» قُلْتُ: كُنْتَ بَيْنَ أَظْهُرِنَا، فَقُمْتَ فَأَبْطَأْتَ عَلَيْنَا، فَخَشِينَا أَنْ تُقْتَطَعَ دُونَنَا، فَفَزِعْنَا، فَكُنْتُ أَوَّلَ مَنْ فَزِعَ، فَأَتَيْتُ هَذَا الْحَائِطَ، فَاحْتَفَزْتُ كَمَا يَحْتَفِزُ الثَّعْلَبُ، وَهَؤُلَاءِ النَّاسُ وَرَائِي، فَقَالَ: «يَا أَبَا هُرَيْرَةَ» وَأَعْطَانِي نَعْلَيْهِ، قَالَ: «اذْهَبْ بِنَعْلَيَّ هَاتَيْنِ، فَمَنْ لَقِيتَ مِنْ وَرَاءِ هَذَا الْحَائِطَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ، فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ»، فَكَانَ أَوَّلَ مَنْ لَقِيتُ عُمَرُ، فَقَالَ: مَا هَاتَانِ النَّعْلَانِ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ؟ فَقُلْتُ: هَاتَانِ نَعْلَا رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، بَعَثَنِي بِهِمَا مَنْ لَقِيتُ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ، بَشَّرْتُهُ بِالْجَنَّةِ، فَضَرَبَ عُمَرُ بِيَدِهِ بَيْنَ ثَدْيَيَّ فَخَرَرْتُ لِاسْتِي، فَقَالَ: ارْجِعْ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، فَرَجَعْتُ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَجْهَشْتُ بُكَاءً، وَرَكِبَنِي عُمَرُ، فَإِذَا هُوَ عَلَى أَثَرِي، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا لَكَ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ؟» قُلْتُ: لَقِيتُ عُمَرَ، فَأَخْبَرْتُهُ بِالَّذِي بَعَثْتَنِي بِهِ، فَضَرَبَ بَيْنَ ثَدْيَيَّ ضَرْبَةً خَرَرْتُ لِاسْتِي، قَالَ: ارْجِعْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا عُمَرُ، مَا حَمَلَكَ عَلَى مَا فَعَلْتَ؟» قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، بِأَبِي أَنْتَ، وَأُمِّي، أَبَعَثْتَ أَبَا هُرَيْرَةَ بِنَعْلَيْكَ، مَنْ لَقِيَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ بَشَّرَهُ بِالْجَنَّةِ؟ قَالَ: «نَعَمْ»، قَالَ: فَلَا تَفْعَلْ، فَإِنِّي أَخْشَى أَنْ يَتَّكِلَ النَّاسُ عَلَيْهَا، فَخَلِّهِمْ يَعْمَلُونَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَخَلِّهِمْ» (رواه مسلم)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত কতিপয় বিষয়ের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে:
১. আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কেন আবূ হুরায়রা (রা)-কে তাঁর জুতা জোড়া দান করলেন? হাদীস ব্যাখ্যাকারীগণ তার গোটা কয়েক কারণ উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে বোধগম্য কারণ হলো, যে মহান সুসংবাদের ঘোষণা প্রদান করার জন্য আবু হুরায়রা (রা)-কে পাঠান হয়েছিল তার অস্বাভাবিক গুরুত্বের কারণে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সম্ভবতঃ তাঁর নিকট তার নিজের কোন খাস নিদর্শন প্রদান করা সমীচীন মনে করেছেন। সে সময় সম্ভবতঃ তাঁর নিকট পাক পবিত্র জুতা জোড়া ছাড়া তাকে দেয়ার মত অন্য কিছু ছিল না। তাই আল্লাহর নবী (ﷺ) তাকে জুতা জোড়া দিয়েছেন। আসল রহস্য একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনই জানেন।
২. এ ব্যাপারে আবু হুরায়রা (রা)-এর সাথে যে কঠিন আচরণ করা হয়েছে তার তাৎপর্য অনুধাবন করার সময় সাহাবাদের জামা'আতে ওমর (রা)-এর বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে রাখা আবশ্যক। আবূ বকর (রা)-এর ন্যায় তিনিও রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বিশেষ সহযোগী পরামর্শদাতা উযির এবং প্রতিনিধি ছিলেন। এবং সাহাবায়ে কিরাম তার এ বিশেষ মর্যাদার বিষয় অবগত ছিলেন। এরূপ প্রত্যেক খান্দান এবং দলের প্রধান ব্যক্তি ছোটদেরকে সাবধান ও সতর্ক করার অধিকার রাখেন ঠিক তদ্রূপ ওমর (রা) অধিকার রাখেন এবং কোন কোন সময় প্রয়োজনবোধে সে অধিকার প্রয়োগও করতেন। বস্তুতঃ ছোটদের সংশোধন ও তরবিয়াতের জন্য বড়দের এ অধিকার স্বীকার করে নেয়া একান্ত আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে আবূ হুরায়রা (রা)-এর সাথে তিনি যে শক্ত আচরণ করেছেন তা এ ধরনের একটা বিষয়। এটা অনুমিত হয় যে, সূচনাতে তিনি সম্ভবতঃ তাকে ফিরে যেতে বলেছেন। যেহেতু তামাম আহলে ঈমানের জন্য তিনি বাশারতে উজমা বা মহাসুসংবাদের ঘোষণা বহন করছিলেন এবং তাঁর দৃষ্টিতে এটা তাঁর জন্য এক মহা সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। তাই আবূ হুরায়রা (রা) সম্ভবতঃ ফিরে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। অবশেষে সম্ভবতঃ ওমর (রা) শক্তি প্রয়োগ করে তাঁকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিলেন। মোকামে নবুওয়াতের পূর্ণ ধ্যান-ধারণা ও অনুভূতির কারণে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ সাধারণ সুসংবাদের ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ)-কে অবহিত করলে তিনিও তা অনুধাবন করবেন এবং সাধারণ ঘোষাণা প্রদান করা থেকে আবূ হুরায়রা (রা)-কে বারণ করবেন। কার্যত তাই হয়েছে।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এক সময় মা'আয (রা)-কেও এ ধরনের সুসংবাদ দান করেছিলেন। মা'আয (রা) এ সুসংবাদ সাধারণের মধ্যে প্রকাশ করার অনুমতি তাঁর নিকট চেয়েছিলেন। হুযুর (ﷺ) তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন নি এবং তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে, মানুষ এ ঘোষণার পর ভরসা করে দীনী তরক্কী থেকে পেছনে পরে থাকবে।
৩. আলোচ্য হাদীসে শুধু মাত্র লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর শাহাদত দানের উপর জান্নাতের সুসংবাদ দান করা হয়েছে। তার সাধারণ তাৎপর্য উপরে আলোচিত হয়েছে। হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ থেকেও একথা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ইরশাদ করেছেন, তার লক্ষ্য হল যে ব্যক্তি 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ'-এ শাহাদত প্রদান করে অর্থাৎ আন্তরিকতা সহকারে দীনে তাওহীদ কবুল করে তাকে যেন এ সুসংবাদ প্রদান করা হয় যে, সে অবশ্যই জান্নাতে যাবে। এমন কি সে যদি গুনাহ করে থাকে তাহলে শাস্তি ভোগ করার পর বেহেশতে যাবে।
এছাড়া আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর পাক দরবারে কোন কোন সময় আল্লাহ তা'আলার কহর, জালাল, শাস্তি এবং গযব সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচিত হত এবং সে সময় সাহাবায়ে কিরামের মনে ভয়-ভীতির উদ্রেক হত এবং তারা মনে করতেন যে, সম্ভবতঃ কোন গুনাহগার ব্যক্তি নাজাত পাবে না বা যে কোন এক বিশেষ গুনাহ করবে, বেহেশতে যেতে পারবে না বা বেহেশতের বাতাস পর্যন্ত পাবে না। আবার কোন কোন সময় আল্লাহ তা'আলার বে-হিসাব রহমত এবং বে-ইনতেহা ফযল ও করমের বিষয় আলোচিত হলে সাহাবায়ে কিরামের মনে আশা ভরসার সঞ্চার হত এবং তারা মনে করতেন যে, যার মধ্যে সামান্য কল্যাণ পাওয়া যাবে মাফ করে দেয় হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের মুখ থেকে সাধারণ সুসংবাদ প্রদানের বিষয় উচ্চারিত হত। এ বিষয়টি সিরাজী (রহ) এভাবে বর্ণনা করেছেন:
এটা অনুমিত হয় যে, আবূ হুরায়রা (রা) যে সময় বনু নাজ্জারের বাগানে নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন সম্ভবতঃ সে সময় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহু সুবাহানাহু-এর বে-ইনতেহা রহমত ও তাজাল্লিয়াতের মোরাকাবা ও মোশাহিদার মধ্যে মগ্ন ছিলেন। এই অবস্থায়ই তিনি আবূ হুরায়রা (রা)-কে নিশানী হিসাবে তার নিজের পাক পবিত্র জুতা জোড়া প্রদান করে প্রত্যেক তাওহীদের সাক্ষ্য প্রদানকারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করার হুকুম দিয়েছেন। যেহেতু ওমর (রা)-এ পূর্ণ হাকীকত এবং পরিবেশ ও মানসিকতার চড়াই উৎরাই সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিলেন। সম্ভবতঃ তাই তিনি নিজে সরাসরি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে বিষয়টি অনুসন্ধান না করা পর্যন্ত আবূ হুরায়রা (রা)-কে ঘোষণা প্রদান করতে বারণ করেছিলেন। অন্যভাবে বলা যায় যে, সে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্তর মোবারকে যে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ওমর (রা) জ্ঞাত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর নূরানী দূরদৃষ্টির দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর মনের এ বিশেষ অবস্থা দূর হবে এবং তাঁর সামনে এ ঘোষণার অপর দিকটি তুলে ধরা হবে তখন তিনি স্বয়ং তা নিষেধ করবেন। কার্যত তাই হয়েছে। এধরনের ঘটনার সহীহ হাকীকত অনুধাবন করার বিষয়টি ওমর (রা)-এর ইমতিয়াজি ফযীলত এবং এটাকেই নবী (ﷺ)-এর হাদীসে মোকামে মোহাদ্দাসিয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এধরনের আয়াত ও হাদীসের উপর চিন্তা-ভাবনা করার সময় যে মূলনীতি লক্ষণীয় তা হল সুসংবাদ দানকারীদের বক্তব্যের মূল লক্ষ্য হল কোন বিপরীতধর্মী আমলের পরিণতি কি হবে তা বর্ণনা করা নয়, বরং কোন বিশেষ আমলের বিশিষ্ট ও ফযীলতের উপর গুরুত্ব আরোপ করা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থে এ নীতির ভিত্তিতে ঔষধের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, হাকিমী গ্রন্থে উল্লিখিত হয়ে থাকে যদি কোন ব্যক্তি ত্রিফলা ব্যবহার করে তাহলে তার সর্দি থাকবে না। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি তার সাথে ঠাণ্ডা উৎপাদনকারী জিনিস তথা তেল প্রভৃতি ব্যবহার করার পর চিন্তা করে যে, সর্দি তার লাগবে না তাহলে সে মস্ত বড় ভুল করবে এবং ত্রিফলার গুণের তাৎপর্য উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অজ্ঞতার পরিচয় দিবে।
১. আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কেন আবূ হুরায়রা (রা)-কে তাঁর জুতা জোড়া দান করলেন? হাদীস ব্যাখ্যাকারীগণ তার গোটা কয়েক কারণ উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে বোধগম্য কারণ হলো, যে মহান সুসংবাদের ঘোষণা প্রদান করার জন্য আবু হুরায়রা (রা)-কে পাঠান হয়েছিল তার অস্বাভাবিক গুরুত্বের কারণে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সম্ভবতঃ তাঁর নিকট তার নিজের কোন খাস নিদর্শন প্রদান করা সমীচীন মনে করেছেন। সে সময় সম্ভবতঃ তাঁর নিকট পাক পবিত্র জুতা জোড়া ছাড়া তাকে দেয়ার মত অন্য কিছু ছিল না। তাই আল্লাহর নবী (ﷺ) তাকে জুতা জোড়া দিয়েছেন। আসল রহস্য একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনই জানেন।
২. এ ব্যাপারে আবু হুরায়রা (রা)-এর সাথে যে কঠিন আচরণ করা হয়েছে তার তাৎপর্য অনুধাবন করার সময় সাহাবাদের জামা'আতে ওমর (রা)-এর বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে রাখা আবশ্যক। আবূ বকর (রা)-এর ন্যায় তিনিও রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বিশেষ সহযোগী পরামর্শদাতা উযির এবং প্রতিনিধি ছিলেন। এবং সাহাবায়ে কিরাম তার এ বিশেষ মর্যাদার বিষয় অবগত ছিলেন। এরূপ প্রত্যেক খান্দান এবং দলের প্রধান ব্যক্তি ছোটদেরকে সাবধান ও সতর্ক করার অধিকার রাখেন ঠিক তদ্রূপ ওমর (রা) অধিকার রাখেন এবং কোন কোন সময় প্রয়োজনবোধে সে অধিকার প্রয়োগও করতেন। বস্তুতঃ ছোটদের সংশোধন ও তরবিয়াতের জন্য বড়দের এ অধিকার স্বীকার করে নেয়া একান্ত আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে আবূ হুরায়রা (রা)-এর সাথে তিনি যে শক্ত আচরণ করেছেন তা এ ধরনের একটা বিষয়। এটা অনুমিত হয় যে, সূচনাতে তিনি সম্ভবতঃ তাকে ফিরে যেতে বলেছেন। যেহেতু তামাম আহলে ঈমানের জন্য তিনি বাশারতে উজমা বা মহাসুসংবাদের ঘোষণা বহন করছিলেন এবং তাঁর দৃষ্টিতে এটা তাঁর জন্য এক মহা সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। তাই আবূ হুরায়রা (রা) সম্ভবতঃ ফিরে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। অবশেষে সম্ভবতঃ ওমর (রা) শক্তি প্রয়োগ করে তাঁকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিলেন। মোকামে নবুওয়াতের পূর্ণ ধ্যান-ধারণা ও অনুভূতির কারণে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ সাধারণ সুসংবাদের ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ)-কে অবহিত করলে তিনিও তা অনুধাবন করবেন এবং সাধারণ ঘোষাণা প্রদান করা থেকে আবূ হুরায়রা (রা)-কে বারণ করবেন। কার্যত তাই হয়েছে।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এক সময় মা'আয (রা)-কেও এ ধরনের সুসংবাদ দান করেছিলেন। মা'আয (রা) এ সুসংবাদ সাধারণের মধ্যে প্রকাশ করার অনুমতি তাঁর নিকট চেয়েছিলেন। হুযুর (ﷺ) তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন নি এবং তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে, মানুষ এ ঘোষণার পর ভরসা করে দীনী তরক্কী থেকে পেছনে পরে থাকবে।
৩. আলোচ্য হাদীসে শুধু মাত্র লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর শাহাদত দানের উপর জান্নাতের সুসংবাদ দান করা হয়েছে। তার সাধারণ তাৎপর্য উপরে আলোচিত হয়েছে। হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ থেকেও একথা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ইরশাদ করেছেন, তার লক্ষ্য হল যে ব্যক্তি 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ'-এ শাহাদত প্রদান করে অর্থাৎ আন্তরিকতা সহকারে দীনে তাওহীদ কবুল করে তাকে যেন এ সুসংবাদ প্রদান করা হয় যে, সে অবশ্যই জান্নাতে যাবে। এমন কি সে যদি গুনাহ করে থাকে তাহলে শাস্তি ভোগ করার পর বেহেশতে যাবে।
এছাড়া আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর পাক দরবারে কোন কোন সময় আল্লাহ তা'আলার কহর, জালাল, শাস্তি এবং গযব সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচিত হত এবং সে সময় সাহাবায়ে কিরামের মনে ভয়-ভীতির উদ্রেক হত এবং তারা মনে করতেন যে, সম্ভবতঃ কোন গুনাহগার ব্যক্তি নাজাত পাবে না বা যে কোন এক বিশেষ গুনাহ করবে, বেহেশতে যেতে পারবে না বা বেহেশতের বাতাস পর্যন্ত পাবে না। আবার কোন কোন সময় আল্লাহ তা'আলার বে-হিসাব রহমত এবং বে-ইনতেহা ফযল ও করমের বিষয় আলোচিত হলে সাহাবায়ে কিরামের মনে আশা ভরসার সঞ্চার হত এবং তারা মনে করতেন যে, যার মধ্যে সামান্য কল্যাণ পাওয়া যাবে মাফ করে দেয় হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের মুখ থেকে সাধারণ সুসংবাদ প্রদানের বিষয় উচ্চারিত হত। এ বিষয়টি সিরাজী (রহ) এভাবে বর্ণনা করেছেন:
এটা অনুমিত হয় যে, আবূ হুরায়রা (রা) যে সময় বনু নাজ্জারের বাগানে নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন সম্ভবতঃ সে সময় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহু সুবাহানাহু-এর বে-ইনতেহা রহমত ও তাজাল্লিয়াতের মোরাকাবা ও মোশাহিদার মধ্যে মগ্ন ছিলেন। এই অবস্থায়ই তিনি আবূ হুরায়রা (রা)-কে নিশানী হিসাবে তার নিজের পাক পবিত্র জুতা জোড়া প্রদান করে প্রত্যেক তাওহীদের সাক্ষ্য প্রদানকারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করার হুকুম দিয়েছেন। যেহেতু ওমর (রা)-এ পূর্ণ হাকীকত এবং পরিবেশ ও মানসিকতার চড়াই উৎরাই সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিলেন। সম্ভবতঃ তাই তিনি নিজে সরাসরি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে বিষয়টি অনুসন্ধান না করা পর্যন্ত আবূ হুরায়রা (রা)-কে ঘোষণা প্রদান করতে বারণ করেছিলেন। অন্যভাবে বলা যায় যে, সে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্তর মোবারকে যে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ওমর (রা) জ্ঞাত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর নূরানী দূরদৃষ্টির দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর মনের এ বিশেষ অবস্থা দূর হবে এবং তাঁর সামনে এ ঘোষণার অপর দিকটি তুলে ধরা হবে তখন তিনি স্বয়ং তা নিষেধ করবেন। কার্যত তাই হয়েছে। এধরনের ঘটনার সহীহ হাকীকত অনুধাবন করার বিষয়টি ওমর (রা)-এর ইমতিয়াজি ফযীলত এবং এটাকেই নবী (ﷺ)-এর হাদীসে মোকামে মোহাদ্দাসিয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এধরনের আয়াত ও হাদীসের উপর চিন্তা-ভাবনা করার সময় যে মূলনীতি লক্ষণীয় তা হল সুসংবাদ দানকারীদের বক্তব্যের মূল লক্ষ্য হল কোন বিপরীতধর্মী আমলের পরিণতি কি হবে তা বর্ণনা করা নয়, বরং কোন বিশেষ আমলের বিশিষ্ট ও ফযীলতের উপর গুরুত্ব আরোপ করা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থে এ নীতির ভিত্তিতে ঔষধের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, হাকিমী গ্রন্থে উল্লিখিত হয়ে থাকে যদি কোন ব্যক্তি ত্রিফলা ব্যবহার করে তাহলে তার সর্দি থাকবে না। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি তার সাথে ঠাণ্ডা উৎপাদনকারী জিনিস তথা তেল প্রভৃতি ব্যবহার করার পর চিন্তা করে যে, সর্দি তার লাগবে না তাহলে সে মস্ত বড় ভুল করবে এবং ত্রিফলার গুণের তাৎপর্য উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অজ্ঞতার পরিচয় দিবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)