মা'আরিফুল হাদীস

ঈমান অধ্যায়

হাদীস নং:
ঈমান অধ্যায়
ইসলাম, ঈমান ও ইহসান (উম্মুল আহাদীস বা হাদীসে জিবরাঈল)
২. হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেনঃ একদিন আমরা রাসূল (ﷺ)-এর খেদমতে হাযির ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে হাযির হলেন, তাঁর পোশাক ধবধবে সাদা ও মাথার চুল খুব কালো। তার শরীরের কোথাও সফরের চিহ্নমাত্র ছিল না, অথচ আমরা কেউ তাকে চিনতে পারছিলাম না। এমন কি তিনি নবী (ﷺ)-এর পাশে বসে গেলেন এবং তাঁর হাঁটু নবী (ﷺ)-এর হাঁটুর সাথে লাগিয়ে দিলেন ও তাঁর হাত তাঁর নিজের উরুর উপর রেখে বললেনঃ হে মুহাম্মদ (ﷺ), আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ইসলাম হল, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর রাসূল বলে সাক্ষ্য দান করা, নামায কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানের রোযা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা। তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। ওমর (রা) বলেন, আমরা অবাক হলাম যে, আগন্তুক তাঁকে প্রশ্নও করছেন আবার তাঁর (জবাবের) সত্যায়নও করছেন।

অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে কিছু বলুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ঈমান হল আল্লাহ ও তাঁর সমস্ত ফিরিশতা, কিতাব, রাসূল, আখিরাত এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। অতঃপর বললেন, ইহসান সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আল্লাহর ইবাদাত এমনভাবে করা যেন তুমি তাঁকে দেখছ। তুমি তাঁকে না দেখতে পেলেও তিনি তোমাকে দেখছেন। তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, আমাকে শেষ সময় (কিয়ামত) সম্পর্কে কিছু বলুন। রাসূল (ﷺ) বললেনঃ জবাব দানকারী প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশী কিছু জানেন না। তিনি (প্রশ্নকারী) বললেনঃ আমাকে তার কিছু নিদর্শন বলুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ (নিদর্শন হল) দাসী তাঁর মুনিবকে জন্ম দান করবে এবং তুমি দেখবে যে জামা জুতা শূন্য রিক্ত হস্ত রাখালেরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিরাট বিরাট ইমারত তৈরী করবে।

ওমর (রা) বলেনঃ তিনি (প্রশ্নকারী) চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ হে ওমর! তুমি কি বুঝতে পেরেছ প্রশ্নকারী কে? আমি বললাম : আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। নবী (ﷺ) বললেন, তিনি জিবরাঈল। তোমাদেরকে তোমাদের দীন সম্পর্কে শিক্ষা দানের জন্য এসেছিলেন।মুসলিম
کتاب الایمان
أَبِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ: بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ، إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ، شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ، لَا يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ، وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ، حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ، وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ، وَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الْإِسْلَامِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلًا»، قَالَ: صَدَقْتَ، قَالَ: فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ، وَيُصَدِّقُهُ، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِيمَانِ، قَالَ: «أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ، وَمَلَائِكَتِهِ، وَكُتُبِهِ، وَرُسُلِهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ»، قَالَ: صَدَقْتَ، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِحْسَانِ، قَالَ: «أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ»، قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ السَّاعَةِ، قَالَ: «مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ» قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَتِهَا، قَالَ: «أَنْ تَلِدَ الْأَمَةُ رَبَّتَهَا، وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ فِي الْبُنْيَانِ»، قَالَ: ثُمَّ انْطَلَقَ فَلَبِثْتُ مَلِيًّا، ثُمَّ قَالَ لِي: «يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنِ السَّائِلُ؟» قُلْتُ: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: «فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এই হাদীসে জিবরাঈল (আ)-এর সাওয়ালের জবাব দানকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাঁচটি জিনিসের বর্ণনা করেছেন এগুলো হচ্ছে, ইসলাম, ঈমান, ইহসান, কিয়ামত ও তার কিছু নিদর্শন। এগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামের অর্থ হল, অন্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা এবং নিজেকে তার হুকুমের অধীন করে দেয়া। আল্লাহর প্রেরিত ও রাসূলদের মারফতে আগত দীনকে এজন্য ইসলাম বলা হয় যে, মানুষ পরিপর্ণভাবে নিজেকে তার প্রভুর নিকট সোপর্দ করে এবং তার পরিপূর্ণ আনুগত্য করাকে নিজের জীবন-বিধান হিসাবে গ্রহণ করে। বস্তুতঃ এটাই দীন ইসলামের তাৎপর্য ও আবেদন। এজন্য আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ

فَاِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ فَلَہٗۤ اَسۡلِمُوۡا

তোমাদের মাবুদ একই মাবুদ। সুতরাং তোমরা তাঁরই আনুগত্য করবে। সুরা হজ্জ: ৩৪
ইসলাম সম্পর্কে অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَمَنۡ اَحۡسَنُ دِیۡنًا مِّمَّنۡ اَسۡلَمَ وَجۡہَہٗ لِلّٰہِ وَہُوَ مُحۡسِنٌ وَّاتَّبَعَ مِلَّۃَ اِبۡرٰہِیۡمَ حَنِیۡفًا

তার চেয়ে উত্তম দীন আর কার হতে পারে, যে (তার গোটা অস্তিত্বসহ) নিজ চেহারাকে আল্লাহর সম্মুখে অবনত করেছে, সেই সঙ্গে সে সৎকর্মে অভ্যস্ত এবং একনিষ্ঠ ইবরাহীমের দীন অনুসরণ করেছে। নিসা: ১২৫

কুরআনের অন্য সূরায় বলা হয়েছে:

وَمَنۡ یَّبۡتَغِ غَیۡرَ الۡاِسۡلَامِ دِیۡنًا فَلَنۡ یُّقۡبَلَ مِنۡہُ ۚ وَہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

যে ব্যক্তিই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও দীন অবলম্বন করতে চাবে, তার থেকে সে দীন কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে মহা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আলে-ইমরান: ৮৫

বলা বাহুল্য, ইসলামের মূলকথা হলো, পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে তাঁর হুকুমের অন্তর্গত হওয়া।

নবীদের (আ) প্রচারিত বিভিন্ন শরীয়ত বা বিধি-বিধানের মধ্যে এই ইসলামের কয়েকটি রোকন বা স্তম্ভও রয়েছে। এসব রোকনকে ইসলামের বাহ্যিক মূল বিষয় বলা যেতে পারে। এগুলোই ইসলামকে সতেজ ও বিকশিত করে। বাহ্যত এগুলো ইসলামের অনুসারী ও প্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্যে পার্থক্য সষ্টি করে।
খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত ইসলামের যে পরিপূর্ণ ও সর্বশেষ বিধান আমাদের কাছে এসেছে, তার বুনিয়াদ হল- (১) আল্লাহর তাওয়ীদ ও হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান, (২) নামায কায়েম করা (৩) যাকাত দেয়া, (৪) রমযানের রোযা রাখা এবং (৫) আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা। এগুলোকে ইসলামের বুনিয়াদ বলা হয়।

ঈমান : ঈমানের দের্ঘ্য হল, কারো উপর বিশ্বাস স্থাপন করে কোন কথাকে সত্য বলে মেনে নেয়া। দীনের পরিভাষায় ঈমানের মূলকথা হল, আমাদের ধরা ছোয়া ও বোধ শক্তির বাইরে যে সব জিনিস আল্লাহর রাসূল পেশ করেছেন এবং যে জ্ঞান ও হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ে এসেছেন তাকে সত্য জ্ঞান করে বিশ্বাস করা এবং কবুল করা। বস্তুতঃ শরীয়তের দৃষ্টিতে ঈমান হলো, এমন কতকগুলো অদৃশ্য বিষয় যেগুলো আমাদের নাক, কান, চোখ প্রভৃতি পঞ্চইন্দ্রীয় দ্বারা জানা যায় না, যেমন আল্লাহ তাঁর গুণাবলী এবং হুকুম-আহকাম, রাসূলগণের রিসালাত, তাঁদের উপর ওহীর আগমন, অনাদি অনন্ত সম্পর্কে তাদের পরিবেশিত জ্ঞান প্রভৃতি। এ ধরনের যত বিষয় আল্লাহর রাসূল বর্ণনা করেছেন, তাঁর উপর আস্থা স্থাপন করে সেগুলো সত্য বলে গ্রহণ করার নাম ঈমান। আল্লাহর রাসূলের যে কোন একটি কথাকেও অস্বীকার করা বা হক মনে না করা হল রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা। এ ধরনের কাজ মানুষকে ঈমানের গণ্ডী থেকে কুফরীর গণ্ডীতে নিয়ে যায়। তাই মু'মিন হতে হলে আল্লাহর রাসূল যা কিছুই নিয়ে এসেছেন তার প্রত্যেকটিকে সত্য বলে অবশ্যই মেনে নিতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য এসবের বিস্তারিত জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই হাদীসে ঈমান সম্পর্কিত সওয়ালের জবাবে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন যেমন আল্লাহ্, ফেরেশতা, আল্লাহর কিতাব, তাঁর রাসূল, রোজ হাশর এবং তাকদীরের ভাল মন্দ। এগুলো হল বুনিয়াদী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলোর প্রতি সুনির্দিষ্ট করে ঈমান আনতেই হবে। আর এজন্যই রাসূলে আকরাম (ﷺ) সুনির্দিষ্টভাবে এগুলোর উল্লেখ করেছেন। কুরআনে কারীমেও ঈমান সম্পর্কে এ কথাগুলো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে:

اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡہِ مِنۡ رَّبِّہٖ وَالۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰہِ وَمَلٰٓئِکَتِہٖ وَکُتُبِہٖ وَرُسُلِہٖ

রাসূল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাতে ঈমান এনেছে, যা তাঁর উপর তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তাঁর সাথে) মুমিনগণও। তাঁরা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। বাকারা: ২৮৫

وَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاللّٰہِ وَمَلٰٓئِکَتِہٖ وَکُتُبِہٖ وَرُسُلِہٖ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا

যে ব্যক্তি আল্লাহকে, তাঁর ফিরিশতাগণকে, তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলগণকে এবং পরকালকে অস্বীকার করে, সে বহু দূরের ভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। নিসা: ১৩৬

কুরআন শরীফের উপরোক্ত আয়াতগুলোতে যদিও ঈমান সম্পর্কিত আলোচনায় তাকদীরের কথা উল্লেখ করা হয় নি। কিন্তু কুরআনের অন্যত্র এ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে:

قُلۡ کُلٌّ مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ

"বল, সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ হতে।" নিসাঃ ৭৮

فَمَنۡ یُّرِدِ اللّٰہُ اَنۡ یَّہۡدِیَہٗ یَشۡرَحۡ صَدۡرَہٗ لِلۡاِسۡلَامِ ۚ وَمَنۡ یُّرِدۡ اَنۡ یُّضِلَّہٗ یَجۡعَلۡ صَدۡرَہٗ ضَیِّقًا حَرَجًا

আল্লাহ যাকে হিদায়াত দানের ইচ্ছা করেন, তার বক্ষ ইসলামের জন্য খুলে দেন; আর যাকে (তার হঠকারিতার কারণে) পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষ অতিশয় সংকীর্ণ করে দেন। -আন'আম: ১২৫
এসবের উপর ঈমান আনার অর্থ কি তাও সংক্ষিপ্তভাবে জানার প্রয়োজন রয়েছে।

আল্লাহর উপর ঈমান : আল্লাহর উপর বিশ্বাসের অর্থ হল তাঁর অস্তিত্ব তাঁর একত্ব তাঁর লা-শরীফ এবং বিশ্ব-জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক হওয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। তিনি সব ধরনের দোষ থেকে ত্রুটিমুক্ত এবং তাকে পরিপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী বলে মনে করতে হবে।

আল্লাহ্ তা'আলার অস্তিত্ব, গুণাবলী এবং অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে শুধু মনের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করলেই চলবে না, বরং চলমান জীবনে তা বাস্তবায়িত করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা শুধু আমাদের খালিক ও মালিকই নন তিনি আমাদের পালনকর্তা ও রিযিকদাতা তিনি তাঁর বান্দাদের সকল প্রকাশ্য ও গোপনীয় কাজ শুধু অবলোকনই করেন না বরং তাঁর বান্দা এই দুনিয়ার পিচ্ছিল পথে কিভাবে চললে কল্যাণ ও মংগল লাভ করবে তাও তিনি বাতলে দিয়েছেন। তিনি দুনিয়া জাহান সৃষ্টি করেছেন এবং যাবতীয় জিনিসের লালন-পালনের জিম্মাদারী তার রয়েছে। তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে হুকুম দানের অধিকার একমাত্র তারই। তিনি মানুষের প্রয়োজন পূরণকারী এবং দু‘আ ও ফরিয়াদ শ্রবণকারী। তিনি ছাড়া কারো কাছে অভাব পূরণের দরখাস্ত পেশ করা বা ফরিয়াদ করা ঈমানের বিপরীত কাজ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে যতটুকু আল্লাহ ও তাঁর এখতিয়ারকে মেনে নেবে সে শুধু ততটুকু ঈমানের অধিকারী হবে।

ফিরিশতা: ফিরিশতাগণ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বিশেষ অস্তিত্বের অধিকারী। তাদের সত্তাকে সত্য বলে মানতে হবে। এও বিশ্বাস করতে হবে, ফিরিশতাগণ আল্লাহ পাকের সম্মানিত সৃষ্টি। তারা কখনও কোন মন্দ কাজে লিপ্ত হন না বা বিদ্রোহ করেন না। তারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদত করেন। তাঁর হুকুম পালনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। তাদের উপর যে সব দায়িত্ব আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সোপর্দ করেন সেগুলো তারা সুচারুরূপে সম্পাদন করেন।

সন্দেহের অপনোদন
ফিরিশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা হয় যে, তাদের অস্তিত্ব থাকলে দেখা যেত। এটা খুবই নির্বুদ্ধিতামূলক সন্দেহ। দুনিয়াতে অনেক জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলো আমরা দেখতে পাই না। দূরবিক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারের পূর্বে পানি, বায়ু ও রক্তের মধ্যে জীবানুর অস্তিত্ব বুঝা যেত না। কিন্তু বর্তমানে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি দূরবিক্ষণের সাহায্যে এগুলো দেখতে পারে। আমরা কি আমাদের রূহকে দেখতে পাই? যেভাবে আমাদের চোখ আমাদের রূহকে দেখতে অক্ষম এবং আমরা দূরবিক্ষণ যন্ত্র ছাড়া জীবানু যেভাবে দেখতে পারি না, ঠিক সেভাবেই আমাদের চোখ ফিরিশতাদের দেখতে অক্ষম। এটা কি কোন দলীল যে, আমরা চোখে যা দেখতে পাই না তার অস্তিত্ব নেই? আমাদের দৃষ্টিশক্তি বা বোধশক্তির দ্বারা কি আমরা দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞানের জরীপ করতে পেরেছি? বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে প্রত্যহ কোন না কোন জিনিস আবিষ্কৃত হচ্ছে। এ অবস্থায় নিছক অজ্ঞ ছাড়া কেউ এধরনের কথা বলতে পারে না। বস্তুতঃ মানুষের জ্ঞান এবং জ্ঞানের উপায় উপকরণ সীমাবদ্ধ।

এজন্যই কুরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ

وَمَاۤ اُوۡتِیۡتُمۡ مِّنَ الۡعِلۡمِ اِلَّا قَلِیۡلًا

তোমাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে সামান্যমাত্র। বনি ইসরাঈল: ৮৫

আল্লাহর কিতাবে বিশ্বাস
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন সময় মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ্ তা'আলা কিতাব পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ পাঠিয়েছেন পবিত্র কুরআন। কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা স্বীকার করে, শুধু তাই নয়, কুরআনের মধ্যে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের বা অনেক জিনিস নেয়া হয়েছে সেগুলোর তা'লীম ও তাবলীগ প্রত্যেক যুগের মানুষের জন্য জরুরী। আখেরী কিতাব নাযিল হওয়ার পর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রয়োজন শেষ হয়ে গিয়েছে। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ আসল অবস্থায় সংরক্ষিত নেই। তাই আসমানী হেদায়াতের এই পরিপূর্ণ কিতাব পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং কুরআন পাকের হিফাযতের জিম্মাদারী গ্রহণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَاِنَّا لَہٗ لَحٰفِظُوۡنَ

বস্তুত এ উপদেশ বাণী (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা। হিজর ৯

রাসূলগণের উপর বিশ্বাস
এই বাস্তব সত্যের উপর ঈমান আনতে হবে যে, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর বান্দাদের হেদায়াত ও পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন এলাকায় তাঁর মনোনিত বান্দাদেরকে হেদায়াত নামা এবং তার পছন্দনীয় বিধানসহ প্রেরণ করেছেন।
পয়গম্বরগণ পরিপূর্ণ সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়েছেন এবং সৎপথে নিয়ে আসার জন্য প্রাণপণ কোশেশ করেছেন। তাঁরা আল্লাহর মনোনীত সত্যবাদী পুরুষ ছিলেন। কোন কোন পয়গম্বরের নাম ও অবস্থা সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে আবার কারো কারো সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি। ইরশাদ হচ্ছে ৪

مِنۡہُمۡ مَّنۡ قَصَصۡنَا عَلَیۡکَ وَمِنۡہُمۡ مَّنۡ لَّمۡ نَقۡصُصۡ عَلَیۡک

তাদের মধ্যে কতক এমন, যাদের কতিপয়ের বৃত্তান্ত আমি তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি আর কতক এমন যাদের বৃত্তান্ত তোমাকে জানাইনি। মু'মিন: ৭৮

আল্লাহর রাসূলদের সত্যতার সাক্ষ্যদান করা এবং পয়গম্বর হিসাবে তাঁদেরকে পূর্ণ মর্যাদা দান করা ঈমানের অন্যতম শর্ত। এর সংগে অবশ্যই ঈমান আনতে হবে যে, মুহাম্মদ (ﷺ)-এর উপরই নবুওয়াত ও রিসালতের ধারাবাহিকতার পূর্ণ সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি খাতিমুল আম্বিয়া, আল্লাহর আখেরী রাসূল এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং তাঁর হেদায়াতের অনুসরণের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের পরিত্রাণ এবং কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আখিরাতের উপর ঈমান
এই সত্যকে একিন করতে হবে যে, একদিন দুনিয়াকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। আল্লাহ্ তা'আলা তার কুদরতের দ্বারা পুনরায় সকল মৃতকে জীবিত করবেন এবং পৃথিবীতে যে যেরূপ কাজ করেছে তাকে তার কাজ অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করবেন। দীন ও মাযহাবের গোটা ব্যবস্থার বুনিয়াদ আখিরাতে শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানের বিশ্বাসের উপর নিহিত হয়েছে। যদি কেউ এ আকীদার অনুসারী না হয় তাহলে সে মাযহাবী তা'লীম ও হেদায়াতকে কবুল করা এবং সে অনুযায়ী আমল করার কোন প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করবে না। এজন্য প্রত্যক ধর্মে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদানকে বুনিয়াদী আকীদা হিসাবে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। আখিরাত বা হাশর-নশর অনুষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কে ইসলাম যে ধারণা পেশ করেছে তা পূর্ববর্তী সকল আসমানী ধর্মে সমর্থন করা হয়েছে। কুরআন পাক এসম্পর্কে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছে। এরপরও একমাত্র বুদ্ধি বিভ্রম ব্যক্তিই কিয়ামতের অনুষ্ঠান অসম্ভব মনে
করতে পারে।

তাকদীরের প্রতি ঈমান
দুনিয়াতে ভাল-মন্দ যা কিছু হচ্ছে সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা ও হুকুম মুতাবিক হচ্ছে। তিনি তা পর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। এই বিশ্বের কারখানায় কোন কাজই তাঁর ইচ্ছার বিপরীত অনুষ্ঠিত হয় না। তাঁর ইচ্ছার বিপরীত কোন কাজ হতে পারার ধারণা পোষণ করলে অবশ্যই তাঁকে অক্ষম ও দুর্বল মনে করা হবে।

তাকদীর সম্পর্কে আমাদের সমাজে নানা ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তাই এখানে আরো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছি। তাকদীর সম্পর্কিত ইসলামী ধারণা হল, মানুষ না পরিপূর্ণভাবে নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে না সে ভাগ্যের দ্বারা পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আল্লাহর সার্বভৌম ইচ্ছার বিপরীত কোন কাজই অনুষ্ঠিত হয় না। এমন কি গাছের একটা পাতাও তার ইচ্ছার বাইরে নড়ে না।

لِلّٰہِ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضِ ؕ  یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ ؕ  یَہَبُ لِمَنۡ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّیَہَبُ لِمَنۡ یَّشَآءُ الذُّکُوۡرَ ۙ اَوۡ یُزَوِّجُہُمۡ ذُکۡرَانًا وَّاِنَاثًا ۚ وَیَجۡعَلُ مَنۡ یَّشَآءُ عَقِیۡمًا ؕ اِنَّہٗ عَلِیۡمٌ قَدِیۡرٌ


আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। যাকে চান কন্যা দেন এবং যাকে চান পুত্র দেন। অথবা পুত্র ও কন্যা উভয় মিলিয়ে দেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। -শুরা: ৪৯, ৫০

কুরআন শরীফে এ ধরনের আরো অনেক আয়াত রয়েছে। এসব আয়াত আল্লাহ তা'আলার সার্বভৌম ইচ্ছা ও অতুলনীয় শক্তির ইংগিত বহন করে। কিন্তু এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে আল্লাহ্ তা'আলা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে চিন্তা ও কর্মের আযাদী প্রদান করেছেন। মানুষের বুদ্ধি বিবেচনার সংগতি সম্পন্ন কর্মের আযাদীর ভিত্তিতেই তাকে আখিরাতের জীবন শাস্তি বা পুরস্কার দান করা হবে। মানুষকে যদি কোনরূপ কর্মের আযাদীই দান না করা হত এবং পূর্ব হতে তার জন্য নির্ধারিত রাখা হতো, তাহলে এ দুনিয়াতে তাকে ভাল কাজের তাকিদ করা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার কোন প্রয়োজনই দেখা দিত না। মহান আল্লাহ্ আম্বিয়া কিরামদের মাধ্যমে যে জীবন ব্যবস্থা দান করেছেন তাতে মানুষের কর্মফলের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মানুষকে তার সামন্যতম ভাল কাজেরও পুরস্কার দেয়া হবে। অনুরূপভাবে তাকে মন্দকাজেরও শাস্তি পদান করা হবে। দুনিয়ার জিন্দেগীতে আল্লাহ্ তা'আলা নিয়ম বেধে দিয়েছেন, মানুষ যে পথে নিজেকে পরিচালিত করবে সে পথেই আল্লাহ অগ্রসর করেন। আল্লাহ মানুষকে ভাল কাজের হুকুম ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাল বা মন্দ কাজে নিয়োজত করেন না। তিনি মানুষকে ভাল মন্দ নির্ণয় করার কমতা এবং আযাদী প্রদান করেছেন। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

اِنَّ اللّٰہَ لَا یُغَیِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتّٰی یُغَیِّرُوۡا مَا بِاَنۡفُسِہِمۡ

আল্লাহ তা'আলা কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। সুরা রা'দ-১১

তাকদীর সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা দরকার যে, আমাদের এ বিশ্ব ও তার প্রবতীয় উপায়-উপাদান ঘটনাচক্রে বা আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয় নি। বরং তার সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা মোতাবিক হয়েছে। তিনি তার অশেষ জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞাত রয়েছেন যে তার সৃষ্ট জীব কখন কি করবে, ভাল করবে না মন্দ করবে, জাহান্নামী হবে, না জান্নাতী হবে, মায়ের পেটের সন্তান ছেলে হবে, না মেয়ে হবে, বিকলাংগ হবে, না নিখুত হবে।

উপরে বর্ণিত ঈমান বিল্লাহ, ঈমান বিল মালাইকাহ, ঈমান বিল কিতাব, ঈমান বির রাসূল, ঈমান বিল আখিরাত এবং ঈমান বিল কদর এই ছয়টি মূল জিনিসের উপর ঈমান আনাকে ঈমানিয়াতে ইসলাম বলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ ঈমান বিস সা'আত বা কিয়ামতের উপর ঈমান আনাকে ঈমান বিল আখিরাতের সাথে একত্রিত করেছেন।

ইহসান
উপরে বর্ণিত হাদীসে ইসলাম এবং ঈমান সম্পর্কিত প্রশ্নের পর প্রশ্নকারী রাসূল (ﷺ)-কে ইহসানের হাকীকত বা মূলতত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। ঈমান এবং ইসলামের ন্যায় ইহসানও দীনি ও কুরআনী পরিভাষা। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে:

بَلٰی مَنۡ اَسۡلَمَ وَجۡہَہٗ لِلّٰہِ وَہُوَ مُحۡسِنٌ فَلَہٗۤ اَجۡرُہٗ عِنۡدَ رَبِّہٖ


কেন নয়? (নিয়ম তো এই যে,) যে ব্যক্তিই নিজ চেহারা আল্লাহর সামনে নত করবে এবং সে সৎকর্মশীলও হবে, সে নিজ প্রতিপালকের কাছে তার প্রতিদান পাবে। বাকারা- ১১২
কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَمَنۡ اَحۡسَنُ دِیۡنًا مِّمَّنۡ اَسۡلَمَ وَجۡہَہٗ لِلّٰہِ وَہُوَ مُحۡسِن

তার চেয়ে উত্তম দীন আর কার হতে পারে, যে (তার গোটা অস্তিত্বসহ) নিজ চেহারাকে আল্লাহর সম্মুখে অবনত করেছে, সেই সঙ্গে সে সৎকর্মে অভ্যস্ত।

সাধারণতঃ ইহসান বলতে ভাল ব্যবহারকে বুঝায়। কিন্তু এখানে এক বিশেষ পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মহা-মহিম আল্লাহকে চোখের সামনে উপস্থিত জ্ঞান করে ইবাদাত করাকে আলোচ্য হাদীসে রাসূল (ﷺ) ইহসান বলে আখ্যায়িত করছেন। এরূপ মনে করা যেতে পারে যে, একজন গোলাম তার মনিবের সামনে তার হুকুম পালন করছে এবং হুকুম পালন করার সময় তার মনে এ ভয় ও বিশ্বাস রয়েছে যে, তার মনিব তাকে ভালভাবে দেখছেন। আবার কোন সময় এমনও হয় যে, মনিবের অবর্তমানে গোলাম তার মনিবের হুকুম পালন করছে। সাধারণভাবে এই গোলামের উভয়ের সময়ের কাজের মধ্যে পার্থক্য থাকে। যে ধরনের ধ্যান মনোযোগ ও পরিশ্রম সহকারে গোলাম মনিবের উপস্থিতিতে কাজ করে তা তার অনুপস্থিত থাকা কালে করতে পারবে না। হাকীকি বা প্রকৃত মনিবের সংগেও মানুষের অনুরূপ আচরণ হয়ে থাকে। বান্দা যদি মনে করে যে, তার প্রভু তার সামনে উপস্থিত এবং তার প্রত্যেকটি কাজ ও গতিবিধি দেখছেন তাহলে তার মনের মধ্যে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং তার বন্দেগীর মধ্যে বিনম্রভাবের সৃষ্টি হবে। যদি মানুষের মনে আল্লাহর উপস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকে তাহলে তার কাজকর্ম ও ইবাদতের সময় তার মনে অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে না। ইহসানের অর্থ, আল্লাহর বন্দেগী এমনভাবে করতে হবে যেন আল্লাহ্ বান্দার চোখের সামনে এবং বান্দাহ আল্লাহর সামনে এবং তিনি বান্দাকে দেখছেন। রাসূল (ﷺ) এ কাথাই হাদীসের উপরোক্ত অংশে পেশ করেছেন। এই হাদীসাংশের অন্য অর্থও করা হয়ে থাকে এবং সেটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। আল্লাহর ইবাদাত এমনভাবে কর যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি এ অবস্থায় তুমি নিজেকে উন্নীত করতে না পার তাহলে এ ধারণার সাথে ইবাদাত কর যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। যারা রাসূল (ﷺ)-এর বাণীর এ অর্থ গ্রহণ করেন, তাদের কাছে ইবাদতের দুটি স্তর রয়েছে। এক: মুশাহিদায়ে হক বা হকের অবলোকন-এর সাথে ইবাদত করা। এ মর্যাদা একমাত্র কামিল বুযুর্গ ব্যক্তিরাই হাসিল করেন। দুই: বান্দাহ এ ধারণার সাথে ইবাদাত করে যে আমি আল্লাহর সামনে এবং আল্লাহ্ আমাকে দেখছেন। এই দ্বিতীয় মর্যাদার অধিকারী হচ্ছে আবেদ ব্যক্তিরা। হাদীসের মশহুর ব্যাখ্যাকারীগণ অনুরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। ইমাম নববী শরহে মুসলিমে ও আল্লামা সিন্দী 'সহীহ বুখারী' ইহসানের কমবেশী এ জাতীয় ব্যাখ্যাই পেশ করেছেন।

একটি ভ্রান্ত ধারণা
এই হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদানকালে অনেকে একে শুধুমাত্র নামাযের সাথে সংশ্লিষ্ট করে থাকেন। যেন শুধুমাত্র নামায ভয়-ভীতিসহকারে পড়ার উপরই এ হাদীসে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অথচ, শুধুমাত্র নামাযকেই বুঝানোর জন্য এখানে কোন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। تعبد বলে যে শব্দটি এই হাদীসে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে যাবতীয় ইবাদত বুঝায়। তাই নবী করীম (ﷺ)-এর উক্ত বাণীকে শুধু নামাযের সংগে সংশ্লিষ্ট করার কোন কারণ নেই। অপর এক হাদীসে ইহসানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে تخشی শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে: أَن تخشى الله كَأَنَّك ترَاهُ খোদাকে এমন ভাবে ভয় কর যেন তমি তাকে দেখছ"। এ ব্যাপারে অন্য হাদীসে বলা হয়েছে:

الإحسان أن تعمل لله كأنك تراه

ইহসান অর্থ আল্লাহর জন্য প্রত্যেকটি কাজ এমনভাবে করো যেন তুমি তাকে দেখছ। উপরের দুটি হাদীস থেকে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, ইহসানের সম্পর্ক শুধু নামাযের সঙ্গে নয়, মানুষের গোটা জিন্দেগীর প্রত্যেকটা কাজের সার্থেই সম্পৃক্ত। ইহসানের হাকীকাত বা মূলতত্ত্ব হলো, আল্লাহর প্রতিটি ইবাদাত বন্দেগী ও তাঁর হুকুমের আনুগত্য এমন ভয় ও ভীতিসহকারে করা উচিত যেন তিনি আমাদের সামনে উপস্থিত রয়েছেন এবং আমাদের প্রত্যেকটি গতিবিধি প্রত্যক্ষ করছেন।

শেষ সময় (কিয়ামত)
উল্লিখিত হাদীসে প্রশ্নকারী জানতে চাইলেন কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে। রাসূল (ﷺ) জবাবে বললেনঃ "জবাবদানকারী প্রশ্নকারীর চেয়ে ভাল কিছু জানেন না।" সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, এ প্রসংগে রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ

في خمس لا يعلمها إلا الله إن الله عنده علم الساعة وينزل الغيث ويعلم ما في الأرحام وما تدري نفس ماذا تكسب غدا وما تدري نفس بأي أرض تموت إن الله عليم خبير


পাঁচটি জিনিস আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানেন না। সেগুলো, কেয়ামত বা শেষ সময়ের জ্ঞান আল্লাহর কাছেই রয়েছে, তিনি বৃষ্টিপাত করেন, তিনিই জানেন মায়ের গর্ভে কি রয়েছে, কোন প্রাণীই জানে না যে কোন ভূখণ্ডে তার মৃত্যু হবে। একমাত্র আল্লাহই সবকিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন।" আমি জানিনা জবাবের পরিবর্তে “প্রশ্নকারীর চেয়ে জবাবদানকারী বেশী জ্ঞাত নন”, এই জবাবের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এ কথা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন, কোন প্রাণীই এ সম্পর্কে কিছু অবগত নয়। কুরআনের আয়াতের উল্লেখ করে তাঁর এ বক্তব্যকে সুদৃঢ় করে দিয়েছেন যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই এ সম্পর্কে অবগত আছেন।

কিয়ামতের আলামত
কিয়ামত সম্পর্কে রাসূল (ﷺ)-এর জবাব শোনার পর প্রশ্নকারী কিয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কে জানতে চাইলেন। রাসূল (ﷺ) যে জবাব দান করলেন তাতে দুটি আলামতের উল্লেখ রয়েছে। এক: দাসী নিজের মনিবের জন্মদান করবে। দুই : অন্ন-বস্ত্রহীন মেষপালকগণও বড় বড় ইমারত তৈরী করবে।

প্রথম আলামত বা নিদর্শন সম্পর্কে হাদীস ব্যাখ্যাদাতাগণ অনেক বক্তব্য পেশ করেছে। কেউ বলেছেন, দাসীগণ এমন সব সন্তান প্রসব করবে যারা পরবর্তী কালে বাদশাহ বা নেতার স্থান দখল করবে। আবার কেউ বলেন, এর দ্বারা বিজয় ও সাফল্যের ইংগিত দান করা হয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ বিজয়ের মাধ্যমে দাসদাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের গর্ভে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্ম হবে। কিন্তু আমি মনে করি যে, কিয়ামতের নিকটবর্তীকালে পিতা-মাতার অবাধ্যতা ব্যাপক বেড়ে যাবে। এমন কি মেয়েরা যারা সাধারণতঃ মায়ের অনুগতা ও বিশ্বস্ত হয় তারাও মায়ের শুধু অবাধ্যই হবে না, মায়েদেরকে এমনভাবে শাসন করবে যেমন কোন গৃহকর্তী তার কেনা দাসীকে শাসন করে থাকে। "দাসী নিজের কর্তা-কর্ত্রীকে জন্ম দান করবে"-এ কথার দ্বারা রাসূল (ﷺ) এ বিষয়ের প্রতিই ইংগিত করেছেন। বলাবাহুল্য কিয়ামতের এই নিদর্শন শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় নিদর্শন সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেন: অন্ন বস্ত্রহীনু মেষ পালকগণ সুউচ্চ ইমারত তৈরী করবে। কিয়ামতের নিকটবর্তীকালে পার্থিব ধন-দৌলত এমন সব লোকের হাতে আসবে যারা তার যোগ্য অধিকারী হবে না। তারা তাদের ধন-দৌলতকে বিরাট ও সুউচ্চ ইমারত নির্মাণের কাজে ব্যয় করতে পছন্দ করবে। এই অর্থ ব্যয় করাকে তারা খুব গৌরবময় মনে করবে। ইমারত নির্মাণে তারা পরস্পর প্রতিযোগিতা করবে।

অপর এক হাদীসে এ বিষয়বস্তুরই উল্লেখ এভাবে করা হয়েছে:

إذا وسد الأمر إلى غير أهله فانتظر الساعة

যখন সরকারী পদমর্যাদা এবং অধিকার অযোগ্য ব্যক্তিদের উপর সোপর্দ করা হবে তখন কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা কর।"

উল্লিখিত হাদীসের সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে দীনের এক পরিপূর্ণ নকশা অংকন করা হয়েছে। এতে তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে (১) বান্দাহ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর যেন অনুগত হয় এবং আল্লাহর বন্দেগীকে নিজের জিন্দেগী বানিয়ে নেয়। এর নামই হচ্ছে ইসলাম এবং ইসলামের স্তম্ভ হল এই সত্যের প্রকাশ। (২) আল্লাহর পয়গম্বরগণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ গায়েবী বিষয় বর্ণনা করেছেন এবং যা মেনে নেয়ার জন্য দাওয়াত দিয়েছেন সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হল ঈমান। (৩) আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবাণীতে রান্দাহ ঈমান ও ইসলামের মনযিল অতিক্রম করে তৃতীয় ও আখেরী মনযিলে পদার্পণ করে। এ মনযিলে বান্দাহর মনে আল্লাহর নৈকট্য ও দর্শন লাভের এক বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হয়। সে আল্লাহর প্রতিটি হুকুম-আহকাম পালন করার সময় আল্লাহকে তার যাবতীয় সৌন্দর্য ও কুদরত-সহকারে চোখের সামনে দেখতে পায় এবং আল্লাহ তাকে দেখেন। বান্দার মনের এ অবস্থার নাম ইহসান।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান