মা'আরিফুল হাদীস
ঈমান অধ্যায়
হাদীস নং: ১
ঈমান অধ্যায়
আল্লাহর জন্য যা করা হয় একমাত্র তাই গ্রহণযোগ্য এবং নিয়তের উপর আমল
১. হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, নিয়তের উপরই আমল। নিয়ত অনুসারেই মানুষ ফল পেয়ে থাকে। তাই আল্লাহ এবং রাসূলের জন্য যে হিজরত করল তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই এবং যে দুনিয়া লাভ বা কোন মহিলাকে বিয়ে করার জন্য হিজরত করল, বস্তুতঃ তার হিজরত সে জন্যই হল। -বুখারী, মুসলিম
کتاب الایمان
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقُوْلُ «إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا، أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ ۔
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হাদীসের যে তরজমা উপরে দেয়া হয়েছে তার কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তবুও গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের কারণে এর উদ্দেশ্য ও উপকারিতা সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন রয়েছে, এ হাদীসের আসল উদ্দেশ্য হল মুসলিম জাতির কাছে এসত্য সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা যে, আল্লাহ কোন কাজ কবুল করবেন কি করবেন না ফল দেবেন কি দেবেন না, তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে মানুষের নিয়তের বিশুদ্ধতার উপর। যে কাজ ভাল নিয়তে করা হল তাই সৎকর্ম বা আমলে সালেহ এবং আল্লাহর কাছে তারই মূল্য মর্যাদা রয়েছে। যে সৎকর্ম বা আমলে সালেহ মন্দ উদ্দেশ্য বা বাতিল নিয়তে করা হয় তা সৎকর্ম নয় এবং তা কবুলও হবে না। যদিও তা বাহ্যত সৎকর্ম বলে মনে হয়। কিন্তু নিয়তের ভিত্তিতে তা বাতিল বিবেচিত হবে। আল্লাহ তা প্রত্যাখ্যান করবেন।
মোটকথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের আমলের সাথে সাথে তার নিয়ত এবং বাহ্যিক দিকের সাথে আভ্যন্তরীণ দিকও দেখে থাকেন। তিনি নিয়ত অনুযায়ী প্রত্যেকের কাজের মূল্য ও মর্যাদা দান করেন।
একটি ভুল ধারণা
উপরের আলোচনা থেকে এ ধরনের ভুল ধারণা যেন কারও না হয় যে, ভাল নিয়তে মন্দ কাজ করিলেও তা ভাল হয়ে যাবে এবং সাওয়াব পাওয়া যাবে। যদি কেউ চুরি বা ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে গরীব মিসকীনকে সাহায্য করে সাওয়াব হাসিল করতে চায় তাহলে সে ভুল করবে। তার একাজ আমলে সালেহ বা ভালকাজ হিসাবে গণ্য হবে না। বরং বাতিল বিবেচিত হবে।
আসলকথা হল যেটা মন্দ কাজ যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করছেন তার সম্পর্কে কোনরূপ সৎনিয়তের প্রশ্নই উঠে না। তার সব অবস্থায়ই মন্দ কাজ তা আল্লাহর গযব ডেকে আনে। এ ধরনের কাজে ভাল নিয়ত করা এবং সাওয়াবের আশা পোষণ করা শুধু বৃথাই নয়, আল্লাহর শাস্তির পথও প্রশস্ত করে। এরূপ কাজ করা আল্লাহর দীনের সাথে তামাশা বৈ কিছু নয়। এ হাদীসের উদ্দেশ্য হল, আমলে সালেহ সম্পর্কে ধারণা দান করা যে, মন্দ নিয়তের দ্বারা কোন ভাল কাজ করলে তা আমলে সালেহ হিসাবে পরিগণিত হবে না, বরং তার ফল মন্দ হবে।
'খুশু-খুযূ' বা ভয়ভীতি সহকারে নামায পড়া খুবই উত্তম কাজ। এ কাজটি অবশ্যই আমলে সালেহ। কিন্তু নামাযে ভয়-ভীতি যদি এজন্য প্রকাশ করা হয় যে, মানুষ নামাযী ব্যক্তিকে খুবই দীনদার ও খোদাভীরু মনে করবে তাকে সম্মান প্রদান করবে। তাহলে তার এ ভয়ভীতির কোন মূল্য ও মর্যাদা আল্লাহর কাছে থাকবে না। মনে করুন কোন ব্যক্তি দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলাম হিজরত করল এবং হিজরতের জন্য বিভিন্ন প্রকার দুঃখ কষ্টও সহ্য করল। কিন্তু তার হিজরতের উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল না হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের কোন মহিলাকে বিবাহের জন্য হয়ে থাকে তাহলে এ হিজরত আল্লাহর জন্য হবে না। আল্লাহর কাছে সে কোন প্রতিদানও পাবে না তার আমল নামায় গুনাহ লেখা হবে।
আন্তরিকতাহীন বিরাট আমলও জাহান্নামে নিয়ে যাবে
এক হাদীসে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদালত থেকে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে জাহান্নামের ফয়সালা শুনানো হবে। সর্বপ্রথম এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে, যে জিহাদের ময়দানে হাযির হয়েছিল। হাযির করার পর আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম তাকে যে সব নি'আমত দুনিয়াতে দান করেছিলেন তার উল্লেখ করবেন সেও এগুলোর স্মরণ করবে। অতঃপর তিনি তাকে প্রশ্ন করবেন, তুমি এসব নিয়তের হক কি আদায় করেছ? সে জবাব দিবে, হে আল্লাহ! আমি তোমার রাস্তায় জিহাদ করেছি এবং তোমার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আমার প্রিয় প্রাণ কুরবান করেছি। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি জিহাদ করেছ, বাহদুর হিসাবে খ্যাতি লাভ করার জন্য। আর দুনিয়াতে তোমার বাহাদুরীর চর্চা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। এভাবে একজন আলেমে-দীন এবং কুরআনের পণ্ডিতকে আদালতে হাযির করা হবে। তাকেও আল্লাহ্ তা'আলা জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কি আমল করেছ? সে জবাব দেবে আমি তোমার দীনের এবং কিতাবের শিক্ষালাভ করেছি। অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। আর এসব কিছুই তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী তুমিতো এসব এজন্য করেছ যে, লোক তোমাকে আলেম, কারী, মাওলানা বলবে। আল্লাহর হুকুমে তাকেও দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর এমন এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে যাকে আল্লাহ্ তা'আলা দুনিয়াতে ধনদৌলত দিয়েছিলেন। তাকেও সাওয়াল করা হবে, তুমি কি করেছ? সে জবাব দিবে, হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির জন্য প্রত্যেক মঙ্গলজনক কাজে অর্থ ব্যয় করেছি আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি এজন্য অর্থ-সম্পদ খরচ করেছ যে, দুনিয়ার লোক তোমাকে দানশীল বলুক। দুনিয়াতে তোমার দানশীলতার খুব চর্চা হয়েছে। অতঃপর তাকেও নীচের দিকে মুখ করে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।-মুসলিম
আল্লাহ তা'আলা নিয়তের সময় অহংকার ও কপটতার অভিশাপ থেকে আমাদের রক্ষা করুন। সারকথা, আল্লাহর কাছে ঐ কাজ গৃহীত হবে যা সৎ নিয়তে অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে। দীনের বিশেষ পরিভাষায় একে ইখলাস বা আন্তরিকতা বলা হয়।
কুরআনের উদাহরণ
নীচে উল্লিখিত, পবিত্র কুরআনের আয়াত দু'টিতে সদকা ও খয়রাত দানকারী দু'ধরনের লোকের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এক শেণীর লোক অন্যকে দেখানোর জন্য নিজের সম্পদ সৎকাজে ব্যয় করে থাকে, অপর শেণীর লোক শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য গরীব মিসকীন ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করে। এ দু'ধরনের দাতার বাহ্যিক আচরণ এক এবং অভিন্ন। মানুষের চোখ তাদের কাজে কোন ব্যবধান খুঁজে পাবে না। কিন্তু কুরআন বলে, যেহেতু তাদের নিয়তে বিভিন্নতা রয়েছে, তাই তাদের কর্মের ফলও বিভিন্ন হবে। একজনের আমল বরবাদ হবে এবং অপরজনের আমল বরকতময় হবে। ইরশাদ হচ্ছে:
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُبۡطِلُوۡا صَدَقٰتِکُمۡ بِالۡمَنِّ وَالۡاَذٰی ۙ کَالَّذِیۡ یُنۡفِقُ مَالَہٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَلَا یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ فَمَثَلُہٗ کَمَثَلِ صَفۡوَانٍ عَلَیۡہِ تُرَابٌ فَاَصَابَہٗ وَابِلٌ فَتَرَکَہٗ صَلۡدًا ؕ لَا یَقۡدِرُوۡنَ عَلٰی شَیۡءٍ مِّمَّا کَسَبُوۡا ؕ وَاللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ
হে মুমিনগণ! খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন এক মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং) সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না। আর আল্লাহ (এরূপ) কাফিরদেরকে হিদায়াতে উপনীত করেন না। আল বাকারা, আয়াত নং: ২৬৪
وَمَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَہُمُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰہِ وَتَثۡبِیۡتًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ کَمَثَلِ جَنَّۃٍۭ بِرَبۡوَۃٍ اَصَابَہَا وَابِلٌ فَاٰتَتۡ اُکُلَہَا ضِعۡفَیۡنِ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یُصِبۡہَا وَابِلٌ فَطَلٌّ ؕ وَاللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
আর যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং নিজেদের মধ্যে পরিপক্বতা আনয়নের জন্য, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন কোনও টিলার উপর একটি বাগান রয়েছে, তার উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হল, ফলে তা দ্বিগুণ ফল জন্মাল। যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিও (তার জন্য যথেষ্ট)। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ তা অতি উত্তমরূপে দেখেন।
রিয়াকারীগণ নিজেদের নেক আমলের কোন সওয়াব পাবে না। আল্লাহ্ এধরনের লোকদের হেদায়াত এবং কর্মের সুফল থেকে বঞ্চিত রাখেন। দু'ধরনের লোকই প্রকাশ্যে গরীব-মিসকীন ও অভাবগ্রস্তদের জন্য ব্যয় করেছে। যেহেতু একের উদ্দেশ্যে ছিল লোক দেখানো তাই লোকের বাহবা এবং প্রশংসা ছাড়া তারা আর কিছুই হাসিল হবে না। কিন্তু অপরের ত্যাগ ও সম্পদ খরচের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর ফযল ও করম হাসিল করা তাই আল্লাহ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল দেবেন।
আল্লাহর এ নিয়ম ও কানুনের ঘোষণাই তাঁর রাসূল (ﷺ) উপরোক্ত হাদীসে ব্যক্ত করেছেন। দুনিয়াতে প্রকাশ্য বিষয়ের উপর ফয়সালা হয়, আখিরাতে নিয়তের ভিত্তিতে ফয়সালা হবে। আমরা যে দুনিয়াতে বসবাস করি তাকে জাহেরী দুনিয়া বা স্বার্থের দুনিয়া বলা হয়। আমাদের বিচারবোধ প্রকাশ্য জিনিস পর্যন্ত সীমিত। আমরা মানুষের বাহ্যিক চালচালন দেখে তার সম্পর্কে ভাল বা মন্দ রায় কায়েম করি এবং তার বাহ্যিক কাজের ভিত্তিতে তার সঙ্গে আচরণ করি। তার বাহ্যিক কাজের অন্তরালে তার নিয়ত এবং তার মনের আপন কথা খুঁজে বের করতে আমরা অক্ষম। এজন্য ফারূকে আযম (রা) বলেন: আমরা বাহ্যিক কাজের ভিত্তিতে হুকুম দান করি, গোপন কাজের রহস্য আল্লাহই জানেন। পরজগতের ফয়সালাকারী হবেন সমস্ত গায়েবী জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেখানে তিনি মানুষের কাজের ফয়সালা নিয়ত অনুযায়ী করবেন দুনিয়াতে যেমন মানুষের কাজের ফয়সালা প্রকাশ্য বিষয়ের ভিত্তিতে করা হয়, নিয়তের এখানে কোন গুরুত্ব থাকে না তেমনি আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা নিয়তের ভিত্তিতেই বিচার করবেন এবং যাহেরী আমলকে নিয়তের অধীন করে দেবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানী, মানুষ ভাল কাজের নিয়ত করার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের আমলনামায় এক সওয়াব লিখা হয় এবং নিয়ত অনুযায়ী যখন কাজ সম্পাদন করে তখন তিনি কাজের গুরুত্ব অনুসারে দশ থেকে সাতশ বা আরও বেশী সওয়াব দেন। কিন্তু মন্দ কাজের নিয়ত করলেই মানুষের আমলনামায় কোন গুনাহ লিখা হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবে মন্দ কাজ করা না হয়।
বিশেষ গুরুত্ব : এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এমন এক বাণী যা সংক্ষিপ্ত হলেও ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। এতে দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক নিহিত রয়েছে। এ যেন সাগরকে কূপের মধ্যে এঁটে দেয়া হয়েছে। কোন কোন ইমাম বলেন, ইসলামের এক তৃতীয়াংশ এ হাদীসের মধ্যে রয়েছে এটা কোন অতিশয়োক্তি নয়। কেননা নীতিগতভাবে ইসলাম তিনভাগে বিভক্ত: ঈমান, আমল ও এখলাস। যেহেতু এখলাসের সাথে এ হাদীসটি জড়িত তাই বলা যেতে পারে, এতে ইসলামের এক ততীয়াংশের উল্লেখ রয়েছে। অধিকন্তু এখলাস এমন এক বস্তু যা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন হয়। যে কোন ভাল কাজ করার সময় রাসূল (ﷺ)-এর এ হাদীসটি সামনে থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বুযুর্গ ব্যক্তিগণ তাঁদের পুস্তকের গুরুতে এ হাদীস উল্লেখ করা উত্তম মনে করেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর 'জামে সহীহ' ও ইমাম কাবী তাঁর 'মাসবীহ'-এর শুরুতে এ হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা যেন একে 'ফাতেহাতুল কিতাব'-এর মর্যাদা দিয়েছেন। হাফীযুল হাদীস ইবনে মাহদী বলেন, যখনই কোন মানুষ কোন দীনি কিতাব লেখে সে যেন তার কিতাব এ হাদীস দিয়ে শুরু করে। অতঃপর তিনি বলেন, আমি যদি কোন কিতাব লিখি তাহলে প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শুরুতে এ হাদীস উল্লেখ করব।
মোটকথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের আমলের সাথে সাথে তার নিয়ত এবং বাহ্যিক দিকের সাথে আভ্যন্তরীণ দিকও দেখে থাকেন। তিনি নিয়ত অনুযায়ী প্রত্যেকের কাজের মূল্য ও মর্যাদা দান করেন।
একটি ভুল ধারণা
উপরের আলোচনা থেকে এ ধরনের ভুল ধারণা যেন কারও না হয় যে, ভাল নিয়তে মন্দ কাজ করিলেও তা ভাল হয়ে যাবে এবং সাওয়াব পাওয়া যাবে। যদি কেউ চুরি বা ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে গরীব মিসকীনকে সাহায্য করে সাওয়াব হাসিল করতে চায় তাহলে সে ভুল করবে। তার একাজ আমলে সালেহ বা ভালকাজ হিসাবে গণ্য হবে না। বরং বাতিল বিবেচিত হবে।
আসলকথা হল যেটা মন্দ কাজ যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করছেন তার সম্পর্কে কোনরূপ সৎনিয়তের প্রশ্নই উঠে না। তার সব অবস্থায়ই মন্দ কাজ তা আল্লাহর গযব ডেকে আনে। এ ধরনের কাজে ভাল নিয়ত করা এবং সাওয়াবের আশা পোষণ করা শুধু বৃথাই নয়, আল্লাহর শাস্তির পথও প্রশস্ত করে। এরূপ কাজ করা আল্লাহর দীনের সাথে তামাশা বৈ কিছু নয়। এ হাদীসের উদ্দেশ্য হল, আমলে সালেহ সম্পর্কে ধারণা দান করা যে, মন্দ নিয়তের দ্বারা কোন ভাল কাজ করলে তা আমলে সালেহ হিসাবে পরিগণিত হবে না, বরং তার ফল মন্দ হবে।
'খুশু-খুযূ' বা ভয়ভীতি সহকারে নামায পড়া খুবই উত্তম কাজ। এ কাজটি অবশ্যই আমলে সালেহ। কিন্তু নামাযে ভয়-ভীতি যদি এজন্য প্রকাশ করা হয় যে, মানুষ নামাযী ব্যক্তিকে খুবই দীনদার ও খোদাভীরু মনে করবে তাকে সম্মান প্রদান করবে। তাহলে তার এ ভয়ভীতির কোন মূল্য ও মর্যাদা আল্লাহর কাছে থাকবে না। মনে করুন কোন ব্যক্তি দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলাম হিজরত করল এবং হিজরতের জন্য বিভিন্ন প্রকার দুঃখ কষ্টও সহ্য করল। কিন্তু তার হিজরতের উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল না হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের কোন মহিলাকে বিবাহের জন্য হয়ে থাকে তাহলে এ হিজরত আল্লাহর জন্য হবে না। আল্লাহর কাছে সে কোন প্রতিদানও পাবে না তার আমল নামায় গুনাহ লেখা হবে।
আন্তরিকতাহীন বিরাট আমলও জাহান্নামে নিয়ে যাবে
এক হাদীসে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদালত থেকে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে জাহান্নামের ফয়সালা শুনানো হবে। সর্বপ্রথম এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে, যে জিহাদের ময়দানে হাযির হয়েছিল। হাযির করার পর আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম তাকে যে সব নি'আমত দুনিয়াতে দান করেছিলেন তার উল্লেখ করবেন সেও এগুলোর স্মরণ করবে। অতঃপর তিনি তাকে প্রশ্ন করবেন, তুমি এসব নিয়তের হক কি আদায় করেছ? সে জবাব দিবে, হে আল্লাহ! আমি তোমার রাস্তায় জিহাদ করেছি এবং তোমার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আমার প্রিয় প্রাণ কুরবান করেছি। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি জিহাদ করেছ, বাহদুর হিসাবে খ্যাতি লাভ করার জন্য। আর দুনিয়াতে তোমার বাহাদুরীর চর্চা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। এভাবে একজন আলেমে-দীন এবং কুরআনের পণ্ডিতকে আদালতে হাযির করা হবে। তাকেও আল্লাহ্ তা'আলা জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কি আমল করেছ? সে জবাব দেবে আমি তোমার দীনের এবং কিতাবের শিক্ষালাভ করেছি। অপরকে শিক্ষা দিয়েছি। আর এসব কিছুই তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী তুমিতো এসব এজন্য করেছ যে, লোক তোমাকে আলেম, কারী, মাওলানা বলবে। আল্লাহর হুকুমে তাকেও দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর এমন এক ব্যক্তিকে হাযির করা হবে যাকে আল্লাহ্ তা'আলা দুনিয়াতে ধনদৌলত দিয়েছিলেন। তাকেও সাওয়াল করা হবে, তুমি কি করেছ? সে জবাব দিবে, হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির জন্য প্রত্যেক মঙ্গলজনক কাজে অর্থ ব্যয় করেছি আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি এজন্য অর্থ-সম্পদ খরচ করেছ যে, দুনিয়ার লোক তোমাকে দানশীল বলুক। দুনিয়াতে তোমার দানশীলতার খুব চর্চা হয়েছে। অতঃপর তাকেও নীচের দিকে মুখ করে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।-মুসলিম
আল্লাহ তা'আলা নিয়তের সময় অহংকার ও কপটতার অভিশাপ থেকে আমাদের রক্ষা করুন। সারকথা, আল্লাহর কাছে ঐ কাজ গৃহীত হবে যা সৎ নিয়তে অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়েছে। দীনের বিশেষ পরিভাষায় একে ইখলাস বা আন্তরিকতা বলা হয়।
কুরআনের উদাহরণ
নীচে উল্লিখিত, পবিত্র কুরআনের আয়াত দু'টিতে সদকা ও খয়রাত দানকারী দু'ধরনের লোকের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এক শেণীর লোক অন্যকে দেখানোর জন্য নিজের সম্পদ সৎকাজে ব্যয় করে থাকে, অপর শেণীর লোক শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য গরীব মিসকীন ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করে। এ দু'ধরনের দাতার বাহ্যিক আচরণ এক এবং অভিন্ন। মানুষের চোখ তাদের কাজে কোন ব্যবধান খুঁজে পাবে না। কিন্তু কুরআন বলে, যেহেতু তাদের নিয়তে বিভিন্নতা রয়েছে, তাই তাদের কর্মের ফলও বিভিন্ন হবে। একজনের আমল বরবাদ হবে এবং অপরজনের আমল বরকতময় হবে। ইরশাদ হচ্ছে:
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُبۡطِلُوۡا صَدَقٰتِکُمۡ بِالۡمَنِّ وَالۡاَذٰی ۙ کَالَّذِیۡ یُنۡفِقُ مَالَہٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَلَا یُؤۡمِنُ بِاللّٰہِ وَالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ فَمَثَلُہٗ کَمَثَلِ صَفۡوَانٍ عَلَیۡہِ تُرَابٌ فَاَصَابَہٗ وَابِلٌ فَتَرَکَہٗ صَلۡدًا ؕ لَا یَقۡدِرُوۡنَ عَلٰی شَیۡءٍ مِّمَّا کَسَبُوۡا ؕ وَاللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ
হে মুমিনগণ! খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন এক মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং) সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না। আর আল্লাহ (এরূপ) কাফিরদেরকে হিদায়াতে উপনীত করেন না। আল বাকারা, আয়াত নং: ২৬৪
وَمَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَہُمُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰہِ وَتَثۡبِیۡتًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ کَمَثَلِ جَنَّۃٍۭ بِرَبۡوَۃٍ اَصَابَہَا وَابِلٌ فَاٰتَتۡ اُکُلَہَا ضِعۡفَیۡنِ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یُصِبۡہَا وَابِلٌ فَطَلٌّ ؕ وَاللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
আর যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং নিজেদের মধ্যে পরিপক্বতা আনয়নের জন্য, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন কোনও টিলার উপর একটি বাগান রয়েছে, তার উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হল, ফলে তা দ্বিগুণ ফল জন্মাল। যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিও (তার জন্য যথেষ্ট)। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ তা অতি উত্তমরূপে দেখেন।
রিয়াকারীগণ নিজেদের নেক আমলের কোন সওয়াব পাবে না। আল্লাহ্ এধরনের লোকদের হেদায়াত এবং কর্মের সুফল থেকে বঞ্চিত রাখেন। দু'ধরনের লোকই প্রকাশ্যে গরীব-মিসকীন ও অভাবগ্রস্তদের জন্য ব্যয় করেছে। যেহেতু একের উদ্দেশ্যে ছিল লোক দেখানো তাই লোকের বাহবা এবং প্রশংসা ছাড়া তারা আর কিছুই হাসিল হবে না। কিন্তু অপরের ত্যাগ ও সম্পদ খরচের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর ফযল ও করম হাসিল করা তাই আল্লাহ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল দেবেন।
আল্লাহর এ নিয়ম ও কানুনের ঘোষণাই তাঁর রাসূল (ﷺ) উপরোক্ত হাদীসে ব্যক্ত করেছেন। দুনিয়াতে প্রকাশ্য বিষয়ের উপর ফয়সালা হয়, আখিরাতে নিয়তের ভিত্তিতে ফয়সালা হবে। আমরা যে দুনিয়াতে বসবাস করি তাকে জাহেরী দুনিয়া বা স্বার্থের দুনিয়া বলা হয়। আমাদের বিচারবোধ প্রকাশ্য জিনিস পর্যন্ত সীমিত। আমরা মানুষের বাহ্যিক চালচালন দেখে তার সম্পর্কে ভাল বা মন্দ রায় কায়েম করি এবং তার বাহ্যিক কাজের ভিত্তিতে তার সঙ্গে আচরণ করি। তার বাহ্যিক কাজের অন্তরালে তার নিয়ত এবং তার মনের আপন কথা খুঁজে বের করতে আমরা অক্ষম। এজন্য ফারূকে আযম (রা) বলেন: আমরা বাহ্যিক কাজের ভিত্তিতে হুকুম দান করি, গোপন কাজের রহস্য আল্লাহই জানেন। পরজগতের ফয়সালাকারী হবেন সমস্ত গায়েবী জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেখানে তিনি মানুষের কাজের ফয়সালা নিয়ত অনুযায়ী করবেন দুনিয়াতে যেমন মানুষের কাজের ফয়সালা প্রকাশ্য বিষয়ের ভিত্তিতে করা হয়, নিয়তের এখানে কোন গুরুত্ব থাকে না তেমনি আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা নিয়তের ভিত্তিতেই বিচার করবেন এবং যাহেরী আমলকে নিয়তের অধীন করে দেবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানী, মানুষ ভাল কাজের নিয়ত করার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের আমলনামায় এক সওয়াব লিখা হয় এবং নিয়ত অনুযায়ী যখন কাজ সম্পাদন করে তখন তিনি কাজের গুরুত্ব অনুসারে দশ থেকে সাতশ বা আরও বেশী সওয়াব দেন। কিন্তু মন্দ কাজের নিয়ত করলেই মানুষের আমলনামায় কোন গুনাহ লিখা হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবে মন্দ কাজ করা না হয়।
বিশেষ গুরুত্ব : এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এমন এক বাণী যা সংক্ষিপ্ত হলেও ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। এতে দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক নিহিত রয়েছে। এ যেন সাগরকে কূপের মধ্যে এঁটে দেয়া হয়েছে। কোন কোন ইমাম বলেন, ইসলামের এক তৃতীয়াংশ এ হাদীসের মধ্যে রয়েছে এটা কোন অতিশয়োক্তি নয়। কেননা নীতিগতভাবে ইসলাম তিনভাগে বিভক্ত: ঈমান, আমল ও এখলাস। যেহেতু এখলাসের সাথে এ হাদীসটি জড়িত তাই বলা যেতে পারে, এতে ইসলামের এক ততীয়াংশের উল্লেখ রয়েছে। অধিকন্তু এখলাস এমন এক বস্তু যা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন হয়। যে কোন ভাল কাজ করার সময় রাসূল (ﷺ)-এর এ হাদীসটি সামনে থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বুযুর্গ ব্যক্তিগণ তাঁদের পুস্তকের গুরুতে এ হাদীস উল্লেখ করা উত্তম মনে করেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর 'জামে সহীহ' ও ইমাম কাবী তাঁর 'মাসবীহ'-এর শুরুতে এ হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা যেন একে 'ফাতেহাতুল কিতাব'-এর মর্যাদা দিয়েছেন। হাফীযুল হাদীস ইবনে মাহদী বলেন, যখনই কোন মানুষ কোন দীনি কিতাব লেখে সে যেন তার কিতাব এ হাদীস দিয়ে শুরু করে। অতঃপর তিনি বলেন, আমি যদি কোন কিতাব লিখি তাহলে প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শুরুতে এ হাদীস উল্লেখ করব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ মা'আরিফুল হাদীস (মাওলানা মনযূর নোমানী রহ.)