মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

নবীগণ (আ) সম্পর্কিত তথ্যাবলী অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৯
নবীগণ (আ) সম্পর্কিত তথ্যাবলী অধ্যায়
আল্লাহ্ নবী মূসা ইবনে ইমরান (আ) সম্পর্কিত পরিচ্ছেদসমূহ

পরিচ্ছেদ : আল্লাহর নবী মূসা (আ)-এর মর্যাদা এবং খানিকটা আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা
(৪৯) ইব্‌ন আব্বাস (রা) রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, আমার সম্মুখে উম্মতসমূহ (বিভিন্ন) পেশ করা হয়। আমি জনৈক নবীকে (ﷺ) দেখলাম, তাঁর সাথে একটি সম্প্রদায়। আরেক নবীকে (আ) দেখলাম তাঁর সাথে একজন ও দুইজন পুরুষ। আরেক নবীকে (আ) দেখলাম- তাঁর সাথে কেউ নেই। এই সময় আমার সম্মুখে বিশাল জনতা পেশ করা হয়, আমি বললাম-এটি কি আমার উম্মত? বলা হলো, এঁরা হচ্ছেন মূসা (আ) ও তাঁর সম্প্রদায়। আপনি সম্মুখ দিগন্তে দৃষ্টিপাত করুন। (আমি চেয়ে দেখলাম) বিশাল জনতা; বলা হলো, অন্য দিগন্তে দেখুন। (আমি দেখলাম) বিশাল জনতা। বলা হলো, এই হচ্ছে আপনার উম্মত এবং এদের সাথে রয়েছে সত্তর হাজার, যাঁরা বিনা হিসাবে ও বিনা শাস্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবীগণের মধ্যে কেউ কেউ মন্তব্য করছিলেন, সম্ভবতঃ এঁরা (এই সত্তর হাজার) নবীর (ﷺ) সাহাবীবৃন্দ (রা)। আবার কেউ বলছিলেন, এঁরা সম্ভবতঃ সেই সব লোক, যাঁরা ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং আল্লাহর সাথে কখনও কোন শরীক করেননি। এছাড়া অন্য বিষয়াদিও তাঁরা উল্লেখ করেন। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁদের সম্মুখে বের হয়ে আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত ছিলে? তখন তাঁরা তাঁকে আলোচিত বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন। তখন রাসূল (ﷺ) বলেন, তাঁরা (সত্তর হাজার) হচ্ছেন সেই সব লোক, যাঁরা (গরম লোহার) দাগ লাগায় না, তাবিজ-তুমার করে না, শুভাশুভ নির্ণয়ের জন্য পাখি উড়ায় না। এবং তারা তাদের রবের উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করে। একথা শুনে 'উক্কাশা ইবনে মিহসান আল 'আশ'আরী (রা) দণ্ডায়মান হয়ে আরয করেন, আমি কি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। রাসূল (ﷺ) বলেন, হ্যাঁ তুমি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর অন্য একজন দণ্ডায়মান হয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি কি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত, ইয়া রাসূলাল্লাহ্? তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন, এ বিষয়ে 'উকাশা তোমার অগ্রে চলে গিযেছে।
(এই হাদীসের বরাত সপ্তদশ খণ্ডে 'কিতাবুত তিব্ব'-এ বর্ণিত হয়েছে।)
كتاب أحاديث الأنبياء عليهم وعلى نبينا الصلاة والسلام
أبواب ذكر نبى الله موسى بن عمران عليه السلام

باب ما جاء فى فضل نبى الله موسى وشئ من فضل نبينا عليهما الصلاة والسلام
عن سعيد بن جبير (4) قال حدثنا ابن عباس رضى الله عنهما عن النبي صلي الله عليه وسلم قال عرضت علىّ الأمم فرأيت النبى صلي الله عليه وسلم ومعه الرهط والنبى ومعه الرجل والرجلين والنبى وليس معه أحد إذ رفع لى سواد عظيم فقلت هذه أمتى؟ فقيل هذا موسى وقومه ولكن انظر الى الأفق، فاذا سواد عظيم ثم قيل انظر الى هذا الجانب الآخر، فاذا سواد عظيم فقيل هذه أمتك ومعهم سبعون الفا يدخلون الجنة بغير حساب ولا عذاب: فقال بعضهم لعلهم الذين صحبوا النبى صلي الله عليه وسلم وقال بعضهم لعلهم الذين ولدوا فى الاسلام ولم يشركوا بالله شيئا قط وذكروا أشياء، فخرج اليهم النبى صلي الله عليه وسلم فقال ما هذا الذى كنتم تخوضون فيه؟ فأخبروه بمقالتهم فقال هم الذين لا يكتوون ولا يسترقون ولا يتطيرون وعلى ربهم يتوكلون، فقام عكاشة بن محصن الأشعرى رضى الله عنه فقال أنا منهم يا رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم سبقك بها عكاشة

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সায়্যিদুল-আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন। নবী-রাসূলগণের প্রধান। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সঙ্গে এমন অনেক মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছেন, যা আর কারও সাথে করা হয়নি। যেমন তাঁর মি‘রাজ যাত্রা। এ হাদীছে সেরকম এক মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে সমস্ত নবী রাসূল ও তাঁদের উম্মতকে তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া। এ দেখানোটা মি‘রাজের সফরে হয়েছিল না স্বপ্নযোগে, তা এ হাদীছে স্পষ্ট করা হয়নি। যেভাবেই হোক না কেন, তাঁকে দেখানো হয়েছে এটাই সত্য। কখন কিভাবে দেখানো হয়েছে, তা জানা আমাদের জন্য জরুরি নয়। আমাদের জন্য জরুরি কেবল হাদীছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। এ হাদীছে সে শিক্ষা স্পষ্টভাবেই আছে।

এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতসংখ্যা সবচে' বেশি। এর আগে যত নবী-রাসূল দুনিয়ায় এসেছেন, তাঁদের কারও উম্মতসংখ্যাই তাঁর উম্মতের সমান নয়। এখানে সর্বপ্রথম যে নবীর উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর সঙ্গে ছিল একটি ক্ষুদ্র দল। শব্দ বলা হয়েছে 'রুহাইত' (رهيط)। এটি 'রাহত' (رهط)-এর তাসগীর (ক্ষুদ্রতাজ্ঞাপক রূপ)। এর দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে বোঝায়।

কোনও নবীর সঙ্গে ছিল এক-দুইজন লোক এবং কোনও নবীর সঙ্গে একজনও নয়। এ সকল নবী কে কে ছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু হযরত মূসা আ.-এরই নাম বলা হয়েছে যে, তাঁর সাথে মোটামুটি একটা বড় দল ছিল। অন্যান্য নবীদের উম্মতের সংখ্যা কম হওয়ার মানে তাঁদের ডাকে অল্প লোকই সাড়া দিয়েছিল। আবার কোনও নবী এমন ছিলেন, যাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। ফলে তাঁর সঙ্গে কেউ ছিল না।

দীনী কাজে সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি
এখানে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি তাঁর দা'ওয়াতী মেহনত কি ব্যর্থ হয়েছে? কিংবা যাঁর ডাকে অল্পসংখ্যক লোক সাড়া দিয়েছে, তাঁর সফলতা কি কম?
না, তাঁদের কারওই মেহনত ব্যর্থ হয়নি এবং কেউই অসফল বা অল্প সফল হননি। তাঁদের প্রত্যেকেই পুরোপুরি সফল, তাতে কেউ সাড়া দিক বা না দিক। কেননা সফলতা ও ব্যর্থতা পার্থিব ফলাফলের উপর নির্ভর করে না। কার ডাকে বেশি লোক সাড়া দিয়েছে এবং কার ডাকে কম, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। এর দ্বারা সফলতা-ব্যর্থতা নিরূপিত হয় না। দীনী কাজে সফলতা-অসফলতা নির্ভর করে কে কতটুকু ইখলাসের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করল তার উপর। যার কাজ যতবেশি ইখলাসভিত্তিক ও শুদ্ধ-সঠিক হবে সে ততবেশি সফল, তাতে পার্থিব ফলাফল যাই হোক না কেন। নবীদের কাজ ছিল আল্লাহর হুকুম মানুষের কাছে পৌঁছানো ও মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। তাঁরা এ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে আদায় করেছিলেন। শতভাগ ইখলাসের সঙ্গে করেছিলেন। তাঁরা মানুষের কাছে কোনওরকম বিনিময় আশা করেননি। তাঁদের যা-কিছু চাওয়া-পাওয়ার, সবই ছিল আল্লাহর কাছে। তাঁদের একজনও আপন দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেননি। সাড়া দেওয়া না দেওয়া যাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তার কাজ। সাড়া দিলে সে সফল, না দিলে ব্যর্থ। তার ব্যর্থতা কেবল তারই। তা নবীকে স্পর্শ করে না। সে সাড়া না দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে নবীও ব্যর্থ হয়ে যাবেন এমন কোনও কথা নেই। সুতরাং সকল নবীই সফল, যেহেতু তাঁদের সকলেই পরিপূর্ণভাবে নবুওয়াতী দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এর দ্বারা দীনী দাওয়াতের অঙ্গনে যারা কাজ করে তারা শিক্ষা নিতে পারে। তাদেরও কাজ কেবল দা'ওয়াত দিয়ে যাওয়া। তাদের কোনও ব্যর্থতা নেই, যদি ইখলাসের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। তাদের ডাকে একজনও যদি সাড়া না দেয়, তাতে তাদের দমে যাওয়ার কারণ নেই। যথার্থভাবে কাজ করতে পারাটাই সফলতা। যদি তা করে থাকে, তবে সে সফল। তার কর্তব্য সেজন্য শোকর আদায় করা।

হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বনবী
সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে তাঁর নিজ উম্মতকে তুলে ধরা হয়। তাঁকে তাদের দেখানো হয় আকাশের দুই প্রান্তে। হযরত মূসা আ.-এর উম্মতকেও একই স্থানে দেখানো হয়, যদিও তাঁর উম্মতের সংখ্যা আখেরী উম্মত ছাড়া অন্যান্য নবীদের উম্মত অপেক্ষা বেশি ছিল। কিন্তু এ উম্মতকে দেখানো হয় আকাশের দুই দিকে। দুই দিগন্তে। খুব সম্ভব এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে অন্যান্য নবীর মত আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত পৃথিবীর কোনও এক স্থানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। তিনি জাতিবিশেষের নবী নন। তিনি আরব-অনারব, পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর সকলের নবী। ইরশাদ হয়েছে–

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থ এবং (হে নবী!) আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝছে না। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)

অপর এক আয়াতে আছে–

قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا

অর্থঃ বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। (সূরা আ'রাফ, আয়াত ১৫৮)

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান, তাঁর উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে যাবে। হাশরের ময়দানে তাদের ইহজীবনের কাজকর্মের কোনও হিসাব নেওয়া হবে না। তারা সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। এমন হবে না যে, পাপকর্মের শাস্তি ভোগের জন্য প্রথমে তাদের জাহান্নামে দেওয়া হবে। তারপর যখন শাস্তি ভোগের মেয়াদ শেষ হবে, তখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাত দেওয়া হবে। বরং তারা প্রথমেই চিরকালের জন্য জান্নাতে চলে যাবে।

প্রশ্ন হতে পারে, হাদীছে যে গুণগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা যদি অন্যান্য পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, তবুও বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে?

এর উত্তর হল, ব্যাপারটা এরকম হবে না। হাদীছে বর্ণিত চারটি গুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা অবশ্যই যাবতীয় পাপকর্ম থেকে মুক্ত থাকবে। কেননা ওই চারটি গুণ তাকওয়ার উচ্চতর স্তরের। যারা তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিত থাকে, তারা সাধারণত কবীরা গুনাহ ও কঠিনতম পাপে লিপ্ত হয় না। কখনও শয়তানের প্ররোচনায় ও নফসের ধোঁকায় পড়ে কঠিন কোনও পাপ করে ফেললেও যথাশীঘ্র তাওবা করে নেয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদের ক্ষমা করে দেন এবং পাপমুক্ত হয়েই তারা কবরে যায়।
বিনা হিসাবে যারা জান্নাতে যাবে, এ হাদীছে তাদের সংখ্যা বলা হয়েছে সত্তর হাজার। অপর এক বর্ণনায় আছে, এ সত্তর হাজারের প্রত্যেকের সঙ্গে থাকবে আরও সত্তর হাজার। সে হিসেবে সত্তর হাজারকে সত্তর হাজার দ্বারা গুণ দিতে হবে। সুতরাং বিনা হিসাবে যারা জান্নাত লাভ করবে তাদের সর্বমোট সংখ্যা চারশ' নব্বই কোটি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

যে তিনটি গুণ থাকলে বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ হবে
বিনা হিসাবে জান্নাত লাভকারীদের প্রথম গুণ বলা হয়েছে- তারা ঝাড়ফুঁক করে না এবং অন্যকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করায় না।
ঝাড়ফুঁক করার অর্থ কোনওকিছু পড়ে অসুস্থ ব্যক্তির উপর দম করা, যেমন সূরা ফাতিহা পড়ে দম করা, সূরা নাস ও ফালাক পড়ে দম করা কিংবা হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দু’আ পড়ে দম করা। একে 'রুকয়া' (رقية) বলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রুকয়া করেছেন এবং করার অনুমতিও দিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম থেকেও তা করার কথা বর্ণিত আছে। এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে তারা এটা করে না। তার মানে এটা করা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা। প্রশ্ন ওঠে, যে কাজ বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয় তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এবং সাহাবায়ে কিরাম কিভাবে করতেন? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও করা যায় যে কাজ তিনি নিজে এবং সাহাবায়ে কিরাম করতেন তা জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয় কিভাবে?
‘উলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। সারকথা হল, রুকয়া তিন প্রকার।

ক. জাহিলী যুগের প্রচলিত রুকয়া। তখন এমনসব মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করা হত, যার অর্থ বোধগম্য ছিল না। এরূপ ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়। কেননা হতে পারে তা শিরকী কথা। অথবা এমন কথা, পরিণামে যা শিরকীর দিকে গড়ায়।

খ. আল্লাহর কালাম বা আল্লাহর নাম দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা। এটা নিঃসন্দেহে জায়েয।বরং যে ঝাড়ফুঁক নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তা করা মুস্তাহাব।

গ. যে ঝাড়ফুঁক ফিরিশতা, ওলী-বুযুর্গ, 'আরশ প্রভৃতি মর্যাদাপূর্ণ মাখলুকের নামে করা হয়, এমনিতে তা করা নাজায়েয নয় বটে, তবে এর থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কেননা এতে শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

এ হাদীছে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারীদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে ঝাড়ফুঁক না করার কথা বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা প্রথম ও শেষ প্রকারের ঝাড়ফুঁক বোঝানো হয়েছে,দ্বিতীয় প্রকারের ঝাড়ফুঁক নয়।
এমনও হতে পারে যে, সর্বপ্রকার রুকয়াই এর অন্তর্ভুক্ত। সে ক্ষেত্রে বলা হবে এটা সর্বোচ্চ স্তরের তাওয়াক্কুলের বিষয়, যাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি এমন গভীর আস্থা আছে যে, আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা না করা উভয়ই তাদের পক্ষে সমান। অসুস্থ অবস্থায় যদি কোনও চিকিৎসা গ্রহণ না করে, তারপর দেখা যায় রোগ আরও বেড়ে গেছে, তখনও তাদের আস্থায় কোনও চিড় ধরে না। তারা মনে করে না যে, চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ অবস্থা হত না, তার রোগ ভালো হয়ে যেত। মোটকথা আল্লাহ যখন যে হালে রাখেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, কোনওরকম অভিযোগ-আপত্তিমূলক কথা মুখে তো উচ্চারণ করেই না, মনেও আসে না। হাদীছে এ শ্রেণির আওলিয়ার কথাই বলা হয়েছে।

বলাবাহুল্য, আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালাম-এর তাওয়াক্কুল ছিল সর্বোচ্চ স্তরের। অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরামের তাওয়াক্কুলও উচ্চ পর্যায়েরই ছিল। তা সত্ত্বেও যে তারা রুকয়া করেছেন, তা তাদের তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়। কেননা রুকয়া না করা অবস্থায় তাঁদের মনের যে হাল থাকত, রুকয়া করা অবস্থায়ও সেই একই হাল বিরাজ করত। আসবাব অবলম্বন করা না করায় তাঁদের তাওয়াক্কুলে কোনও প্রভেদ হত না। বরং তাঁদের রুকয়া বা আসবার অবলম্বন করা ছিল আল্লাহর প্রতি অধিকতর সমর্পিত থাকার আলামত। তা এভাবে যে, রোগ দিয়েছেন আল্লাহ। চিকিৎসার ব্যবস্থাও দিয়েছেন তিনিই। কাজেই অসুস্থ অবস্থায় ওষুধ খাওয়া বা রুকয়া করার দ্বারা প্রকারান্তরে তাঁর দিকে রুজু করাই হয়। এটাও নিজেকে তাঁর হাতে ছেড়ে দেওয়ার এক পন্থা। ওষুধে কী হবে না হবে সেটা কোনও কথা নয়। ওষুধ তাঁর দান। তাঁর দান গ্রহণ করাতেই বান্দার বন্দেগী। তাই দেখা যায় সমস্ত নবী-রাসূল আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রুকয়া করেছেন এবং তাঁর সুন্নতের অনুসরণে সাহাবায়ে কিরামও তা করেছেন। আমাদেরও কর্তব্য তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।

তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ভেতরই আমাদের দীন ও ঈমানের নিরাপত্তা। আমাদের তাওয়াক্কুল তাঁদের পর্যায়ে না হলেও এ দৃষ্টিকোণ থেকে আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা নিরাপদ যে, তা গ্রহণ না করলে আমাদের তাওয়াক্কুল ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। ঈমানের দুর্বলতার কারণে হয়তো বলে বসব- যথাসময়ে ওষুধ খেলে আমার এ অবস্থা হত না অথবা অমুক উপায় অবলম্বন করলে আমার এ দশা ঘটত না। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফয়সালা খুশিমনে মেনে নেওয়ার মত দৃঢ় ঈমান না থাকা অবস্থায় আসবাব-উপকরণ পরিত্যাগ করা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা সে ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি ঈমানের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তবে ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবজ গ্রহণকালে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন তা নাজায়েয কিসিমের রুকয়া না হয়। যদি কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম বা হাদীছের দু'আ দ্বারা রুকয়া করা হয়, তবে তা আলোচ্য হাদীছের পরিপন্থি হবে না এবং তা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের পক্ষেও বাধা হবে না ইনশাআল্লাহ।

অশুভ লক্ষণ প্রসঙ্গ
বিনা হিসাবে জান্নাত লাভকারীদের দ্বিতীয় গুণ- তারা কোনওকিছুকে অশুভ লক্ষণ মনে করে না। হাদীছের শব্দ হল لا يتطيرون । এর মূল শব্দ طير, যার অর্থ পাখি। জাহিলী যুগে মানুষ বিশেষ কোনও কাজ করার সময় বা কোনওদিকে যাত্রাকালে পাখির দিকে লক্ষ করত। যদি দেখত পাখি ডানদিকে উড়ে গেছে, তবে তাকে শুভলক্ষণ মনে করত এবং কাজটি সম্পন্ন করত। আর যদি বামদিকে উড়ত, তবে অশুভলক্ষণ মনে করত এবং সে কাজ থেকে বিরত থাকত। অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃতই পাখি উড়াত এবং লক্ষ করত সেটি ডানে যাচ্ছে না বামে। আর সে হিসেবে কাজ করা বা না করার ফয়সালা নিত। ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কেননা এটা মূর্খতা। পাখির ডানে বামে উড়ার সাথে শুভ-অশুভের কী সম্পর্ক? এটা একটা কুসংস্কার। ইসলাম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয় না। তাছাড়া এটা তাওয়াক্কুলেরও পরিপন্থি। শুভ-অশুভ আল্লাহর হাতে। হবে সেটাই, যা তিনি চান। পাখির উড়ায় কিছু হবে না। এর প্রতি বিশ্বাস রাখা শিরকও বটে। এটা আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদার বানানোর নামান্তর। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। এরকম আরও যত কুসংস্কার আছে, যেমন কাকের ডাককে কোনও বিপদের সংকেত মনে করা, যাত্রাকালে ঝাড়ু দেখলে যাত্রা অশুভ মনে করা, যাত্রাকালে কেউ হাঁচি দিলে তাকে বিপদসংকেত মনে করা ইত্যাদি, এসবই অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ইসলামে এসব কুসংস্কারের কোনও স্থান নেই। এ জাতীয় ধারণা কঠিন পাপ।

আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল
সর্বশেষ গুণ আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল। বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে সে সকল লোক, যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে। তারা তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ স্তরে থাকার কারণে হয় আসবাব-উপকরণ গ্রহণই করে না, অথবা তা গ্রহণ করলেও বিন্দুমাত্র তার প্রতি ভরসা থাকে না। মনেপ্রাণে ভরসা আল্লাহরই উপর থাকে। ফলে আসবাব উপকরণের প্রত্যাশিত ফল না পেলে আশাহত হয় না ও আক্ষেপ করে না। বরং ফলাফল যাই হয়, তাকে আল্লাহর ফয়সালা মনে করে পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকে এবং নিজ পসন্দের উপর আল্লাহর পসন্দকে প্রাধান্য দেয়।

হযরত ‘উক্কাশা ইব্ন মিহসান রাযি.
হযরত উক্কাশা ইব্ন মিহসান রাযি. যখন জানতে পারলেন উল্লিখিত তিনগুণ বিশিষ্ট মু'মিনগণ বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ করবে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুরোধ করলেন যেন তার জন্য দু'আ করেন, যাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তার জন্য দু'আ করলেন এবং বললেন, তুমিও তাদের একজন।

হযরত উক্কাশা রাযি. বনূ আসাদ গোত্রের একজন বিশিষ্ট সাহাবী। তিনি একজন সুদর্শন ও বীরপুরুষ ছিলেন। ছিলেন আরবের একজন শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধা। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন, আরবের শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী আমাদেরই একজন। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি কে? তিনি বললেন, 'উক্কাশা ইব্ন মিহসান। বদর যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ। এ যুদ্ধে তাঁর তরবারি ভেঙে গিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে একটি কাঠের টুকরা প্রদান করেন। তিনি সেটি নাড়া দিলে ধারালো তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। তিনি সেটি দ্বারা যুদ্ধ করতে থাকেন। আল্লাহ তা'আলা এ যুদ্ধে মুমিনদের জয়যুক্ত করেন। তরবারিটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'আওন' (সাহায্য)। অর্থাৎ এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলা সাহাবীগণকে সাহায্য করেছিলেন। তরবারিটি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকে। এর দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থেকে বহু যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর যমানায় ভণ্ড নবী তুলায়হা ইব্ন খুওয়াইলিদ আল-আসাদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সে যুদ্ধেও তিনি এ তরবারি ব্যবহার করেন। তিনি তুলায়হার হাতে শাহাদাত বরণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতকালে তাঁর বয়স ছিল ৪৪ বছর।

হযরত উক্কাশা রাযি.-এর দেখাদেখি আরও এক সাহাবী যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দু'আ করতে অনুরোধ করলেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাকেও যেন উল্লিখিত গুণবিশিষ্ট লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ করবে, তখন তিনি বললেন, 'উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। সম্ভবত তিনি ওহী মারফত জানতে পেরেছিলেন যে, উক্কাশা রাযি, তাদের অন্তর্ভূক্ত। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। কাজেই তিনি যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নন, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বিশেষত তিনি যখন একজন সাহাবী আর সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা তাঁদের জীবদ্দশায়ই নিজ সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দিয়েছেন, তখন তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারেই জান্নাতবাসী হওয়ার প্রবল আশা রয়েছে।

ওই সাহাবী সম্পর্কে তখন ওহী মারফত জান্নাতবাসী হওয়ার কথা না জানানোর কারণ এই হয়ে থাকবে যে, তখন যদি বলা হত তুমিও তাদের একজন, তাহলে একের পর এক দু'আর আবেদন চলতে থাকত আর তাঁকে বলতে হত তুমিও তাদের একজন। এক তো এটা নবুওয়াতী দায়িত্বের বিষয় নয় যে, প্রত্যেককে জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে দেওয়া হবে। নবীর কাজ কেবল জান্নাতের পথ দেখিয়ে দেওয়া আর উম্মতের কাজ সে পথে চলে জান্নাত লাভের চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত ওরকম বলতে থাকলে তা কতক্ষণ বলা যেত? একের পর একজন দাঁড়িয়ে অনুরোধ জানাতে থাকত। কখনও এ সিলসিলা শেষ হত না। তাই তখন ক্ষান্ত করে দেওয়াই সমীচীন ছিল।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিয়েছেন 'উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। এমন বলেননি যে, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও। এ কথা বললে তাঁর অন্তরে আঘাত লাগত এবং হতাশার সৃষ্টি হত। কাউকে হতাশ করা ঠিক নয়। কারও অন্তরে আঘাত দিয়ে কথা বলাও তাঁর চরিত্র ছিল না। এর দ্বারা জানা গেল যে, কারও প্রশ্নের উত্তর এমন নম্র-কোমল ভাষায় ও যৌক্তিক পন্থায় দেওয়া উচিত, যাতে প্রশ্নকর্তার মনে আঘাত না লাগে এবং সে সন্তুষ্ট হতে পারে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছের প্রধান বিষয় আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতা। বান্দার উচিত সকল কাজে আল্লাহরই উপর নির্ভর করা, আসবাব-উপকরণের উপর নয়।

খ. প্রত্যেকের উচিত বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের জন্য আশাবাদী হওয়া এবং সেজন্য শরী'আত নির্দেশিত পন্থা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা।

গ. দীনী কাজে ইখলাসের সঙ্গে মেহনত করে যাওয়াই আমাদের কাজ। ফলাফল আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা উচিত। তা একান্তই আল্লাহর কাজ। কাঙ্ক্ষিত ফল দেখতে না পাওয়ার অর্থ মেহনত ব্যর্থ যাওয়া নয়। মেহনতের পরকালীন পুরস্কার অবশ্যই পাওয়া যাবে।

ঘ. অবৈধ ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-তুমার থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। বৈধ রুকয়া ও চিকিৎসা করাতে কোনও দোষ নেই। তা তাওয়াক্কুলেরও পরিপন্থি নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান