মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

নবীগণ (আ) সম্পর্কিত তথ্যাবলী অধ্যায়

হাদীস নং: ১৭
নবীগণ (আ) সম্পর্কিত তথ্যাবলী অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: তাবুকের যুদ্ধের বছর রাসূল (ﷺ) কর্তৃক ছামুদ সম্প্রদায়ের এলাকায় অবস্থিত আল- হিজর উপত্যকা পার হওয়া
(১৭) সালিম ইব্‌ন আব্দুল্লাহ তাঁর পিতা (আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন আল-হিজর উপত্যকা অতিক্রম করেন, তখন (সাথীদের উদ্দেশ্যে) বলেন, ক্রন্দনরত অবস্থা ছাড়া তোমরা যালিমদের স্থানসমূহে প্রবেশ করো না; পাছে তোমাদেরকে পেয়ে বসে সেই শাস্তি, যা তাদেরকে পেয়েছিল এবং রাসূল (ﷺ) তাঁর বাহনে বসে চাঁদরে মুখ ঢেকে ঐ স্থান পাড়ি দেন। (অন্য বর্ণনায় এসেছে) যদি তোমরা ক্রন্দনরত হতে না পার, তবে তাদের সীমানায় প্রবেশ করবে না, পাছে তোমাদরেকেও সেই শান্তি পেয়ে বসে, যা তাদেরকে পেয়েছিল।
(ইবনে কাছীর হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন; এবং তিনি বলেছেন যে, এটি বুখারীতে আবদুল্লাহ্ ইব্‌নুল মুবারক থেকে বর্ণিত হয়েছে।)
كتاب أحاديث الأنبياء عليهم وعلى نبينا الصلاة والسلام
باب مرور النبى صلى الله عليه وسلم بوادى الحجر من أرض ثمود عام تبوك
عن سالم بن عبد الله عن أبيه (7) أن النبى صلى الله عليه وسلم لما مر بالحجر قال لا تدخلوا أماكن الذين ظلموا إلا أن تكونوا باكين أن يصيبكم ما أصابهم وتقنع بردائه وهو على الرحل (زاد فى رواية) فان لم تكونوا باكين فلا تدخلو عليهم ان يصيبكم مثل ما أصابهم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হিজরী ৯ম সনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তাবূকের যুদ্ধে যাচ্ছিলেন, তখন 'হিজর' নামক স্থানটির উপর দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছিল। এ জায়গাটি ছিল ছামূদ জাতির বাসস্থান। বর্তমানকালে এ জায়গাটি 'মাদাইনে সালিহ' নামে পরিচিত। এটি মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে ৪০০ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে এবং জর্ডানের পেত্রা নগর থেকে ৫০০ কি. মি. দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এখানে ছামূদ জাতি বাস করত। এ জাতিটি প্রাচীন 'আদ জাতির বংশধর। এদেরকে দ্বিতীয় 'আদ'-ও বলা হয়। এরা ছিল খুবই শক্তিশালী, সচ্ছল ও উন্নত একটি জাতি। তাদের ছিল বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি। তাতে ছিল ক্ষেত-খামার, খেজুর বাগান, নানা বাগ-বাগিচা ও নদী-নালা। তারা সমতল ভূমিতে সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করত। পাহাড় কেটেও ঘর-বাড়ি বানাত। প্রথমদিকে তারা হযরত হূদ আলাইহিস সালামের শিক্ষার উপর চলছিল। পরবর্তীকালে তারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা'আলা হযরত সালিহ আলাইহিস সালামকে নবী করে পাঠান। কিন্তু তারা তাঁকে মানতে অস্বীকার করল। তাঁর প্রতি ঈমান তো আনলই না; উল্টো নানাভাবে তাঁর বিরোধিতা করতে থাকল। নানারকম উদ্ভট দাবি করে তাঁকে হেনস্থা করতে চাইত।

হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম সবকিছু সহ্য করে তাদের মধ্যে দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা দাবি করে, আপনি যদি সত্যিই নবী হয়ে থাকেন, তবে এই পাহাড় থেকে একটি উটনী বের করে আমাদের সামনে উপস্থিত করুন। এটা করতে পারলে আমরা আপনাকে নবী বলে বিশ্বাস করবো। হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম তাদের ঈমানের আশায় আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করলেন। সত্যি সত্যিই আল্লাহ তাআলা পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি উটনী বের করে দেখালেন। তা দেখে কিছু লোক তো ঈমান আনল, কিন্তু তাদের নেতৃস্থানীয় লোকজন কথা রাখলো না। তাদের দেখাদেখি অধিকাংশ লোকই ঈমান আনা হতে বিরত থাকল। এমনকি তারা ঈমানদারদেরকেও বিপথগামী করার চেষ্টা চালাল। আশঙ্কা ছিল তারা উটনীটিরও কোনও ক্ষতি করে বসবে। আর তা হলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। তাই হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম তাদেরকে বোঝালেন যে, তোমরা অন্ততপক্ষে উটনীটির কোনও ক্ষতি করো না। এটিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দাও। কুরআন মাজীদে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে-
وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۖ قَدْ جَاءَتْكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ ۖ هَٰذِهِ نَاقَةُ اللَّهِ لَكُمْ آيَةً ۖ فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللَّهِ ۖ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
'আর ছামুদ জাতির কাছে তাদের ভাই সালিহকে (পাঠাই)। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনও মাবুদ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এক উজ্জ্বল প্রমাণ এসে গেছে। এটা আল্লাহর উটনী, যা তোমাদের জন্য একটি নিদর্শনস্বরূপ। সুতরাং তোমরা এটিকে স্বাধীনভাবে আল্লাহর জমিতে (চরে) খেতে দাও এবং একে কোনও মন্দ ইচ্ছায় স্পর্শ করো না। পাছে কোনও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তোমাদের পাকড়াও করে’। (সূরা আ'রাফ, আয়াত ৭৩)

উটনীটি ছিল আল্লাহ তা'আলার কুদরতের নিদর্শন। সেটির পিপাসা নিবারণের জন্য তাদের কুয়ার সবটা পানি দরকার হত। ফলে উটনীটি যেদিন পানি পান করত, সেদিন ছামূদ জাতি পানি পেত না। তাই হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম পালাবণ্টন করে দিলেন যে, একদিন উটনীটি পানি পান করবে এবং আরেকদিন এলাকাবাসী। কিন্তু তারা তা মানতে চাইল না। গোপনে চক্রান্ত করল উটনীটিকে তারা হত্যা করে ফেলবে। কুদার নামক উদ্ধত এক ব্যক্তি তা করেই ফেলল। এমনকি তারা হযরত সালিহ আলাইহিস সালামকেও হত্যা করতে চাইল। তারা কয়েকজন লোককে এ কাজের দায়িত্ব দিল। আল্লাহ তা'আলা তাদের সে চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিলেন এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপনার পরিণামে গোটা জাতিটিকেই ধ্বংস করে দিলেন। তাদের ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান রয়েছে। ২০০৮ সালে ইউনেসকো এ অঞ্চলটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন সূরায় তাদের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। দেখুন সূরা আ'রাফ, আয়াত ৭৩-৭৯; সূরা হূদ, আয়াত ৬১-৬৮; সূরা শু'আরা, আয়াত ১৪১-১৫৯: সূরা নামল, আয়াত ৪৫-৪৮; সুরা কমার, আয়াত ২৩।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরের উপকন্ঠে পৌছেন, তখন সাহাবায়ে কেরামকে হুকুম দেন- َلَا تَدْخُلُوا عَلَى هؤُلَاءِ الْمُعَذَّبِينَ إِلَّا أَنْ تَكُوْنُوا بَاكِين (তোমরা এই শাস্তিপ্রাপ্তদের এলাকায় ক্রন্দনরত না হয়ে প্রবেশ করো না)। অর্থাৎ তাবূকে যেতে হলে তোমাদেরকে এই ভূমির উপর দিয়েই যেতে হবে। কিন্তু এ জাতিটি আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতা করার কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তাদের উপর আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব পড়েছিল। এখানকার ধ্বংসাবশেষ সেই আযাব ও গযবের স্মৃতি আজও পর্যন্ত বহন করে চলছে। এর দাবি হল এর উপর দিয়ে যে-কেউ অতিক্রম করবে, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবে এবং সেই ভয়ে ক্রন্দন করতে থাকবে। কাজেই তোমরা এই সম্পূর্ণ অঞ্চলটি অবশ্যই ক্রন্দনরত অবস্থায় পার হবে।

فَإِنْ لَمْ تَكُوْنُوْا بَاكِيْنَ، فَلَا تَدْخُلُوْا عَلَيْهِمْ (যদি তোমরা কান্না করতে না পার, তবে তাদের অঞ্চলে প্রবেশ করো না)। কেননা এটা আল্লাহ তা'আলার ক্রোধ পতিত হওয়ার স্থান। এটা আযাব ও গযবের জায়গা। আযাব ও গযবের জায়গা নির্ভয়ে পার হওয়া উচিত নয়। আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে তো নয়ই।

لَا يُصِيبُكُمْ مَا أَصَابَهُمْ (পাছে তাদেরকে যে আযাব আক্রান্ত করেছিল তা তোমাদেরও আক্রান্ত করে)। অর্থাৎ তোমরা যদি আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় এ স্থান অতিক্রম না কর, তবে আশঙ্কা রয়েছে যে, তাদেরকে যে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল, অনুরূপ শাস্তি তোমাদের উপরও অবতীর্ণ হবে। সে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যই তোমাদের কর্তব্য ক্রন্দনরত অবস্থায় অতিক্রম করা।

বক্তব্য দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত সাহাবায়ে কেরামকে সচেতন করে তুলতে চাচ্ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন তাদের চিন্তা-ভাবনা জাগ্রত হোক। তারা ভাবুক আল্লাহ তা'আলা কী মহাশক্তিমান। তাঁর নির্দেশ অমান্য করার পরিণতি কী কঠিন হতে পারে। আল্লাহ তা'আলা চান তাঁর বান্দা সুপথে চলুক, তাঁর আনুগত্য করুক। এজন্যই তিনি নবী-রাসূল পাঠান। তা সত্ত্বেও যদি কেউ অবাধ্যতা করে, তবে তিনি এভাবেই তাদের ধ্বংস করে দেন, যেমনটা ধ্বংস করেছেন 'আদ জাতিকে। 'আদ জাতি অনেক শক্তিশালী ছিল। তা সত্ত্বেও তারা আল্লাহর আযাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। তাঁর আযাব থেকে নিজেদের রক্ষা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন। তাই সর্বাবস্থায় দরকার তাঁরই শরণাপন্ন হওয়া, তাঁরই প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁরই ভয়ে ভীত থাকা। সে ভয় যদি কারও অন্তরে না আসে, যদি তার অন্তর শক্ত হয়ে যায়, ফলে কান্না না আসে, তবে আশঙ্কা রয়েছে একইরকম শাস্তি তাকেও পেতে হবে। সে কারণেই ক্রন্দন না আসলে আযাব ও গযবের স্থানে প্রবেশ করা হতে বিরত থাকা উচিত।

হাদীসে আছে, ثُمَّ قَنَّعَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ رَأْسَهُ وَأَسْرَعَ السَّيْرَ حَتَّى أَجَازَ الْوَادِيَ (তারপর তিনি নিজ মাথা ঢেকে ফেললেন এবং গতি দ্রুত করে দিলেন। এভাবে উপত্যকাটি অতিক্রম করলেন)। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে হুকুম দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না; নিজেও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়ই সে জায়গাটি অতিক্রম করলেন। তিনি ভয়ে মাথা ঢেকে ফেললেন। চলার গতিও বাড়িয়ে দিলেন এবং দ্রুত জায়গাটি অতিক্রম করলেন। বস্তুত আল্লাহ তা'আলার ভয় তাঁর মধ্যেই ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি। তিনি আল্লাহ তা'আলার রহমত ও ক্ষমাশীলতা সম্পর্কে যেমন অবগত ছিলেন, তেমনি তাঁর ক্রোধ ও শক্তি-ক্ষমতা সম্পর্কেও পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তিনি আল্লাহকে চিনতেনও বেশি। তাই তাঁকে ভয়ও করতেন সর্বাপেক্ষা বেশি। তিনি ইরশাদ করেন-
أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ
'শোনো, আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তাঁর জন্য তোমাদের চেয়ে বেশি তাকওয়া অবলম্বন করে থাকি।’
(সহীহ বুখারী: ৫০৬৩; সহীহ মুসলিম: ১৪০১; সুনানে নাসাঈ: ৩২১৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৩৫৫৮; বায়হাকী: ১৩৪৪৮; বাগাবী, শারহুস-সুন্নাহ: ৯৬)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহর আযাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির বাসভূমিতে আনন্দভ্রমণে যাওয়া উচিত নয়।

খ. এরূপ ভূমিতে যাওয়া যাবে কেবল শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে।

গ. বিশেষ প্রয়োজনে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির এলাকার উপর দিয়ে যেতে হলে খুব ভয়-ভীতির সঙ্গে যেতে হবে এবং দ্রুতগতিতে অতিক্রম করতে হবে।

ঘ. আল্লাহ তা'আলার পরিচয় যার যত বেশি জানা থাকে, তার কর্তব্য নিজ অন্তরে তাঁর ভয়ও ততো বেশি জাগ্রত রাখা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান