মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

প্রশংসা ও ভর্ৎসনা সম্পর্কে অধ্যায়

হাদীস নং: ১৪
প্রশংসা ও ভর্ৎসনা সম্পর্কে অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: মহিলাদের নিন্দা সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে
১৪. আবু সা'ঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুনিয়ার উল্লেখ করে বললেন, নিশ্চয় দুনিয়া সবুজ-শ্যামল ও লোভনীয়। সাবধান। দুনিয়া ও নারীদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনি ইসরাঈলের তিনজন মহিলার কথা উল্লেখ করেন। এদের দু'জন ছিলেন লম্বা, তাদেরকে চেনা যেত এবং একজন ছিলেন খাট, তাকে চেনা যেতো না। যে খাট ছিল, সে কাঠের জুতা পরিধান করে লম্বা আকৃতি ধারণ করলো এবং মিশক পরিপূর্ণ করে একটি আংটি পরিধান করলো। যখন সে কোন মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতো, তখন আংটি উচিয়ে ধরে সুগন্ধ ছড়াতো, বর্ণনাকারী আল-মুসতামির বলেন, সেটা ছিল তার বাম হাতের কনিষ্ট আংগুলিতে। সে এ আংগুলটি দেখাতো বাকী তিন আংগুল দেখাতো না।
كتاب المدح والذم
باب ما جاء في ذم النساء
عن أبي سعيد الخدري (6) أن رسول الله صلى الله عليه وسلم ذكر الدنيا فقال ان الدنيا خضرة حلوة فاتقوها واتقوا النساء ثم ذكر نسوة ثلاثا من بني اسرائيل امرأتين طويلتين تعرفان وامرأة قصيرة لا تعرف فاتخذت رجلين من خشب (7) وصاغت خاتما فحشبه من أطيب الطيب المسك وجعلت له غلقا فإذا مرت بالملاء أو المجلس قالت به (8) ففتحته ففاح ريحه قال المستمر بخنصره (9) اليسرى فأشخها دون أصابعه الثلاث شيئا وقبض الثلاثة

হাদীসের ব্যাখ্যা:

حلوة এর অর্থ মিষ্ট। আর خضرة এর অর্থ সবুজ। অর্থাৎ সবুজ বর্ণবিশিষ্ট। দ্বিতীয় অর্থ সবুজ বর্ণের এক প্রকার তৃণ বা ঘাস, যা গবাদি পশু খেয়ে থাকে। এ হাদীছে দুই অর্থের যে-কোনও অর্থই বোঝানো হতে পারে। প্রথম অর্থ ধরলে হাদীছের অর্থ হবে- দুনিয়া মিষ্টি ও সবুজময়। এ দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে দুনিয়া মানুষের কাছে আকর্ষণীয়। কেননা মিষ্ট বস্তু সুস্বাদু হওয়ায় তার প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণ থাকে। আর সবুজ শ্যামল পরিবেশ নয়নপ্রীতিকর হয়। দেখতে ভালো লাগে। আর যে বস্তু দেখতে ভালো লাগে, তার প্রতিও মানুষ আকৃষ্ট হয়। তো বোঝানো উদ্দেশ্য দুনিয়া এক আকর্ষণীয় স্থান। এর যাবতীয় বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণ আছে। কেননা এর প্রতিটি বস্তু হয় ভোগের, নয়তো উপভোগের। হয়তো খেতে সুস্বাদু, নয়তো দেখতে শুনতে শোভনীয়। কোনও না কোনও রকমের ইন্দ্রিয়সুখ তার মধ্যে আছেই। এজন্যই মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ-

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
অর্থ : মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রূপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগ-সামগ্রী।

خضرة এর দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে হাদীছের অর্থ হবে দুনিয়া সুস্বাদু সবুজ ঘাসের মত, যা গবাদি পশুর কাছে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু সে আকর্ষণে কোনও পশু যদি তা অতিরিক্ত খেয়ে ফেলে, তবে তার বদহজম হয়ে যায়। অনেক সময় সে কারণে মারাও যায়। আবার একদম না খেলেও মারা যাবে বৈকি। তার মানে খাওয়া উচিত পরিমিতভাবে। যে পশু পরিমিতভাবে খায়, সে খেয়ে বাঁচে এবং তার জন্য তা উপকারী হয়। এর দ্বারা দু'টি বিষয় বোঝানো উদ্দেশ্য।

এক. দুনিয়া ও এর বস্তুরাজি পশুখাদ্য তুল্য। এটা এমন কিছু মূল্যবান জিনিস নয়, যার প্রতি মানুষের মত মহান সৃষ্টি আসক্ত হতে পারে। জীবন কাটানোর উপকরণ হিসেবে সে এগুলো ব্যবহার করবে ঠিক, কিন্তু এগুলোকে জীবনের লক্ষ্যবস্ত্র বানানো তার পক্ষে শোভা পায় না। তার লক্ষ্যবস্তু হবে কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ। আর সেজন্য তার শারীরিক ও আত্মিক শক্তিসমূহ শরী'আত মোতাবেক ব্যবহারে মনোযোগী থাকা।

দুই. দ্বিতীয়ত বোঝানো উদ্দেশ্য- দুনিয়া ও এর বস্তুরাজি যেহেতু জীবনের লক্ষ্যবস্তু নয়; বরং কেবল ইহজীবন কাটানোর উপকরণ, সেহেতু মানুষের উচিত এসব পরিমিতভাবে গ্রহণ করা। একদম বর্জন করাও ঠিক নয়, আবার মাত্রাতিরিক্ত ভোগে লিপ্ত হওয়াও উচিত নয়। একদম বর্জন যেমন প্রাণঘাতী, তেমনি অতিরিক্ত ভোগও ধ্বংসাত্মক। এগুলো উপকারী হবে কেবল ততক্ষণই, যতক্ষণ পরিমাণমত গ্রহণ করা হবে।

মোটকথা দুনিয়া একটি চাকচিক্যময় ও আকর্ষণীয় স্থান। এর সবকিছু মানুষকে আকর্ষণ করে ও নিজের দিকে ডাকে। মানুষের কর্তব্য এখানে নিজ বুদ্ধি ব্যবহার করা। পশুর মত নির্বিচারে ভোগে রত হয়ে পড়া তার জন্য শোভনীয় নয়। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন- আর আল্লাহ তোমাদেরকে এখানে স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছেন। তিনি দেখতে চান তোমরা কেমন কাজ কর। অর্থাৎ তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ছিল। তারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতায় মেতে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছিল। পাপাচারের পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাদের মধ্যে বহু জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন। ইহুদী ও খৃষ্টান জাতিও দুনিয়ার আসক্তিতে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে তাদেরকেও বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তারপর তাদের জায়গায় তোমাদের বসানো হয়েছে। তোমাদের কাছে সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ কিতাব পাঠানো হয়েছে।

এ উম্মতকে আল্লাহ তা'আলা বিগত জাতির স্থলাভিষিক্ত কেন করেছেন? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিনি দেখতে চান তোমরা কেমন কাজ কর। অর্থাৎ তোমরা তাদের অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর ও তাদের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা কর, নাকি তোমরাও তাদের মত দুনিয়ার মোহে বিভোর থাক? তোমরা তাদের মত দুনিয়ার বহুমুখী আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে ক্ষণস্থায়ী ইহজীবনকে প্রাধান্য দাও, না আখিরাতকে লক্ষ্যবস্তু বানাও? তোমরা হালাল-হারাম নির্বিচারে দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত হও, না আয়-রোজগারে নির্মোহ থাক ও শরী'আতের বিধান মেনে চল? এমনিভাবে তোমরা পার্থিব ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাঁর সন্তুষ্টি সন্ধান কর, না হারাম পথে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ে বিরত থেকে তাঁর অসন্তুষ্টি কুড়াও? মোটকথা ইহজগতে তোমরা পরীক্ষার মধ্যে আছ। দুনিয়াকে আকর্ষণীয় ও এর বস্ত্ররাজিকে লোভনীয় বানিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। তোমাদের কর্তব্য সে পরীক্ষা সম্পর্কে সচেতন থাকা। বিশেষত পূর্ববর্তীদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা, যাতে তাদের মত বিপথগামী হয়ে আল্লাহর আযাব ও গযবের উপযুক্ত হয়ে না যাও।

দুনিয়া আকর্ষণীয় ও এর বস্তুরাজি লোভনীয় হওয়ার কারণে তার প্রতি মানুষ পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করছেন- তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাক। অর্থাৎ দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে তোমরা বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিও না। এর ধোঁকায় পড়ো না। এর আকর্ষণ ও প্রলোভনের শিকার হয়ে আখিরাত ভুলে যেও না। মনে রেখ, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। আখিরাত চিরস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার আকর্ষণ মানুষের চিরস্থায়ী আখিরাত বরবাদ করে দেয়। পূর্বের জাতিসমূহ এভাবেই ধ্বংস হয়েছে। অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

فوالله ما الفقر أخشى عليكم، ولكني أخشى أن تبسط عليكم الدنيا كما بسطت على من كان قبلكم، فتنافسوها كما تنافسوها، وتهلككم كما أهلكتهم

আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্র্যের ভয় করি না। আমি ভয় করি সুনিয়ার যে, তোমাদেরকে তার প্রাচুর্য দিয়ে দেওয়া হবে, যেমন তার প্রাচুর্য দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের। ফলে তোমরা এর প্রতি আসক্ত হয়ে যাবে, যেমন তারাও এর প্রতি আসক্ত হয়েছিল। এবং তা তোমাদের ধ্বংস করে দেবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করে দিয়েছিল।

তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে নারীদের ব্যাপারে সতর্ক করেন। কেননা দুনিয়ায় যা-কিছু আছে, তার মধ্যে নারীই সর্বাপেক্ষা বেশি আকর্ষণীয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ হিকমতে নারীদের বেশি আকর্ষণীয় বানিয়েছেন। সে হিকমতের একটা দিক এইও যে, নর-নারীর মিলনকে আল্লাহ তা'আলা মানুষের বংশ বিস্তারের মাধ্যম বানিয়েছেন। এর জন্য নারীর আকর্ষণীয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল, যাতে পুরুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয় ও বিবাহের আগ্রহ বোধ করে। দুনিয়া যেহেতু পরীক্ষার স্থান, তাই প্রয়োজনীয় সবকিছু দ্বারাই তাকে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর ভেতর আকর্ষণও রেখেছেন, প্রত্যেকের মধ্যে তার প্রতি স্বভাবগত চাহিদা রেখেছেন এবং তা ব্যবহারের জন্য কিছু নীতিমালাও দিয়েছেন। যদি নীতিমালা রক্ষা করে তা দ্বারা নিজ চাহিদা পূরণ করা হয়, তবে তা বৈধ হবে। পক্ষান্তরে তার আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে নীতিমালা উপেক্ষা করলে এবং যথেচ্ছভাবে নিজ চাহিদা পূরণ করলে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ। নারীর ক্ষেত্রেও বিষয়টা এরকমই। তার আছে নিজস্ব আকর্ষণ এবং পুরুষমনে আছে তার প্রতি চাহিদা। পুরুষ যদি এ ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী নিজ চাহিদা পূরণ করে, তবে তা বৈধ হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তার জন্য প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে। নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণ ও চাহিদা মূলত সেই কল্যাণ সাধনেরই জন্য। সে হিসেবে এটা মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান। এটা ক্ষতিকর হয় তখনই, যখন মানুষ এ ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে। তো এ ক্ষেত্রে আল্লাহর পরীক্ষা এই যে, তিনি দেখেন বান্দা তার চাহিদা পূরণে আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা রক্ষা করে ও তাঁর দেওয়া সীমারেখার মধ্যে থাকে, নাকি বল্গাহীনভাবে চাহিদা পূরণে রত হয় এবং এ ব্যাপারে সব নীতিমালা ও সীমারেখা ছাড়িয়ে যায়?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়া অতি চাকচিক্যময় এক ক্ষণস্থায়ী জায়গা। এর চাকচিক্যে মাতোয়ারা হয়ে আখিরাত ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

খ. এ দুনিয়ায় আমরা পূর্ববর্তী জাতিসমূহের স্থলাভিষিক্ত। আমাদের কর্তব্য তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া।

গ. দুনিয়া পরীক্ষার স্থান। ভোগ-বিলাসিতায় মেতে থাকার জায়গা নয়। এখানকার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করতে হবে। তবেই পরীক্ষায় পাস করা যাবে।

ঘ. নারীদের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। যাতে কোনও অবস্থায়ই তাদের ব্যাপারে শরী'আতের সীমালঙ্ঘন না হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ - হাদীস নং ১৪ | মুসলিম বাংলা