মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

বিবাহ অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫৯
বিবাহ অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: স্বামীর উপর স্ত্রীর হক।
২৫৯। হাকিম ইবনে মুয়াবিয়া (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ)কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, স্বামীর উপর স্ত্রীর হক কি? তিনি বললেন, তুমি তাকে খাবার খাওয়াবে, তুমি যখন খাবার খাবে। আর তুমি তাকে কাপড় পরিধান করাবে যখন তুমি কাপড় পরিধান করবে। তুমি তাকে তার চেহারায় মারবে না। তুমি তার সমালোচনা করবে না। যদি তোমার তাকে এড়িয়ে চলার প্রয়োজন হয় তাহলে তার সাথে এক ঘরে থেকে এড়িয়ে চলবে।
(নাসাঈ, ইবন মাজাহ, বায়হাকী। হাকিম, ইবন হিব্বান। হাকিম এবং ইবন হিব্বান হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)
كتاب النكاح
باب حق الزوجة على الزوج
عن حكيم بن معاوية عن أبيه (9) عن النبى صلى الله عليه وسلم قال سأله رجل (10) ما حق المرأة على الزوج؟ قال تطعمها اذا طعمت وتكسوها اذا اكتسيت ولا تضرب الوجه ولا تقبح ولا تهجر الا فى البيت

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীর কয়েকটি হক উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সামর্থ্য অনুযায়ী খোরপোশ দেওয়া। সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতাভেদে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীদেরকে খোরপোশ দেবে। ধনী দেবে তার অবস্থা অনুযায়ী এবং গরীবও তার অবস্থা অনুযায়ী। ধনী ব্যক্তি যদি স্ত্রীকে খোরপোশ দিতে কার্পণ্য করে এবং তাকে গরীবদের হালে রাখে, তবে এটা একরকম জুলুম গণ্য হবে। আবার স্ত্রীও যদি স্বামীর কাছে তার সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে খোরপোশ দাবি করে, তাও তার উপর জুলুমই বটে। উভয়ের কর্তব্য উভয়ের সামর্থ্য বিবেচনায় রাখা। খাবার দেওয়ার ক্ষেত্রে এটাও লক্ষণীয় যে, স্ত্রীর পিতৃগৃহে যদি মেয়েদের রান্নাবান্না করার রেওয়াজ না থাকে, তবে এরকম স্ত্রীকে রান্নাবান্নার কষ্টে ফেলা জায়েয হবে না। সে ক্ষেত্রে স্বামীর কর্তব্য হবে রান্নাবান্নার আলাদা ব্যবস্থা করা।

আরেকটি হক বলেছেন তার চেহারায় না মারা। কোনও কোনও স্বামী রাগের বশে স্ত্রীর মুখে চড় মারে। এটা নিতান্তই গর্হিত কাজ। রাগ মেটানোর জন্য স্ত্রী কেন, কাউকেই মারা জায়েয নয়। মারের উদ্দেশ্য হতে হবে কেবলই ভুলত্রুটির সংশোধন। আর সেটাও হতে হবে মাত্রাজ্ঞানের সঙ্গে এবং শরীআতের সীমারেখার ভেতর। সে সীমারেখার একটা এইও যে, চেহারায় মারা যাবে না। না স্ত্রীর চেহারায়, না অন্য কারও চেহারায়। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. ও আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِذَا قَاتَلَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيَجْتَنِب الْوَجْهَ

‘তোমাদের কেউ যখন তার ভাইকে মারে, তখন সে যেন চেহারা পরিহার করে।৩৩৬

অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

إذا ضرب أحدكم خادمه فليجتنب الوجه

‘তোমাদের কেউ যখন খাদেমকে মারে, তখন চেহারায় যেন না মারে।৩৩৭
চেহারা হচ্ছে মানুষের সর্বাপেক্ষা সুন্দর, আকর্ষণীয় ও মর্যাদাপূর্ণ অঙ্গ। শরীরের সবগুলো নাজুক ও স্পর্শকাতর অঙ্গও এখানেই। এখানে মারার দ্বারা যেমন সৌন্দর্যের অবমূল্যায়ন করা হয়, তেমনি ব্যক্তিকেও অসম্মান করা হয়। সেইসঙ্গে চোখ, নাক, দাঁত ইত্যাদির বড় রকম ক্ষতিরও আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় সে মারের চিহ্ন স্থায়ী হয়ে যায়, যা সকলেরই চোখে পড়ে। এসবই মারার উদ্দেশ্যেরও পরিপন্থী। উদ্দেশ্য সংশোধন করা, ক্ষতিগ্রস্ত করা ও অসম্মান করা নয়।
যে-কাওকে মারার ক্ষেত্রে যখন চেহারা এড়ানো জরুরি, তখন স্ত্রীর ক্ষেত্রে তো এটা আরও বেশি জরুরি হয়ে যায়। স্ত্রী প্রেম-ভালোবাসার পাত্র। মারের বিষয়টি তার সঙ্গে যায় না। এটা নিতান্তই ঠ্যাকার কাজ। তাই মার যেমন লঘু হতে হবে, তেমনি চেহারাও এড়াতে হবে।

স্ত্রীর আরেকটি অধিকার হচ্ছে তাকে গালমন্দ না করা। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ স্ত্রীকে লক্ষ্য করে এ কথা বলা যে, আল্লাহ তোমার মন্দ করুন। এটা একটি বদদুআ ও অভিশাপ। অভিশাপ দেওয়া ইসলামী আখলাকের পরিপন্থী। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনওই এটা করতেন না।
এর অর্থ আরও ব্যাপক। মন্দ বলার এক অর্থ গাল দেওয়া, যেমন ছোটলোক বলা, অভদ্র বলা, কোনও পশু-পাখির সঙ্গে তুলনা করা, বিশেষ কোনও পশু-পাখির বাচ্চা বলা ইত্যাদি। এমনিভাবে তার চেহারা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বংশ বা কোনও অভ্যাস নিয়ে খোঁটা দেওয়াও একরকম মন্দ বলাই বটে। তোমার চেহারা ভালো নয়, তুমি দেখতে আকর্ষণীয় নও, তোমার নাকটা বোঁচা, তোমার বাপ এই-ওই করত, তুমি নীচ বংশের মেয়ে, তুমি কেমন করে যেন হাঁট- এ সবই মন্দ বলার মধ্যে পড়ে।
বিষয়টা একটু খুলেই বলা হল। এর কারণ অনেক স্বামীই স্ত্রীকে লক্ষ্য করে এ জাতীয় কথাবার্তা বলে। এটা খুবই ন্যাক্কারজনক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অত্যন্ত পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। এ জাতীয় কথাবার্তা সে সম্পর্কের সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। এরকম অভ্যাস পরিত্যাগ করা খুবই জরুরি।

আরেকটি হক বলেছেন — (এবং ঘরের ভেতর ছাড়া অন্যত্র তাকে ত্যাগ করবে না)। অর্থাৎ তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না। ক্ষণিকের জন্য নিজের থেকে তাকে একটু আলাদা রাখার উদ্দেশ্য কেবলই তাকে সংশোধন করা। ঘর থেকে বের করে দেওয়াটা সংশোধনমূলক আচরণ নয়। এর মধ্যে বরং বিভিন্ন অনর্থ রয়েছে। এক তো ঘর থেকে বের করে দেওয়াটা অত্যন্ত অপমানজনক। স্ত্রীকে কিছুতেই অপমান করা উচিত নয়। তাছাড়া ঘর থেকে বের করে দিলে অনেক বড় ক্ষতিরও আশঙ্কা থাকে। কেউ আশ্রয় দেওয়ার নামে তার অনেক বড় সর্বনাশ ঘটাতে পারে। তদুপরি ঘরে থাকতে দেওয়াটা স্ত্রীর অধিকার। বের করে দেওয়ার দ্বারা তাকে সে অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। তাই হাদীছে এটা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের সচেতনতা অনুভব করা যায়।

খ. স্বামীর কর্তব্য নিজ সঙ্গতি অনুযায়ী স্ত্রীর খোরপোশ দেওয়া।

গ. স্ত্রীর বা অন্য কারও চেহারায় মারা উচিত নয়।

ঘ. স্ত্রীকে গালমন্দ করা, অভিশাপ দেওয়া বা তার কোনওকিছু নিয়ে খোঁটা দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

৫. সংশোধনের নামে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া যাবে না।

৩৩৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৫৫৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬১২ : সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬০৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮১২৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৭৯৫১; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪৭১৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫৭৩; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬৩১১

৩৩৭. আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৭৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান