আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২৫. অধ্যায়ঃ পুনরুত্থান ও কিয়ামাত
হাদীস নং: ৫৪৪১
অধ্যায়ঃ পুনরুত্থান ও কিয়ামাত
অধ্যায়: পুনরুত্থান ও কিয়ামত দিবসের ভয়ভীতি
পরিচ্ছেদ: শিঙায় ফুৎকার দেওয়া ও কিয়ামত কায়েম হওয়া
পরিচ্ছেদ: শিঙায় ফুৎকার দেওয়া ও কিয়ামত কায়েম হওয়া
৫৪৪১. হয়রত আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, আমি কিভাবে স্বাচ্ছন্দবোধ করব, অথচ শিল্পাধারী ফিরিশতা শিল্পা মুখে দিয়ে নিয়েছে, এবং হুকুমের অপেক্ষায় তার কপাল ঝুঁকিয়ে দিয়েছে ও কান সজাগ রেখেছে। হুকুম পাওয়া মাত্রই সে ফুঁক দেবে। এ বিবরণটি যেন তাঁর সাহাবীগণের কাছে গুরুতর মনে হল, তাই তাঁরা আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ﷺ)। তা হলে আমরা কি করব? অথবা তাঁরা বলেছেন, আমরা কি বলব? তিনি বললেন, তোমরা বল: حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيل وَعَلَى الله توكلت "আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম তত্তাবধায়ক এবং আল্লাহর উপরই আমরা তাওয়াক্কুল করি।"আবার কখনো তিনি على الله توكلنا এর পরিবর্তে (توكلنا على الله) বলেছেন।
(তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির উল্লিখিত পাঠ তাঁরই বর্ণিত। তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান। ইবন হিব্বানও তাঁর 'সহীহ'-এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। আহমাদ যায়িদ ইব্ন আরকাম (রা)-এর রিওয়ায়েতে এবং ইবন আব্বাস (রা)-এর রিওয়ায়েতেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
(তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির উল্লিখিত পাঠ তাঁরই বর্ণিত। তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান। ইবন হিব্বানও তাঁর 'সহীহ'-এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। আহমাদ যায়িদ ইব্ন আরকাম (রা)-এর রিওয়ায়েতে এবং ইবন আব্বাস (রা)-এর রিওয়ায়েতেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
كتاب البعث
كتاب الْبَعْث وأهوال يَوْم الْقِيَامَة
فصل فِي النفخ فِي الصُّور وَقيام السَّاعَة
فصل فِي النفخ فِي الصُّور وَقيام السَّاعَة
5441- وَعَن أبي سعيد رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم كَيفَ أنعم وَقد الْتَقم صَاحب الْقرن الْقرن وحنى جَبهته وأصغى سَمعه ينْتَظر أَن يُؤمر فينفخ فَكَأَن ذَلِك ثقل على أَصْحَابه فَقَالُوا فَكيف نَفْعل يَا رَسُول الله أَو نقُول قَالَ قُولُوا حَسبنَا الله وَنعم الْوَكِيل على الله توكلنا وَرُبمَا قَالَ توكلنا على الله
رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَاللَّفْظ لَهُ وَقَالَ حَدِيث حسن وَابْن حبَان فِي صَحِيحه وَرَوَاهُ أَحْمد وَالطَّبَرَانِيّ من حَدِيث زيد بن أَرقم وَمن حَدِيث ابْن عَبَّاس أَيْضا
رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَاللَّفْظ لَهُ وَقَالَ حَدِيث حسن وَابْن حبَان فِي صَحِيحه وَرَوَاهُ أَحْمد وَالطَّبَرَانِيّ من حَدِيث زيد بن أَرقم وَمن حَدِيث ابْن عَبَّاس أَيْضا
হাদীসের ব্যাখ্যা:
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাঝেমধ্যেই খুব বিমর্ষ দেখা যেত। কেন তাঁর সে বিমর্ষতা, এ হাদীছে তিনি তা স্পষ্ট করেছেন। তার কারণ ছিল কিয়ামতভীতি। তিনি জানতেন কিয়ামত অতি নিকটে। হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। শিঙ্গা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে তিনি অপেক্ষায় আছেন কখন আল্লাহ ফু দিতে হুকুম করবেন, অমনি ফুঁ দেবেন। কিয়ামত অত্যন্ত বিভীষিকাময়। কুরআন মাজীদে তার ছবি আঁকা হয়েছে এভাবে-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)
‘হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সেদিন) আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠোর।৩৮৩
কিয়ামতের বিভীষিকা জীবিত, মৃত, যমীনবাসী ও আসমানবাসী সকলকেই স্পর্শ করবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ
‘এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করবেন সে ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই মূর্ছিত হয়ে পড়বে। তারপর তাতে দ্বিতীয় ফুঁক দেওয়া হবে, অমনি তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকিয়ে থাকবে।৩৮৪
কুরআন মাজীদের আরও বহু আয়াতে সেদিনের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কিয়ামত সংঘটিত হবে নিকৃষ্ট মানুষদের উপর। তার আগে ঈমানদারদের সকলকে মৃত্যু দিয়ে দেওয়া হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تَقُوْمُ السَّاعَةُ إِلَّا عَلَى شِرَارِ النَّاسِ
‘যাদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে, তারা হবে কেবলই নিকৃষ্ট মানুষ।৩৮৫
এক হলো কিয়ামতের ভয়াবহতা, দ্বিতীয়ত যাদের উপর তা সংঘটিত হবে তাদের পরকালীন দুর্ভোগ। কেউ জানে না কিয়ামতের সময় কারা জীবিত থাকবে। যারাই জীবিত থাকবে, তারাই সর্বকালের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে পানাহ চাওয়া উচিত যাতে তিনি আমাদেরকে সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন না করেন। সেদিনের ভয়াবহতা ও নৈকট্য সম্পর্কে যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই সবচে' ভালো জানা ছিল, তাই তিনি ভীতও ছিলেন সবচে' বেশি। তিনি তো মা'সুম ও নিষ্পাপ ছিলেন। কাজেই তাঁর ভয়টা মূলত ছিল উম্মতের জন্য। তিনি যেন সতর্ক করছেন যাতে তারাও সেদিনের ভয়ে ভীত থাকে এবং আগে থেকেই সেদিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
যে কিয়ামত ঘটবে নিকৃষ্ট লোকদের উপর, তার নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ সাহাবায়ে কেরামের কাছে খুব ভারী মনে হলো। মুখের ভেতর শিঙ্গার মুখ লাগিয়ে বসে থাকা। যে-কোনও সময়ই তো ঘটে যেতে পারে সে মহা প্রলয়কাণ্ড! যদি তা ঘটেই যায়, তখন কী অবস্থা হবে তাদের? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাদের নির্ভার করতে চাইলেন যে, তোমরা বল -
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মসম্পাদক)। অর্থাৎ তোমরা হতাশ হয়ো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। অন্তরে বিশ্বাস রাখ আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনিই যাবতীয় কাজের প্রকৃত কর্তা। তিনিই সৃষ্টি করেন, রিযিক দেন, জীবন দান করেন, মৃত্যু ঘটান, ঐশ্বর্য দেন ও ফকীর বানান। তাঁর উপর যে ভরসা রাখে তার কোনও ভয় নেই, কোনও চিন্তা নেই। তিনি তার যাবতীয় কাজ সমাধা করে দেন, যেমনটা তিনি উপযুক্ত মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল ও ভরসার বাণী। যে-কোনও বিপদে এবং যে-কোনও ঝুঁকি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ বাক্যটি উচ্চারণ করা চাই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
‘যে-কেউ আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট।৩৮৬
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন-
أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ
‘(হে রাসূল!) আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নয়?”৩৮৭
নমরূদ যখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার হাতে ছেড়ে দিয়ে এ কথাই বলেছিলেন যে-
حَسْبِيَ اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
‘আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনিই উত্তম কর্ম সম্পাদনকারী ।৩৮৮
এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে হেফাজত করেছিলেন। আগুন তার জন্য শীতল ও আরামদায়ক হয়ে গিয়েছিল। উহুদ যুদ্ধের পর কাফের বাহিনীর পক্ষ থেকে পুনরায় হামলার হুমকি আসলে সাহাবায়ে কেরামও এ দুআই পাঠ করেছিলেন। কুরআন মাজীদে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (173) فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ (174)
‘যাদেরকে লোকে বলেছিল, (মক্কার কাফের) লোকেরা তোমাদের (সাথে যুদ্ধ করার) জন্য (পুনরায়) সেনা সংগ্রহ করেছে, সুতরাং তাদেরকে ভয় কর। তখন এটা (এই সংবাদ) তাদের ঈমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তারা বলে ওঠে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক। পরিণামে তারা আল্লাহর নিআমত ও অনুগ্রহ নিয়ে এভাবে ফিরে আসল যে, বিন্দুমাত্র অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহ যাতে খুশি হন তার অনুসরণ করেছে। বস্তুত আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক।৩৮৯
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কিয়ামত অবশ্যই ঘটবে। কিয়ামত অত্যন্ত ভয়ংকর ঘটনা। এর জন্য অন্তরে ভয় রাখা চাই।
খ. কিয়ামত সংঘটিত হবে শিঙ্গার ফুৎকারে। এর জন্য দায়িত্বশীল ফিরিশতা হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম প্রস্তুত হয়ে আছেন।
গ. কিয়ামতের বিভীষিকাকালে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভের জন্য বেশি বেশি পড়া চাই- حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মসম্পাদক)। যে-কোনও বিপদ ও সংকটকালে এটি একটি উপকারী দু'আ।
৩৮৩. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ১-২
৩৮৪. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৬৮
৩৮৫. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৩৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৭৬৩৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬৮৩৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৮৯৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৫২৪৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪২৯১
৩৮৬. সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৩
৩৮৭. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩৬
৩৮৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৫৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৯৫৮৮; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১০১৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৭
৩৮৯. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৭৩-১৭৪
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)
‘হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সেদিন) আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠোর।৩৮৩
কিয়ামতের বিভীষিকা জীবিত, মৃত, যমীনবাসী ও আসমানবাসী সকলকেই স্পর্শ করবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ
‘এবং শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করবেন সে ছাড়া আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই মূর্ছিত হয়ে পড়বে। তারপর তাতে দ্বিতীয় ফুঁক দেওয়া হবে, অমনি তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকিয়ে থাকবে।৩৮৪
কুরআন মাজীদের আরও বহু আয়াতে সেদিনের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কিয়ামত সংঘটিত হবে নিকৃষ্ট মানুষদের উপর। তার আগে ঈমানদারদের সকলকে মৃত্যু দিয়ে দেওয়া হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تَقُوْمُ السَّاعَةُ إِلَّا عَلَى شِرَارِ النَّاسِ
‘যাদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে, তারা হবে কেবলই নিকৃষ্ট মানুষ।৩৮৫
এক হলো কিয়ামতের ভয়াবহতা, দ্বিতীয়ত যাদের উপর তা সংঘটিত হবে তাদের পরকালীন দুর্ভোগ। কেউ জানে না কিয়ামতের সময় কারা জীবিত থাকবে। যারাই জীবিত থাকবে, তারাই সর্বকালের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব। তাই আল্লাহ তাআলার কাছে পানাহ চাওয়া উচিত যাতে তিনি আমাদেরকে সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন না করেন। সেদিনের ভয়াবহতা ও নৈকট্য সম্পর্কে যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই সবচে' ভালো জানা ছিল, তাই তিনি ভীতও ছিলেন সবচে' বেশি। তিনি তো মা'সুম ও নিষ্পাপ ছিলেন। কাজেই তাঁর ভয়টা মূলত ছিল উম্মতের জন্য। তিনি যেন সতর্ক করছেন যাতে তারাও সেদিনের ভয়ে ভীত থাকে এবং আগে থেকেই সেদিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
যে কিয়ামত ঘটবে নিকৃষ্ট লোকদের উপর, তার নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ সাহাবায়ে কেরামের কাছে খুব ভারী মনে হলো। মুখের ভেতর শিঙ্গার মুখ লাগিয়ে বসে থাকা। যে-কোনও সময়ই তো ঘটে যেতে পারে সে মহা প্রলয়কাণ্ড! যদি তা ঘটেই যায়, তখন কী অবস্থা হবে তাদের? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে তাদের নির্ভার করতে চাইলেন যে, তোমরা বল -
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মসম্পাদক)। অর্থাৎ তোমরা হতাশ হয়ো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। অন্তরে বিশ্বাস রাখ আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনিই যাবতীয় কাজের প্রকৃত কর্তা। তিনিই সৃষ্টি করেন, রিযিক দেন, জীবন দান করেন, মৃত্যু ঘটান, ঐশ্বর্য দেন ও ফকীর বানান। তাঁর উপর যে ভরসা রাখে তার কোনও ভয় নেই, কোনও চিন্তা নেই। তিনি তার যাবতীয় কাজ সমাধা করে দেন, যেমনটা তিনি উপযুক্ত মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল ও ভরসার বাণী। যে-কোনও বিপদে এবং যে-কোনও ঝুঁকি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ বাক্যটি উচ্চারণ করা চাই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
‘যে-কেউ আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট।৩৮৬
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন-
أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ
‘(হে রাসূল!) আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নয়?”৩৮৭
নমরূদ যখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার হাতে ছেড়ে দিয়ে এ কথাই বলেছিলেন যে-
حَسْبِيَ اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
‘আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনিই উত্তম কর্ম সম্পাদনকারী ।৩৮৮
এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে হেফাজত করেছিলেন। আগুন তার জন্য শীতল ও আরামদায়ক হয়ে গিয়েছিল। উহুদ যুদ্ধের পর কাফের বাহিনীর পক্ষ থেকে পুনরায় হামলার হুমকি আসলে সাহাবায়ে কেরামও এ দুআই পাঠ করেছিলেন। কুরআন মাজীদে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (173) فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ (174)
‘যাদেরকে লোকে বলেছিল, (মক্কার কাফের) লোকেরা তোমাদের (সাথে যুদ্ধ করার) জন্য (পুনরায়) সেনা সংগ্রহ করেছে, সুতরাং তাদেরকে ভয় কর। তখন এটা (এই সংবাদ) তাদের ঈমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তারা বলে ওঠে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক। পরিণামে তারা আল্লাহর নিআমত ও অনুগ্রহ নিয়ে এভাবে ফিরে আসল যে, বিন্দুমাত্র অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহ যাতে খুশি হন তার অনুসরণ করেছে। বস্তুত আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক।৩৮৯
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কিয়ামত অবশ্যই ঘটবে। কিয়ামত অত্যন্ত ভয়ংকর ঘটনা। এর জন্য অন্তরে ভয় রাখা চাই।
খ. কিয়ামত সংঘটিত হবে শিঙ্গার ফুৎকারে। এর জন্য দায়িত্বশীল ফিরিশতা হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম প্রস্তুত হয়ে আছেন।
গ. কিয়ামতের বিভীষিকাকালে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভের জন্য বেশি বেশি পড়া চাই- حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মসম্পাদক)। যে-কোনও বিপদ ও সংকটকালে এটি একটি উপকারী দু'আ।
৩৮৩. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ১-২
৩৮৪. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৬৮
৩৮৫. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৩৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৭৬৩৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬৮৩৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৮৯৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৫২৪৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪২৯১
৩৮৬. সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৩
৩৮৭. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩৬
৩৮৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৫৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৯৫৮৮; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১০১৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৭
৩৮৯. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৭৩-১৭৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)