আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২২. অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৪৬৭৯
অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার
সৎসঙ্গী গ্রহণে উৎসাহ প্রদান ও অসৎসঙ্গীর সাহচর্যের ব্যাপারে সতর্কীকরণ এবং মজলিসের মধ্যস্থলে উপবেশনকারী, মজলিসের আদব ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ
৪৬৭৯. উক্ত হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকেই বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ সাবধান। তোমরা পথের উপর বসা থেকে বিরত থাক। সাহাবায়ে কিরাম বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের তো পথের উপর বসে কথাবার্তা বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ যদি তোমাদের অগত্যা বসতেই হয়, তবে পথের হক আদায় করে দেবে। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ্। পথের হক কি? উত্তরে তিনি বললেন: দৃষ্টি অবনত রাখা, কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেয়া, সালামের জওয়াব দেয়া, সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজের নিষেধ করা।
(বুখারী, মুসলিম ও আবূ দাউদ (র) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
كتاب الأدب
الترغيب في الجليس الصالح والترهيب من الجليس السيىء وما جاء فيمن جلس وسط الحلقة وأدب المجلس وغير ذلك
4679- وَعَن أبي سعيد أَيْضا رَضِي الله عَنهُ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ إيَّاكُمْ وَالْجُلُوس بالطرقات
قَالُوا يَا رَسُول الله مَا لنا بُد من مجالسنا نتحدث فِيهَا فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِن أَبَيْتُم فأعطوا الطَّرِيق حَقه
قَالُوا وَمَا حق الطَّرِيق يَا رَسُول الله قَالَ غض الْبَصَر وكف الْأَذَى ورد السَّلَام وَالْأَمر بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْي عَن الْمُنكر

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَأَبُو دَاوُد

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাস্তাঘাটে বসতে নিষেধ করেছেন। কেননা তাতে যাতায়াতকারীদের কষ্ট হয়। সে কষ্ট যেমন চলাচল করতে গিয়ে হয়, তেমনি কখনও হয় মানসিক। কেননা পথিকদের বিভিন্ন রকম অবস্থা থাকে। কোনও কোনও অবস্থা এমন থাকে, যা অন্যরা লক্ষ করুক তারা তা চায় না। চলাচলকারীদের কার কী অবস্থা তা সাধারণত অন্য পথিকদের নজরে পড়ে না। তা নজরে পড়ে তাদেরই, যারা রাস্তায় বা রাস্তার আশেপাশে বসে থাকে। অনেক সময় এ কারণে অন্যের গীবত হয়ে যায়, কখনও কথা কাটাকাটি হয়, এমনকি মারামারি লেগে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। মোটকথা রাস্তায় বসলে কোনও না কোনও অনর্থের আশঙ্কা থাকেই। তাই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে বসতে নিষেধ করেছেন। সেতু, কালভার্ট ইত্যাদিও এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে।

সকলেরই জানা যে, সাহাবায়ে কিরাম অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। তাদের ঘর-বাড়িও হত ছোট ছোট। তাতে আলাদা বৈঠকখানা থাকত না। ফলে লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তার কাজ রাস্তাঘাটেই সম্পন্ন করতে হত। বলাবাহুল্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে থাকার কারণে তাদের স্বভাব-চরিত্র ছিল অত্যন্ত পরিশুদ্ধ। ফলে তারা রাস্তায় কখনও অন্যদের ক্ষতি হয় এমন কোনও কাজ করতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে রাস্তায় বসতে নিষেধ করেছেন। কেননা এক তো অন্যের ক্ষতি অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেও হয়ে যায়, দ্বিতীয়ত তারা কোনও কষ্টদায়ক কাজ না করলেও তাদের দেখাদেখি অন্যরাও রাস্তায় বসতে চাবে এবং সাহাবায়ে কিরামের মত পরিশুদ্ধ আখলাক-চরিত্রের না হওয়ায় তাদের দ্বারা কষ্টদায়ক কাজকর্ম ঘটে যাবে।

কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের যেহেতু বাড়ির ভেতর অন্যদের সঙ্গে বসে কথা বলার মত সুযোগ ছিল না, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সে সমস্যার কথা তুলে ধরলেন। তিনি বিষয়টা আমলে নিলেন এবং রাস্তার হক আদায় করার শর্তে তাদেরকে বসার অনুমতি দিলেন।

রাস্তার হকসমূহ
এ হাদীছে রাস্তার চারটি হক উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. দৃষ্টি অবনত রাখা। অর্থাৎ নারী-পুরুষ কারও দিকেই বিশেষ দৃষ্টিতে না তাকানো। নারী হলে তো এমনিতেই নাজায়েয। আর যদি পুরুষ হয়, তবে বিশেষভাবে লক্ষ করার কারণে সে বিব্রত বোধ করতে পারে। অন্যকে বিব্রত করা জায়েয নয়।

দুই. কষ্টদায়ক বিষয় থেকে বিরত থাকা। কারও প্রতি কটুক্তি না করা; খোঁচা দিয়ে কথা না বলা; কারও চাল-চলন, বেশভূষা বা অন্য কোনও বিষয় নিয়ে মন্তব্য না করা; চলাচলপথ সংকীর্ণ করে না বসা; রাস্তায় এমনকিছু না ফেলা, যাতে পা লেগে কারও পিছলে যাওয়া বা উষ্ঠা খাওয়ার আশঙ্কা থাকে ইত্যাদি।

তিন. সালামের জবাব দেওয়া। সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। সালামের একটি আদব হচ্ছে চলাচলকারী ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে। কাজেই রাস্তায় যারা বসা থাকে তাদের কর্তব্য কোনও পথিক যখন তাদের সালাম দেবে তখন অবশ্যই তার উত্তর দেবে।

চার. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ। রাস্তায় বসে থাকা অবস্থায় অনেক সময় এমনকিছু চোখে পড়ে যায়, যাতে কারও পক্ষ হতে করণীয় কাজ করতে অবহেলা হয় কিংবা যে কাজ করা উচিত নয় তা ঘটে যায়। আজকাল যখন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবেই বিঘ্নিত হচ্ছে, তখন তো পথেঘাটে অন্যায় অনুচিত কাজ মাঝেমধ্যেই ঘটে থাকে এবং তা সাধারণভাবে অন্যদের চোখে পড়েও। এ জাতীয় কাজে পথিকদের তুলনায় যারা বসে থাকে তাদের পক্ষেই বাধা দেওয়া সহজ। সুতরাং কোনও অন্যায়-অনুচিত কাজ চোখে পড়লে তা প্রতিহত করা তাদের জন্য অবশ্যকর্তব্য। এটা রাস্তার হক, যা তাদেরকে অবশ্যই আদায় করতে হবে।

অন্যান্য হাদীছে রাস্তার এ ছাড়া আরও বিভিন্ন হকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- যে ব্যক্তি পথ হারিয়ে যায় তাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, কারও মাথা থেকে বোঝা নামানোর প্রয়োজন হলে তা নামিয়ে দেওয়া, কারও মাথায় বোঝা তোলার প্রয়োজন হলে তা তুলে দেওয়া, কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া, বিপন্নকে সাহায্য করা, কেউ হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা, উত্তম কথা বলা, মজলুমকে সাহায্য করা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া ও সালামের প্রসার ঘটানো।

এটা ইসলামেরই গৌরব যে, সে মানুষকে নানারকম হকের সাথে পরিচিত করেছে। অন্যের হক আদায়ের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা তার অন্যান্য শিক্ষার মতই এতটা পূর্ণাঙ্গ যে, তার কোনও নজির অন্য কোনও ধর্ম বা অন্য কোনও মতাদর্শে নেই। ইদানীং মানুষ মানবাধিকারের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার আওয়াজ তুলেছে। কিন্তু ইসলাম এসব বিষয়ে শুরু থেকেই কথা বলে এসেছে। ইসলাম পশুপাখির হকের সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামে যাওয়ার ফয়সালা যুক্ত করে দিয়েছে। বৃক্ষরোপণের সাথে নেকী অর্জনের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। আর এ হাদীছে আমরা দেখছি যে, রাস্তার হক আদায়ের মত এক অভাবনীয় ও অকল্পনীয় চেতনা ঈমানদারদের অন্তরে সঞ্চার করে দেওয়া হয়েছে। এবং সে হকসমূহও কেমন? এর দ্বারা মানুষের কেবল জানমালের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করা হয়নি; তার ইজ্জত ও সম্ভ্রমেরও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামী শিক্ষার পরিপূর্ণতা অনুভব করা যায়।

খ. ইসলামে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কী গুরুত্ব, তাও এ হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় রাস্তায় পথিকদের অধিকারই অগ্রগণ্য। সুতরাং তাদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনও কাজ করা বৈধ নয়। যেমন রাস্তা বন্ধ করে জনসভা করা। নাচ-গান তো এমনিই নাজায়েয। অতএব রাস্তা বন্ধ করে সেরকম কোনও অনুষ্ঠান করা কতটা কঠিন গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য। যারা রাস্তা বন্ধ করে ওয়াজ-মাহফিল কিংবা সভা অনুষ্ঠান করে, তাদের উচিত এ হাদীছটিকে বিবেচনায় রাখা।

ঘ. পিতামাতা, উস্তায বা অন্য কোনও মুরুব্বী কাউকে যদি কোনও হুকুম করে আর তা পালনে তার কোনও ওযর থাকে, তবে তার উচিত সে ওযরের কথা মুরুব্বীকে জানানো। মুরুব্বীর উচিত সে ওযরটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।

ঙ. এ হাদীছে যে বিষয়গুলোকে রাস্তার হক সাব্যস্ত করা হয়েছে সেগুলো যে শরী'আতের গুরুত্বপূর্ণ বিধান তা এ হক সাব্যস্তকরণ দ্বারাই বোঝা যায়। সুতরাং এগুলোর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান