আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২২. অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার

হাদীস নং: ৪১৬২
অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার
মানুষের সাথে মেলামেশায় নিরাপত্তাহীনতার আশংকা থাকলে নির্জনতা অবলম্বনের প্রতি অনুপ্রেরণা
৪১৬২. হযরত আমির ইবনে সা'দ (রা) থেকে বর্ণিত। হযরত সা'দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা) তাঁর ঘরে অবস্থান করা কালে তার পুত্র উমার তাঁর নিকট আসেন। সা'দ (রা) তাকে দেখে বলেন: এই অনিষ্টকর আরোহী থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাচ্ছি। সে নেমে এসে তাকে বলেনঃ তুমি কি তোমার উট ও বকরী নিয়ে দূরে সরে আছ, অথচ লোকদের ক্ষমা নিয়ে বাদানুবাদের মধ্যে ছেড়ে দিলে? তখন হযরত সা'দ (রা) তাঁর বুকে আঘাত করে বলেনঃ তুমি থাম। কেননা, আমি রাসূলুল্লাহ্-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ্ মুত্তাকী ও অল্পে তুষ্ট বান্দাকে ভালোবাসেন।
(মুসলিম বর্ণিত।)
كتاب الأدب
التَّرْغِيب فِي الْعُزْلَة لمن لَا يَأْمَن على نَفسه عِنْد الِاخْتِلَاط
4162- عَن عَامر بن سعد قَالَ كَانَ سعد بن أبي وَقاص فِي بَيته فَجَاءَهُ ابْنه عمر فَلَمَّا رَآهُ سعد قَالَ أعوذ بِاللَّه من شَرّ هَذَا الرَّاكِب فَنزل فَقَالَ لَهُ أنزلت فِي إبلك وغنمك وَتركت النَّاس يتنازعون الْملك بَينهم فَضرب سعد فِي صَدره وَقَالَ اسْكُتْ سَمِعت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول إِن الله يحب العَبْد التقي الْغَنِيّ الْخَفي

رَوَاهُ مُسلم
الْغَنِيّ أَي الْغَنِيّ النَّفس القنوع

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে ৩টি গুণসম্পন্ন বান্দা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে মহব্বত করেন। 'মহব্বত' শব্দের প্রকৃত অর্থ কারও প্রতি মনের ঝোঁক ও আসক্তি। এ অর্থ আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রযোজ্য হয় না। কাজেই আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে যখন শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা রূপক অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আর তা হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক দেওয়া, দয়া ও অনুগ্রহ করা এবং ফিরিশতাদের কাছে প্রশংসা করা। অর্থাৎ যে বান্দার মধ্যে এ গুণগুলো থাকে, আল্লাহ তা'আলা তাকে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক দান করেন, তার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন এবং ফিরিশতাদের কাছে তার প্রশংসা করেন।

গুণ তিনটির প্রথমটি হল তাকওয়া। আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু আদেশ করেছেন তা যথাযথ পালনের চেষ্টা এবং যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার সাধনাকে তাকওয়া বলা হয়। এরূপ ব্যক্তিকে তাকী ও মুত্তাকী বলা হয়। আল্লাহ তা'আলা মুত্তাকীকে ভালোবাসেন। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।(সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৪)

দ্বিতীয় গুণ হল 'গিনা' (ঐশ্বর্য)। হাদীছে 'ঐশ্বর্য' দ্বারা হৃদয়ের ঐশ্বর্য বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثرَةِ الْعَرَضِ، وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ
সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না; মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।(সহীহ বুখারী: ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫১; জামে' তিরমিযী: ২৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ৭৩১৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৩৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৪০)

এ গুণ যার মধ্যে থাকে, তাকেই প্রকৃত গনী (ধনী ও ঐশ্বর্যবান) বলা হয়। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয়। বোঝা গেল যাদের প্রচুর ধন-সম্পদ আছে, কিন্তু তাদের অন্তরে ঐশ্বর্য নেই; বরং আছে সম্পদের মোহ ও লোভ-লালসা, আল্লাহ তা'আলা তাদের পসন্দ করেন না। পক্ষান্তরে গরীব হওয়া সত্ত্বেও যাদের মনে অর্থ-সম্পদের মোহ নেই; বরং যা আছে তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট এবং সেজন্য তারা আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তারা আল্লাহর প্রিয়। অবশ্য ধনী ব্যক্তি যদি হৃদয়ের দিক থেকেও ঐশ্বর্যবান হয়, ধন-সম্পদের কারণে অহমিকা দেখায় না; বরং সেজন্য আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে দান-খয়রাত করে, তবে সে আল্লাহ তা'আলার কাছে অধিকতর প্রিয় হবে বৈ কি।

তৃতীয় গুণ হল প্রচারবিমুখতা, মানুষের কাছে অপরিচিত ও অখ্যাত হয়ে থাকা। অর্থাৎ যারা মানুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে না, নিজ ঈমান-আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যেসব বিষয় ঈমান-আমলের পক্ষে ক্ষতিকর, তা এড়িয়ে চলে, নিজেদের নেক আমলের কথা প্রচার করে বেড়ায় না; বরং সতর্ক থাকে যাতে তা প্রকাশ না পায়, ফলে মুত্তাকী-পরহেযগার ও ইবাদতগুযার হিসেবে লোকসমাজে তাদের খ্যাতি ছড়ায় না, এরূপ লোকদেরকে আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসেন।

এর আরেক অর্থ হতে পারে- যারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের অভাব-অনটনের কথা কারও কাছে প্রকাশ করে না; বরং তা গোপন রাখতে চেষ্টা করে এবং যা চাওয়ার তা কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছেই চায়, কোনও মাখলুকের কাছে নয়, ফলে কেউ তাদের অভাব-অনটন সম্পর্কে জানতে পারে না যে, তাদের কোনওরূপ আর্থিক সাহায্যের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তা'আলা এরূপ লোকদের ভালোবাসেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।

খ. আমরা ধনী হই বা গরীব, সর্বাবস্থায় মনের দিক থেকে ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠার সাধনা করতে হবে।

গ. ইবাদত-বন্দেগীতে রিয়া বা লোকদেখানোর মানসিকতা বর্জন করা জরুরি।

ঘ. নিজ ঈমান ও আমলের হেফাজত করার লক্ষ্যে যদি লোকসংসর্গ এড়িয়ে নিভৃত জীবন যাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সেজন্যও প্রস্তুত থাকা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান