আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২০. অধ্যায়ঃ হদ্দ
হাদীস নং: ৩৫৬১
অধ্যায়ঃ হদ্দ
হুদূদ (আল্লাহর আইন) প্রতিষ্ঠার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং শিথীলতা প্রদর্শন করার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৩৫৬১. হযরত নু'মান ইবনে বাশীর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থানকারী এবং সীমালংঘনকারীর দৃষ্টান্ত হলঃ একদল লোক লটারী করে একটি সমুদ্রযানে উঠলো। তাদের কতক নিচের তলায়, আর কতক উপরের তলায় স্থান পেল। নিচের তলার লোকদের পানির প্রয়োজন হলে তারা তাদের উপরের তলার লোকদের কাছ দিয়ে পানি আনতে যায়। পরে তার (নিচের তলার লোকেরা) পরস্পর বলল: আমরা যদি আমাদের এখান দিয়ে একটি ছিদ্র করে নেই, তবে উপরের তলার লোকদের কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচা যেত। এখন যদি তারা (উপরের তলার লোকেরা) তাদেরকে একাজ করতে দেয়, তবে সবাই ধ্বংস হবে, আর যদি তারা তাদেরকে বাধা দেয়, তবে নিজেরাও বাঁচতে পারবে এবং সবাইকে বাঁচাতেও পারবে।
(বুখারী নিজ শব্দে তিরমিযী ও অন্যান্যগণ কর্তৃক বর্ণিত। الشفاعة المانعة من حد من حدود الله تعالی অনুচ্ছেদে এ পর্যায়ে হাদীস পেছনে অতিবাহিত হয়েছে।)
(বুখারী নিজ শব্দে তিরমিযী ও অন্যান্যগণ কর্তৃক বর্ণিত। الشفاعة المانعة من حد من حدود الله تعالی অনুচ্ছেদে এ পর্যায়ে হাদীস পেছনে অতিবাহিত হয়েছে।)
كتاب الحدود
التَّرْغِيب فِي إِقَامَة الْحُدُود والترهيب من المداهنة فِيهَا
3561- وَعَن النُّعْمَان بن بشير رَضِي الله عَنْهُمَا أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ مثل الْقَائِم فِي حُدُود الله وَالْوَاقِع فِيهَا كَمثل قوم استهاموا على سفينة فَأصَاب بَعضهم أَعْلَاهَا وَبَعْضهمْ أَسْفَلهَا فَكَانَ الَّذين فِي أَسْفَلهَا إِذا استقوا من المَاء مروا على من فَوْقهم فَقَالُوا لَو أَنا خرقنا فِي نصيبنا خرقا وَلم نؤذ من فَوْقنَا فَإِن تركوهم وَمَا أَرَادوا هَلَكُوا جَمِيعًا وَإِن أخذُوا على أَيْديهم نَجوا ونجوا جَمِيعًا
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَاللَّفْظ لَهُ وَالتِّرْمِذِيّ وَغَيره وَتَقَدَّمت أَحَادِيث فِي الشَّفَاعَة الْمَانِعَة من حد من حُدُود الله تَعَالَى
رَوَاهُ البُخَارِيّ وَاللَّفْظ لَهُ وَالتِّرْمِذِيّ وَغَيره وَتَقَدَّمت أَحَادِيث فِي الشَّفَاعَة الْمَانِعَة من حد من حُدُود الله تَعَالَى
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। তিনি একটি দৃষ্টান্তের দ্বারা সে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা করেছেন।
এ হাদীসে ব্যবহৃত حدود (হুদূদ) শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে حد। এর আভিধানিক অর্থ সীমারেখা। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দ্যেশ্য দীন ও শরী'আতের ওই সকল বিষয়, যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শরী'আতের প্রত্যেকটি নিষিদ্ধ ও হারাম বিষয়কে হুদূদ নামে অভিহিত করে বোঝানো হচ্ছে যে, এগুলো সব নিষিদ্ধ সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত। এর মধ্যে প্রবেশ কোনওক্রমেই জায়েয নয়। আদেশমূলক বিধানকেও এক দৃষ্টিতে হুদূদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা তা পালন না করা নিষিদ্ধ। যেমন নামায পড়া ফরয আর না পড়া হারাম। সুতরাং নামায না পড়ার কাজটি একটি নিষিদ্ধ কাজ। কোনওক্রমেই তাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। এ হিসেবে গোটা দীনই হুদুদের অন্তর্ভুক্ত।
যে ব্যক্তি শরী'আত পালন করে তথা নামায, রোযা ইত্যাদি আদিষ্ট কাজ আঞ্জাম দেয় আর চুরি করা, মদপান করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকে, এ হাদীছে তাকে শরী'আতের সীমারেখায় অবস্থানকারী নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি শরী'আতের বিধান লঙ্ঘন করে, তাকে সীমারেখা অতিক্রমকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
যখন কোনো ব্যক্তি শরী'আতের সীমা অতিক্রম করে, তখন সীমারেখার মধ্যে অবস্থানকারী তথা শরী'আতের বিধান পালনকারীদের কর্তব্য হচ্ছে তাকে শরী'আতমত চলতে আদেশ-উপদেশ দেওয়া এবং তাতে বাধ্য করা। এ কর্তব্য পালন করা না হলে এর ক্ষতি কেবল সেই সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকেই নয়; বরং যারা শরী'আতের সীমার মধ্যে থাকে তাদেরকেও তা ভোগ করতে হয়। হাদীসে প্রদত্ত উদাহরণে তা স্পষ্ট।
সীমারেখার মধ্যে অবস্থানকারী ও সীমারেখা লঙ্ঘনকারীদের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সামুদ্রিক জাহাজের আরোহীদের দ্বারা। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। মুসলিমসমাজ যেন এক সামুদ্রিক জাহাজ। সমুদ্র বড় বিপদসঙ্কুল। জাহাজের আরোহীদেরকে তাতে কঠিন ঝড়ঝাপ্টা ও নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। নাবিককে হতে হয় অত্যন্ত সুদক্ষ ও সচেতন। তেমনি মুসলিম সমাজকেও নানা প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে চলতে হয়। নফস ও শয়তানের কুমন্ত্রণা ছাড়াও কুফর ও তাগুতী শক্তি তার চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাকে বিপথগামী করার জন্য সবরকম চক্রান্ত চালায়। সেসব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে এবং সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সরল-সঠিক পথে নিজ সচলতা অব্যাহত রাখতে হলে দরকার হয় কঠিন সংগ্রামের। সে সংগ্রামে সফলতা পেতে হলে সমাজের ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজন জাহাজের নাবিকের মত সুযোগ্য উলামা-মাশায়েখ এবং সুদক্ষ আমীর ও শাসকের নেতৃত্ব।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ হচ্ছে এমন এক পারস্পরিক সহযোগিতার নাম, যা মুসলিম সমাজের আপন দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অপরিহার্য। এ সহযোগিতাকে জাহাজের ওপরতলা ও নিচতলার আরোহীদের পারস্পরিক সহযোগিতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
জাহাজের বিভিন্ন তলার মত সমাজেরও বিভিন্ন স্তর আছে। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে অর্থ-বিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে নানা স্তরে বণ্টন করেছেন। এ বণ্টন ও শ্রেণীবিভাগ একটি পরিপূর্ণ সমাজের জন্য জরুরি, যাতে জীবনরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহে এক শ্রেণীর লোক অপর শ্রেণীর সেবা ও সহযোগিতা পেতে পারে। সুতরাং প্রত্যেক শ্রেণীর লোকের কর্তব্য তার বিশেষ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দ্বারা অপরাপর শ্রেণীর সেবায় নিয়োজিত থাকা। তা না করা হলে অপরাপর শ্রেণীর সেই প্রয়োজন অপূর্ণ থেকে যাবে। ফলে তারা সে প্রয়োজন মেটানোর জন্য এমন কোনও পন্থা অবলম্বন করবে, যা সকল শ্রেণীর জন্যই ক্ষতিকর।
উদাহরণত, যারা সম্পদশালী তাদের কর্তব্য তাদের সম্পদ দ্বারা গরীব ও অসহায় শ্রেণীর সেবা করা। এ ব্যাপারে অবহেলা করা হলে নিরুপায় অবস্থায় তাদের পক্ষ থেকে চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অন্যায় পন্থা অবলম্বনের আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে সকলেরই জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এভাবে একশ্রেণীর দায়িত্ব পালনে অবহেলার খেসারত দিতে হয় সকলকেই। আবার এই চুরি-ডাকাতির কাজটি যারাই যে অজুহাতেই করুক না কেন, তা যেহেতু অন্যায় ও কঠিন পাপ তাই অন্য সকলের কর্তব্য তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করা। সে চেষ্টায় গাফলাতি করা হলে তারও খেসারত সকলকেই দিতে হয়। যেমন জাহাজের নিচতলার লোকেরা যদি জাহাজ ফুটো করে পানি সংগ্রহ করতে চায় আর উপরের তলার লোক তাতে বাধা না দেয়, তবে ডুবে মরতে হয় সকলকেই।
নিচতলা থেকে ওপরতলায় পানি আনতে গেলে তাতে উপরের তলার লোকদের কিছু না কিছু ঝামেলা হয়ই। নিচতলার লোকদের পানির সমস্যা মেটানোর জন্য সে ঝামেলাটুকু তাদের সহ্য করতেই হবে। তারা বিরক্ত হলে নিচতলার লোকেরা জাহাজ ফুটো করেই পানি সংগ্রহ করতে চাবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে। তেমনি সমাজের যারা অন্যায়-অপরাধ করে তারা কোনও না কোনও অজুহাতেই তা করে। সে অজুহাত সঙ্গত বা অসঙ্গত যাই হোক না কেন, তার ভিত্তিতে তারা যে অন্যায়-অপরাধ করে তা কেবল তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর নয়; অন্যদের পক্ষেও সর্বনাশা। তাই সকলেরই আত্মরক্ষার তাগিদে তাদেরকে সে অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। বরং শুরুতেই চেষ্টা করা উচিত যাতে তারা কোনও অন্যায়-অপরাধের দিকে না ঝোকে। সে চেষ্টার একটা অংশ এইও যে, সমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারা একজনের দ্বারা অন্যের যে ছোটখাটো ঝামেলা ও অশান্তি দেখা দেয় তা সহ্য করে যাওয়া, যেমন এ উদাহরণে ওপরতলার লোকদের উচিত নিচতলার লোকদের পানির জন্য আসা-যাওয়া করায় তাদের যে ঝামেলা হয় তা বরদাশত করা।
এ হাদীছটিতে দুই শ্রেণীর লোকের কথা বলা হয়েছে। এক শ্রেণী হচ্ছে তারা, যারা সীমার মধ্যে অবস্থান করে অর্থাৎ হারাম কাজে লিপ্ত হয় না; বরং অন্যদেরকেও তা থেকে বাধা দেয়। আরেক শ্রেণী হল সীমালঙ্ঘনকারী, যারা হারাম কাজে লিপ্ত হয়। তৃতীয় একটি শ্রেণীও আছে। তারা হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা অন্যায়-অপরাধ দেখেও তাতে বাধা দেয় না; বরং নীরবতা অবলম্বন করে। এদেরকে বলা হয় মুদাহিন। এ তৃতীয় শ্রেণীর কথা হাদীছে সরাসরি নেই। তবে পরোক্ষভাবে তারাও দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা অসৎকর্মে বাধা না দেওয়াও একটি অসৎকর্মই বটে। সুতরাং তারাও সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত হল।
উল্লেখ্য, নিচতলার লোকেরা জাহাজ ফুটো করে পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে কথাটি বলেছে, আপাতদৃষ্টিতে তা সুন্দর। তারা বলেছে, আমাদের যাতায়াত দ্বারা ওপরতলার লোকেরা কষ্ট পায়। কাজেই তাদেরকে কষ্ট না দিয়ে আমরা জাহাজ ফুটো করে পানি সংগ্রহ করলেই ভালো হয়। অতি সাধু নিয়ত এবং খাসা যুক্তি। কিন্তু এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা চিন্তা করেনি। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, কোনও কাজ করার আগে তার পরিণামও চিন্তা করা উচিত। কেবল নিয়ত ভালো হওয়াই যথেষ্ট নয়, তার ফলাফলও ভেবে দেখা দরকার।
সেইসঙ্গে এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, আপাতমধুর শ্লোগানে বিভ্রান্ত হতে নেই। কোনও কোনও ব্যক্তি বা কোনও কোনও দল অনেক সময় সুন্দর সুন্দর কথা বলে মানুষকে তাদের দিকে ডাকে। এরকম যে-কেউ ডাকে, গভীরভাবে চিন্তা না করে তাতে সাড়া দিতে গেলে কঠিন বিপদের ভয় থাকে। তা থাকে দুনিয়াবী কাজেও এবং দীনী বিষয়েও। এরকম অনেক আকর্ষণীয় ডাকের ভেতর কঠিন গোমরাহী লুকায়িত থাকে। তাতে সাড়া দেওয়ার পরিণাম পথভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ব্যাপারে মু'মিনদের সতর্ক থাকা জরুরি।
জাহাজ আরোহীদের কে কোন তলায় থাকবে তা স্থির করার জন্য লটারির কথা বলা হয়েছে। استهموا এর অর্থ তারা লটারি করল। এর দ্বারা সাধারণভাবে সব লটারি জায়েয মনে করা ঠিক হবে না। প্রচলিত লটারিসমূহ একেক রকমের জুয়া। সব জুয়াই হারাম ও নাজায়েয। এ হাদীছে যে লটারির কথা বলা হয়েছে তা কোনও জুয়া নয়। এটা হচ্ছে যৌথ অধিকার বা যৌথ মালিকানার বস্তুর ন্যায় ও ইনসাফসম্মতভাবে বণ্টনের পর কে কোন্ ভাগ নেবে তা লটারির মাধ্যমে স্থির করা। উদাহরণত কোনও পশু জবাই করার পর তা পাঁচভাগে ভাগ করা হল। সকলের টাকা সমান হওয়ায় ভাগও পাবে সমহারেই। এখন কে কোন্ ভাগ নেবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘোচানোর জন্য লটারি করা এক উত্তম ব্যবস্থা। এতে দোষের কিছু নেই। কেননা এতে কারও হারজিত নেই, তাই জুয়ারও কোনও ব্যাপার নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ক্ষেত্রবিশেষে এরকম লটারি করেছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছটির প্রধান শিক্ষা হচ্ছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার অপরিহার্যতা।
খ. কেউ কোনও অসৎকাজ করলে সেটাকে কেবল তার ব্যাপার মনে করে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কেননা তার অশুভ পরিণাম নিজেকেও ভোগ করতে হতে পারে।
গ. কেবল নিজের নগদ সুবিধা দেখেই কোনও কাজ শুরু করে দিতে নেই। তাতে নিজের বা অন্যদের কোনও ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না তাও ভেবে দেখা উচিত।
ঘ. সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অন্যের পক্ষ হতে ছোটখাটো ঝামেলা সহ্য করে নেওয়া চাই। একটুতেই বিরক্ত হলে তা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে।
ঙ. ন্যায্য ভাগ-বাটোয়ারার পর কে কোন্ ভাগ নেবে, লটারি দ্বারা তা নির্ণয় করা জায়েয।
এ হাদীসে ব্যবহৃত حدود (হুদূদ) শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে حد। এর আভিধানিক অর্থ সীমারেখা। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দ্যেশ্য দীন ও শরী'আতের ওই সকল বিষয়, যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শরী'আতের প্রত্যেকটি নিষিদ্ধ ও হারাম বিষয়কে হুদূদ নামে অভিহিত করে বোঝানো হচ্ছে যে, এগুলো সব নিষিদ্ধ সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত। এর মধ্যে প্রবেশ কোনওক্রমেই জায়েয নয়। আদেশমূলক বিধানকেও এক দৃষ্টিতে হুদূদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা তা পালন না করা নিষিদ্ধ। যেমন নামায পড়া ফরয আর না পড়া হারাম। সুতরাং নামায না পড়ার কাজটি একটি নিষিদ্ধ কাজ। কোনওক্রমেই তাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। এ হিসেবে গোটা দীনই হুদুদের অন্তর্ভুক্ত।
যে ব্যক্তি শরী'আত পালন করে তথা নামায, রোযা ইত্যাদি আদিষ্ট কাজ আঞ্জাম দেয় আর চুরি করা, মদপান করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকে, এ হাদীছে তাকে শরী'আতের সীমারেখায় অবস্থানকারী নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি শরী'আতের বিধান লঙ্ঘন করে, তাকে সীমারেখা অতিক্রমকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
যখন কোনো ব্যক্তি শরী'আতের সীমা অতিক্রম করে, তখন সীমারেখার মধ্যে অবস্থানকারী তথা শরী'আতের বিধান পালনকারীদের কর্তব্য হচ্ছে তাকে শরী'আতমত চলতে আদেশ-উপদেশ দেওয়া এবং তাতে বাধ্য করা। এ কর্তব্য পালন করা না হলে এর ক্ষতি কেবল সেই সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকেই নয়; বরং যারা শরী'আতের সীমার মধ্যে থাকে তাদেরকেও তা ভোগ করতে হয়। হাদীসে প্রদত্ত উদাহরণে তা স্পষ্ট।
সীমারেখার মধ্যে অবস্থানকারী ও সীমারেখা লঙ্ঘনকারীদের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সামুদ্রিক জাহাজের আরোহীদের দ্বারা। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। মুসলিমসমাজ যেন এক সামুদ্রিক জাহাজ। সমুদ্র বড় বিপদসঙ্কুল। জাহাজের আরোহীদেরকে তাতে কঠিন ঝড়ঝাপ্টা ও নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। নাবিককে হতে হয় অত্যন্ত সুদক্ষ ও সচেতন। তেমনি মুসলিম সমাজকেও নানা প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে চলতে হয়। নফস ও শয়তানের কুমন্ত্রণা ছাড়াও কুফর ও তাগুতী শক্তি তার চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাকে বিপথগামী করার জন্য সবরকম চক্রান্ত চালায়। সেসব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে এবং সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সরল-সঠিক পথে নিজ সচলতা অব্যাহত রাখতে হলে দরকার হয় কঠিন সংগ্রামের। সে সংগ্রামে সফলতা পেতে হলে সমাজের ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজন জাহাজের নাবিকের মত সুযোগ্য উলামা-মাশায়েখ এবং সুদক্ষ আমীর ও শাসকের নেতৃত্ব।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ হচ্ছে এমন এক পারস্পরিক সহযোগিতার নাম, যা মুসলিম সমাজের আপন দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অপরিহার্য। এ সহযোগিতাকে জাহাজের ওপরতলা ও নিচতলার আরোহীদের পারস্পরিক সহযোগিতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
জাহাজের বিভিন্ন তলার মত সমাজেরও বিভিন্ন স্তর আছে। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে অর্থ-বিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে নানা স্তরে বণ্টন করেছেন। এ বণ্টন ও শ্রেণীবিভাগ একটি পরিপূর্ণ সমাজের জন্য জরুরি, যাতে জীবনরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহে এক শ্রেণীর লোক অপর শ্রেণীর সেবা ও সহযোগিতা পেতে পারে। সুতরাং প্রত্যেক শ্রেণীর লোকের কর্তব্য তার বিশেষ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দ্বারা অপরাপর শ্রেণীর সেবায় নিয়োজিত থাকা। তা না করা হলে অপরাপর শ্রেণীর সেই প্রয়োজন অপূর্ণ থেকে যাবে। ফলে তারা সে প্রয়োজন মেটানোর জন্য এমন কোনও পন্থা অবলম্বন করবে, যা সকল শ্রেণীর জন্যই ক্ষতিকর।
উদাহরণত, যারা সম্পদশালী তাদের কর্তব্য তাদের সম্পদ দ্বারা গরীব ও অসহায় শ্রেণীর সেবা করা। এ ব্যাপারে অবহেলা করা হলে নিরুপায় অবস্থায় তাদের পক্ষ থেকে চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি অন্যায় পন্থা অবলম্বনের আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে সকলেরই জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এভাবে একশ্রেণীর দায়িত্ব পালনে অবহেলার খেসারত দিতে হয় সকলকেই। আবার এই চুরি-ডাকাতির কাজটি যারাই যে অজুহাতেই করুক না কেন, তা যেহেতু অন্যায় ও কঠিন পাপ তাই অন্য সকলের কর্তব্য তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করা। সে চেষ্টায় গাফলাতি করা হলে তারও খেসারত সকলকেই দিতে হয়। যেমন জাহাজের নিচতলার লোকেরা যদি জাহাজ ফুটো করে পানি সংগ্রহ করতে চায় আর উপরের তলার লোক তাতে বাধা না দেয়, তবে ডুবে মরতে হয় সকলকেই।
নিচতলা থেকে ওপরতলায় পানি আনতে গেলে তাতে উপরের তলার লোকদের কিছু না কিছু ঝামেলা হয়ই। নিচতলার লোকদের পানির সমস্যা মেটানোর জন্য সে ঝামেলাটুকু তাদের সহ্য করতেই হবে। তারা বিরক্ত হলে নিচতলার লোকেরা জাহাজ ফুটো করেই পানি সংগ্রহ করতে চাবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে। তেমনি সমাজের যারা অন্যায়-অপরাধ করে তারা কোনও না কোনও অজুহাতেই তা করে। সে অজুহাত সঙ্গত বা অসঙ্গত যাই হোক না কেন, তার ভিত্তিতে তারা যে অন্যায়-অপরাধ করে তা কেবল তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর নয়; অন্যদের পক্ষেও সর্বনাশা। তাই সকলেরই আত্মরক্ষার তাগিদে তাদেরকে সে অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। বরং শুরুতেই চেষ্টা করা উচিত যাতে তারা কোনও অন্যায়-অপরাধের দিকে না ঝোকে। সে চেষ্টার একটা অংশ এইও যে, সমাজে মিলেমিশে থাকার দ্বারা একজনের দ্বারা অন্যের যে ছোটখাটো ঝামেলা ও অশান্তি দেখা দেয় তা সহ্য করে যাওয়া, যেমন এ উদাহরণে ওপরতলার লোকদের উচিত নিচতলার লোকদের পানির জন্য আসা-যাওয়া করায় তাদের যে ঝামেলা হয় তা বরদাশত করা।
এ হাদীছটিতে দুই শ্রেণীর লোকের কথা বলা হয়েছে। এক শ্রেণী হচ্ছে তারা, যারা সীমার মধ্যে অবস্থান করে অর্থাৎ হারাম কাজে লিপ্ত হয় না; বরং অন্যদেরকেও তা থেকে বাধা দেয়। আরেক শ্রেণী হল সীমালঙ্ঘনকারী, যারা হারাম কাজে লিপ্ত হয়। তৃতীয় একটি শ্রেণীও আছে। তারা হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা অন্যায়-অপরাধ দেখেও তাতে বাধা দেয় না; বরং নীরবতা অবলম্বন করে। এদেরকে বলা হয় মুদাহিন। এ তৃতীয় শ্রেণীর কথা হাদীছে সরাসরি নেই। তবে পরোক্ষভাবে তারাও দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা অসৎকর্মে বাধা না দেওয়াও একটি অসৎকর্মই বটে। সুতরাং তারাও সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত সাব্যস্ত হল।
উল্লেখ্য, নিচতলার লোকেরা জাহাজ ফুটো করে পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে কথাটি বলেছে, আপাতদৃষ্টিতে তা সুন্দর। তারা বলেছে, আমাদের যাতায়াত দ্বারা ওপরতলার লোকেরা কষ্ট পায়। কাজেই তাদেরকে কষ্ট না দিয়ে আমরা জাহাজ ফুটো করে পানি সংগ্রহ করলেই ভালো হয়। অতি সাধু নিয়ত এবং খাসা যুক্তি। কিন্তু এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা চিন্তা করেনি। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, কোনও কাজ করার আগে তার পরিণামও চিন্তা করা উচিত। কেবল নিয়ত ভালো হওয়াই যথেষ্ট নয়, তার ফলাফলও ভেবে দেখা দরকার।
সেইসঙ্গে এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, আপাতমধুর শ্লোগানে বিভ্রান্ত হতে নেই। কোনও কোনও ব্যক্তি বা কোনও কোনও দল অনেক সময় সুন্দর সুন্দর কথা বলে মানুষকে তাদের দিকে ডাকে। এরকম যে-কেউ ডাকে, গভীরভাবে চিন্তা না করে তাতে সাড়া দিতে গেলে কঠিন বিপদের ভয় থাকে। তা থাকে দুনিয়াবী কাজেও এবং দীনী বিষয়েও। এরকম অনেক আকর্ষণীয় ডাকের ভেতর কঠিন গোমরাহী লুকায়িত থাকে। তাতে সাড়া দেওয়ার পরিণাম পথভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ব্যাপারে মু'মিনদের সতর্ক থাকা জরুরি।
জাহাজ আরোহীদের কে কোন তলায় থাকবে তা স্থির করার জন্য লটারির কথা বলা হয়েছে। استهموا এর অর্থ তারা লটারি করল। এর দ্বারা সাধারণভাবে সব লটারি জায়েয মনে করা ঠিক হবে না। প্রচলিত লটারিসমূহ একেক রকমের জুয়া। সব জুয়াই হারাম ও নাজায়েয। এ হাদীছে যে লটারির কথা বলা হয়েছে তা কোনও জুয়া নয়। এটা হচ্ছে যৌথ অধিকার বা যৌথ মালিকানার বস্তুর ন্যায় ও ইনসাফসম্মতভাবে বণ্টনের পর কে কোন্ ভাগ নেবে তা লটারির মাধ্যমে স্থির করা। উদাহরণত কোনও পশু জবাই করার পর তা পাঁচভাগে ভাগ করা হল। সকলের টাকা সমান হওয়ায় ভাগও পাবে সমহারেই। এখন কে কোন্ ভাগ নেবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘোচানোর জন্য লটারি করা এক উত্তম ব্যবস্থা। এতে দোষের কিছু নেই। কেননা এতে কারও হারজিত নেই, তাই জুয়ারও কোনও ব্যাপার নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ক্ষেত্রবিশেষে এরকম লটারি করেছেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছটির প্রধান শিক্ষা হচ্ছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার অপরিহার্যতা।
খ. কেউ কোনও অসৎকাজ করলে সেটাকে কেবল তার ব্যাপার মনে করে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কেননা তার অশুভ পরিণাম নিজেকেও ভোগ করতে হতে পারে।
গ. কেবল নিজের নগদ সুবিধা দেখেই কোনও কাজ শুরু করে দিতে নেই। তাতে নিজের বা অন্যদের কোনও ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না তাও ভেবে দেখা উচিত।
ঘ. সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অন্যের পক্ষ হতে ছোটখাটো ঝামেলা সহ্য করে নেওয়া চাই। একটুতেই বিরক্ত হলে তা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে।
ঙ. ন্যায্য ভাগ-বাটোয়ারার পর কে কোন্ ভাগ নেবে, লটারি দ্বারা তা নির্ণয় করা জায়েয।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)