আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৯. অধ্যায়ঃ বিচার ব্যবস্থা

হাদীস নং: ৩৩৫৫
অধ্যায়ঃ বিচার ব্যবস্থা
মুসলমানের কোন কাজে ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসনভার গ্রহণ করা ইত্যাদির প্রতি অনুপ্রেরণা এবং প্রজাদের প্রতি কঠোরতা আরোপ করা, অত্যাচার করা, প্রতারণা করা, তাদের সাক্ষাৎ না দেওয়া, তাদের প্রয়োজনের সময় দরজা বন্ধ রাখার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৩৩৫৫. হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি মুসলমানের শাসক নিযুক্ত হওয়ার পর বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে জাহান্নামী।
(তাবারানীর আওসাত ও সাগীর গ্রন্থে বর্ণিত। তবে আবু লায়লা আবদুল্লাহ্ ইবনে মায়সারা ব্যতীত তার বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত।)
كتاب القضاء
ترغيب من ولي شَيْئا من أُمُور الْمُسلمين فِي الْعدْل إِمَامًا كَانَ أَو غَيره وترهيبه أَن يشق على رَعيته أَو يجور أَو يغشهم أَو يحتجب عَنْهُم أَو يغلق بَابه دون حوائجهم
3355- وَعَن أنس بن مَالك رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من ولي من أَمر الْمُسلمين شَيْئا فغشهم فَهُوَ فِي النَّار

رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ فِي الْأَوْسَط وَالصَّغِير وَرُوَاته ثِقَات إِلَّا عبد الله بن ميسرَة أَبَا ليلى

হাদীসের ব্যাখ্যা:

غاش এর উৎপত্তি غش থেকে। এর অর্থ প্রতারণা করা, ধোঁকা দেওয়া, খেয়ানত করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা। غاش এর অর্থ বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, খেয়ানতকারী। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বা শাসকের কর্তব্য আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দেওয়া। তার পদটি তার উপর অর্পিত একটি আমানত। এ আমানত জনগণের পক্ষ থেকেও এবং আল্লাহর পক্ষ থেকেও। যদি সে আল্লাহ তা'আলার বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে এবং জনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করে, তবেই সে আমানত রক্ষা হয়। অন্যথায় সে একজন খেয়ানতকারী ও বিশ্বাসঘাতক বলে গণ্য হয়। হাদীছে এরূপ শাসক সম্পর্কে সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে যে-
مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللَّهُ رَعِيَّةً ، يَمُوْتُ يَوْمَ يَمُوْتُ وَهُوَ غَاش لِرَعِيَّتِهِ، إِلَّا حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ (আল্লাহ তাঁর যে বান্দাকেই জনগণের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, সে যেদিন মারা যায়, সেদিন যদি এ অবস্থায় মারা যায় যে, সে তার জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেন)। কেননা আল্লাহ তা'আলা তাকে দায়িত্বশীল বানিয়েছিলেন জনগণের কল্যাণ করার জন্য, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য নয়। কাজেই সে যদি ঈমান নিয়েও মারা যায়, তবুও এ বিশ্বাসঘাতকতার দরুন তাকে একটা কাল পর্যন্ত জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। শুরুতেই সে জান্নাতে যেতে পারবে না। যদি বিশ্বাসঘাতকতা ও খেয়ানত করাকে বৈধ মনে করে থাকে, তবে তো তার ঈমানই বরবাদ। এ অবস্থায় সে কোনওদিনই জান্নাতে যেতে পারবে না। তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল, জনগণের অভিভাবকত্ব ও রাষ্ট্রক্ষমতার বাগডোর আল্লাহরই হাতে। তিনি যার হাতে অর্পণ করেন, এটা সেই পায়। এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ
বলো, হে আল্লাহ! সার্বভৌম শক্তির মালিক! তুমি যাকে চাও ক্ষমতা দান কর, আর যার থেকে চাও ক্ষমতা কেড়ে নাও। (সূরা আলে 'ইমরান (৩), আয়াত ২৬)

রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত দাতা যেহেতু আল্লাহ তা'আলাই, তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীনদেরকে আল্লাহ তা'আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা শাসনকার্য কীভাবে পরিচালনা করেছিলে? আমার দেওয়া বিধানমতো, না নিজেদের মনগড়া ব্যবস্থা অনুযায়ী? তোমরা তাদের উপর ন্যায়, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলে, না জনগণের উপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছিলে? সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসকশ্রেণিকে এ জবাবদিহির কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

হাদীসে আরো আছে- فَلَمْ يَحُطْهَا بِنُصْحِهِ لَمْ يَجِدْ رَائِحَةَ الْجَنَّة (সে যদি তাদের সকলের প্রতি পুরোপুরি কল্যাণকামিতা প্রদর্শন না করে, তবে সে জান্নাতের সুবাসও পাবে না)। অর্থাৎ সে জান্নাতে তো যেতে পারবেই না, জান্নাতের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবে না। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, জান্নাতের সুবাস সত্তর বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়। কাজেই জান্নাতের সুবাসও না পাওয়ার অর্থ তাকে জান্নাতের অন্ততপক্ষে সত্তর বছরের দূরত্বে থাকতে হবে। হাদীসে আরো আছে-
مَا مِنْ أَمِيْرٍ يَلِي أُمُورَ الْمُسْلِمِينَ ، ثُمَّ لَا يَجْهَدُ لَهُمْ وَيَنْصَحُ لَهُمْ، إِلَّا لَمْ يَدْخُلْ مَعَهُمُ الْجَنَّةَ (যে শাসক মুসলিমদের বিষয়াবলির অভিভাবকত্ব লাভ করে, তারপর সে তাদের অনুকূলে পুরোপুরি চেষ্টা করে না এবং তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা দেখায় না, সে তাদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না)। এখানে বিশেষভাবে মুসলিমদের কথা বলা হলেও অন্যসব ধর্মাবলম্বীও এর অন্তর্ভুক্ত। শাসকের কর্তব্য দেশের সমস্ত জনগণের অধিকার রক্ষা করা। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার অধিকার রাখে। তাদের উপর জুলুম করার কোনও অধিকার সরকারের নেই। হাদীছটির প্রথম বর্ণনায় সাধারণভাবে সকল নাগরিকের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই সেটাই ধর্তব্য। 'মুসলিম' শব্দ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য আল্লাহর কাছে তাদের বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইশারা করা। এর দ্বারা নাগরিক অধিকার তাদের জন্য সীমাবদ্ধ করা উদ্দেশ্য নয়। যাহোক, হাদীছটিতে শাসকবর্গকে জনগণের কল্যাণসাধনের জন্য পুরোপুরি চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। চেষ্টায় অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই। অবহেলা করার পরিণাম বলা হয়েছে জান্নাতলাভ থেকে বঞ্চিত থাকা।

ইবন বাত্তাল রহ. বলেন, জালেম শাসকদের জন্য এটা এক কঠিন সতর্কবাণী। যারা জনগণের উপর জুলুম-নিপীড়ন চালায় এবং তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে, কিয়ামতে তাদের ন্যায়বিচার করা হবে। তাদেরকে হুকুম করা হবে, যাদের অধিকার হরণ করেছিলেন তাদের সে অধিকার আদায় করে দাও। যাদের উপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছিলে, তাদের দাবি-দাওয়া থেকে নিজেকে মুক্ত করে নাও। কিন্তু কীভাবে তারা নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হবে? বিপুল জনগোষ্ঠীর উপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল, তা থেকে নিজেদের মুক্তিলাভের কী উপায় হবে?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. রাষ্ট্রক্ষমতা আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে দেন কেবল সেই পায়।

খ. রাষ্ট্রক্ষমতা আল্লাহর দেওয়া আমানত। কাজেই রাষ্ট্রপরিচালনায় স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে একজন বিশ্বাসঘাতকরূপে গণ্য হবে।

গ. জুলুম ও নিপীড়নকারী শাসককে জাহান্নামে যেতে হবে।

ঘ. ক্ষমতাসীনদের কর্তব্য জনগণের কল্যাণে কাজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান