আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৬. অধ্যায়ঃ বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়

হাদীস নং: ২৯৮৯
অধ্যায়ঃ বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়
স্বামীর প্রতি তার স্ত্রীর হক আদায় ও তার প্রতি সদাচরণ এবং স্ত্রীর প্রতি তার স্বামীর হক আদায় ও আনুগত্য করার অনুপ্রেরণা এবং স্বামীর হক বিনষ্ট করা ও বিরোধিতা করার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
২৯৮৯. হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনসারদের একটি পরিবার উট দ্বারা কূপ থেকে পানি উঠাত। উটটি অপরাগতা প্রকাশ করল এবং তার পিঠে তাদের ভার বহন করতে চাইল না। আনসারদের একটি দল রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছে গেল এবং বলল: আমরা আমাদের একটি উট দ্বারা পানি বহনের কাজ করতাম। কিন্তু সেটি আমাদের কাজে অপারগতা প্রকাশ করেছে এবং তার পিঠ ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। অথচ আমাদের শস্যক্ষেত ও খেজুর বাগান পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। (এমতাবস্থায় আমাদের কি করণীয়?) নবী (ﷺ)-তাঁর সাহাবীদের বললেন: তোমরা রওয়ানা হও। তখন তাঁরা দাঁড়িয়ে গেল। তিনি বাগানে প্রবেশ করলেন, আর উটটি তখন বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল। নবী (ﷺ) সেটির দিকে হেঁটে গেলেন। আনসারগণ বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এটি পাগলা কুকুরের ন্যায়, আমরা আপনাকে আক্রমণের আশংকা করছি। তিনি বললেন: ওটি আমার কোন ক্ষতি করবে না। এরপর উটটি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর দিকে তাকাল এবং তাঁর দিকে এসে তাঁকে সিজদা করল। যখন তিনি সেটির মাথায় চুল ধরলেন, তখন উটটি এমন বিনয়ী হল, যা কখনো দেখা যায়নি, এমন কি তিনি তার দ্বারা কাজ শুরু করিয়ে দিলেন। তখন তাঁর সাহাবাগণ তাঁকে বললঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্। এটি একটি অবুঝ চতুষ্পদ জন্তু, আপনাকে সিজদা করল অথচ আমরা বুদ্ধিমান ও বিবেকবান, কাজেই আমরা আপনাকে সিজদা করার ব্যাপারে অধিক হকদার। তিনি বলেন: কারও জন্য কোন লোককে সিজদা করা শোভনীয় নয়। আমি যদি কারও জন্য কাউকে সিজদা করা সঙ্গত মনে করতাম, তাহলে স্ত্রীর উপর তার স্বামীর অধিকার থাকায় সিজদা করার নির্দেশ দিতাম। যদি স্বামীর আপদমস্তকে দগদগে ঘা হয় এবং তা থেকে পুঁজ নির্গত হয়, এরপর তা জিহ্বা দ্বারা লেহন করে পরিষ্কার করে, তবুও স্বামীর খেদমত (পুরোপুরি) আদায় হয় না।
(আহমাদ ও নাসাঈ (র) উত্তম সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং হাদীসের রাবীগণ বিশ্বস্ত ও তারা সবাই মাশহুর। বাযযার সংক্ষেপে বর্ণনা করেন এবং হযরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে সংক্ষেপে ইবনে হিব্বান (র) তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে বর্ণনা করেন। তবে তাঁর বর্ণনায় لو كان إلى آخر থেকে অবশিষ্টাংশ উল্লেখ নেই। এ হাদীসের অনুরূপ হাদীস আবু সাঈদ (রা) সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।
يسنون তারা কুপ থেকে পানি তুলে ক্ষেত-খামারে দিত। الحائط বাগান, উদ্যান। تنجس উপচে উঠা।)
كتاب النكاح
ترغيب الزَّوْج فِي الْوَفَاء بِحَق زَوجته وَحسن عشرتها وَالْمَرْأَة بِحَق زَوجهَا وطاعته وترهيبها من إِسْقَاطه ومخالفته
2989- وَعَن أنس بن مَالك رَضِي الله عَنهُ قَالَ كَانَ أهل بَيت من الْأَنْصَار لَهُم جمل يسنون عَلَيْهِ
وَإنَّهُ استصعب عَلَيْهِم فَمَنعهُمْ ظَهره وَإِن الْأَنْصَار جاؤوا إِلَى رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَقَالُوا إِنَّه كَانَ لنا جمل نسني عَلَيْهِ وَإنَّهُ استصعب علينا ومنعنا ظَهره وَقد عَطش الزَّرْع وَالنَّخْل فَقَالَ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لاصحابه قومُوا فَقَامُوا فَدخل الْحَائِط والجمل فِي ناحيته فَمشى النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم نَحوه فَقَالَت الْأَنْصَار يَا رَسُول الله قد صَار مثل الْكَلْب نَخَاف عَلَيْك صولته قَالَ لَيْسَ عَليّ مِنْهُ بَأْس فَلَمَّا نظر الْجمل إِلَى رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم أقبل نَحوه حَتَّى خر سَاجِدا بَين يَدَيْهِ فَأخذ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بناصيته أذلّ مَا كَانَت قطّ حَتَّى أدخلهُ فِي الْعَمَل فَقَالَ لَهُ أَصْحَابه يَا رَسُول الله هَذَا بَهِيمَة لَا يعقل يسْجد لَك وَنحن نعقل فَنحْن أَحَق أَن نسجد لَك قَالَ لَا يصلح لبشر أَن يسْجد لبشر وَلَو صلح لبشر أَن يسْجد لبشر لأمرت الْمَرْأَة أَن تسْجد لزَوجهَا لعظم حَقه عَلَيْهَا لَو كَانَ من قدمه إِلَى مفرق رَأسه قرحَة تنبجس بالقيح والصديد ثمَّ استقبلته فلحسته مَا أدَّت حَقه

رَوَاهُ أَحْمد وَالنَّسَائِيّ بِإِسْنَاد جيد رُوَاته ثِقَات مَشْهُورُونَ وَالْبَزَّار بِنَحْوِهِ وَرَوَاهُ مُخْتَصرا وَابْن حبَان فِي صَحِيحه من حَدِيث أبي هُرَيْرَة بِنَحْوِهِ بِاخْتِصَار وَلم يذكر قَوْله لَو كَانَ إِلَى آخِره وَرُوِيَ معنى ذَلِك فِي حَدِيث أبي سعيد الْمُتَقَدّم
قَوْله يسنون عَلَيْهِ بِفَتْح الْيَاء وَسُكُون السِّين الْمُهْملَة أَي يستقون عَلَيْهِ المَاء من الْبِئْر
والحائط هُوَ الْبُسْتَان
تنبجس أَي تتفجر وتنبع

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি স্বামীর আনুগত্য করা ও তার হক আদায় করার বিষয়টিকে অত্যন্ত কঠোরভাবে ব্যক্ত করছে। কারও প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সর্বোচ্চ পন্থা তাকে সিজদা করা। এভাবে আনুগত্য প্রকাশ কেবল আল্লাহ তা'আলার প্রতিই করা যায়। তিনি বান্দার সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। বান্দার প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগানদাতা। তার পালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। তিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তাই ইবাদত ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের আনুগত্য, যা কিনা সিজদার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, কেবল তাঁরই জন্য সংরক্ষিত। অন্য কাউকে সিজদা করলে শিরক হয়ে যায়। শিরক মহাপাপ।
হাঁ, আরেকরকম সিজদা আছে, যাকে সম্মানসূচক সিজদা বলা হয়ে থাকে। ফিরিশতাগণ হযরত আদম আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে এরূপ সিজদা করেছিলেন। হযরত ইয়ুসুফ আলাইহিস সালামকে এরূপ সিজদা করেছিল তাঁর ভাইয়েরা। ইসলামে এটাও নাজায়েয। তাওহীদের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ দীনে এমন কোনও কিছুর সুযোগ রাখা হয়নি, যা দ্বারা তাওহীদের গায়ে আঁচড় লাগতে পারে। সম্মানসূচক সিজদা বাহ্যদৃষ্টিতে ইবাদত-আনুগত্যমূলক সিজদার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এরূপ সিজদার অবকাশ থাকলে তা আনুগত্যমূলক সিজদায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট। ফলে ব্যাপকভাবেই মানুষের তাওহীদ থেকে সরে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ইসলাম সে ঝুঁকি নেয়নি। অতএব আল্লাহ তা'আলা ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার সিজদাই হারাম ও নাজায়েয।
হযরত কায়স ইবনে সা'দ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি হীরায় এসে দেখলাম সেখানকার মানুষ তাদের রাজাকে সিজদা করে। আমি মনে মনে। বললাম, এরূপ সিজদা পাওয়ার অধিকার তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই বেশি। ফিরে এসে আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হীরায় গিয়ে দেখেছি, সেখানকার লোকজন তাদের রাজাকে সিজদা করে। আপনিই তো এর বেশি হকদার যে, আপনাকে সিজদা করা হবে। তিনি বললেন, আচ্ছা বল তো, তুমি যদি আমার কবরের কাছে আস তবে কি আমাকে সিজদা করবে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে এখনও করো না। তারপর তিনি স্বামীকে সিজদা করা সম্পর্কিত আলোচ্য হাদীছটি বয়ান করেন।৩৫৫
যারা কবরে সিজদা করে বা তথাকথিত পীরদের উদ্দেশ্যে সিজদা করে, তাদের ভেবে দেখা উচিত তারা আসলে কী করছে। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজেকে লক্ষ্য করে কারও সিজদা অনুমোদন করেননি এবং সিজদা করাকে কেবলই আল্লাহ তা'আলার জন্য নির্দিষ্ট রেখেছেন, সেখানে পীর-ফকীর ও কবরকে সিজদা করার কতটুকু বৈধতা থাকতে পারে? যে আমল কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নির্দিষ্ট, তাতে পীর-ফকীরদের ভাগ বসিয়ে তারা কি গুরুতর শিরকে লিপ্ত হচ্ছে না? তাওহীদী ধর্ম ইসলামের নামে এ জাতীয় শির্কী কর্মকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে চরম গোমরাহী। নিজেদেরকে যারা মুসলিম বলে বিশ্বাস করে এবং তা সত্ত্বেও এহেন শিরকী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছে, তাদের অবশ্যকর্তব্য এর থেকে তাওবা করা এবং সর্বপ্রকার শিরক ও বিদআত পরিহার করে চলা।

যাহোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন যে, কোনও মানুষকে লক্ষ্য করে সিজদা দেওয়া যায় না। যদি তা জায়েয হত তবে স্বামীর হক আদায়ার্থে স্ত্রীকে নির্দেশ দেওয়া হত যেন সে তাকে সিজদা করে। এভাবে তিনি স্ত্রীর পক্ষে স্বামী যে কত বড় মান্যজন এবং তার অধিকার কত উচ্চ, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর বার্তা হচ্ছে, স্ত্রীর কর্তব্য শরীআতের সীমারেখার ভেতর স্বামীকে মেনে চলা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বান্দার সিজদা কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই নির্দিষ্ট। গাইরুল্লাহকে সিজদা করা শিরক ও মহাপাপ। অতএব পীর বা কবরকে সিজদা করার কোনও বৈধতা নেই।

খ. এ হাদীছ দ্বারা স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায় এবং স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমান করা যায়। কাজেই প্রত্যেক স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা ও তার আনুগত্য বজায় রাখা।

৩৫৫. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২১৪০; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৫০৪; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৯৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ১৪৮৭; মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীছ নং ২৭৬৩; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৭০৫
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান