আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৩. অধ্যায়ঃ কুরআন পাঠ

হাদীস নং: ২২০৯
অধ্যায়ঃ কুরআন পাঠ
অধ্যায়ঃ কুরআন পাঠ
সালাত ও এর বাইরে কুরআন পাঠের প্রতি উৎসাহ দান, কুরআন শিক্ষা ও এর শিক্ষাদানের ফযীলত এবং সিজদা-ই-তিলাওয়াত আদায়ের প্রতি উৎসাহ দান প্রসঙ্গে
২২০৯. হযরত ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ দু'টি ক্ষেত্রেই ঈর্ষা করা সাজে। ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ্ এই কিতাব (কুরআন) দান করেছেন। আর সে রাত-দিন এ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
দ্বিতীয়, ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন। আর সে রাত-দিন তা থেকে দান করতে থাকে।
(হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন।)
كتاب قِرَاءَة الْقُرْآن
كتاب قِرَاءَة الْقُرْآن
التَّرْغِيب فِي قِرَاءَة الْقُرْآن فِي الصَّلَاة وَغَيرهَا وَفضل تعلمه وتعليمه وَالتَّرْغِيب فِي سُجُود التِّلَاوَة
2209- وَعَن ابْن عمر رَضِي الله عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لَا حسد إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ رجل آتَاهُ الله هَذَا الْكتاب فَقَامَ بِهِ آنَاء اللَّيْل وآناء النَّهَار وَرجل أعطَاهُ الله مَالا فَتصدق بِهِ آنَاء اللَّيْل وآناء النَّهَار

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম বলেছেন- لا حَسَدَ إِلاَّ في اثْنَتَيْنِ (দুই অবস্থা ছাড়া অন্য কোনও অবস্থার প্রতি হাসাদ করা যায় না)। 'হাসাদ' অর্থ ঈর্ষা বা হিংসা। কারও মধ্যে বিশেষ কোনও প্রাপ্তি (অর্থ-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, ক্ষমতা, সুখ্যাতি প্রভৃতি) দেখে অন্তর্জালা বোধ করা এবং তার থেকে তা লোপ পাওয়ার কামনা করাকে হাসাদ বলে। এটি একটি মন্দ গুণ ও আত্মিক ব্যাধি। মনের ভেতর এ গুণকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়; বরং এর চিকিৎসা জরুরি। কেননা মনের এ অবস্থা যদি অবদমিত হয়ে ওঠে, তবে একে কার্যে পরিণত করারও আশঙ্কা থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এ অবস্থাকে কার্যে পরিণত করা না হয় বা কার্যে পরিণত করার সংকল্প করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এতে কোনও গুনাহ নেই। যেমন কারও অন্তরে অন্যের ভালো দেখে অন্তর্জালা দেখা দিল এবং কামনা জাগল তার সে ভালোটা যেন দূর হয়ে যায়। কিন্তু তা দূর করার জন্য সে নিজে কোনও চেষ্টা করছে না বা চেষ্টার সংকল্পও করছে না। তবে এ অবস্থায় সে গুনাহগার হবে না। পক্ষান্তরে যদি সেরকম কোনও চেষ্টা করে বা চেষ্টার সংকল্প করে, তবে গুনাহগার হবে। তাই যাতে হাসাদ এ পর্যায়ে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নিয়ে এর চিকিৎসা করা চাই।

আলোচ্য হাদীছে যদিও ‘হাসাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর দ্বারা উল্লিখিত অর্থ বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য ‘গিবতা’ (غِبطَةٌ)। কারও মধ্যে ভালো কিছু দেখে তার বিলুপ্তি কামনা না করে নিজের জন্যও অনুরূপ ভালোর আশা করাকে গিবতা বলে। যেমন কারও সুস্বাস্থ্য দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ সুস্বাস্থ্য কামনা করা বা কারও বিদ্যা-বুদ্ধির পরিপক্কতা দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ বিদ্যা-বুদ্ধি কামনা করা ইত্যাদি। কুরআনের ভাষায় একে 'মুনাফাসা' বলে। পার্থিব হালাল ও বৈধ বিষয়াবলিতে এটা জায়েয। ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে এটা কাম্য ও প্রশংসনীয়। কুরআন-হাদীছে এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26)
‘এটাই এমন জিনিস, লুব্ধজনদের উচিত এর প্রতি অগ্রগামী হয়ে লোভ প্রকাশ করা।’(সূরা মুতাফফিফীন (৮৩), আয়াত ২৬)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
‘তোমরা পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও।’(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৪৮)

হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝাচ্ছেন, হাসাদ তথা গিবতা যদি করতেই হয়, তবে দু'টি ক্ষেত্রে করবে। কোন দু'টি ক্ষেত্রে করবে, হাদীছের পরবর্তী অংশে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে-
(এক ঐ ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ অর্থ–সম্পদ দিয়েছেন এবং সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) খরচ করে)। অর্থাৎ অকুন্ঠ ও অকৃপণভাবে খরচ করে এমন কাজে, যাতে ছাওয়াব হয় এবং যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ হয়। যেমন আর্ত ও পীড়িতের সেবা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি।

প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলার পথে খরচ করার জন্য ধনী হওয়া জরুরি নয়। আল্লাহ তা'আলা যাকে যতটুকু মাল দিয়েছেন সে তা থেকেই খরচ করবে, তা বেশি হোক বা কম। সুতরাং অপর এক আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, (অর্থাৎ যে গরীব) সে, আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকেই খরচ করবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার উপর অর্পণ করেন না।’(সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৭)

(আর ওই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তাতে লিপ্ত থাকে)। কুরআন নিয়ে লিপ্ত থাকার মানে কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা, নামায ও নামাযের বাইরে তিলাওয়াত করা, অন্যকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং কুরআন অনুযায়ী ফাতওয়া দেওয়া ও বিচার করা। এ দুই ক্ষেত্রে গিবতা করার অর্থ এরূপ কামনা করা যে, আমারও যদি ওরকম থাকত, তবে আমিও ওইরকম আমল করতাম। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا حَسَدَ إلَّا في اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ عَلَّمَهُ اللَّهُ القُرْآنَ، فَهو يَتْلُوهُ آناءَ اللَّيْلِ، وآناءَ النَّهارِ، فَسَمِعَهُ جارٌ له، فقالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ، ورَجُلٌ آتاهُ اللَّهُ مالًا فَهو يُهْلِكُهُ في الحَقِّ، فقالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ ما أُوتِيَ فُلانٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ ما يَعْمَلُ.
‘দুজন ব্যক্তির অবস্থা ছাড়া অন্য কারও প্রতি হাসাদ (ঈর্ষা পোষণ) করা যায় না। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন দিয়েছেন, আর সে দিবারাত্রের মুহূর্তগুলোতে তা তিলাওয়াত করে। এ কথা তার এক প্রতিবেশী শুনল। তখন সে বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (কুরআন) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব। আর ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং সে ন্যায় খাতে তা (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) উজাড় করে দেয়। তখন এক ব্যক্তি বলল, আমাকেও যদি তার অনুরূপ (সম্পদ) দেওয়া হয়, তবে আমিও তার মতো আমল করব।(সহীহ বুখারী : ৫০২৬; মুসনাদে আহমাদ: ১০২১৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৭৮২৭)

বোঝা গেল এরূপ গিবতা করা পসন্দনীয়। অন্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, এর দ্বারাও আমলকারী ব্যক্তির সমান ছাওয়াব পাওয়া যায়। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَفْضَلِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ وَعَبْدٍ رَزَقَهُ اللَّهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْمًا فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ لاَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ وَلاَ يَعْلَمُ لِلَّهِ فِيهِ حَقًّا فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ وَعَبْدٍ لَمْ يَرْزُقْهُ اللَّهُ مَالاً وَلاَ عِلْمًا فَهُوَ يَقُولُ لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ فَهُوَ بِنِيَّتِهِ فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ
‘দুনিয়া তো চার ব্যক্তির। (ক) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ ও ইলম দিয়েছেন। সে তাতে তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তা রক্ষা করে, তার ভেতর আল্লাহর হক জেনে নেয় (ও তা আদায় করে)। এটা উচ্চতর স্তর। (খ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, কিন্তু সম্পদ দেননি। সে খাঁটি নিয়তের অধিকারী। সে বলে, আল্লাহ যদি আমাকে সম্পদ দিতেন, তবে অমুকের মতো আমল করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির ছাওয়াব ও প্রতিদান সমান। (গ) ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু ইলম দেননি। সে ইলম ব্যতিরেকে তার সম্পদ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, তাতে আল্লাহকে ভয় করে না, আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং তাতে আল্লাহর কোনও হক আছে বলে জানে না। এটা নিকৃষ্টতম স্তর। (ঘ) এবং ওই বান্দা, যাকে আল্লাহ মালও দেননি এবং ইলমও নয়। সে বলে, আমার যদি মাল থাকত, তবে তাতে ওই ব্যক্তির মতো কাজ করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। এ দুই ব্যক্তির গুনাহ সমান।'(জামে তিরমিযী: ২৩২৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৮০৩১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর : ৮৬৮)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও ভালো কিছু দেখে হাসাদ করতে নেই।

খ. গিবতা করা জায়েয। দীনের ক্ষেত্রে তা কাম্য।

গ. সম্পদ আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। ন্যায় খাতে তা খরচ করতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়। এ হাদীছ খরচ করতে উৎসাহ যোগায়।

ঘ. সম্পদহীন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যে সম্পদ কামনা করলে তা দূষণীয় নয়।

ঙ. দীনী ইলম আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ নি'আমত যার আছে তার উচিত আমলে যত্নবান হওয়া।

চ. যার ইলম নেই, তার উচিত আমলের লক্ষ্যে ইলমের আশা করা ও তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করা।

ছ. কুরআন তিলাওয়াত করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি তিলাওয়াত করতে পারে না, তার উচিত শিখে নেওয়া। আর যে ব্যক্তি তিলাওয়াত করতে পারে, তার অবশ্যই প্রতিদিন নিয়মিতভাবে তিলাওয়াত করা উচিত।

জ. কুরআন শিক্ষা করা, শিক্ষা দেওয়া ও কুরআনের শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারা বান্দার পক্ষে মহাসৌভাগ্য।

ঝ. সঠিক খাতে ইলম ও মালের ব্যবহার আল্লাহ তা'আলার তাওফীকেই সম্ভব। তাই এজন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওফীক প্রার্থনা করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান