আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৮. অধ্যায়ঃ সদকা

হাদীস নং: ১৩৬৩
কল্যাণ খাতে সম্পদ ব্যয় করার প্রতি উৎসাহ প্রদান ও কার্পণ্যবশত সম্পদ আঁকড়ে থাকা ও তা পুঞ্জীভূত করা থেকে ভীতি প্রদর্শন
১৩৬৩. হযরত আবুদ্-দারদা (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: যে দিনই সূর্য উঠে, তার দু'পার্শ্বে দু'জন ফিরিশতা বলতে থাকেন: হে আল্লাহ্! যে দান করে তাকে এর প্রতিদান দাও। আর যে সম্পদ আঁকড়ে ধরে থাকে, তাকে ধ্বংস করে দাও।
(হাদীসটি আহমদ ও ইব্‌ন হিব্বান তাঁর 'সহীহ' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। হাকিমও অনুরূপ বর্ণনা করে বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। বায়হাকীও হাকিম-এর সনদে এটি বর্ণনা করেন। তাঁর একটি বর্ণনা নিম্নরূপ: রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: যেদিনই সূর্য উদিত হয়, তার দু'পার্শ্বে দু'জন ফিরিশতা এই বলে আহ্বান করতে থাকেন- যা মানুষ ও জিন্ন ছাড়া আল্লাহর সকল সৃষ্ট বস্তুই শুনতে পায়: হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে আস। যে প্রাচুর্য গাফিল করে দেয়, তার চাইতে সেই অপ্রতুলতাই বিবেচিত হয়। আর যখনই সূর্য অস্তমিত হয়, তার দু'পার্শ্বে দু'জন ফিরিশতা এই বলে আহ্বান করতে থাকেন যা মানুষ ও জিন্ন ব্যতীত আল্লাহর সকল সৃষ্ট বস্তুই শুনতে পায়—হে আল্লাহ্! দানশীলকে তুমি প্রতিদান দাও আর কৃপণকে ধ্বংস কর। ফিরিশতাদের এই আহ্বান "হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে আস।" প্রসঙ্গে আল্লাহ্ কুরআনের সূরা ইউনুসে এ আয়াত নাযিল করেছেন:
وَالله يَدْعُو إِلَى دَار السَّلَام وَيهْدِي من يَشَاء إِلَى صِرَاط مُسْتَقِيم
অর্থ: আর আল্লাহ্ শান্তি ও নিরাপত্তার আলয়ের প্রতি আহবান জানান এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন
করেন। (১০৪ ২৫)

আর তাদের এই কথাঃ "হে আল্লাহ্! দানশীলদের প্রতিদান দাও আর কৃপণকে ধ্বংস কর।" প্রসঙ্গে এ আয়াতগুলো নাযিল করেছেন:
وَاللَّيْل إِذا يغشى وَالنَّهَار إِذا تجلى وَمَا خلق الذّكر وَالْأُنْثَى} إِلَى قَوْله للعسرى
অর্থ: শপথ রাত্রির, যখন সে আচ্ছন্ন করে, শপথ দিনের, যখন সে আলোকিত হয় এবং তাঁর- যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের। অতএব যে দান করে ও আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য জ্ঞান করে, আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করব। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা জ্ঞান করে, আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করব। (৯২ : ১-১০)
التَّرْغِيب فِي الْإِنْفَاق فِي وُجُوه الْخَيْر كرما والترهيب من الْإِمْسَاك والادخار شحا
1363 - وَعَن أبي الدَّرْدَاء رَضِي الله عَنهُ أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ مَا طلعت شمس قطّ إِلَّا وبجنبيها ملكان يناديان اللَّهُمَّ من أنْفق فأعقبه خلفا وَمن أمسك فأعقبه تلفا

رَوَاهُ أَحْمد وَابْن حبَان فِي صَحِيحه وَالْحَاكِم بِنَحْوِهِ وَقَالَ صَحِيح الْإِسْنَاد وَالْبَيْهَقِيّ من طَرِيق الْحَاكِم وَلَفظه فِي إِحْدَى رواياته قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم مَا من يَوْم طلعت شمسه إِلَّا وبجنبيها ملكان يناديان نِدَاء يسمعهُ خلق الله كلهم غير الثقلَيْن يَا أَيهَا النَّاس هلموا إِلَى ربكُم إِن مَا قل وَكفى خير مِمَّا كثر وألهى وَلَا آبت الشَّمْس إِلَّا وَكَانَ بجنبيها ملكان يناديان نِدَاء يسمعهُ خلق الله كلهم غير الثقلَيْن اللَّهُمَّ أعْط منفقا خلفا وَأعْطِ ممسكا تلفا وَأنزل الله فِي ذَلِك قُرْآنًا فِي قَول الْملكَيْنِ يَا أَيهَا النَّاس هلموا إِلَى ربكُم فِي سُورَة يُونُس {وَالله يَدْعُو إِلَى دَار السَّلَام وَيهْدِي من يَشَاء إِلَى صِرَاط مُسْتَقِيم} يُونُس 52 وَأنزل فِي قَوْلهمَا اللَّهُمَّ أعْط منفقا خلفا وَأعْطِ ممسكا تلفا {وَاللَّيْل إِذا يغشى وَالنَّهَار إِذا تجلى وَمَا خلق الذّكر وَالْأُنْثَى} إِلَى قَوْله للعسرى اللَّيْل 1 01

হাদীসের ব্যাখ্যা:

সূর্যের উদয় ও অস্তকালে কিভাবে ফিরিশতাদেরকে তার দুপাশে পাঠানো হয় এবং মানুষ ও জিন্ন ছাড়া আর সকলেই শুনতে পায় এমন আওয়াজে তারা কিভাবে এসব কথা বলে তা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টির কতটুকুই বা আমরা বুঝতে পারি? তাঁর বিশ্বপরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের পক্ষে কতটুকু উপলব্ধি করা সম্ভব? আমাদের কর্তব্য আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন তাতে বিশ্বাস রাখা ও তা মেনে চলা। আমাদের লক্ষ্য করে যে আদেশ ও উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্ট। তা বোধ বুদ্ধির অতীত নয়। সুতরাং এ হাদীছেরও উপদেশ পরিষ্কার। এর উপদেশ হচ্ছে, তোমরা দুনিয়ার মোহে বিভোর হয়ে থেকো না। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ ও আখেরাতের মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে অকাতরে দান-খয়রাত করতে থাক। কৃপণতা করো না। দান খয়রাত করলে কোনও না কোনওভাবে তার প্রতিদান পাবে। কৃপণতা করলে পাবে না কিছুই। খালি হাতে কবরে চলে যাবে আর তোমার রেখে যাওয়া সম্পদ অন্যরা নষ্ট করবে।
ফিরিশতাদের দুআয় বলা হয়েছে- اللهم أعط ممسكا تلفا 'হে আল্লাহ! খরচকারীকে উত্তম বদলা দিন'। খরচকারী বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো উদ্দেশ্য, যে তার অর্থ সম্পদ পরিবারবর্গের মৌলিক ও বৈধ চাহিদা পূরণে ব্যয় করে। আত্মীয়-স্বজন ও অতিথিদের সেবা করে। অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করে। এছাড়াও যে-কোনও দীনী খাতে অকাতরে ব্যয় করে।
এখানে যে خلف (উত্তম বদলা) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এর দ্বারা আসলে কী বোঝানো উদ্দেশ্য তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। নির্দিষ্ট না করার দ্বারা এর মধ্যে ব্যাপকতা এসে গেছে। কাজেই হতে পারে সে যা খরচ করেছে, আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ায়ই তাকে তা আরও বেশি পরিমাণে দেবেন। অর্থ-সম্পদ থেকে দান করা অর্থ-সম্পদের একরকম শোকরও বটে। শোকর আদায় করলে নি'আমত আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ইরশাদ হয়েছে لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ “তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব।৩৮৬
এর দ্বারা আখেরাতের ছাওয়াবও বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। এমনও অনেক দানশীল আছে, যে দুনিয়া থেকে চলে যায় অথচ সে যা অর্থ-সম্পদ দান করেছে দুনিয়ায় তার কোনও প্রতিদান দেখে যেতে পারে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিদানের অর্থ নেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হয়তো ছাওয়াবই বুঝতে হবে। অথবা হতে পারে, দান-খয়রাতের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তার দুনিয়ার কোনও বালা মসিবত দূর করে দেন। বলাবাহুল্য, এর প্রত্যেকটিই উত্তম প্রতিদান এবং প্রত্যেক বান্দার কাঙ্ক্ষিতও বটে।
خلف এর দ্বারা উত্তম স্থলাভিষিক্তও বোঝানো হতে পারে। দুআয় যেন বলা হয়েছে, হে আল্লাহ! এই দান-খয়রাতকারীকে এমন সুসন্তান দান করুন, যে তার মৃত্যুর পর তার দান-খয়রাতের ধারা অব্যাহত রাখবে। সে তার রেখে যাওয়া সম্পদ নষ্ট করবে না; বরং আপনার পথে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে সে সম্পদে আরও প্রবৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করবে। সন্দেহ নেই, এরূপ নেক সন্তান আল্লাহর পথে ব্যয় করা অর্থ-সম্পদের অতি উৎকৃষ্ট বদলা, যা যে-কোনও দীনদারের পরম কাম্য।
দু'আর পরবর্তী বাক্য হচ্ছে- وأعط ممسكا تلفا, 'কৃপণকে দিন বিনাশ'। কৃপণ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যে ওয়াজিব ও ফরজ খাতসমূহে ব্যয় করে না, মালের হক আদায় হতে বিরত থাকে এবং কোনও রকম নফল দান-খয়রাতের বিলকুল আগ্রহ রাখে না।
এখানে تلف শব্দটি خلف এর বিপরীতে আনা হয়েছে। কাজেই তা এর ব্যাখ্যায় উপরে যা-কিছু উল্লেখ করা হল, তার বিপরীত সবকিছুই تلف এর অধীনে আসতে পারে। অতএব এর দ্বারা হয়তো বোঝানো হচ্ছে যে, কৃপণের মাল যেন এমনিই শেষ হয়ে যায়, এর কোনও আর্থিক প্রতিদান সে না পায়। অথবা কৃপণ ব্যক্তির জীবন বৃথাই ধ্বংস হয়ে যায়। দান-খয়রাত না করার কারণে আখেরাতে কোনও প্রতিদান তো সে পাবেই না। ফলে তার ইহজীবন বৃথাই নষ্ট হয়ে যায় বৈকি। ইহজীবনে সে সঞ্চয়ের ধান্ধায় পড়ে নেক আমলে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায় না। সম্পদ বাড়ানোর দৌড়ঝাঁপ করতে করতেই কবরে চলে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (পার্থিব ভোগ-সামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্যলাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছ।৩৮৭
এ অর্থও হতে পারে যে, তার যেন কোনও সুসন্তান জন্ম না নেয়। ফলে তার মৃত্যুর পর ওয়ারিছগণ তার রেখে যাওয়া সম্পদ নষ্ট করে ফেলবে, সৎকাজে খরচ করবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল ফিরিশতার অস্তিত্ব সত্য এবং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। তাদের একটা কাজ হচ্ছে নেককারদের জন্য নেকদুআ করা ও বদকারদের জন্য বদ্দুআ করা।

খ. জানা গেল সৎপথে খরচের প্রতিদান কোনও না কোনওভাবে অবশ্যই পাওয়া যায়।

গ. আরও জানা গেল কৃপণতা অতি মন্দ স্বভাব। এর অশুভ পরিণাম কোনও না কোনওভাবে ভোগ করতেই হয়।

৩৮৬. সূরা ইবরাহীম (১৪), আয়াত ৭

৩৮৭. সূরা তাকাছুর (১০২), আয়াত ১, ২
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ১৩৬৩ | মুসলিম বাংলা