আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৮. অধ্যায়ঃ সদকা

হাদীস নং: ১২৬৯
দান-খয়রাতের উৎসাহ দান, সামর্থ্যহীন ব্যক্তির প্রয়াস ও ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও দান প্রসংগ
১২৬৯. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করে, আর আল্লাহ্ হালাল ব্যতীত অন্য কিছু কবুলও করেন না, তখন আল্লাহ্ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন। তারপর দানকারীর জন্য তা লালন করতে থাকেন। যেমনটি তোমরা উটের বাচ্চাকে প্রতিপালন করতে থাকো- যাবৎ না তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়।
(হাদীসটি বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, তিরমিযী, ইব্‌ন মাজাহ ও ইব্‌ন খুযায়মা তাঁর 'সহীহ্' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।)
التَّرْغِيب فِي الصَّدَقَة والحث عَلَيْهَا وَمَا جَاءَ فِي جهد الْمقل وَمن تصدق بِمَا لَا يجب
1269 - عَن أبي هُرَيْرَة رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من تصدق بِعدْل تَمْرَة من كسب طيب وَلَا يقبل الله إِلَّا الطّيب فَإِن الله يقبلهَا بِيَمِينِهِ ثمَّ يُرَبِّيهَا لصَاحِبهَا كَمَا يُربي أحدكُم فلوه حَتَّى تكون مثل الْجَبَل

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَالنَّسَائِيّ وَالتِّرْمِذِيّ وَابْن مَاجَه وَابْن خُزَيْمَة فِي صَحِيحه

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বান্দা তার হালাল মাল থেকে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করলে আল্লাহ তা'আলা সে দান-খয়রাতকে কীভাবে বাড়াতে থাকেন, এ হাদীছে একটি দৃষ্টান্ত দ্বারা তা বোঝানো হয়েছে। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করে)। অর্থাৎ এমন মাল থেকে দান করে, যা সে বৈধ পন্থায় অর্জন করেছে। কাউকে ঠকিয়ে নেয়নি, আত্মসাৎ করেনি কিংবা অন্য কোনও নাজায়েয পন্থায় হস্তগত করেনি। কেননা নাজায়েয পন্থায় অর্জিত মাল দান-খয়রাত করলে কোনও লাভ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(আর বাস্তবিকপক্ষে আল্লাহ হালাল ছাড়া তো গ্রহণ করেন না)। কোন কোন বর্ণনায় আছে-
‘আল্লাহর কাছে হালাল ছাড়া অন্য কিছু ওঠে না।'(সহীহ বুখারী : ৭৪৩০; মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৮১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩৩১৯)
অর্থাৎ হারাম মাল থেকে দান-খয়রাত করলে কবুল হওয়া তো দূরের কথা, তা উপরের দিকেই ওঠে না। কেন? হারাম মাল থেকে দান-খয়রাত করলে তা কবুল না হওয়া বা উপরে না ওঠার কারণ কী? কারণ হচ্ছে যে ব্যক্তি হারাম মাল থেকে দান, খয়রাত করে, সে তো ওই মালের মালিকই হয় না। কারও হাতে হারাম মাল আসলে তা কোনওভাবেই খরচ করা তার জন্য জায়েয নয়। এ অবস্থায় আল্লাহ তা'আলা যদি তা কবুল করেন, তবে তো ওই ব্যক্তির মালিকানা স্বীকার করে নেওয়া হল কিংবা ওই ব্যক্তির পক্ষে তার অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হল। এটা তো হতে পারে না যে, একই মালে খরচের নিষিদ্ধতাও থাকবে আবার অনুমতিও থাকবে! যাহোক হাদীছটিতে বোঝানো উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য যে অর্থ-সম্পদ খরচ করা হবে তা অবশ্যই হালাল উপার্জন থেকে হতে হবে। হালাল পথে উপার্জিত সম্পদ দান করলে আল্লাহ তা'আলা তা সাদরে গ্রহণ করে নেন। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(আল্লাহ তা'আলা নিজ ডান হাতে তা গ্রহণ করেন)। ডান হাতে গ্রহণ করেন মানে তিনি তা কবুল করে নেন। আল্লাহ তা'আলার মাখলুকের মতো কোনও হাত নেই। তিনি নিজের জন্য 'হাত' শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর মর্ম কী তা কেবল তিনিই জানেন। আমরা গ্রহণ করার বেলায় ডান হাত ব্যবহার করে থাকি, বিশেষত সাদরে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। আল্লাহ তা'আলাও যে বান্দার দান আদর-যত্নের সঙ্গে গ্রহণ করেন, তা বোঝানোর লক্ষ্যে বলা হয়েছে যে, নিজ ডান হাতে তা গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলার ডান-বাম বলতে কিছুই থাকতে পারে না। কেননা এটা দিক ও সীমাবদ্ধতার নির্দেশক। আল্লাহ তা'আলা সমস্ত দিক ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে।

হাদীছটিতে যে 'ডান' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এটাও কেবল মর্যাদা বোঝানোর উদ্দেশ্যে। এর দ্বারা বামের বিপরীত যে ডান, সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়নি। এ কারণেই এক হাদীছে আছে-
وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِين
‘আল্লাহর দু'হাতই ডান।(সহীহ মুসলিম: ১৮২৭; সুনানে নাসাঈ : ৫৩৭৯)
‘দু'হাতই ডান’ কথাটি দ্বারা বোঝা যায় 'ডান' শব্দটি দ্বারা কেবলই মর্যাদা বোঝানো উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, হাত বলতে আমরা যা বুঝি, আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে ঠিক তা নয়। ঠিক কী বোঝানো উদ্দেশ্য, তা তিনিই ভালো জানেন। তবে এটা আমরা না বুঝলেও হাদীছের মর্ম বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই।

আমরা বুঝতে পারছি যে, আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে আমরা যদি হালাল মাল থেকে তাঁর পথে ব্যয় করি, তবে তিনি আদরের সঙ্গে তা গ্রহণ করে নেন।

(তারপর দাতার পক্ষে তা প্রতিপালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চা লালন-পালন করতে থাকে। অবশেষে তা পাহাড়ের মতো হয়ে যায়)। অর্থাৎ বান্দার দান কবুল করার পর আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময় বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। তা কম হলেও দশগুণ। আর বেশি পরিমাণ সাতশ' গুণ। বরং কারও কারও জন্য তা হয় হিসাব-নিকাশ ও ধারণা-কল্পনার অতীত। এখানে মানুষের কাছে সহজে বোধগম্য করে তোলার লক্ষ্যে ঘোড়ার বাচ্চার তুলনা দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি ঘোড়া বা অন্য কোনও পশুর বাচ্চা লালন-পালন করে, তার যত্ন পেয়ে সে বাচ্চাটি ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকে। প্রথমে সেটি এতই ছোট থাকে যে, ইচ্ছামতো সেটিকে কোলে-পিঠে বহন করতে পারত। কিন্তু পরে বড় হতে হতে সেটি এক পর্যায়ে এমন বড় হয়ে যায় যে, কয়েকজনে মিলেও সেটিকে তোলা সম্ভব হয় না। তেমনি ছোট্ট একটা খেজুরও আল্লাহ তা'আলার প্রতিপালনে বড় হতে হতে পাহাড়ের মতো হয়ে যায়। ফলে আখিরাতে যখন তার সেই সামান্য দান দাড়িপাল্লায় তোলা হবে, তখন তার ওজন দুনিয়ায় যেমন সামান্য ছিল সেরকম নয়; বরং পাহাড়ের মতো ভারী হবে। চিন্তা করা যায়, একটা খেজুরের তুলনায় একটা পাহাড় কত বড়? বান্দার তুচ্ছ দানকে আল্লাহ তা'আলা কত বড় বানিয়ে দেন? বলাবাহুল্য এটা আল্লাহ তা'আলার অসীম রহমতেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি বান্দার সামান্য দানকেও অকল্পনীয়ভাবে মূল্যায়ন করেন। বান্দার তুচ্ছ দানেও তিনি এত বেশি খুশি হয়ে যান যে, তার পুরস্কার দেন বিশাল আকারে। এর পরও কি আমরা তাঁর পথে আপন আপন সাধ্যমতো দান-সদাকা করব না?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহ তা'আলার পথে আপন সাধ্য অনুযায়ী খরচ করা চাই, তা একটা খেজুরই হোক না কেন।

খ. আল্লাহর পথে অবশ্যই হালাল উপার্জন থেকে খরচ করতে হবে। সে লক্ষ্যে উপার্জন যাতে হালাল হয়, সে চেষ্টাও করা জরুরি।

গ. দান-খয়রাত করতে হবে অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হওয়ার লক্ষ্যে, অন্য কোনও নিয়তে নয়।

ঘ. সহীহ নিয়তে দান করলে আল্লাহ তা'আলা তা সাদরে গ্রহণ করেন।

ঙ. বান্দা যা দান করে, তা সামান্য হলেও আল্লাহ তা'আলা তার বিনিময় দান করেন অকল্পনীয়রূপে বড়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ১২৬৯ | মুসলিম বাংলা